ঘর : পূবালী রাণা
সময়ের বিলম্বিত ভাঁজে রেখে দেওয়া পুরনো রাগ দুঃখগুলোর যত্ন নিতে হয়। মাঝেমধ্যে বুকের ভিতর থেকে বের করে ধুয়ে মুছে সাফ করি, আবার ঢুকিয়ে দিই বুকের কামরায়। দুঃখ সরণির সিড়ি বেঁয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে নেমে আসে ক্লান্তি, খানিক জিরোই বনানীর আবছায়ায়।
শহর ছেড়েছি বহুকাল। শরীর মন থেকে মুছে যাচ্ছে শহুরে রং। শহরের বাড়িটা আমার দিকে চেয়ে আছে হয়তো। আর বাড়ির পাশে রাধাচূড়া যে গাছ সেই গাছে কয়েক জোড়া পাখি বসত, ওরা কী এখন আমার জানলার দিয়ে চেয়ে থাকে? সন্ধ্যা লাগার আগে আমার বাড়ির উপরে আগেরমতো চক্কর কাটে? আর ঘরে বইয়ের শেল্ফটার মধ্যে হাজার হাজার বিপ্লবীরা কী রাতে ডাকে? আমার সহযোদ্ধারাই বা কী করছে এখন? বিপ্লবের উত্তাপে গা সেঁকছে নাকি ভয়ে কুঁকড়ে গেছে !
একদিকে বৈশ্বিক মহামারী আর ঝড়ঝঞ্ঝার তাণ্ডবে শ্মশানের মতো নিথর ঘুমিয়ে আমার জন্মভূমি। লকডাউন, বেকারত্ব, দুর্ভোগে কফিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে জীবনকে। যেন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া কত সহজ, কত আনন্দময়। আর যেসব জীবনগুলি হারিয়ে গিয়েছে রাস্তায়, তারা যেন এযুগের সন্তান নয়, মৃত জঞ্জাল। এভাবে পায়ে হেঁটে শ্রমিকের ঘরে ফেরা পৃথিবী বড় একটা দেখেনি। অথচ, এরা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। নিজের উঠোনে পা রাখতে চেয়েছিল, শিশুর মুখে একটা চুম্বন রেখে নদীতে স্নানে যেতে চেয়েছিল! মানুষের কাছে জীবন মানেই একটা করে মৃত্যুসংখ্যা? এরা অধিকার ছিনিয়ে নিতে শেখেনি বলে বেনামী লাশ হয়ে। ছোটকু নিমিষেই লাশ হয়ে যায় একফোঁটা জলের জন্য। তার মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মৃত সন্তানের দিকে চেয়ে। অন্ধকারের বুক চিরে হেডলাইট জ্বালানো একটা গাড়ি ঝলসে দিয়ে যায় ছোটকুর মায়ের চোখ।
রোজ দেখি কাতারে কাতারে শ্রমিক চলেছে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে তাদের পিঠে মলিন ব্যাগ। ক্লান্ত শরীর বন্ধক রেখেছে পথের কাছে। তাদের যে পৌঁছতেই হবে নিজের ঘরে। ‘ঘর’!! হোক না সেটা একচালা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে আছে জিয়নকাঠি। ভালোবাসার মানুষ। একবার সেখানে পৌঁছাতে পারলে আবার নতুন পৃথিবী গড়ে নিতে পারবে এই বিশ্বকর্মারা। আমরা নির্বাক হয়ে দেখি শ’য়ে শ’য়ে ভারতবর্ষ চলেছে দিশাহীন। আমরা তাকিয়ে থাকি, শুধুই তাকিয়ে থাকি এক অচেনা ভারতের দিকে ।
তাই আর নিজের মেকি বাড়ির কথা ভাবলে তাকে আর ঘর বলে ভাবতে পারি না। নিজেকে বড় অক্ষম মনে হয়! নিশ্চিন্তের আশ্রয়ে শুয়ে বসে হাহাকারও বিলাসিতা। লকডাউনের পর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে যারা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ঝড় তোলা সেই অসংখ্য কীটে ভরে গেছে আমাদের মজ্জা ঘিলু।
সন্তানের পড়াশোনা নামি দামী স্কুলে পড়ানো চৈতন্যদীপ্ত মা-বাবারা খানিক বিপ্লবের ধ্বজা উড়িয়ে ঘরে দোর দেয়। তাদের কপালের বলিরেখা স্পষ্ট বলে দেয় “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”, মনের ভেতর অসংখ্য আশঙ্কার ঝড়, সন্তানের ভবিষ্যৎ হোয়াইট কলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। রেললাইনে শুয়ে থাকা শিশু বা পথচলতি শ্রমিকের শিশু তারা ভীন গ্রহের জীব! আসলে আমরা সবাই রাষ্ট্রের গোলাম হয়েই থাকতে চাই। অনিবার্য বিপর্যয় থেকে মুখ ফিরেয়ে রাখাটাই অভ্যেস। তার সঙ্গে লড়াই করে বীজ বোনার অভ্যাস আমাদের আয়ত্তের বাইরে। তাই মেঠোপথের বদলে শেওলা ধরা গলিতেই আমরা বেশি সচ্ছন্দ।
এর শেষ কোথায় জানি না। অভাব মৃত্যু আর কাজ হারানো পৃথিবীতে জন্মকে অভিশাপ মনে হয়। মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে যে ঈশ্বরের জন্ম হয়, তাকেও সাম্রাজ্যবাদী নেতার মতোই মনে হয়। এই পৃথিবীতে নিজের বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলি বানে ভেসে যাওয়া খড়কুটো। শহর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলি ভাগাড়, মানুষ নেই পশুদের হাড়গোড় ।
সমস্ত দুঃখরা ফিরে আসে শিল্পসম্ভাবনার কাছে। চোখের জল শুকিয়ে গেলে মানুষ মোম হয়ে ওঠে। আমিও সেরকম এক শুকনো মোম হয়ে উঠেছি যেন দিনদিন। আমার ভিতরে দাহ্য, বাইরে কোমল প্রলেপ। শহর ভুলে গ্রাম ভুলে সারাদিন শাল মহুয়ার বনে বনে ঘুরি, লোকে বলে পাগলি। গাছের মতো নিঃস্বার্থ হতে চেয়ে হয়ে উঠি যুগের বিদ্রোহী। ভাবি, আমি আগুন, আমি মোম, আমি ছাই। কেউ একজন অন্তত চিনুক আমায়, যে দেশলাই ধরিয়ে দেবে আমার মোমের শরীরে। হয় আলো দেবো, নয় পুড়িয়ে করে দেব ছারখার…
[লেখিকা – কবি, সমাজকর্মী।]
Posted in: June 2020 - Cover Story, PROSE