বিবর্তনের ধারায় মুখোশ নৃত্য : মৌ মুখার্জী

কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রা, ভাষা, ধর্ম, আচার, লোক-বিশ্বাস, লোক-প্রথা, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, নাচ, গান, বাদ্য, উৎসব, অনুষ্ঠান এই সব কিছুরই মিলিত রূপ হল সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি বিবিধ পরিবর্তন ঘটে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এই সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ হল কলাবিদ্যা। কেবল মাত্র কলাবিদ্যার ক্ষেত্রেই ব্যক্তি নিজস্ব বাসনা ও কল্পনার দ্বারা উদবুদ্ধ হয় এবং শিল্পী তার শিল্প সৃষ্টি করে যা তার মনের বাসনাকে চরিতার্থ করে। এই কলাবিদ্যার মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই চারটি ধারার কলাবিদ্যার উল্লেখ মেলে, সেগুলি হল- সাহিত্যকলা, সঙ্গীতকলা, চিত্রকলা ও নৃত্যকলা। সংস্কৃতি এই চারটি প্রাচীন ধারার মধ্যে নৃত্যকলাকেই সব থেকে প্রাচীনতম কলা হিসেবে ধরা যায়। তবে নৃত্যের সূচনা কালটি শুরু হয়ে ছিল জাদুর অঙ্গ হিসেবে এবং মুখোশ ছিল এই জাদুর বহিপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম বা উপকরণ। আদিম মানুষের সমাজ সংস্কৃতির এই মুখোশ পরম্পরার ছায়া সমসাময়িক কালেও লক্ষ করা যায় লোক-জন গোষ্ঠী ও জন-জাতি গোষ্ঠী গুলির মধ্যে। এই মুখোশ নৃত্যের বিবর্তন প্রসঙ্গে নিচে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল।
মানব জাতির সূচনা পর্বে প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর আগে পাথরের হাতিয়ার তৈরি আর দুপায়ে ভর দিয়ে দাড়ানোর পর্যায়ের সঙ্গেই তাদের বিবর্তনের অভিমুখই পাল্টে গেল পৃথিবীর বুকে। সর্ব প্রথম আফ্রিকা মহাদেশে হোমো ইরেকটাসের (Homo erectus) উদ্ভব ঘটে ১.৫ থেকে ১.৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে। এরা বিবিধ জলবায়ু ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম মানব জাতি রূপে চিহ্নিত হল, তার পরবর্তীতে এদের দ্বারাই আগুনের ব্যবহার, ও উন্নত শিকার পদ্ধতির সূচনা ঘটে। এরপর আসে হোমো সেপিয়েন্স নিয়ানডার্থালয়েন্সিস(Homo sapiens neanderthalensis) বা নিয়ানডার্থালরা, এরা প্রস্তর দ্বারা তৈরি উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করত এবং গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে থাকার সাথে সাথে এরাই প্রথম মৃত্যুর পর আত্মার কল্পনা করে ছিল বলে মনে করা হয়। এছাড়া, এরাই আধিভৌতিক বিবিধ আচার, জাদু ও শিকার জাদু (Hunting Magic) প্রভৃতি বিষয়ের উপরেও প্রথম চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিল বলেও ধারণা করা হয়। এর পরবর্তী ভাগের থেকেই বর্তমান মানুষ হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স (Homo sapiens sapiens) বিকাশলাভ করল, এটিই ছিল বিবর্তনের সুদীর্ঘ পর্যায় ক্রমের রূপ।
মানব সভ্যতার আদি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এই সকল আদিম মানবরা তাদের জীবন নির্বাহ করত দলবদ্ধ ভাবে। এই মানব গোষ্ঠীর তৎকালীন বাসস্থান ছিল গিরিগুহা অথবা সুড়ঙ্গে। আর, তারা ছিল যাযাবর, এরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খাদ্য অন্বেষণ করত। এই সকল মানব গোষ্ঠীরা সদা ব্যস্ত থাকত বাঁচার তাগিদে খাদ্য অন্বেষণ ও পশুদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য। অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মানব জাতির সাংস্কৃতিক সূচনাকাল শুরু হয় প্রস্তর যুগ দিয়ে, এই প্রস্তর যুগকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় (ক)প্র্ত্ন-প্রস্তর যুগ বা প্রাচীন প্রস্তর যুগ(Palaeolithic Period), (খ)মধ্য-প্রস্তর যুগ(Mesolithic Period) ও (গ)নিম্ন-প্রস্তর যুগ বা নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic Period)। প্র্ত্ন-প্রস্তর যুগ বা বলা যায় প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়ে, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি হাজার বছর আগের গুহাবাসী মানুষেরা যে শিল্প স্বাক্ষর রেখে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে্র গুহার দেওয়াল ও ছাদে, সেই শিল্প স্বাক্ষর গুলিই প্রমান করে যে তা ছিল শিকার নৃত্য ও জাদুবিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের ভাবনা ও আচরণের প্রতিফলন বা প্রতিফলিত রূপ। দক্ষিণ ফ্রান্সের পিরেনিজ পর্বতমালার আরীজ অঞ্চলের লেস্ ত্রোয়া ফ্রের (Les Trois Freres) নামক গুহার একটি গুহাচিত্রে কয়েকটি নৃতারত মুখোশধারী মানুষের মধ্যে, একটি জাদুকরের চিত্র দেখা যায়। য়ার দেহ বিবিধ পশুর আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা আবৃত ছিল, ক্যাথলিক যাজক, নৃতত্ত্ববিদ তথা আদিম গুহা চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ অ্যাবে হেনরি ব্রুইল (Abbe Henry Breuil, 1952) এই নৃত্যরত মুখোশ পরা মানুষটিকে “Sorcerer” অর্থাৎ, জাদুকর বলে উল্লেখ করে ছিলেন।”.. the figure we called at first the “Sorcerer”, which is really the “God” of the Trois-Freres.” এটি প্রায়, ২৫০০০ বছর আগের, আদিম মানবের হয়তবা নিয়ানডার্থাল মানব জাতির তৈরি মুখোশের একটি অন্যতম আদিম নিদর্শন বলে মনে করা যায়। অর্থাৎ, জাদুবিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের সেই আদিকালের ভাবনা ও আচরণের সূত্রটি এবং একই সাথে মুখোশ উদ্ভবের প্রাচীনতম মূল সূত্রটিও এর থেকেই পাওয়া যায়। আমাদের দেশের মধ্যপ্রদেশের ‘ভীমবেটকা’-সহ পৃথিবীর আর অন্য যে সকল স্থানে আদিম গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে তাতে প্রধানত বিবিধ পশু ও তাদের শিকার চিত্র, পশুর বেশধারী ও গাছের ডালপালা পরিহিত দন্ডাকৃতি কিছু মানুষের চিত্র ও কখন কখন শিংওয়ালা প্রাণীর আদলের মুখোশসহ মানুষের চিত্র এবং আদিম পুরুষ ও মহিলা উভয় মানুষের সম্মিলিত নাচের দৃশ্য অথবা কখন কখন সারিবদ্ধ নাচের বহুল দৃশ্যও এই সমস্ত অঙ্কনে লক্ষ করা যায়। প্রধানত এই সকল গুহাচিত্রের সিংহ ভাগই ছিল শিকার কেন্দ্রিক। এই প্রাচীন গুহা মানবের যুগের নাচ, ছবি প্রভৃতির বিশেষ ভূমিকা ছিল। আর এর প্রধান কারণ ছিল বাঁচার তাগিদের জন্য এবং যে বিশ্বাসের দ্বারা এই সকল সংস্কৃতি ও জীবন ধারা প্রবাহিত হয়েছিল সেই বিশ্বাসটি ছিল জাদু-বিশ্বাস। আর মুখোশ ছিল বাস্তব জগৎ ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যে সংযোগকারী এক জাদু-মাধ্যম। এযেন শিকার থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসে সম্পৃক্ত হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার চিহ্নকেই বহন করছিল। যা পরবর্তী কাল, সমাজ, ধর্ম, আচার প্রভৃতি সকল বস্তুর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
গুহাগাত্রে চিত্রিত মুখোশসহ গুহামানবদের মুখোশ ব্যবহারের কারনকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে ধরা যাক – মুখোশের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের রূপান্তর ঘটানো হত। আদিম নৃত্য শিল্পীদের ছদ্মবেশ ধারণের প্রধান উপকরণই ছিল গাছের ছাল ও ডাল-পালা বা পূর্বে তাদের হাতেই শিকার হওয়া এইরূপ প্রাণীর মাথা, শিং বা গায়ের ছাল। যা পরিধান করে এবং তার গলার স্বর নকল করে ও চলন নকল করে সেই প্রাণীকে আকর্ষণ বা বিভ্রান্ত করত এবং ঐ গোত্রীয় প্রাণীকে আবার শিকার করতে সুবিধা হত। অন্য মতে, দ্বিতীয় ভাগে ধরাযাক – মুখোশ ছিল জাদু বিদ্যার প্রয়োগ মাধ্যম। যার দ্বারা মানুষ শিকারে যাবার আগে শিকারটির ছবি গুহাগাত্রে এঁকে তাকে বধ করার চিহ্ন এঁকে দিত। অর্থাৎ, নকল ভাবে শিকার মেরে আসল শিকার করার সমস্যাকে দূর করত। এই জাদু ক্রিয়া করা হত শিকারের মান্যাটিকে খুশি করতে এবং ছবির বিষয়কে বাস্তবে রূপদান করতে। আবার, ছবি আঁকার বদলে শিকারের মহড়ার নাচ বা নকল শিকারের নাচ করত। পূর্বে যে শিকারটিতে তারা জয়লাভ করেছিল সেই শিকারে যাবার আগে তারা এইরূপ নাচ করে ছিল এবং জয়ী হয়ে ছিল, তাই বর্তমান শিকারে যাবার আগে এই রূপ নাচ করলে এরা আবার জয়ী হবে এই ধারণাই তাদের অনুপ্রাণিত করত। এছাড়া শিকারে যাবার পূর্বে শিকার নৃত্যের মহড়া চলাকালীনও তাদের ছদ্মবেশ তথা মুখোশ ধারণ করে মুখোশ নৃত্য করার রীতি ও ছিল যা আচার ধর্মী নাচেরই এক প্রয়োগ বলে মনেকরা যায়। অথবা প্রায় একই ভাবে বলাযায়-পূর্বে শিকার করা পশু বা প্রাণীর মুখোশ বা ছদ্মবেশের মধ্যে সেই প্রাণীটির আত্মা ভর করবে বা কোনো অলৌকিক ঘটনার দ্বারা পুর্বে ঘটে যাওয়া শিকারটির অনুকরণ আবার ঘটবে; এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই ছদ্মবেশ ধারণ করে তার অন্তলীন জাদুকে বা পূর্বের শিকারের আত্মাকে সন্তুষ্ট করে ও সেই মান্যাকে কাজে লাগিয়ে আসল শিকারটিকে বর্তমান শিকারীর অস্ত্রের সামনে এনে দাঁড় করানো যাবে এবং বর্তমান শিকারটিকে এই জাদু বিশ্বাসের জোরেই বধ করা যাবে। অর্থাৎ মুখোশের সাহায্যে তৈরি হত এক ইন্দ্ৰজালিক আবহের, যা শিকারটিকে বিভ্রান্ত করত এবং শিকারটি সহজেই বধ করা যেত। অর্থাৎ, সেই সময় থেকেই জাদু ও নৃত্যের উপকরণ হিসেবে মুখোশের ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে ধরা যায়। অর্থাৎ, এই বর্ণনার মধ্যে দিয়েও যেন টোটেম ও মান্যার ছায়াটিই বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়। নিয়ানডার্থাল মানব জাতির সময় কাল থেকেই টোটেম ও মান্যার বিকাশ ঘটে ছিল বলেই মনে করা হয়। আবার তৎকালীন মানবসমাজে জাদুকরের ক্ষমতা ও তার ভূমিকা সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়। এই সকল বিষয় থেকে এই ধারনায় আসা যায় যে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম মানব গোষ্ঠীর ঐন্দ্রজালিক বা জাদু বিশ্বাস ছাড়াও টোটেম, ট্যাবু ও মান্যার উপরেও বিশেষ ভাবে আস্থাশীল ছিল। এই সকল বস্তু একে অন্যটির সঙ্গে বিশেষ ভাবে যুক্ত, মান্যা সূত্রে অলৌকিক শক্তি, টোটেম সূত্রে গোত্র, ট্যাবু সূত্রের সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধ, জাদু সূত্রে ওঝা তন্ত্র বা শ্যামনিজম / শামানইজম্ (Shamanism), অর্থাৎ এই সকল বিষয়ই মানব সমাজ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিল; এবং এই সকল বিষয় থেকেই সৃষ্টি হল দেবতা বা ধর্মের এবং এই প্রতিটি পর্যায়ের সঙ্গেই যুক্ত ছিল মুখোশ নাচের ধারা। যার প্রকাশ বর্তমানেও দেখতে পাওয়া যায়।
পশুর দেহের অসীম শক্তি ও দীর্ঘাকার দেহ আদিম মানুষের মনে ভীতির কারণ ছিল, তাই আদিম মনুষ পশুকে বেশি পরাক্রমশালী দেখে অজ্ঞানতাবশত তারা মনে করত যে, ওই সমস্ত পশুদের আত্মাও তাদের আত্মার থেকে বেশি পরাক্রমশালী হবে। তাই এই শক্তিশালী পশু ও তার আত্মাকে বিভিন্ন জাদুক্রিয়া বা উপাসনার দ্বারা তারা খুশি করত এবং তারা মনে করত যে এই সমস্ত পশুরা নিশ্চয় এমন কোনো শক্তি হবে, যাদের মানুষের সুখ দুঃখের উপর পূর্ণ প্রভাব আছে, এবং যাদের বরপ্রাপ্তি অথবা ক্রোধকে শান্ত করার জন্য উপাসনা করা আবশ্যক। অর্থাৎ ভয় থেকেই ভক্তির সৃষ্টি হল, যার থেকেই মানুষের মধ্যে পশু-পূজার আবির্ভাব হল এবং এই উপাসনা অর্থাৎ জাদু কেন্দ্রিক আচারটি পালন করতে প্রধানত যে বিশেষ উপকরণটিকে কাজে লাগাত তা হল মুখোশ।
আবার একই রকম ভাবে আদি মানব জাতি কোনো এক অলৌকিক শক্তির আধার রূপে প্রকৃতিকেও মনে করত এবং সেই অলৌকিক শক্তি মানুষের জীবনের উপর পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করত বলেও তারা ধারণা করত। এই অলৌকিক শক্তিকে আবার অলক্ষ্য শক্তি বা অলক্ষ্য-সত্তা অথবা অতীন্দ্রিয় শক্তি বা ঐশী শক্তিও বলা হয়ে থাকে। যাকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বৈপায়ন আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে মান্যা, ম্যানা বা মানা (Manya) বলত। এটি একটি মেলানেশিয় শব্দ, এখন এই শব্দটি সর্বত্র গ্রহণীয়। দ্বৈপায়ন আদিবাসী জাতি গুলি মান্যা বলতে বুঝত নৈর্ব্যক্তিক শক্তি বা Impersonal force-কে; অর্থাৎ যা পৃথিবীর সকল বস্তুর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এবং সেই বস্তুর হ্যাঁ বাচক বা ধনাত্মক(Positive) কার্যকলাপকেই মান্যা বলত। পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির মতানুসারে এই অলক্ষ্য-সত্তা সকল প্রাকৃতিক বস্তু যেমন- সূর্য, চন্দ্র, পর্বত, নদী, গাছপালা ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে পারে। প্রাকৃতিক বিবিধ ঘটনা যেমন ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিষয় গুলির দ্বারা ঘটে যাওয়া ঘটনা বা দুর্ঘটনার পেছনেও লুকিয়ে থাকে এই অলক্ষ্য সত্তা। অর্থাৎ, এই ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পেছনে যে অলক্ষ্য শক্তি লুকিয়ে থাকে তাকেই মান্যা বলে। এই শক্তির কোনো আকার নেই। এটি বিশ্বের সকল শক্তির আধার। এই কারণেই অলৌকিক শক্তিকে তুষ্ট রাখতে অলৌকিক শক্তির সঙ্গে মানুষ এক যোগসূত্র স্থাপন করলো জাদুকরের সাহায্যে। এই শক্তির তুষ্টিকরণ পদ্ধতিটি ছিল জাদুকরদের কাছে খুব ঝুঁকি সাপেক্ষ ও ভয়ের। তাই এই সময়ই প্রয়োজন হত মুখোশের, যা যোগসূত্র স্থাপন কারি জাদুকরেরকে রক্ষা করতে পূর্ণ সহযোগিতা করত, কারণ তারা মনে করত যদি এই শক্তি ক্রোধান্বিত হয় তখন মানুষের মুখে মুখোশ থাকলে সেই ক্রধিত শক্তি মানুষটিকে চিনতে পাড়বে না এবং বিভ্রান্ত হবে অথবা মুখোশটিকে দেখে ভয় পাবে।
প্রাকৃতিক এই অলক্ষ্য শক্তিকে অর্থাৎ মান্যাদেরকে তুষ্টি লাভের আশায় ও আকাঙ্ক্ষায় সৃষ্টি হল বিবিধ পূজা-পার্বন ও আচারের। যার থেকে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হল ধর্ম ও দেবতার। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিবিধ শক্তি বা মান্যা থেকেই বহু দেবতার জন্ম হয়েছে বলে মনে করা হয়, অথবা বলা যায় যে – মান্যাই বিবর্তিত হল দেবতায়। প্রথমে প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে তৈরি মান্যা দেবতার মান্যতা পায় যেমন – অগ্নি, বরুণ, সূর্য, চন্দ্র, বিবিধ পর্বত, নদী ইত্যাদি। এরপর গাছ-পালা, পশু, পাখিরা মান্যা থেকে দেবতার স্থানে উন্নীত হল। এ গুলিকে আবার টোটেম হিসেবেও আমরা দেখি। টোটেম শব্দটি প্রথমে উত্তর-পূর্ব আমেরিকা গ্রেট লেক অঞ্চলের রেড ইন্ডিয়ানদের বিবিধ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই ব্যবহার হয়ে ছিল বলে ধরা হয়। এরা নিজের গোষ্ঠীর সদস্যদের ওটোটেমান (Ototeman) অথবা নটোটেম বা ওটোটেমা বলে চিহ্নিত করত, এই কথার অর্থ হল -নিজের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় বা আমার আত্মীয়। টোটেমের মূল সূত্রই হল ক্ল্যান (Clan) অর্থাৎ গোষ্ঠী, বংশ বা গোত্র। গোত্র কথার অর্থ বলতে বোঝায় বংশ বা কুলকে অর্থাৎ যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে। আবার টোটেম কথার অর্থ হল কুলপ্রতীক। অর্থাৎ টোটেম – সংস্কারের প্রেক্ষাপটে যে কোনো একটি পশু বা পাখি অথবা ফুল বা ফল কিংবা গাছকে কোন গোষ্ঠীর আদি প্রবর্তক বলে মনে করা হয়; এবং ঐ বিশেষ প্রাণী বা ফল, ফুল অথবা গাছকে ঐ গোষ্ঠীর টোটেম চিহ্ন বা কুলপ্রতীক হিসেবে মনে করা হত। অর্থাৎ, টোটেম চিহ্নটির সঙ্গে নিজেকে এক মনে করা হত। এই টোটেমের থেকেই নাকি সেই গোষ্ঠী বা দলের সবার জন্ম হয়েছে, অর্থাৎ টোটেমটি তাদের পূর্ব পুরুষ। আদিবাসীদের মধ্যে প্রতিটি গোষ্ঠীর ভেতরেই টোটেম বিষয়ক ধারণাটি হল,- প্রতিটি কুল প্রতীক বা টোটেম চিহ্ন হয়তো সেই গোষ্ঠীর পূর্ব-পুরুষদের কোনো ভাবে সাহায্যে এসেছিল, বা সেই গোষ্ঠীর রক্ষার্থে কাজে এসেছিল। তাই সেই দলের কাছে তাদের টাটেম চিহ্নটি বড়ই পবিত্র তাই বর্তমানে ও পূর্বে সেই গোষ্ঠীর বংশধরেরা সেই চিহ্নটির প্রতি শ্রদ্ধাবশত নিজের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় বা তাদের পূর্ব-পুরুষ বলে চিহ্নিত করেছে। সেই সময়ে কুল প্রতীক বা টোটেম চিহ্ন দিয়ে মানব গোষ্ঠীর গোত্র পরিচিত হত। এই গোত্রনাম পরবর্তীতে জীবাঙ্গ, নক্ষত্র, প্রাকৃতিক সকল বস্তু, স্থান, বৃত্তি, মুনি-ঋষি ইত্যাদির নামেও পরিবর্তিত হল। গোত্রহীন লোক সভ্য জীবন যাপনের অধিকার লাভ করত না। পৃথিবী সহ ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের সকল প্রান্তেই কুল প্রতীক বা টোটেম চিহ্নের নাম থেকে মানুষের গোত্র বা পদবির নামকরণ হয়।
এবার আসা যাক মুখোশ নৃত্যের কথায় – মানুষ তার টোটেম চিহ্নকে তার পূর্বপুরুষ রূপে মনে করার ফলে সে সেই টোটেমের চিহ্ন দ্বারা তৈরি মুখোশ পরে তার প্রয়াত পূর্বপুরুষের সত্তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম বলে মনে করত এবং বিশেষ এক পবিত্র দিনে সেটি ধারণ করে নাচ করত এবং কোনো এক দৈবি শক্তির সঙ্গে নিজেকে একাত্মবোধ করত। নৃত্য এই উৎসবের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল। টোটেমের সভ্যরা তাদের টোটেমের চাল-চলন এবং বৈশিষ্ঠ্যকে নকল করে এই নাচের মধ্যে রূপ দেয়। যে সব নৃত্যের মধ্যে একই গোষ্ঠীর সমস্ত লোকই টোটেমের বেশ ধরে এবং তার মতো ব্যবহার করে, সেগুলি বহুপ্রকার ম্যাজিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধন করে এবং সর্ব শেষে দেখা যায় আনুষ্ঠানিক ভাবে টোটেম প্রাণীটিকে হত্যা করা হচ্ছে। এই মুখোশই পরবর্তীতে এক একটি প্রতীকে রূপান্তরিত হল এবং সামাজিক বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী মুখোশ ও মুখোশ নৃত্য পর্যায়ক্রমে পশু থেকে মানুষ, মানুষ থেকে পশু ও মানুষের যৌথ রূপ, এবং ভয়ঙ্কর ভূত, প্রেত, দানব ও দেবতার মুখোশ প্রতীক হিসেবে প্রতিফলিত করতে দেখা গেল এবং এর পাশাপাশি কল্পনা মিশ্রিত অদ্ভুত মুখোশেরও সৃষ্টি ঘটল।

[ক্রমশ]

[লেখিকা – কুচিপুড়ি নৃত্যশিল্পী। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশনৃত্য নিয়ে গবেষণারত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক সময়ের অধ্যাপিকা।]

Facebook Comments

Leave a Reply