গল্প : রোমেল রহমান

গোরেস্তানে পঙ্খিরাজ

গোরেস্তানে মধ্যরাত্রে পঙ্খিরাজ টানা গাড়ি নামে! গাড়ি ভরা লাশ! গোরেস্তানের নীরবতায় ঝিঁঝিঁর ঝিমঝিম টানা সুরের মধ্যে ঝুমঝুমি বাজিয়ে পঙ্খিরাজ গাড়িটা নাজেল হয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে আর  ঘোড়ার ক্ষুরের ক্লান্ত শব্দ চারদিকের মৌনতার মধ্যে রহস্যে ঢেলে দেয়! গোরখোদক দুজনের নাম চান মিয়া আর তারা মিয়া! তারা দুইজন যমজ ভাই! লোকে বলে, মুর্দা দাফন করতে করতে এরা হাফ মুর্দা হয়ে গেছে! চান মিয়া পান খায় আর তারা মিয়া গুল নেয়! দাঁত দেখে আলাদা করা যায় তাদের! কথাবার্তা বলে খুব কম! ফাজিল ছেলেপেলেরা বলে, এরা হইলো কবরের ফেরেশতা মুনকার-নকির! এইসব বেদাতি কথাবার্তা থাক, মূল গল্পে আসা যাক! চান মিয়া তারা মিয়া গত দুই যুগ মুর্দাফরাসের কাজ করতে করতে দাড়িতে পাক ধরিয়ে ফেলার পর একসময় দুনিয়ায় মহামারী লাগে! একদিন রাত্রে পঙ্খিরাজ গাড়ি ভর্তি লাশ আসে দাফনের জন্য! সঙ্গে কেউ নেই! দুজন পুলিশ আর ঘোড়ার সহিস! চান মিয়া তারা মিয়া এতো লাশ দেখে বলে, এক্সিডেন্টের লাশ? পুলিশ বলে, অতো জানার কাজ কি? এখন থেকে রোজ লাশ আসবে, দাফন দিবা! যদি ১৪টা দাফন দেও, খাতায় লিখবা ৪ টা! ২৯ টা হইলে ৯ টা, ৬০ টা হইলে ৬ টা! তারা মিয়া বলে, এইটা কেমন কারবার? পুলিশ বলে, এইটা ছোট সংখ্যা বড় সংখ্যা খেলা, তোমরা বুঝবা না; তোমাদের কাজ কোদাল চালানো আর কবর দেয়া! এহন লাশ গুলান রে কবর দেও! সেদিন সারারাত কেটে যায় তাদের দুজনের লাশগুলো কবর দিতে! ভোরবেলায় পুলিশ যাবার আগে বলে যায়, বাসায় গিয়া ঘুমাও! কেউ বেশি কিছু জিগাইলে বলবা, থানায় খোঁজ নিতে!

এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে একটা ব্যারাছ্যাড়া লাগে সমস্ত রাজ্যে! গোরেস্তানে দাফনের হিড়িক বেফাঁস হয়ে যায়! ফলে সেদিন রাত্রে যখন পঙ্খিরাজ ভর্তি লাশ আসে! লাশ দাফনের আগে পুলিশ সুঁই সুতো আর শানানো ছুরি দিয়ে বলে, লাশ গুলার মুখ সেলাই কইরা দেও আর চোখ তুইলা আমাদের বস্তায় দেও! চান মিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলে ওঠে, এইসব কি বলেন আবোলতাবোল? পুলিশ বলে, আমি বলি না তয় আমার বলতে হয়! তারা মিয়া বলে, মুর্দার সাথে এইসব করতে আমরা রাজি না! পুলিশ বলে, তোমরা করবা না তোমাদের বাপে করবে! চান মিয়া  বলে, এইসব কেন করতে  হবে? পুলিশ বলে, লাশ গুলান যাতে দাফনের পর ফেরেশতাকে সত্য কথা গুলো বলতে না পারে তাই জবান সেলাই করে দেয়া হবে! আর চোখ তুলে নেয়া হবে যাতে চোখ সাক্ষী দিতে না পারে সে কি কি দেখেছিলো জিন্দা অবস্থায়!

ফলে এক ভয়ঙ্কর দিন নাজেল হয় চান মিয়া আর তারা  মিয়ার জীবনে! তাদেরকে আর বাসায় যেতে দেয়া হয় না! গোরেস্তানের অফিসেই তারা থাকে আর তাদেরকে খানাদানা দেয়া হয়! কিন্তু দুই ভাইয়ের চোখের ঘুম উড়ে যায় আর ক্রমে তাদেরকে দেখলে মনে হয় লোকদুটো জ্যান্ত আছে তবে বহুদিন আগের মরা! কিন্তু মুর্দার ঠোঁট সেলাই করতে করতে আর চোখ তুলতে তুলতে তারা মিয়া উন্মাদ হয়ে যায়! একদিন সে গোরেস্তানের এক দাঁড়কাককে বলে ফেলে এই কুৎসিত সত্য! দাঁড়কাক শুনেই আঁতকে ওঠে! ফলে পরের দিন থেকে আর তারা মিয়াকে দেখা যায় না! আগের রাত্রে তারা মিয়াকে একটা অতিরিক্ত কবর খুঁড়তে হয় এবং চান মিয়াকে দাফনের কাজটা করতে হয় একা একা! ফলে পরের দিন সকালে দেখা যায়, চান মিয়া নিজের হাতে সুঁই সুতো দিয়ে তার ঠোঁট সেলাই করতে থাকে এবং কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে বসে থাকা দাঁড়কাকটা আতঙ্ক নিয়ে কাঁপতে থাকে এই জন্য যে, ঠোঁট সেলাই শেষ হলে চান মিয়া কি তার চোখদুটো নিজ হাতে উপড়ে ফেলবে সমস্ত সাক্ষী মুছে ফেলতে?

Facebook Comments

Posted in: June 2020, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply