আমিও পরিযায়ী, ফেরার পথ খুঁজছি : কান্তিরঞ্জন দে
কলকাতা থেকে যশোর রোড ধরে খুলনা – সাতক্ষীরা হয়ে চাঁদপুর শহর মাত্র ৩২৬ কিলোমিটার। সড়কপথে গাড়ি ড্রাইভ করে গেলে ১১ ঘন্টা মতো লাগে। কত কাছে, তবু কতদূর। শিলিগুড়ি সড়কপথে এর চেয়ে বেশি লাগারই কথা।
উত্তরপ্রদেশেও একটা চাঁদপুর আছে। কলকাতা থেকে সেটার দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। আপনি গাড়ি চালিয়ে গেলে সড়কপথে সেখানে পৌঁছবেন দেড়দিনেরও বেশ পরে। অনেকদূর, অথচ যাওয়া খুব সহজ। ট্রেনে যান, প্লেনে যান, গাড়িতে যান— কোনও সমস্যা নেই ।
যত সমস্যা ওই প্রথম চাঁদপুরে যেতে। কেন না, ওটা বিদেশ। ওখানে যেতে এবং আসতে অনেক বিধিনিষেধ আছে। ভিসা – পাশপোর্ট – অনুমতিপত্র, অনেককিছু লাগে।
কেন না, ওটা বিদেশ, বিদেশ, বিদেশ। ওটা দূর্, দূর্, দূর্ ।
আমার পিতৃ-পিতামহের জন্মভূমি চাঁদপুর। পদ্মা – মেঘনা – ডাকাতিয়া এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে এক গঞ্জশহর। আজও বাংলাদেশের ইলিশমাছ রপ্তানির প্রধান মৎস্যবন্দর চাঁদপুর।
আর, মায়ের দেশ ছিল মেঘনার পাড়ে পণ্ডিতসার। জিলা – ফরিদপুর। মাদারীপুর সাব – ডিভিশন। পণ্ডিতসার গ্রাম এখন শরীয়তপুর জেলায়।
বাবা – মায়ের বাসা ছিল পদ্মা – মেঘনার এপারে – ওপারে। সেটা বলবার সময় মায়ের মুখে কেমন একটা সলাজ হাসি ফুটে উঠত। দুটি নদীর কূলই তখন দেদার ভাঙ্গত। আজও ভাঙ্গে। ভেঙ্গেই চলেছে ।
ছোটবেলায় নতুন কারোর সঙ্গে পরিচিত হবার সময় বাবা অথবা মায়ের অবধারিত প্রশ্ন থাকত — ‘ দ্যাশ ছিল কই ?’ চাঁদপুর – কুমিল্লা, ফরিদপুর – মাদারীপুরের লোক হইলে তাগো চোখেমুখে একেবারে আলো খেইল্যা যাইত।
হায় রে, দ্যাশ !!! আমি যে সময়কার কথা বলছি, তারও বছর কুড়ি আগে তাগো দ্যাশ দুই টুকরা হইয়া গ্যাছে।
আজ বাবা – মা নেই। আমিও আজ একটা দেশ (নাকি দেশের স্বপ্ন?) মনে মনে বহন করে চলেছি।
মানুষের রাষ্ট্র বদলায়। কিন্তু, দেশ বা দ্যাশ বদলায় না। রাষ্ট্র বদলায়। কিন্তু, একটা অখণ্ড জাতিসত্তা কখনোই বদলে যায় না। তাকে রাতারাতি বদলানোও যায় না।
দেশ দু টুকরো হবার কথা মনে পড়লেই শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের মতো গ্রামীণ গল্প – উপন্যাসগুলো মনে পড়ে যায়। একই বসতভিটা। একই সংসার। একই হাঁড়ি। দুঃখে – আনন্দে, বিষাদে – বিবাদে দুই ভাইয়ের দিন কাটছিল।
সংসারের কিছু কুচুটে মাতব্বর, আর আশপাশের কিছু কুচক্রী বদমায়েসের প্ররোচনায় দু-ভাইয়ের মাথা গেল গরম হয়ে।
একই উঠোনের মাঝখানে বেড়া উঠল। হাঁড়ি গেল আলাদা হয়ে। দুই ভাইয়ের সংসার দু – টুকরো হয়ে গেল। দু ভাই তাতে দু টুকরো হয়ে গেল কি?
ওই ভাইয়ের সংসারে মাংস রান্না হচ্ছে। বেড়ার এপার থেকে এই ভাইয়ের সংসারের কেউ না কেউ গজগজ করছে। হয়তো শাপ শাপান্তও।
আবার, এই ভাইয়ের সংসারে কারোর ছেলে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। ওই ভাইয়ের সংসারে নিশ্চিত, কারোর না কারোর গর্বে বুক ফুলে উঠছে।
সংসারে পরিজনদের মধ্যে বাইরে যতই হিংসাহিংসি থাক্, রাতে দুই ভাই-ই, বিছানায় শুয়ে সঙ্গোপনে চোখের জল মিশিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিশ্চিত ভাবে ঝগড়াঝাঁটি ছিল, তবু ভালো ছিল। কিন্তু এইভাবে একেবারে আলাদা হয়ে যাওয়াটা কি ভালো হল? কোনও দরকার ছিল এর?
প্রকাশ্য দিনের আলোয় পাড়া প্রতিবেশি অবশ্য জানে — এর উঠোন, ওর বিদেশ। ওর উঠোন এর প্রবাস।
এত কথা মনে এল — গত কয়েকমাস ধরে “পরিযায়ী” শব্দটা শুনতে শুনতে। ডিকশনারি বলছে— পরিযান শব্দের অর্থ, মাল অথবা যাত্রীর যাতায়াত। পরিযায়ী মানে, সাময়িক ভাবে বসবাসের জন্য অন্য দেশে যায় যে। অবিরাম যাতায়াত করে, এমন। তার মানে, পরিযায়ী শব্দটির মধ্যে যাওয়া এবং আসা দুইয়েরই ব্যঞ্জনা আছে।
আমার বাবা নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বাংলার পশ্চিম অংশে এসেছিলেন শিক্ষা ও অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে। আর ফিরতে পারেন নি। বাংলা দু -টুকরো হবার পরেও বছর দশেক তিনি বেশ কয়েকবার পারিবারিক কাজে পূববাংলায় যেতে পেরেছিলেন। ১৯৬৫ সালের পর সে সুযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশ জন্ম নেবার পর, এখন অবশ্য সে দেশে যাওয়াই যায়। কিন্তু ফিরে আসতে হয়। ঢাকা – চট্টগ্রাম -মৈমনসিংহ-বরিশাল – চাঁদপুর – ফরিদপুর এখন পশ্চিমবাঙালির কাছে শুধুই বেড়াবার জায়গা। আর বসবাসের জায়গা নয়। মা – মাসিরা বলতেন — “যাওন নাই, আসো গিয়া।”সে কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
চারের দশকের গোড়ায় গোপালচন্দ্র দে নামক জনৈক যুবক চাঁদপুরের জেলাসদর কুমিল্লা শহরের বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালা এবং বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে যথাক্রমে ম্যাট্রিক এবং আই. এ পাশ করে উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতায় আসে। চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ ঘাট স্টিমারে। গোয়ালন্দে ইলিশমাছ – ভাত খেয়ে ইস্টবেঙ্গল মেইল ধরে সোজা শিয়ালদহ – কলকাতায়।
কলকাতা শহরটি এই বিংশতিবর্ষীয় যুবকটিকে অচিরেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। দিনের পর দিন সে হার্ডিঞ্জ হোস্টেল অথবা বিদ্যাসাগর কলেজ হোস্টেলে থেকে যায়। কলকাতা তাকে গ্র্যাজুয়েশন, মাস্টার্স, আইনের ডিগ্রি দিতে থাকে ঠিকই, কিন্তু চাঁদপুরের শেকড় তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে।
পাটের দালালি করা সচ্ছল উচ্চ মধ্যবিত্ত বংশে টাকাসহ সব ছিল। শিক্ষার আলো ছিল না। গ্র্যাজুয়েশনের পর দেশে গেলে তাকে আশেপাশের তিন গাঁয়ের লোক দেখতে এসেছিল।
দেশভাগের দামামা বাজবার বছর দুয়েক আগে নদীর ওপারে ফরিদপুর নিবাসী কায়স্থকুলীন হিসাবরক্ষক জনৈক চিন্তাহরণ বসু -র অষ্টম শ্রেণী পাশ, রূপসী জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী নীহারকণা বসুকে সে বিবাহ করে। ১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি সে স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিয়ে অর্থ রোজগারের জন্য কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। ছুটিছাটায়, পূজা পার্বণে দেশে যাওয়ায় এই পরিযায়ী মানুষটির কোনও ছেদ ছিল না।
কলকাতার কলুটোলা – জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে তাকে বাসা ভাড়া খুঁজে দেয় তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসমাইল। ইসমাইল চাচার ছেলে মুনাব্বর ছিল আমার শিশুবেলার খেলার সঙ্গী। রহিমচাচার মেয়ে রেহেনা (লিলি) আর আমি একসঙ্গে পুতুল খেলেছি। আমার অসুস্থ বড়বোনের জন্য আকবর চাচা নিয়মিত ছাগলের দুধ নিয়ে আসতেন, আমার মনে আছে। এ সব অবশ্য দেশভাগেরও ১০-১২ বছর পরের কথা।
এখানে বলার কথা এই যে, বাবা কলকাতায় এসেছিলেন শুধু পয়সা রোজগার করতে। স্থায়ীভাবে থাকতে নয়। কিন্তু, তার আর দেশে ফেরা হয় নি।
বাবা মারা গেছেন। কিন্তু তার পরিযায়ী পরিচিতিটা জন্মসূত্রে আমায় দিয়ে গেছেন।
ইসমাইল চাচা, রহিমচাচা, আকবর চাচা এ দেশের লোক। এদেশেই রয়ে গিয়েছিলেন। যদিও তাদের কোনও কোনও রিস্তাদার সম্পত্তি বিনিময় করে ঢাকায় চলে যান। চাচারাও আজ আর নেই। কিন্তু তাদের ভাই- ভাতিজা বংশধরেরা অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছেন।
আমি পরিযায়ী বাবা – মায়ের সন্তান। বাবা এসেছিলেন অস্থায়ী ভাবে। মা -ও তাই। দুজনের কেউই আর জন্মভূমির মাটি ফিরে পান নি।
আমারও শিকড় সন্ধানের কাজ এখনও অনেক বাকি। আমি আমার মাটিতে ফিরতে চাই। পারব কি ?
[লেখক – চিত্রনাট্যকার এবং প্রাবন্ধিক।]
Posted in: June 2020 - Cover Story, PROSE