পরিযায়ী? না। দধীচি! : প্রবুদ্ধ ঘোষ
পরিযায়ী শব্দের মানে প্রথম জেনেছিলুম সাঁতরাগাছি ঝিল, শীতকালে। পাখিরা আসে। কী আশ্চর্য গতিপথে ঠিক খুঁজে পায় বছর বছর একই জল। বিকেল ফুরিয়ে যায় হাতে পড়া স্যানিটাইজারের মতো। সন্ধ্যে আর দেখতে দেয়না ওই ছবির মতো পাখিদের। ফিরতে হয় ঘরে। ছবি আর ঝিলে মেলানো তিরতিরে বাতাসিয়া ঢেউ চোখে নিয়ে ফিরে আসি। পাখিরা থাকে। মাসভর। তারপর ফের যায়। ওরা নাকি সাইবেরিয়া থেকে। ওরা নাকি হাজার হাজার কিলোমিটার ক্লান্তিহীন। ঘর ছুঁয়ে আসে, বাসা ভরে আসে। ফিরে যায় ডানা ঘষে, ঝিলপাড় জানে। ওটুকুই শীতকাল। উত্তুরে হাওয়া নাকি ওদের সঙ্গেই। জেনেছিলুম। বছর ঘুরে আবার আসবে। কী যেন নাম দিয়েছিলুম দু’টো পাখির? ওরা এসেছিল, হয়তো। বা, নয়। ভুলে যাওয়াই দস্তুর। পরিযায়ীদের মনে রাখে কেউ? হা হা হেসে বলেছিল প্রাজ্ঞ কেউ। আমিও রাখিনি। আমরা রাখিনি। বহু বছর পরে জানলুম, পরিযায়ীরা ফেরে না। গ্রীষ্ম গরম হয়, তাপে তাপে ঝলসায় পরিযায়ী। বিকেল ফুরিয়ে যায় ট্রেন চলে গেলে চাকার নিচে ছড়ানো রুটিতে। সন্ধ্যে লুটিয়ে পড়ে যেমন হাইওয়েতে অমোঘ পরিবার। সব পরিযায়ী ঘরে ফেরে না। আমি এখন ভাবতে বসি ‘পরিযায়ী’ শব্দটুকু। খুঁজি অন্ধকার শব্দের মানে। কতটা তার বিস্তার, কতটা সময় জুড়ে।
#
“কেরল থেকে বেলপাহাড়ি, আমার গাঁয়ের বসতবাড়ি, পায়ে হেঁটে তার অনেকদিনের পথ
আগেই এলো পুজোর ছুটি রেলের তলায় শুকনো রুটি
বারের পুজোয় মানত করে মা
লাশের ওপর লুটিয়ে পড়ে মা
তেলের খনির মজুর ভুখা চাষার ছেলের গতর শুখা, সোনার জলে মোড়া আমার দেশ”
-কথা-সুর-ছবি- প্রমেয়, দেবায়ন, দীপশুভ্র
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় মাইগ্র্যান্ট লেবরের সংজ্ঞা, “casual and unskilled workers who move about systematically from one region to another offering their services on a temporary, usually seasonal basis.” জাতিপুঞ্জের মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কারদের অধিকার রক্ষার সম্মেলনে সংজ্ঞায়ন হয়, “ as a person who is to be engaged, is engaged or has been engaged in a remunerated activity in a state of which he or she is not a citizen ” যে মানুষ বাসভূমি ছেড়ে অন্যভূমিতে যান কাজ করতে, শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করতে, তিনি মাইগ্র্যান্ট লেবর। এই সংজ্ঞায় কখনও আসে এক দেশ থেকে ভিনদেশ, কখনও এক রাজ্য থেকে ভিন রাজ্য, কখনও গ্রামীণ অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত থেকে শহুরে অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে চলে যাওয়া। সংজ্ঞার বিভিন্ন শব্দ যতই অদলবদল হোক বা কালস্থানিকতার সঙ্গে অভিযোজিত হোক, মূলে থেকে যায় দু’টি বিষয়- শ্রম ও উপার্জন এবং বিভুঁয়ে যাওয়া।
ইংরাজিতে যা মাইগ্র্যান্ট, হিন্দিতে তা প্রবাসী আর, বাংলায় পরিযায়ী। প্রবাস অর্থে বিদেশস্থ বাসস্থান ও প্রবাসী অর্থে বিদেশবাসী (চলন্তিকা, রাজশেখর বসু)। পরিযান থেকে এসেছে পরিযায়ী শব্দটি- পরিযানের অর্থ বসবাসের জন্যে দেশান্তর গমন। ‘দেশ’ অর্থে বাসভূমি বোঝানো হত সম্ভবতঃ, কান্ট্রি বা স্টেট পার্থক্যে নয়। পরিযায়ী অর্থে যে পরিযান করে। কিন্তু পুরনো বাংলা শব্দকোষে শব্দটির অস্তিত্ব নেই। ইংরাজিতে migration শব্দের মানে অক্সফোর্ড ডিকশ্নারি অনুযায়ী, “Seasonal movement of animals from one region to another.” আরেকটু বিস্তারে, “Movement of people to a new area or country in order to find work or better living conditions.” বিশেষ ঋতুতে প্রদেশান্তরে যাওয়া (পশুপাখির ক্ষেত্রে) এবং জীবনযাপনের মানোন্নয়নের আশায় প্রদেশান্তরে বা দেশান্তরে যাওয়া (মানুষের ক্ষেত্রে)। বাসভূমি ছেড়ে দেশান্তরে বা প্রদেশান্তরে মানুষ নিশ্চয় শখ ক’রে নয়, পেটের টানেই যায়। একথা হরিহর রায়ের ক্ষেত্রেও সত্যি আবার জামলো মাড়কামের ক্ষেত্রেও সত্যি। জাতিপুঞ্জের নির্ধারিত সংজ্ঞায় এবং আভিধানিক সংজ্ঞায় সেক্ষেত্রে বাংলায় প্রবাসী ও পরিযায়ী দু’টো শব্দই সমার্থক। কিন্তু, পার্থক্য রয়েছে সামাজিক অবস্থানে, স্টেটাসে। আমার যে বন্ধু আমেরিকায় আইটি সেক্টরে চাকরি করে, সে প্রবাসী। পাশের বস্তির যে কিশোর মুম্বাইতে সোনার দোকানে কাজ করে, সে পরিযায়ী। খেয়াল রাখতে হবে ‘চাকরি করে’ আর ‘কাজ করে’-র পার্থক্যও। যে আত্মীয় ব্যাঙ্গালোরের নামী প্রোডাক্ট ডেলিভারি সংস্থায় ‘হোয়াইট কলার জব’ করে, সে প্রবাসী কিন্তু যে অনাত্মীয় উত্তরপ্রদেশ-দিল্লি সীমান্তের কোনও নির্মীয়মাণ বহুতলে রাজমিস্ত্রির চাকরি করে তার কলারে ধুলো লাগা অথবা কলারওয়ালা জামা নয় সে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে কাজ করে, সে পরিযায়ী। প্রতিটি শব্দ ও শব্দের ব্যবহারে রাজনীতি রয়েছে। আর, শব্দের ব্যবহারে আমাদের যে সচেতন বা অবচেতন অনুশীলন, তা ওই রাজনীতির দ্যোতক। ‘পরিযায়ী’ শব্দটি অবমাননাকর কিনা, সেই নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে খেয়াল রাখা যাক এই বক্তব্য,
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ‘দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ অন মাইগ্রেশন’-এর রিপোর্টে যে মেকআপ আর্টিস্ট চারু খুরানার মামলার উল্লেখ করা হয়েছিল, সেই মামলার আইনজীবী তথা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য জয়তিকা কালরা বলছেন, “পরিযায়ী শব্দটি সম্মানজনক নয়। শুধু কর্মী বা শ্রমিক বলা হোক। কিন্তু যেহেতু এই বিষয়ে আইন রয়েছে, তাই তার সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দেই কিছু যায় আসে না।” (আনন্দবাজার, ১লা জুন ২০২০)
শব্দের ব্যবহার কি অর্থনৈতিক বৈষম্যের দ্বারা প্রভাবিত নয়? স্বচ্ছলবিত্তে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া সিংহভাগ ‘শ্রমিক’ চুক্তিপত্র পায়, নিশ্চয়তা ও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ন্যূনতম সুরক্ষাটুকু পায়। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বৃত্তে ভিনরাজ্যে বা মেট্রোশহরে কাজ করতে যাওয়া সিংহভাগ ‘শ্রমিক’ নির্দিষ্ট চুক্তিপত্র পায় না, অন্ন-বাসস্থানের নৈমিত্তিক সুরক্ষা নেই, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন গুজরান করতে হয়। আগের লেখায় (‘অপরজন লকডাউন সংখ্যা’য়) বেশ কিছু অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দিয়ে সম্যক পরিস্থিতি বিচারের চেষ্টা করেছিলুম। সেই লেখা ও পরিসংখ্যানের পুনরাবৃত্তি না করেও এটা বুঝতে অসুবিধে হয়না যে, প্রবল অনিশ্চয়তা আর অন্ন-স্বাস্থ্যের বঞ্চনার মধ্যে ভিনরাজ্যে চাকরিরত শ্রমিকেরা থাকেন। স্টেটাস বা সামাজিক অবস্থানের বিচারে যে দুই শ্রেণির কথা বললুম, একথা স্বীকার্য যে, এঁরা প্রত্যেকেই সস্তা শ্রমের বঞ্চনার শিকার। ভারতবর্ষের মতো আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশে যেখানে পুঁজির বিকাশ বিকৃত পরদেশনির্ভরশীল, সেখানে সস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্য। ফলে, হোয়াইট কলার জব বা গ্রে কলার জব- প্রত্যেকেই ছোট-বড় উদ্যোগপতিদের বঞ্চনার শিকার হন। কিন্তু, বহু সংস্থা (এমএনসি ও বিদেশি পুঁজি-বিনিয়োগ) অনেক ফাঁকফোকর গলেও অন্ততঃ শ্রমিক-আইনের ন্যূনতম শর্ত মানতে নিমরাজি হয় কিন্তু দেশীয়/স্থানীয় সংস্থাগুলো তা মানে না। সম্প্রতি এক বক্তব্যে জানা যাচ্ছে যে,
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন, বর্তমানে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। কারণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা শ্রমিক বা ভিনরাজ্যে দিনমজুরি করা মানুষদের নথিভুক্ত করা হয় না। তিনি জানান, পরিযায়ীদের জন্য ইন্টার-স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯ রয়েছে বটে। তবে পাঁচজন বা তার বেশি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে যে সংস্থা বা কনট্রাকটর কাজ করে এই আইন তাদের ক্ষেত্রে লাগু হয়। ফলে বৃহৎ সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক এর আওতার বাইরে থেকে যায়। (প্রতিদিন, ২৮শে মে, ২০২০)
এই না-মানার খতিয়ান স্বাভাবিকত্ব অর্জন করেছে। পরিযায়ী শ্রমিক মানেই যেমন অন্য রাজ্য থেকে আসা সস্তার ‘মজুর’ বোঝানো হয় সামাজিক অভিধানে, তেমনই স্বাভাবিক হয়ে গেছে এঁদের অনধিকার। আর, বিশালসংখ্যক মজুরের ভিড়ে অধিকারের তাত্ত্বিক বয়ান, সরকারি কানুন খতিয়ে বিবেচনা করার অবকাশই বা তাঁদের কোথায়? ২০১৭ সালে ভারতবর্ষের মোট আন্তঃরাজ্য পরিযায়ীর সংখ্যা ১৩৯ মিলিয়ন,[১] যদিও এই পরিসংখ্যানের বাইরে অ-নথিভুক্ত আরও অনেকেই রয়েছেন, কয়েক লক্ষ শিশুশ্রমিক রয়েছে যাদের নথিভুক্ত করাতে চায়না তাদের পরিবার বা ঠিকেদার। শ্রমিক পরিযানের উৎসরাজ্যগুলোর প্রথমে বিহার এবং উত্তর প্রদেশের নাম, এরপরে মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড ইত্যাদি। তাঁদের গন্তব্যস্থলের মধ্যে প্রথম দিল্লি ও মহারাষ্ট্র, এরপরে তামিলনাড়ু, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা ইত্যাদি রাজ্য। ভাষা, প্রাদেশিকতা, জাতির দ্বিধাগ্রস্ততায় প্রত্যেক রাজ্যের ভদ্রবাবু-শিক্ষিত-স্বচ্ছলবিত্তরা যতই চিন্তিত হোক আর তাত্ত্বিক বাগাড়ম্বরে লাফালাফি জুড়ে দিক- নিম্নবর্গের পরিযানে অন্ততঃ ভাষা-প্রাদেশিকতা-জাতির প্লাস্টিক-মেকি বিভেদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ, সর্বগ্রাসী ক্ষিধের সামনে এই সব বানানো দেওয়াল বালির বাঁধের মতোই ঠুনকো। শ্রমিকরা যে রাজ্যেই যান না কেন, আরও কিছু ব্যাপারে ভাষা-জাতি ব্যাতিরেকে তাঁদের মিল- মালিক/ঠিকেদার কর্তৃক বঞ্চনা, ভোটবাজ সংসদীয় দলগুলোর অবজ্ঞা-অবহেলা (যেহেতু পরিযানের শহরে তাঁদের ভোট নেই) ও কর্মক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। লকডাউন, কোভিড-১৯ অতিমারীর বহু আগে থেকে ভারতের সবচেয়ে কর্মক্ষম অথচ সবচেয়ে অবহেলিত এই শ্রমক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন কতিপয় অর্থনীতিবিদ্ ও সংস্থা,
In an unorganized and chaotic labour market, migrant workers regularly face conflicts and disputes at worksites. The common issues they face are non-payment of wages, physical abuse, accidents and even death. The political class ignores them because they don’t count as votes, especially in the case of inter-state migrants. Due to their mobile nature, they don’t find any place in the manifestos of trade unions. (Krishnavatar Sharma, World Economic Forum, 2017)
রাষ্ট্রের সময় হয়নি এই কথাগুলো শোনার। শাইনিং ইন্ডিয়া বা আচ্ছে দিন ইত্যাদির ঢক্কানিনাদে ও কৃষি-অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়ে ফাটকা-পুঁজির শিল্পায়ন আর বিকৃত অপরিকল্পিত নগরায়ণে বেড়ে গেছে পরিযানের হার। আগের প্রবন্ধে পরিযানের কারণ ও শ্রমিকদের দুরবস্থা বিষয়ে যে পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ ছিল, তা খেয়াল করলে দেখা যায় যে, এই শ্রমিকেরা কখনোই নিরাপদ ছিলেন না, নিশ্চিন্ত-সুখী ছিলেন না। একদিকে রেখে আসা ঘরদোর-পরিবারকে সচল রাখার জন্যে অর্থপ্রেরণ অন্যদিকে বর্তমান জীবনযাপনের অসহ অবস্থা- এই দু’য়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন দশকের পর দশক। রাজ্য সরকারগুলো প্রকৃত পরিসংখ্যান রাখেনি। কেন্দ্র সরকার ধৃতরাষ্ট্র সেজে বসে থেকেছে। সংসদীয় দলগুলো বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগে কোন এমএনসি কত লাভ করবে, কীভাবে সেজ্ প্রকল্পায়িত হবে, কোন লাভজনক সংস্থা কত কোটি টাকা তাদের ভোটব্যাঙ্কে দান তথা বিনিয়োগ করছে এইসব তরজায় মেতে থেকেছে। অথচ কোন ফাঁকে শ্রম-সুরক্ষা আইন কমজোরি হতে হতে প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক শ্রম-সংক্রান্ত আইনগুলোতে [২] শ্রমিকস্বার্থ বঞ্চিত ক’রে মালিকস্বার্থকে যথেচ্ছ অনুমতি ও ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং আগামীদিনে তা কার্যকরীও হবে। ভারতে ক্রমবর্ধমান অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে সস্তা শ্রমিকের চাহিদা-যোগানের অঙ্কে আইন ক্রমশঃ শ্রমিকদের বিপক্ষে যাবে। ভিনদেশে চাকরি করতে যাওয়া অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্দশাও হয়তো বাড়বে। কারণ, রাষ্ট্র ও তার তাঁবেদার মালিকপক্ষ জানে অস্থায়ী শ্রমিকেরা, বিশেষতঃ পরিযান করা অস্থায়ী শ্রমিকেরা সংগঠিত আন্দোলনে যাওয়ার ক্ষোভকাঠামো তৈরি করতে পারবেন না। শীর্ষ আদালতও বলে দিয়েছিল যে, লকডাউন চলাকালীন শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করলে তাঁদের আর বেতনের প্রয়োজন নেই। আবার, শীর্ষ আদালতের রায় সত্ত্বেও প্রশাসনিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলেন বৃহদংশ শ্রমিক, ক্ষোভ-অসহায়তা ক্ষিধেতেষ্টার সঙ্গে ঢোঁক গিলে নিয়ে ফিরলেন তাঁরা অনেকেই বহু অর্থদণ্ড দিয়ে ।[৩] করোনা-পরবর্তী দেশের অর্থনীতি, বিশ্বের সমাজব্যবস্থা কী হবে কিংবা ‘নিউ নর্ম্যাল’ আবহে কীভাবে মানিয়ে নেবে, তা নিয়ে বহু গবেষণা, সম্ভাবনা-তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু, লকডাউন-পরবর্তী সময়ের অর্থনীতি সমাজনীতি কী হবে? যে শ্রমিকেরা প্রবাস থেকে ফিরলেন পায়ে হেঁটে বা বাসে বা ট্রেনে সমস্ত সম্বল খুইয়ে, তাঁদের সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়,
initial data on reverse migration triggered by the national lockdown has shown that more than 67 lakh such people have already reached their home across 116 districts from various urban centres. Data collated by the Union skill development ministry from six states shows that while Bihar and Uttar Pradesh have registered the most number of such returnees, about 44 lakh migrants have returned to 53 districts. (the wire, 11th June, 2020)
বিহারের কাটিহার, চম্পারণ, মধুবনী উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগর, প্রয়াগরাজ রাজস্থানের পালি, উদয়পুরে সবথেকে বেশি শ্রমিক ঘরে ফিরেছেন। যদি এই হিসেব অসম্পূর্ণ ধরেও নিই, তাহলেও দু’টো প্রশ্ন থেকে যায় যে, বাকি শ্রমিকদের ফেরার কোন বন্দোবস্ত হয়েছে এবং যে ৬৭ লাখ শ্রমিক ফেরার পরে তাঁদের অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের কী হবে? পরিযান শেষে ঘরে ফেরা আনন্দের, যে কোনও ভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরতে চায় প্রত্যেকেই, ঘরের জন্যেই বাইরে যাওয়া আবার ফেরা সেই ঘরের টানেই- তবু, যে শ্রমিকেরা ফিরলেন তাঁরা কতখানি আনন্দ-সুখের সংস্থানটুকু নিয়ে ফিরতে পারলেন? এই ঘরে ফেরা তাঁদের পক্ষে স্বস্তির কিন্তু সুখের নয়, আপাত-বন্দিদশা থেকে মুক্তি কিন্তু নিশ্চয়তাহীন। এঁদের মধ্যে প্রায় ৮০% শ্রমিক নিজেদের রেস্তঁটুকুও খরচ ক’রে ফেলেছেন বাড়ি ফেরার রাহাখরচ জোগাড়ে, “About 76 percent of people who have called us since May 15th have less than Rs 300 left with them and 72 percent of people… It is not surprising therefore, that 48 percent (of 1,559 people) have taken loans between Rs 2,000 and Rs 5,000 during this period. 30 percent have taken loans of more than Rs 5,000” (SWAN, 5th June, 2020) সোয়ান ১৯৬৩ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি, অবহেলা আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চাপে ও তাপে শ্রমিকদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অবশেষে ঘরে ফেরার সাময়িক স্বস্তি ছাপিয়ে আগামীর নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত জাঁকিয়ে বসে। বহু টাকা খরচা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফেরার পরেও তাঁদের ভয় পেতে হবে যদি পাড়ার লোক তাচ্ছিল্য করে বা ঢুকতে না দেয়, আতঙ্কে থাকতে হবে যদি ভাড়ার বাড়ি থেকে বাড়িওলা তাড়িয়ে দেয়, লজ্জা পেতে হবে যদি আগের ধার-বাকি শোধ না করতে পারেন, অহোরাত্র মানসিক অবসাদে কাটবে যদি নতুন চাকরি না পান ও পরিবারের সংস্থান উপার্জন না করতে পারেন। অথচ, এঁরাই তো গড়ে তুলেছেন ইন্ডিয়াকে। যে ইন্ডিয়ার মডেল দেখে নাকি সার দিয়ে বিদেশি-বিনিয়োগকারী সংস্থারা দাঁড়িয়ে পড়ে, যে ইন্ডিয়ার মডেল সেলিব্রিটি দ্বারা বিজ্ঞাপিত হয় প্রতিদিন, যে ইন্ডিয়ার চাকচিক্যে ‘মেরা ভারত মহান’ বলতে বলতে গলা বুজে আসে আমাদের, সেই ইন্ডিয়াকে নির্মাণ করেছেন এঁরাই। আমরা করোনা-পরবর্তী ভদ্র-মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত-রুচিবানদের ‘ভাল থাকা’ নিয়ে করোনা-পূর্ব জীবনের স্মৃতিরোমন্থনে বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়েছি, একঘেঁয়ে জাবর কেটেই চলেছি। অথচ, লকডাউন-পরবর্তী সংকটে এঁদের ভাবতে হচ্ছে অর্থনৈতিক সংগ্রামের কথা, আনলক-পরবর্তী যুদ্ধে টিঁকে থাকার সংকট। ভিনরাজ্য থেকে কাজ-হারানো শ্রমিক ফিরে এলে পাড়ায় চপ-তেলেভাজার দোকান খুলে বসেছেন তাঁর স্ত্রী, ভদ্রবাবুদের ফেসবুকীয় মিমকে পাত্তা না দিয়েই। বন্ধ হয়ে যাওয়া গেঞ্জি কারখানায় চাকরি করতে এসেছিলেন উড়িষ্যার যে শ্রমিক, তিনি ভ্যানে শাকসব্জি নিয়ে ঘুরছেন। নির্মীয়মাণ শপিংমলের শ্রমিক কালাম অর্ধেক মাইনে পেয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে গেছেন কোনওমতে, জানেন না আর এশহরে ফিরতে পারবেন কিনা। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের যোগ হয়েছে বাধ্যতঃ পেশাবদলের সংকট।
#
“ডিনামাইট নিয়ে আমি গিয়েছিলুম গভীর থেকে আরও গভীরে
আমি ফিরিনি, কিন্তু তোমাদের জন্যে আগুন এসেছে।
আমার নামে তোমরা কেন নাম রাখোনি শহরের রাস্তার?
তবে সেসব রাস্তা কাদের নামে, তাদের তো চিনি না” -স্মৃতির শহর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
শাসক-মতাদর্শের নিজস্ব বা ঘনিষ্ঠ বয়ানে কোনও আন্দোলন-বিক্ষোভ তা সে যতই ছোট হোক, তাকে গুলিয়ে দেবার মূলধারার শোষণনিষ্ঠ যুক্তিকাঠামোয় মিশিয়ে দেবার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। তাই, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে হত্যা করার পরে ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ বয়ানে বিদ্রোহ শুরু হলে, পাল্টা বয়ান তৈরি ক’রে নেয় শাসক-মতাদর্শ- ‘অল লাইভস্ ম্যাটার’। আক্রমণ করা হবে হত্যা করা হবে অবমানবায়ন হবে বিশেষ একটি শ্রেণির, একটি জাতির, একটি বর্ণের বা একটি বিশেষ ধর্মের কিন্তু তার প্রতিবাদে বিক্ষোভের মেঘ পুঞ্জীভূত হলে ‘বৃহত্তম মানুষ’-র দোহাই মনে পড়ে যায়। অত্যাচার করার সময়, বঞ্চনা করার সময় ভেদভাব আর বৈষম্য কিন্তু তাঁদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ যখন অত্যাচারী আর বঞ্চনাকারীর দিকে অস্ত্র শানায়, তখনই ‘সবাই সমান’-এর সেফ্টি ভালভ্ কৌশল ছড়িয়ে দেয় শাসক; অজান্তে আমরাও। তাই, লকডাউন-পরবর্তী ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সুদীর্ঘ পদযাত্রার ছবি দেখে, পথে হা-ক্লান্ত হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিকের মৃত্যুতে এবং রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত শয়তানি দেখে ‘মাইগ্র্যান্ট লাইভস্ ম্যাটার’ স্লোগান সোচ্চার হ’লে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ-অনুষঙ্গ ‘সবার জীবনেরই দাম আছে’-র উদাসীন ফাঁপা-দার্শনিকতা বাতাসে ভাসিয়ে দেয়। বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা বেতন আর নিশ্ছিদ্র চুক্তিপত্রের বিনিময়ে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া যুবতী/যুবক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টেটাস দ্যায়, সেও পরিযায়ী শ্রমিক। চাকরিক্ষেত্রে আপাত-নিরাপত্তা, সবেতন ছুটি ও ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম সুবিধাসমূহ নিয়ে ভিনশহরে চাকরি করতে যাওয়া যুবক/যুবতী ব্যঙ্গমিশ্রিত তাচ্ছিল্য আড়াল ক’রে হ্যাশট্যাগ খ্যালে, ‘ঊই আর মাইগ্র্যান্ট লেবর টুউউ’। আর, ভারতের হৃৎপিণ্ড শিরা-উপশিরা জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের রক্তছাপ পড়ে তখন। ১২ বছরের জামলো মাড়কাম শহীদ হয়, ঘর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে আত্মহত্যা করে কেউ, বাড়ি ফিরতে চেয়ে রাতের ট্রেনের চাকায় শহীদ হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে ভারতের ঘটমান অর্থনীতি-সংস্কৃতির পাথরে মাইগ্র্যান্ট, পরিযায়ী, প্রবাসী শব্দগুলো খোদাই হয়ে যায়। রাষ্ট্র ও তার মতাদর্শের অনুশীলনকারীরা যতই ‘মাইগ্র্যান্ট লেবর’ শব্দবন্ধকে হালকা ক’রে দিতে চাক কিংবা ‘যারাই বিভুঁয়ে আছে তারাই মাইগ্র্যান্ট/পরিযায়ী’ প্রচার করতে চাক, তা হয় না বাস্তবে। পরিযায়ী শ্রমিক শব্দবন্ধে অপমান আছে, শ্রমের বঞ্চনা আছে, তাচ্ছিল্য ভরে রুটি ছুঁড়ে দেওয়ার মানসিকতা আছে, ঘৃণা-অচ্ছুৎ সংস্কৃতি আছে এবং বাসাছাড়া হওয়ার বিষাদ আছে।
Arun Yadav travelled via Shramik train from Delhi to Katihar in Bihar. With long halts, diversions and unplanned detours, the entire journey took 40 hours. Food was provided at one station in Uttar Pradesh, however this barely fed half the passengers. Arun, who missed the chance to grab a food packet, did not eat anything for nearly 2 days. (SWAN, to leave or not to leave, 37)
অরুণ যাদবের কোনও কোনও সহযাত্রী তাও একটিবার খাবার পেয়েছিলেন কিন্তু বহু ‘শ্রমিক স্পেশ্যাল’ ট্রেনে সেই ব্যবস্থাও করতে পারেনি শাসক। কোথাও দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক ছুঁড়ে দিয়েছে বিস্কুটের প্যাকেট। টিকিটের লাইনে ঠাঠা রোদে হাপিত্যেশ দাঁড়িয়ে থেকে জানা গেছে কোনও ট্রেনই নেই! মৃত শ্রমিকের লাশের সঙ্গে দু’দিন একই ট্রাকে গাদাগাদি ক’রে ফিরতে হয়েছে। ওঁদের কি করোনাক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল না? নাকি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনভর হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে ‘ন্যাচরাল ইমিউনিটি’ তৈরি হয়ে গেছিল? ওঁদের একটাই শব্দে চিনেছে ইন্ডিয়ার সোশ্যাল মিডিয়ায় দক্ষ লোকেরা- পরিযায়ী শ্রমিক! পরিযায়ী শ্রমিক শব্দবন্ধে শ্রমের উচ্চ-নিচ ভাগ বোঝা যায়, দক্ষ-অদক্ষ ভাগ করা যায়, সামাজিক অবস্থান তথা স্টেটাসের জৌলুসহীনতা টের পাওয়া যায়। আর, লকডাউন-পরবর্তী ভারতে পরিযায়ী শ্রমিক বনাম রাষ্ট্রের প্রতর্ক ভদ্দরলোক-শিক্ষিত-মধ্যবিত্তদের ‘আহা-উহু-ওহ্-ইশ’ অব্যয়গুলোতে মালুম করা যায়। মূল সমস্যা পরিযায়ী না প্রবাসী না সদ্যআবিষ্কৃত কোনও শব্দ তার ঔচিত্য-অনৌচিত্যে নেই, সমস্যা আমাদের সমাজকাঠামোয়, অর্থনীতিতে এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক অভিমুখে। সহৃদয় ব্যক্তিরা বা কোনও সংস্থা তাঁদের জন্যে ভেবেছে, খাবার-জলের ব্যবস্থা করেছে, কমিউনিটি কিচেন করেছে কোথাও কোথাও। এ কোনও ত্রাণ নয়, কোনও মহানুভব সেবা নয়- এটুকু আমাদের উচ্চবর্গের দায়িত্ব। রাষ্ট্র তার সচেতন দানবিকতায় যে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে; কারণ রাষ্ট্র জানে যে, ক্ষিধের কাছে স্মৃতি-আবেগ সব তুচ্ছ- এই মানুষদের আবারও অস্থায়ী অসংগঠিত শ্রমিকে রূপান্তরিত করে নেওয়া যাবে। এই মানুষগুলো শ্রম-অধিকার আইনের কথা তুলবে না, বৈষম্যের কথা তুলবে না, সংবাদমাধ্যমের পিনিকপ্রবণ শিরোনামে আসবে না, এরা আইডেন্টিটি কার্ডের নম্বর। এঁদেরই নিংড়ে নিতে শাসকগোষ্ঠী ন্যূনতম কর্মসময় ৮ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা করতে চাইছে, লকডাউন-করোনাঘটিত অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কর্মসময় বাড়িয়ে দেওয়ার অমানবিকতায় শ্রমিক-স্বাস্থ্য (হিউম্যান রিসোর্স ওয়েলফেয়ার-র মতো গালভারি শব্দ) অবনতি হবে আরও এবং শ্রমক্ষেত্রে চাহিদা কমবে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের; শ্রমিকজোগান অব্যাহত থাকায় কমবে মজুরি, মালিকের স্বেচ্ছাচারী আচরণ বাড়বে। তবু বাধ্যতঃ এই মানুষেরাই শ্রম দেবেন। আবারও কোনও ব্যাপক সংকটে এই মানুষগুলোই ট্রেনে, হাইওয়েতে, রেলওয়ে ট্র্যাকে, প্ল্যাটফর্মে, ট্রাকে, বন্ধ ঘরে মরে পড়ে থাকবে। একক নয়, এঁরা অগণন। তাই এঁদের যথেচ্ছ ব্যবহার ক’রে হাত ধুয়ে ফেলবে রাষ্ট্র; এবং রাষ্ট্র নির্মাণ করা আমরা। পরিযায়ী শব্দের ঠিক-ভুল ব্যবহার সরিয়ে এটা ভাবা যায় না, যে এঁরাই দধীচি? এঁদেরই শ্রমে-ঘামে-রক্তে ইন্ডিয়ার নির্মাণ হয়েছে হয়ে চলেছে এবং হবে, যাবতীয় সভ্যতার ভিত এঁরাই অথচ এঁরাই এক্সপেন্ডেবল্। বুকের পাঁজর খুলে বজ্র তৈরি করতে দিয়েছিলেন যেমন, এঁরাও প্রতিদিন প্রতিবছর নিজেদের বলি দেন উন্নত দেশ গড়তে। পার্থক্য একটাই, এঁরা শাসকের বয়ানে ‘মহান’ নন। এঁরা মূলধারার ইতিহাসে নেই, ভূগোলে আছেন (ভূগোল বইয়ের পাতায় লেখা থাকে সস্তা শ্রমিক শিল্পস্থাপনের উপযুক্ত পরিবেশ), সাহিত্যে ছিলেন না, প্রযুক্তির খরিদ্দারও এঁরা নন, মিডিয়ার টিআরপি নন, এঁরা ‘মহান’ নন। না, এঁদের দারিদ্র্য এঁদের মহানও করেনি কোনও কৃষ্ণ বা খ্রিস্টের সম্মানও দান করেনি। তবু এঁরাই দেশ গড়ার কারিগর, গণতন্ত্রের মূল ‘গণ’…
#
অস্থায়ী থেকে স্থায়িত্বে এগিয়ে চলো
অসংগঠিত থেকে সংগঠনে চলো
শোষণ থেকে শোষণমুক্তির পথে চলো
হে শ্রমশক্তি, তোমার শ্রেণিসংগ্রাম, শোককে সক্রোধ লড়াইয়ে পরিণত করো
-সূত্র- “অসতো মা সদ্গময়ঃ…”, বৃহদারণ্যক উপনিষদ
‘নিজেকে বদলাও, সমাজ বদলাও’ নয় বরং সমাজকে বদলাও, নিজেকে বদলাও। সমাজবদলের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে বদলানোর প্রক্রিয়াও চলবে। তা না হলে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমাত্র ‘ব্যক্তি’-র বদল পরীক্ষিতভাবেই অসম্ভব। শব্দের ব্যবহার আর ব্যবহারের রাজনীতিও এই সমাজেই লালিত-পালিত হয়। ‘পরিযায়ী’ শব্দে যে লাঞ্ছনা ও অপমান সামাজিক-অর্থনৈতিক অর্থে লুকিয়ে থাকে, আমাদের সেই অপমান ও লাঞ্ছনার উৎস অনুসন্ধানের সময় এসেছে। বহু দশক ধরেই সেই সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছি আমরা নির্লিপ্ত থেকেছি। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামীর সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক আবহ ওই অপমান-লাঞ্ছনা-শোষণের শিকড়-উৎসকে গোড়ায় আঘাত করার নির্দেশ দেয়। শুধুমাত্র একটা শব্দের ব্যবহার ও অর্থবোধ বিদ্ববৃত্তে পাল্টে গেলে ওই দধীচিদের কিচ্ছু যাবে আসবে না, শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল আর অসহনীয় সংকট থামবে না। ‘পরিযায়ী’-র বদলে প্রবাসী বা ‘শুধু শ্রমিক’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলেই রাষ্ট্র ও তাঁবেদার পুঁজিপতিদের শোষণ থামবে না। শব্দের অর্থবোধের গোড়ায় লাগা রক্তমাংসের শ্রমিকের অপমানের বিরুদ্ধে দ্রোহ প্রয়োজন, কয়েকশো মাইল হেঁটে চলা শ্রমিকের জামলো মাড়কামের প্রতিরোধ জরুরি- তা’লেই আগুনে পুড়েও ধুলো ঝেড়ে ছাই ঝেড়ে উঠে আসবে নতুন চেতনা। সেই উত্তাপে শব্দ নিজেকে ঝলসে নেবে, মজবুত করবে। ‘মজদুর’ শব্দে কোনও অবজ্ঞা থাকবে না ভদ্রবাবুদের, ‘মজুর’ শব্দে রুচিবান-মধ্যবিত্তের রোম্যান্টিক ন্যাকামি ঝরঝরিয়ে পড়বে না আর ‘শ্রম’ শব্দটি দধীচির পাঁজরের মতোই পবিত্র, প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে উঠবে। পরিযায়ী শব্দ ব্যবহার করব কি না, তা কতটা অসম্মানজনক, এ শব্দ ব্যবহারে সহি মানবতাবাদী বা সহি রাজনৈতিক হওয়া গেল কি না, এগুলোর থেকেও বেশি বিচার্য শ্রমিকদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, দুরবস্থার অন্ধকারে আরও তলিয়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর সন্ধিক্ষণ। শ্রমিকদের অধিকারের লড়াই, অস্থায়ী থেকে স্থায়ীকরণের লড়াই, অসংগঠিত থেকে সংগঠিত করার লড়াইয়ের সঙ্গেই জুড়ে থাকে শব্দকে বদলানোর প্রসঙ্গ। পরিযায়ী শ্রমিকদের সক্রোধ শ্রেণিঘৃণা রাষ্ট্রবিরোধী সংগ্রামে রূপান্তরের মধ্যেই নিহিত থাকে শব্দের অর্থবোধ ও চিহ্নক-চিহ্নিত পরিবর্তনের সম্ভাবনা। শ্রমিকের অধিকারের সংগ্রামের চেতনাতে বিশেষণ বদলানোর যে তাগিদ, তা বিচ্ছিন্ন ভাবনা নয়, স্বাধীন/উত্তরাধুনিক শব্দকামুক তাত্ত্বিক উদ্দেশ্যহীনতা নয়। পরিযায়ী শব্দে পাখিদের ডানা ঝাপটানোর গন্ধে শিশিরপতনে যে রোমাঞ্চ, তা অনুভব করেননা ২০০ কিলোমিটার হেঁটে মারা যাওয়া শ্রমিকেরা, পরিযায়ী পরের বসন্তে ফিরে এলে নরম রোদ ক্যামেরায় চলকাবে কিনা, তা ভাবার অবকাশ ছিল না মুজফ্ফরপুর প্ল্যাটফর্মে মারা যাওয়া অবোধ শিশুর মায়ের। অভিরাম যেমন কয়েক দশক পরে এর’মই এক রেলস্টেশনে তার বাগ্দি-মাকে[৪] আবিষ্কার করতে পেরেছিল, ওই শিশুটিও সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। আর, ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের এই বিদ্ববৃত্তের কর্তব্যবোধও নিশ্চয়ই কিছু বলবে।
[লেখক – গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়]
তথ্যপঞ্জি:
[১] https://www.weforum.org/agenda/2017/10/india-has-139-million-internal-migrants-we-must-not-forget-them/
[২] https://www.simpliance.in/labour-reforms
[৪] সুবর্ণরেখা, ঋত্বিক ঘটক, ১৯৬২
Posted in: ARTICLE, June 2020 - Cover Story