গল্প : মিতালি জানা

ভাসমান

ট্রেন থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে আধিকারিক টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো হাবিব, পিছনে একহাতে একটা ময়লা ব্যাগ আর এক হাতে ছেলেকে ধরে জড়োসড়ো জবা। হাবিব খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো লাইনের সামনে থাকা তার সহযাত্রীদের ঠিক কী কী প্রশ্ন করা হচ্ছে। মনে মনে তপনের মুখস্থ করিয়ে দেওয়া গ্রামের নাম, পঞ্চায়েতের নাম, পোস্ট অফিস, থানার নাম আওড়াতে লাগলো। মাত্র তিন মিনিট লাগলো প্রশ্নোত্তর পর্ব মিটতে। টেবিলের ভদ্রলোক মাথা নীচু করে কাগজে লিখতে থাকলেন সব উত্তর একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকাননি। জবা মনে মনে তার ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জানালো ভাগ্যিস ভদ্রলোক হাবিবের দিকে তাকাননি নাহলে হাবিবের ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখ আর জড়িয়ে যাওয়া কথা শুনে ধরে ফেলতেন ওরা মিথ্যে বলছে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওদের তিনজনকে তুলে দেওয়া হলো একটা বাসে যেখানে আগে থেকেই কিছুজন বসে আছে, যাদের কয়েকজনকে ওরা ট্রেনে দেখেছিল। বাসের গন্তব্য বসিরহাট থানা। হাবিব বাসে উঠেই তপনকে খুঁজতে লাগলো দেখলো একদম শেষের সিটে বসেছে সে। পাশে একজনের সাথে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে তাই আর গেলো না। সামনের দিকের পাশাপাশি দুটো সিটে বসলো জবা ও হাবিব। জবা একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ফিসফিস করে বললো এবার কী হবে? থানায় কী আমাদের আটকে রাখবে? তোমাকে আমাকে কী আলাদা করে দেবে ওরা? হাবিব মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে চোখ বুজে বসেছিল। সব শুনলো কিন্তু কোনো উত্তর দিল না।

হাবিবের বন্ধ চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সাত বছরের ভেসে বেড়ানো। বাংলাদেশের সুন্দরবন লাগোয়া এক প্রত্যন্ত গ্রাম পাতাখালিতে তাদের খিদে জয় করার এক অসম লড়াই। গ্রীষ্মে ইঁটভাটার কাজ নিয়ে ছয় মাসের জন্য রংপুরে চলে যেতো। সেখানে সারাদিন কাজের পর একটা ছোট্ট ঘরে ঘেঁসাঘেসি করে ৭-৮ জনের শোয়ার ব্যবস্থা। রান্নার ব্যবস্থা খোলা আকাশের নীচে। মাসে একদিন বাড়ি ফিরতো মজুরি নিয়ে। বাড়ি বলতে সরকারি জমিতে দখলের বসবাস। যখন তখন ভেঙে দেওয়া হতো। তখন কদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে পুনরায় আগের জায়গায় ফিরে প্লাস্টিক বস্তা দিয়ে ঘর বাঁধা। মে মাস পর্যন্ত ইটভাটার কাজ চলতো তারপর সবাই ফিরে এসে লেগে পরতো ধানজমির দিনমজুরিতে। সেও যেতে হতো দূরে। মাসতিনেক তিরাতের বিভিন্ন জায়গায় কাজে লেগে পরতো হাবিব। শীত এলে অনিশ্চিত হতো কাজ। কখনোও কখনোও বরিশালের বাজারে যেতো মোট বওয়ার কাজ নিয়ে। কিন্তু সে কাজ রোজ জুটতো না। তখন সংসারের ছন্দ মিলত না, তাল কাটতো বারবার। সারাবছর এভাবে ভেসে বেড়াতো হাবিব। জবার সাথে সেভাবে আটপৌড়ে সংসার করাই হয়নি।

জবার মধ্যে যেদিন আর একটা প্রানের সঞ্চার হলো হাবিব সিদ্ধান্ত নিল ভারতে যাবে। সে শুনেছে ওখানে কাজের অনেক সুযোগ। অনেক কষ্টে জমানো ৩৬০০ টাকা দালালের হাতে দিয়ে বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকলো হাবিব। দিনমজুরি শুরু করে খালধারের বস্তিতে ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলো হাবিব-জবা। আধার কার্ড বানানোর জন্য ৪০০ টাকা খরচ করে ১০ মাস পরেও কার্ড এলো না, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম মেনে পলাশ এলো, ওদের ছেলে।

বস্তির সব ঘরেই টিকে থাকার লড়াই। এরই মধ্যে বস্তির কিছু ঘরের বেড়ার দেওয়াল ভেঙে ইঁটের হলো চালে নতুন টালি চাপলো। কারন সেই ঘরের ছেলেরা মহারাষ্ট্রে কাজ করে। তারা দু-তিন বছরে একবার করে আসে আর বস্তির আরোও কিছু মানুষকে উড়িয়ে নিয়ে যায় তাদের সাথে। পরিবারের অন্ন নিশ্চিত করতে শিকড় ছেড়ে পরিযায়ী হয়। হাবিবও একদিন উড়ে গেল একটি দলের সাথে। সঙ্গে নিয়ে গেল জবা আর পলাশকে।

মহারাষ্ট্রের একতানগরে এক প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নিলো। দিনের শেষে বস্তির ঘরে ফিরে যখন দেখতো পলাশ বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ খুলে স্লেটে মসকো আঁকছে তখন সে ধন্যবাদ দিতো তার পরমেশ্বরকে। কারখানায় অনেক বাঙালিকে পেয়ে একটু আস্বস্ত হয়েছিল হাবিব। নিজের ভাষায় দুটো মনের কথা বলার মধ্যে যে সুখ তা বুঝেছিল। কারখানাতেই আলাপ হলো তপনের সাথে। বসিরহাটের তপন। বয়সে হাবিবের থেকে কয়েক বছরের বড়ো হলেও সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো হতে সময় লাগেনি। তপন মহারাষ্ট্রে আছে দু’ বছর এর আগে সে ওড়িষায় তিন বছর, হরিয়ানায় এক বছর ও নয়ডায় বছর আড়াই কাটিয়ে এসেছে। এখানে সে একাই থাকে। বসিরহাটের বাড়ীতে মা বাবা ছাড়াও এক দিদি ও এক বোন আছে। যদিও দিদি কলকাতায় এক স্টুডেন্ট মেসে থেকে রান্নার কাজ করে। জমি জায়গা কিছু নেই শুধু বসতভিটে টুকু আছে। তপন বাবার জন্য এক টুকরো জমি কেনার স্বপ্ন দেখে, বোনের বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, এসব করে নিজে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নের কথা জানে হাবিব। স্বপ্ন বড়ো ছোঁয়াচে। হাবিবও তপনের সাথে স্বপ্ন দেখে এক টুকরো নিজস্ব মাটির, যেটা আঁকড়ে এক গভীর শিকড় ডালপালা ছড়াবে, পলাশ যে শিকড়ের প্রতি টান অনুভব করবে। হাবিব তপনকে বলে রেখেছে বসিরহাটে দুকাঠা জমির খোঁজ রাখতে। কিছু টাকা পয়সা জমাতে পারলেই সে কিনবে। তপনের বাবা যেন এ বিষয়ে খোঁজ রাখেন। জবা বাক্সের ভিতর ছোটো একটা ব্যাগে টাকা জমায়।

সারা দেশের সাথে হঠাৎ করে একদিন সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, ট্রেন বাস সব বন্ধ হয়ে যায়। বস্তি খালি হতে শুরু করে। সবাই ফিরে যাচ্ছে তার শিকড়ে। কেউ হেঁটে, কেউ সাইকেলে, কেউ পাথর বোঝাই ট্রাকে। তপন অপেক্ষা করে কিছুদিন, যদি সব স্বাভাবিক হয় এই আশাতে। কিন্তু ক্রমে সব আরো জটিল হতে থাকে। শেষে ট্রেনে ফেরার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। হাবিব অসহায় বোধ করতে থাকে, কারন ততোদিনে তাদের জমানো টাকা শেষের মুখে। কিন্তু কোথায় ফিরবে সে। শিকড় বিহীন ঠিকানা বিহীন রাষ্ট্র বিহীন অন্ন সন্ধানি এক পরিযায়ী। না না পরিযায়ীও নয়, পরিযায়ীর থাকে একটি নির্দিষ্ট ঠিকানা যেখানে সে তার ইচ্ছে মত ফেরে, কিন্তু হাবিবের তা নেই।

কল্পনায় বসিরহাটে কেনা দুকাঠা জমিতে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় হাবিব। সরকারি দপ্তরে ট্রেনে ফেরার আবেদনপত্রে তপনের ঠিকানা নিজের ঠিকানা বলে জানায়। এরপর পূর্ব নির্ধারিত দিনে উঠে বসে ডানকুনিগামী শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে। বাসের ঝাঁকুনিতে চোখ খোলে হাবিব। জবার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে নিজের ভিতরে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করে। আবার একটা টিঁকে থাকার লড়াই এর জন্য।

Facebook Comments

Leave a Reply