গল্প : রিপন হালদার
ঘুম গাড়ি
-মা, আর কত দূর?
-এই তো বাবা, এসে পড়েছি।
-আমরা এখন কোথায় মা?
-তা জানি না। তবে আমরা বাড়ির থেকে আর মনেহয় বেশি দূরে নই।
-দেখো না জিজ্ঞেস করে কাউকে!
-কেউ-ই নেই রে আশেপাশে! কাকে জিজ্ঞেস করব! আমাদের আগের লোকগুলোর কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। পিছনের লোকগুলোকেও দেখতে পাচ্ছি না। আমরা হঠাত কীভাবে এত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম! তুই চিন্তা করিস না। একটু ঘুমাতে চেষ্টা কর!
-ঘুম আসছে না মা।
-কেন রে, বেশ দিব্বি তো যাচ্ছিস গাড়ি করে!
-এই গাড়িতে ঘুম পাচ্ছে না মা।
-কেন রে?
-গাড়িটা খুব ছোট।
-দ্যাখ, সব গাড়ি তো আর বড় হয় না! চেষ্টা কর। ঘুম এসে যাবে।
-মা, একটা গান করো না! ঘুমের সময় তুমি যেমন করো!
-ধুর বোকা! এই অবস্থায় কেউ গান করতে পারে নাকি! দেখছিস না আমার অবস্থা! দড়ি ধরে টানটে টানতে হাতের তালুর মাঝখানে কেটে গেছে। ব্যাগ আর তোর ওজন মিলিয়ে ভারি তো কম না!
-খুব কি ব্যথা হচ্ছে মা?
-নারে, তেমন নয়। দড়িটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিয়েছি। এবার একটু আরাম লাগছে। তবে জানি এইখানটাও একসময় ঠিক কাটতে থাকবে। তখন আবার অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
-আমরা কত পথ এলাম মা?
-হিসেব তো জানি না! মাইলস্টোনগুলোও ফাঁকি দিচ্ছে আমাদের। সবসময় চোখে পড়ে না।
-ঠিক আছে। সামনেরটা লক্ষ্য করো।
-হ্যাঁ করব। দেখতে পেলে জানাব তোকে। তুই এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।
-আসছে না মা ঘুম। এইটুকু জায়গায় ঘুম আসে বলো? তার উপর চাকার ঘর ঘর শব্দ।
-তাও। আচ্ছা শোন, তোকে কি একটু বেঁধে দেব? তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবি!
-না না। এমনিতেই চেষ্টা করছি। … মা!
-কী?
-খুব রোদ লাগছে।
-উপুর হয়ে আছিস তো! রোদ কী করে লাগবে?
-পিঠে লাগছে। পুড়ে যাচ্ছে মনেহয়।
-ও! ও একটু লাগবে বাবা। আমরা আর সাত-আট দিনের মধ্যে পৌঁছে যাব ঠিক দেখিস!
-সাত-আট দিন!
-খুব বেশি নারে! দেখতে দেখতে চলে যাবো ঠিক!
-আমরা কি আমেরিকা যাচ্ছি মা?
-তা কেন? তুই জানিস না আমাদের দেশের বাড়ি কোথায়?
-কী জানি! মনেহয় গাড়ি করে আমেরিকা যাচ্ছি।
-আমেরিকা নিশ্চয় তুই যাবি! কিন্তু বড় হয়ে বাবা। এখন না।
…
-কী রে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি! সাড়া নেই কেন?
-চেষ্টা করছি ঘুমাতে। তুমিই তো বললে ঘুমাতে।
-ও!
-তোর কি ট্রলি ব্যাগের উপর এভাবে শুয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে?
-না মা। খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না! শুধু পিঠে খুব রোদ লাগছে। মনে হচ্ছে পরোটা ভাজার তাওয়া। তুমি ওখানে একটা বাটি রেখে ডিম ফাটিয়ে রাখতে পারবে?
-কেন?
-ওমলেট হয়ে যেতে পারে।
-ধুর বোকা। ভুল বকছিস।
-না গো। ঠিক হয়ে যাবে!… আচ্ছা মা!
-কী বল?
-আজ তাপ কত?
-কী জানি! বকবক করিস না। ঘুমা তো!
-মা!
-আবার কী হল?
-বাবাকে ওরা ছাড়বে না?
-হ্যাঁ, অবশ্যই! মাত্র তো চৌদ্দ দিন! ওর মধ্যেই নাকি করোনার ভাইরাস ধরা পড়ে! অর্ধেক দিন তো কেটেই গেলো! বাড়ি গিয়ে দেখবি ওরা গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের আগেই চলে যাবে দেখিস!
-আমরা কেন গাড়ি করে গেলাম না মা?
-তোর বাবা তো অন্য পথ দিয়ে যাবে তাই। ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। ঘুমা তুই।
-মা! আবার কী হল?
-ঘুম আসছে না মা। উপুর হয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না আর।
-কী করবি তবে? উপুর হলেই রোদে তোর চোখ-মুখ ঝলসে দেবে। সে খেয়াল আছে? ঘুমাস না ঘুমাস উপুর হয়েই তোকে থাকতে হবে। খবর্দার, চোখ কিন্তু খুলবি না!
-দিন আর কতটা বাকি মা?
-এখন তো দুপুর। আরো অর্ধেকটা।
-একটু কোথাও দাঁড়াও না মা?
-কোথায় দাঁড়াব বল? খালি মাঠটার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে চওড়া রাস্তাটা। কোনো গাছটাছও নেই রে!
-মা!
-বল!
-আমাকে একটু কোলে নেবে?
-তুই তো বড় হয়ে গেছিস! ফোরে পড়িস!
-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। সেই কখন থেকে উপুর হয়ে আছি! তুমি চিত হতেও বারণ করছ! নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
-আর কিছুক্ষণ বাবা। চিত হয়ে থাকলে রোদ তোকে অন্ধ করে দেবে। আর চামড়াও পুড়িয়ে দেবে। একটু সহ্য কর। বিকেল হলেই দেখবি রোদ কমে গেছে। আর তখন এত হাওয়া ধেয়ে আসবে আমাদের দিকে যে আমাদের উলটিয়েও ফেলতে পারে। তখন তোর খুব মজা লাগবে দেখিস! আর তখন সত্যি সত্যি তোর ঘুম পেয়ে যাবে। ঐ আরামটা কল্পনা করে এখন একটু সহ্য কর বাবা।
-কল্পনা করতে পারছি না মা।
-করতে হবে বাবা। মানুষ সব পারে।
…
-মা, দাঁড়িয়ে পড়লে নাকি?
-নারে, একটু হাত বদল করলাম দড়িটা। ডান হাতটা ছড়ে গেছে মনেহয়।
-মা, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে?
-নারে, কষ্ট কী? রান্না করতে গিয়ে হাত তো কাটেই!
-মা!
-কী?
-বড় হয়ে তোমাকে আমি একটা গাড়ি কিনে দেব। বড় একটা গাড়ি।
-তাই দিস। এখন ঘুমা।
-পিঠে কিছু একটা ঢাকা দিয়ে দাও না? চামড়া মনেহয় পুড়ে গেছে। প্লিজ মা!
-কী করে দেই বল তো? তাহলে তো এখন দাঁড়াতে হবে। ব্যাগ খুলে খুঁজতে হবে। আর ততক্ষণ এখানে দাঁড়ালে তোর আরো বেশি তাপ লাগবে। একটু সহ্য কর বাবা!
-মা, তুমি বাড়ির রাস্তা ঠিক চেনো তো?
-চিনব না কেন? এই রাস্তা দিয়েই তো চার বছর আগে আমরা ছোট লরিতে মালপত্র সব ভরে মুম্বাইয়ে গিয়েছিলাম!
-আমি যাইনি মা!
-গিয়েছিলি তো! কিন্তু খুব ছোট ছিলি তুই! তাই হয়ত মনে নেই।
-জল দাও না একটু! খুব তেষ্টা পেয়েছে।
-বোতলটা ছিল তো তোর হাতে! কী করলি?
-জানি না। পড়ে গেছে হয়ত।
-যাহ! এখন কী হবে! তোর ঐ বোতলেই তো কিছুটা জল ছিল!
-তোমার বোতলটা দাও।
-আমার বোতলে একটুও জল নেই রে!
-আশেপাশে কল নেই? দেখো না!
-কিচ্ছু নেই রে! শুধু সাদা রোদ রাস্তার দুই দিকে। চোখ ধাঁধিয়ে যায়! আর রোদের মধ্যে রাস্তাটা মনে হচ্ছে কাঁপছে। টলটলে দিঘির মত।
-থাক মা। এখন জল খেতে ইচ্ছা করছে না।
-লজেন্স আছে। চুষবি একটা?
-দাও।
-স্থির হয়ে থাকবি। এক হাত দিয়ে পার্স থেকে আমি বের করছি। … এই নে। র্যাপার ছাড়িয়ে দিয়েছি।
-লজেন্সটা খুব মিষ্টি মা!
-চাবাবি না কিন্তু! চুষে চুষে খা। জলতেষ্টা দূর হবে।
-মা!
-কী?
-তুমিও একটা লজেন্স মুখে দাও।
-আর নেই রে!
-ও! দোকান দেখলে কিনে নিও কয়েকটা।
-আচ্ছা। এখন বকবক থামা। ঘুমানোর চেষ্টা কর তো!
-রোদ পিঠ জ্বালিয়ে দিচ্ছে তো! মুখেও তাপ এসে লাগছে। ঘুম আসছে না।
-দুপুর দুটো বাজে। আর দুই ঘন্টা সহ্য কর বাবা! তারপরই দেখবি বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া। তোকে তখন একটু হাঁটতে দেব। কেমন?
-আচ্ছা।
…
-কী রে ঘুমিয়ে পড়লি?
–
-ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
-নন্ … না …
-তাহলে কথা বলছিস না কেন?
-তুমি তো ঘুমাতে বললে! চেষ্টা করছি।
-ও! আচ্ছা ঘুমা…… কিন্তু তুই ঘুমিয়ে পড়লে আমি কার সঙ্গে কথা বলব! আর কথা না বললে হাঁটব কী করে! এখনো তো সাত-আট দিন হাঁটতে হবে! থাক, তোর আর ঘুমিয়ে কাজ নেই! কথা বল আমার সঙ্গে।
–
-কী রে! সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
–
-কী রে! কথা বল! বলবি না?
–
-কথা বল!
–
-দেখ, বিকেল হয়ে গেছে! কী সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে! তোর বড় বড় চুলগুলো উড়িয়ে উড়িয়ে নিচ্ছে! দেখ, দেখ!
–
-দেখবি না!
–
-কথা বল!
– হুম্
-কী হুম্? ওঠ!
-আর ঘুমাতে হবে না তোর! জাগ এবার! … আমি না আর হাঁটতে পারছি না। বাঁহাতটাও বুড়ো আঙুলের পাশ দিয়ে কেটে গেছে। টানতে গেলেই কাটা জায়গায় লাগছে। ডান বাম কোনো হাত দিয়েই আর টানতে পারছি না তোকে।
–
-উঠে হাঁট না একটু…
–
-আমার খুব মাথা ঘুরছে রে! আর পারছি না হাঁটতে। তুই এখন উঠে নিজের মত হাঁটতে থাক। সোজা রাস্তা বরাবর হাঁটবি। থামবি না কোথাও।
–
-আমি একটু পরে আসছি। ভাবিস না। কোনো একসময় তোকে ঠিকই ধরে ফেলব।
–
-পারবি না?
–
-কী রে?
–
–
–
…
-মা! কোথায় তুমি?
–
-আমরা কি বাড়ি এসে গেছি?
–
-এখানে সব অন্ধকার কেন?
–
-বিকেল কী হয়ে গেছে?
–
-কোথায় তুমি?
–
-কথা বলছ না কেন?
–
-তোমার হাতের ব্যথা সেরেছে?
–
-অনেকদিন তো হয়ে গেল!
–
-আমরা বাড়ি ফিরব না?
–
-মা! কথা বলছ না কেন?
Posted in: June 2020 - Cover Story, STORY