উনবিংশ শতকে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ এবং জীবিকা-সাংবাদিকতা : পৃথ্বী সেনগুপ্ত
উনবিংশ শতকে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ এবং জীবিকা-সাংবাদিকতা
দ্বিতীয় পর্ব
লিখিত দলিল-দস্তাবেজ নাই থাক, কিন্তু বাঙলা ও বাঙালীর মননে সামাজিক অবস্হান ও অর্থনৈতিক অবস্হার অনেক পরিবর্তন ঘটে যে গিয়েছিল তার স্বরুপ উন্মোচিত হতে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্ব থেকে ৷ সেদিন থেকে, যেদিন ১৭৫৭ সালের বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পরাজয় ও মৃত্যু হয়েছিল ৷ কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, সেদিন বাঙালী কেন বিদেশী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল? কেন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি? তার কারণ সহজবোধ্য রবীন্দ্রনাথের কথাতেই- “আমাদের এই বৃহৎ দেশের মধ্যে বাঙালীই সর্বপ্রথমে নতুনকে গ্রহণ করেছে এবং এখনো নতুনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবন করার মতো তার চিত্তের নমনীয়তা আছে ৷ তার একটা কারণ, বাঙালীর মধ্যে রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে; এমন মিশ্রণ ভারতের আর কোথাও হয়েছে কি না সন্দেহ ৷ তারপরে বাঙালী ভারতের যে প্রান্তে বাস করে সেখানে বহুকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ৷ বাংলা ছিল পাণ্ডববর্জিত দেশ ৷ বাংলা একদিন বৌদ্ধ প্রভাবে অথবা অন্য যে কারণেই হোক আচারভ্রষ্ট হয়ে নিতান্ত একঘরে হয়েছিল ৷ তাতে করে তার একটা সংকীর্ণ স্বাতন্ত্র্য ঘটেছিল ৷ এই কারণেই বাঙালীর চিত্ত অপেক্ষাকৃত বন্ধনমুক্ত এবং নূতন শিক্ষা গ্রহণ করা বাঙালীর পক্ষে যত সহজ হয়েছিল এমন ভারতবর্ষের অন্য কোন দেশের পক্ষে সম্ভব হয়নি৷” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২২শ খণ্ড, পৃঃ ৩৮৫) ৷ উল্লিখিত মন্তব্য থেকে একথা সহজবোধ্য যে, ‘রাশিয়ার চিঠি’, পাশ্চাত্য সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্পর্শে আসা বাঙালীর সামনে যে নতুন ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত করেছিল, তার সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল কলকাতাকে কেন্দ্র করেই ৷ কারণ ছিল বাংলায় ইংরেজ কোম্পানীকৃত ১৭৬৬ সালে দ্বৈতশাসন ব্যবস্হা আর ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্হায়ী বন্দোবস্ত’ আইনের প্রয়োগ ৷ প্রথমটির অন্যতম কারণ কোম্পানীর কর্মচারীদের দেশীয় প্রচলিত রাজস্ব-ব্যবস্হা, সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা, সীমাহীন দুর্নীতি আর অন্য বিদেশী বণিক সম্প্রদায়ের স্পর্ধা ৷ এই ব্যবস্হায় নবাবের উপর রয়ে গেল রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব, অথচ সেই রাজস্বের মালিকানা বর্তালো কোম্পানীর উপর ৷ অর্থাৎ নবাব পেলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব, আর কোম্পানী পেল দায়িত্বহীন ক্ষমতা ৷ ফলে বাংলার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে রায়তদের তথা প্রজাদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হল ৷ দ্বিতীয়টি হল, অর্থাৎ ‘চিরস্হায়ী বন্দোবস্ত’ এমনই একটি বন্দোবস্ত, যার আঘাতে বাঙলার প্রচলিত জমিদার-রায়ত তথা প্রজা সম্পর্কিত অবস্হানকে আমূল পাল্টে দিল ৷
প্রকৃত জমিদারশ্রেণী নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব জমা দেওয়ার শর্তে যে জমি ভোগ দখলের অধিকার লাভ করেছিল, তা পূরণ না করার দায়ে সেই জমি নিলাম-এর বিধি প্রকৃত জমিদারদের হাত থেকে চলে যেতে শুরু করে বিত্তবান জমি-সম্পর্কহীন মানুষের হাতে ৷ ফলে জমিদারী অভিজ্ঞতাহীন জমিদারদের অত্যাধিক লোভ আর লালসা একশ্রেণীর নব্য জমিদারদের জন্ম দিল ৷ যে জমিদারদের লক্ষ্য হয়ে উঠল সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জন ৷ ফলস্বরুপ, গ্রামের বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল কলকাতা শহরের বাসা বাড়ীতে, ইজারাদার আর তালুকদারদের হাতে জমিদারীর খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে ৷ সেই দায়িত্ব পালনের অতি উৎসাহে দেখা দিল সেইসব খাজনা আদায়কারী নব্য শ্রেণী সমাজের যাদের অর্থের লোভে সর্বস্বান্ত হতে শুরু করল বাংলার প্রজাকুল ৷ আর কলকাতায় বসবাসকারী জমিদারশ্রেণী অর্থাহঙ্কারে পরস্পরকে টেক্কা দেওয়া আর ইয়ার-বন্ধু নিয়ে ভোগ-লালসা চরিতার্থে শহরতলীতে তৈরী করল বাগানবাড়ী ৷ এই নব্য-সংস্কৃতি বঙ্গ সমাজে জন্ম দিল এক অন্ধকার জগতের, যে জগতে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিল কোম্পানীর অর্থলোভী বড়-বড় কর্মচারীদের ৷
অষ্টাদশ ষতাব্দীর শেষপর্বে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়ের সূচক ৷ বাংলা প্রচলিত সমাজব্যবস্হায় অঙ্গ হিসেবে শিক্ষা শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ও সংস্কৃতির দিশেহারা অবস্হা ৷ ইংরেজ কোম্পানীর উর্ধ্বতন কৃর্তপক্ষও বুঝতে শুরু করেছে অল্পসংখ্যক ইংরেজ রাজকর্মচারী আর অর্ধশিক্ষিত ইংরেজী না-জানা গোমস্তা আর মুনসী দিয়ে বাংলার গ্রামগঞ্জে শাসন ব্যবস্হা প্রসার করা সম্ভব নয় ৷ আর এই উপলব্দ্ধি থেকেই ১৮১৩ সালে ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্ট এক চার্টারের মধ্য দিয়ে ভারতে শিক্ষার জন্য প্রতি বৎসর ১ লক্ষ টাকা অনুদান বরাদ্দ করল (তৎকালীন ১০হাজার ডলার) ৷ কিন্তু এই প্রস্তাব কাগজ-কলমে রইল ১০ বৎসর ৷ ১৮২৩ সালে যখন কার্যকর হলো ততদিনে কলকাতায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংরেজী শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ার আর রামমোহন রায়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল হিন্দু স্কুল ৷ মাত্র ২০ জন ছাত্র নিয়ে ৷ উল্লেখযোগ্য সহায়তায় ছিলেন তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত বাঙালী রাধাকান্ত দেব, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রামকমল সেন ৷ ১৮১৮ সালে উইলিয়ম কেরী, জন মার্শম্যান ও ওয়ার্ড ত্রয়ীর উদ্যোগে স্হাপিত হলো শ্রীরামপুর কলেজ ৷ ১৮১৯-এ বিশপস্ কলেজ ৷ এমনি আরও ইংরেজী শিক্ষার বিদ্যালয় বাংলার অন্যান্য শহরেও গড়ে উঠেছে ৷ ফলস্বরুপ বাংলা কি পেলো? বাংলার সনাতন টোল, পিঠশালা আর মাদ্রাসা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্হায় কি কোন পরিবর্তন আসেনি? কিংবা পাশ্চাত্য দর্শন নির্ভর ইংরেজী শিক্ষার ব্যাপকতা প্রাচ্য দর্শন সমৃদ্ধ বাংলার সমাজব্যবস্হায় কি কোনো প্রভাব ফেলে নি? এর উত্তর লেখা আছে সমকালীন সামাজিক, ধার্মিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ইতিহাসের পাতায় ৷ এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা বাতুলতা ৷ যা উল্লেখ করা অবশ্যই দরকার, বাংলার সমাজের সর্বস্তরে আলোড়ন তুলল কোম্পানীর শাসন, শোষণ, শিক্ষা আর উদারপন্হী খৃষ্টধর্মের প্রচার ও প্রসার ৷ বাংলার উচ্চবর্গীয় অভিভাবক শ্রেণীর মানুষেরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল ৷ দ্বন্দ দেখা দিল প্রাচীনপন্হী সনাতন মানুষের সঙ্গে উদারপন্হী শিক্ষিত সম্পরদায়ের মধ্যে ৷ এরই মাঝখানে সমন্বয় সাধনের জন্য উঠে এল সংস্কারপন্হী একদল মানুষ ৷ শুরু হলো তীব্র বাদানুবাদ ৷ আর মুসলমান সমাজ রইল নীরব দর্শকের ভূমিকায় ৷ কিন্তু ইংরেজী শিক্ষা যে নব্যবঙ্গ সমাজের বাঙালী যুব সমাজের মননে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তার উদাহরণ রয়েছে ১৮২৬-৩১ সালে ডিরোজিও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ইয়ং বেঙ্গল ছাত্রদের আচার-আচরণে ৷ সেই আচরণ যতই তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি করুক, ইংরেজি শিক্ষা তৎকালীন বাঙালী যুব সমাজের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিল,“….ইংরাজি বিদ্যা বর্তমান রাজভাষা অর্থকারী পরমহিতকারিণী অর্থহীন ভদ্রলোকের সদুপজীবিকা ধনীগণের সুখ্যাতি ও প্রতিপত্তি এবং ধনরক্ষাদি হেতু সর্ব্ব সাধারণ পক্ষে দয়া সভ্যতা জ্ঞান সাহসাদি বৃদ্ধির উপায় এবং মন্দ ক্রিয়া মিথ্যা কলহ পরনিন্দা পর দেখাদি বারণের কারণ ইত্যাদি অশেষ গুণযুক্ত ইংরাজি বিদ্যা নিতান্ত শিক্ষা করণের আবশ্যকতা হইতেছে…” (‘সমাচার দর্পণ-প্রকাশিত ২৮শে জুলাই ১৮৩৮, ১৪ই শ্রাবণ ১২৪৫ ৷ উধৃত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,পৃঃ ৬৩) ৷ এবং এটা ঘটনা যে, তৎকালীন ইংরেজী শিক্ষালব্দ্ধ যুবকদের সামনে নিশ্চিন্ত আয়ের কর্মসংস্হানের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল ৷ এঁদের কেউ যোগ দিলেন কোম্পানীর আইন ও প্রশাসনের উচ্চপদে, শিক্ষকতায়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের করণিক হয়ে, পোস্ট-অফিসে পোস্টমাস্টার পদে, নিদেন পক্ষে কোন বনেদী ও অর্থবান বাড়ীর সন্তানদের জন্য পারিবারিক শিক্ষক হিসেবে ৷ চল্লিশের দশকে এসে কেউ এলেন ওকালতী ব্যবসায়, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারিং-র পেশায় ৷ বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় কিংবা জেলা শহরগুলীতে জন্ম দিল ‘ভদ্রলোক’ কিংবা বাবু সম্প্রদায়ের ৷ নিশ্চিন্ত জীবন ও জীবিকার হাতছানি, ইংরেজি শিক্ষার প্রচার ও প্রসার আরও তরান্বিত হোলো বাংলার সমাজজীবনে, যেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র আর কেউ কারো কাছে অচ্ছুৎ নয় ৷ অর্থ উপার্জনের আশায় ও নেশায় তখন আচ্ছন্ন বাঙালী যুব সমাজ কলকাতামুখীন ৷ এই বিত্তনির্ভর সম্প্রদায় তৎকালীন জমিদার, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল বণিক সম্প্রদায় আর নিম্নবিত্ত অতিসাধারণ মানুষের মাঝখানের ফাঁকটুকু ভরাট করতে শুরু করল ৷ এই সম্প্রদায়ই কালক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল ৷ এই মধ্যবিত্ত সমাজের যথার্থ্য সংজ্ঞা আজও নিরুপিত হয়নি, কিন্তু সহজবোধ্য হয় এই মন্তব্যের দ্বারা, “The recognition by the Government of the pre-emineace of English in official and judicial matters made English education respectable from the late thirties. With the growing responsibilty of English education, the educated community stated setting down into a secure position in society and tended rto from what may be described as Middle class ‘society’.” (Dr. Pradip Saha, ‘The History of Bengal’, 1757-1915, Page 402, University of Calcutta publication, 1996). আমরা উপরিউক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে এটাই বোঝার চেষ্টা করেছি যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবকাল একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়ে চিন্হিত করা সম্ভব নয়, সঠিকও নয় ৷ এটি একটি বির্বতিত নাগরিক সমাজ ও সভ্যতার ফসল, যার সূত্রপাত সেদিনই শুরু হয়েছিল, যেদিন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কলকাতা শহরের পত্তন করেছিল ৷
এখানে আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ ঔপনিবেশিক শাসন-ব্যবস্হা পরিচালনায় সমাজ গঠনের বৈশিষ্ট্যে এ দেশের উৎপাদন পদ্ধতিতেও ধরল ভাঙ্গন ৷ সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতন্ত্রের বদলে তা পরিণত হল ঔপনিবেশিক উৎপাদন পদ্ধতিতে ৷ বিস্তৃত এবং জটিল পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট হলো জমিদার-মধ্যশ্রেণী এবং কৃষক ৷ (উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র-মুনতাসীর মামুন, পৃ ১৪-১৬) ৷ ইংরেজরা শুরু করেছিল নিজেদের প্রয়োজনে, পাশ্চাত্য নাগরিক সভ্যতায় অভ্যস্ত সমাজজীবনের সুখ-সুবিধা লাভের প্রবল আকাঙ্খায় ৷ ফলে বদল ঘটল কলকাতার গ্রামীণ সমাজজীবনের চরিত্রে ৷ যা গতিলাভ করে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্বে ৷ তার সঙ্গে অনুঘটকের কাজ করেছিল তৎকালীন বাংলায় সনাতন হিন্দুধর্মের কুসংস্কারচ্ছন্ন মনোভাব আর মুসলমান নবাবের আমলে গড়ে ওঠা লক্ষ্যহীন শাসনব্যবস্হার আবহ ৷ মাঝখানে খৃষ্টধর্মের উদারপন্হী মতবাদের আবির্ভাব স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন স্বশিক্ষিত বাঙালী মননে আলোড়ন তুলেছিল, ভাবতে বাধ্য করেছিল, সমাজপন্হী সংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালী সমাজজীবনের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির পথ কোথায় ?
সাংবাদিকতা: আদর্শ থেকে পেশা : এমনই এক সন্ধিক্ষণে গ্রামবাংলা থেকে উঠে এলেন ইংরেজী, ফারসী, সংস্কৃত, আরবী, পার্শী জানা স্বশিক্ষিত বাঙালী রামমোহন রায় ৷ তখন তিনি রাজা উপাধি পাননি ৷ তৎকালীন কলকাতার বাঙালী সমাজজীবনের আবহে নিজের মতামত স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে ‘আত্মীয় সভা’ নামে এক প্রতিষ্ঠান তৈরী করলেন ৷ চেষ্টা করলেন বিদগ্ধ সমাজের সামনে তৎকালীন সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যার সমাধানে স্বাধীন মতামত বিনিময়ের একটি মঞ্চ তৈরী করতে ৷ সেখানেই উঠে এল বাল্য-বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, কৌলিন্য প্রথা, বিধবা বিবাহ, জাতিভিত্তিক বৈষম্য, আধুনিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা প্রভৃতি নানা সমস্যা সমাধানের উপায় খোজাঁর চেষ্টা ৷ তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে, শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে এই প্রথম একটি সংগঠনের মধ্য দিয়ে জনমত তৈরীর প্রয়াস এক উল্লেখযোগ্য দিগদর্শক হয়ে উঠেছিল ৷ কিন্তু তিনি অচিরেই বুঝতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সভা-সমিতির সীমাবদ্ধতায় সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষদের কাছে পৌছাঁনো সম্ভব নয় ৷ এই অনুভব থেকেই তিনি বুঝতে পারলেন, তার জন্য দরকার আরও শক্তিশালী মাধ্যম ৷ উদাহরণও ছিল তাঁর হাতের সামনে ৷ ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকেই ভারতের তথা, বাংলার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ (ইংরেজীতে) যা জেমস্ অগাস্টাস হিকির সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ৷ তারপর ১৮১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা থেকে ১২টি ইংরেজী সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ৷ কিন্তু কোলকাতার বাঙালী সমাজে তার প্রভাব কতখানি ফেলেছিল তা অনুসন্ধান-সাপেক্ষ ৷ কিন্তু তৎপরবর্তী ১৬ বছর বাংলার সংবাদপত্রের ইতিহাস এক তাৎপর্য্যপূর্ণ পরিবর্তনর সাক্ষী হয়ে রয়েছে ৷
(চলবে…)
[লেখক – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত। স্বাধীন লেখক-গবেষক-কলামনিস্ট, গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ইউটিউবার৷]
Posted in: ARTICLE, June 2020 - Serial