এক ভারতীয়ের ছেঁড়া খাতা থেকে : ফাল্গুনী ঘোষ
২২শে মার্চ, ২০২০
আমার বাড়ি থেকে আমি অনেক দূরে থাকি। মাঝেমধ্যে খাতায় লিখে রাখা স্বভাব, চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে। সেইজন্য বন্ধুগুলা খুব ঠাট্টা করে। তাও খানিক আদেক লেখাপড়া জানি বলে লিখতে পড়তে পারি। তবে এখান থেকে যখন গাঁয়ে ফিরে যাই তখন বন্ধুগুলো শহরের বাবু বলে ঠাট্টা করে। বলে নাকি আমি ইস্টাইল মেরে কথা বলি। বন্ধুগুলোর চেয়ে ভালো রোজগার করি, তাই হয়ত ঠাট্টা করে একটু আধটু।
আজ এমনিতে রবিবার। রবিবারে সকাল থেকে খুব একটা কাজ থাকে না। আরও বন্ধুরা মিলেজুলে বেশ আড্ডা মারি। দলবেঁধে মোড়ের দোকানে পুরী ঘুগনি খেতে যাই। বেশ ভালো খেতে। তবে আজ দোকানটা বন্ধ। শুধু ঐ দোকান নয়, সব দোকানই বন্ধ। সারা ভারত বনধ ডেকেছে মোদী নিজেই। প্রধানমন্ত্রী যখন বনধ ডেকেছে কারণও আছে হবে। ঘরে থাকাই ভালো।
আগে থেকেই বন্ধুরা সব ঠিক করেছিলাম রবিবার বনধ যখন তখন সবাই মিলে ফিস্টি করব। আমি মুম্বাইয়ে গুরুকুল কলেজের পিয়ন বলে রবিবার আমার ছুটি থাকলেও , যেসব বন্ধুগুলোর পোলট্রির ব্যবসাপাতি, যারা রাজমিস্ত্রির কাজ করে সবার তো ছুটি থাকে নাকো। আমার প্রাইভেট কলেজ হলেও সরকারি নিয়মে ছুটি থাকে। আজ বনধের জন্য সবার ছুটি, তাই আজ ফিস্টি হবে।
পাশের গলির পোলট্রির ব্যবসা করা ছেলেগুলো দুটো পোলট্রি ছাড়িয়ে দিয়ে গেলো। সব ছেলেকটা মিলে ভাত, মাংস রান্না করলাম। আজকের খাওয়া দাওয়া জমে গেছিলো। মুম্বাই এফ এম এ খানিক গান শুনলাম। আবার বলছে গোটা দেশে এই বনধ খুব মানছে সব। কি নাকি একটা রোগ এসেছে। ছোঁয়াছুঁয়ি হলে বেড়ে যাবে তাই এই বনধ।
বিকেলবেলায় চারদিকে খুব শাঁখের আওয়াজ, বাজনাও বাজাচ্ছে লোকে। মোদী নাকি বলেছে। আমরা তো মালিকের কারখানা নাহয় কলেজের একটা ঘরে থাকি। এখানে আমাদের শাঁখ, ঢাক, ঢোল কিছুই নাই। তাই খানিক চেঁচিয়ে হুল্লোড় করে নিলাম।
২৫শে মার্চ,২০২০
সেই যে ২২ তারিখ বনধ হলো, সেদিন রাতে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দিলো টিভিতে । সাত-আটটা ছেলে মিলে এই ঘরে থাকি, এখানে তো টিভি নাই। মোবাইলে যা একটু এফ এম শুনি। তাও সবার বড় স্ক্রিন মোবাইল নাই, আমার কাছে শুনতে আসে। রোজগার করলেও দামী মোবাইল কেউ কেনে না। সব ভাবে টাকা জমিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাবে। সেই লেগেই খাটতে আসা । সেই লেগে টিভি কেনার কথা কেউ ভাবেই না।
তা সেইদিনই এফ এম এ শুনলাম, রাত বারোটা থেকে সব ট্রেন বন্ধ। কতদিন বন্ধ থাকবে তা বলেনি। দুদিন ধরে মোড়ে মোড়ে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখছি। আমরা ভাবছি রোগ হলে ডাক্তার, ওষুধ লাগবে। তা পুলিশ কি করবে! সব বন্ধ করে দিলো যে! সবাই ভাবতে লেগেছে খুব ট্রেন কতদিন বন্ধ থাকবে! চায়ের গুমটিতে শুধু ঐ কথা। এইসব ভাবতে ভাবতেই কাল বলে দিলে , গোটা দেশে লকডাউন থাকবে। সবাই ভাবছি লকডাউন কি রে বাবা? সব বন্ধ থাকলে খাবো কি? পরে পরে জানতে পারলাম ওষুধ, খাবার দাবার, ডাক্তার নার্স, পুলিশ ছাড়া সব বন্ধ থাকবে এখন।
আজ আমার জানলা দিয়ে পাশের গলিটা দেখছিলাম। যত বাইক যায় তার অনেক কম যাচ্ছে। একটা বাইককে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাজারের দিকে কি হচ্ছে ভাই? বাজার খুলেছে? লোকজন আছে?’ তা লোকটা বললে, “বাজার মাত যাও, পুলিশ পিটেগা!” বাজার না বসলে আমাদের রান্না খাওয়ার কি হবে? ডিম, আলু, চাল , ডাল যা আছে কাল হবে। তারপর কি খাবো?
মেলা চিন্তা জড়ো হতে লাগলো। কতদূরে বাড়ি আমার। মা কেমন আছে কে জানে! ফোনে তো ভালো আছি বলে সবসময়। এই যে ট্রেন বন্ধ হয়ে গেলো, এদিকে সামনে বোশেখে আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে। আমি বাড়ির বড় ছেলে। এপ্রিলের চোদ্দ তারিখের পর ট্রেন খুলবে তো? আমি টাকাপয়সা নিয়ে বাড়ি না ফিরতে পারলে মেয়েপক্ষ যদি মা’কে ভালো মন্দ কিছু বলে। চোদ্দ এপ্রিলের পর রোগটা কমে যাবে নাকি? বাড়ি ফিরতে পারব তো?
১৩ই এপ্রিল, ২০২০
প্রায় পনের দিন ধরে এরকম চলছে। আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। কোনোদিন আলু, নুন, ভাত তো কোনোদিন ডাল, ভাত। তাও ভগবান আছে মনে করি। এই গলির মুখেই চাল, ডাল, আলু, নুন, তেল পাওয়া যায় সেও কপাল! কতজনা সেটকুও খেতে পেছে নাকো। অরা সব কি করছে কে জানে! হেঁটে যে একটু দূরে যাবো, তা সকালে উঠে ঝাঁট মোছা করতে করতেই আর যাওয়া হয় নাকো। তাছাড়া পুলিশের লাঠির ভয় আছে।
আশপাশ থেকে খবর পেলাম ভিড় করে চাল কিনতে গিয়ে পিটানি খেয়েছে সব। আমার কলেজের মালিকটা ভালো। তাড়িয়ে দেয় নি। কলেজ সারাই করার জন্য বালি, সিমেন্ট, রঙ থাকে গুদামে। তার পাশের ঘরটাতে একটাই জানলা আর দরজা। ঐখানেই সাত –আট জন থাকি আমরা। সবাই কলেজ সারাই এর কাজ করে, আর আমি পিয়ন। কেউ জলের পাইপ লাইনে, কেউ রঙের কাজে, কেউ গ্রিল সারাই-এর কাজ করে।
বেশিদূর কেউ পড়েনি। সেভেন এইট হতে হতেই চলে এসেছে। আমার বাড়ির বড় ছেলে আমি। বাবার ভালো রোজগার নাই। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে আমার ব্যাক চলে এলো। আবার কবে পরীক্ষা হবে, সেই এক বছরের অপেক্ষা, পাশ করব কি না, তাই বন্ধুদের সঙ্গে মুম্বাই চলে এলাম খাটতে। প্রথমে রাজমিস্ত্রির কাজই করতাম এই কলেজে। কোথাও ভেঙেচুরে গেলে সারাই করা ছিলো কাজ। আমার মাধ্যমিক সার্টিফিকেট আছে, লেখাপড়া জানি দেখে কলেজের মালিক পিয়নের কাজে নিলে।
এখন তো অনেক মালিক তাদের আন্ডারে কাজের লোকগুলোকে ঘর ছেড়ে দিতে বলেছে। আমার মালিক ভালো আর নিয়মও আছে তাই যে টাকা পাই তা বন্ধ হয়নি। ১৫% কেটে নিয়ে হাতে টাকা দেয়, থাকার খরচ হিসেবে। খাওয়া দাওয়া নিজের খরচ। তবে এইরকম এতদিন বন্ধ থাকলে মাইনে দেয় কি না কে জানে!
এদিকে এফ এম খবরে শুনলাম মেলা লোক রাস্তায় হাঁটতে লেগেছে। খাবার নাই, থাকার জায়গা নাই, কি করবে! সব ভাবছে রোগ যদি হয়ই, মরতেই যদি হয় বাড়ির লোকের কাছে গিয়ে মরাই ভালো। এদিকে আবার করোনাও বাড়ছে। আমার বাড়িতেও মা খুব ভাবছে । তিনবছরে মাটির বাড়ি ভেঙে পাকা বাড়ি করেছি। এখনও দরজা জানলা সব হয়নি। রঙ করা বাকি। মা এখন বলছে, আর টাকা রোজগার করতে হবে না। বাড়িতে শাকভাত যা পাবি তাই খাবি। আর বাড়ি করতে হবে না।
মায়ের কান্না শুনে ভাবছি মুম্বাইয়ে না খেয়ে মরার চেয়ে যেমন করেই হোক বাড়ি চলে যাওয়া ভালো। বন্ধুরা বলছিলো, ‘চল যা হয় হোক, বেড়িয়ে পড়ি, হাঁটতে লাগি। খানিক করে থামব আর যাব। রেল লাইন ধরে হাঁটতে লাগি। অনেকে ভাবছে, কালকের পর যদি ট্রেন খুলে দেয়! দেখি কাল কী বলছে মোদী।
২রা মে, ২০২০
আর মুম্বাইয়ে থাকা যাবে নাকো। আগেকার টাকা পয়সা সব ফুরিয়ে গেছে। ১৫% টাকা কেটে বাকি টাকা দিয়ে আজ মালিক বলে গেছে পরের মাস থেকে আর মাইনে দিতে পারবে না। কলেজের আয় নেই। নতুন ছেলে কবে ভর্তি হবে ঠিক নেই। যেমন করেই হোক এই মাসের মধ্যে বাড়ি ফিরতেই হবে। যা শুনছি করোনা তো বেড়েই যাচ্ছে। এরকম চললে কমাস পরে সব ঠিক হবে কেউ জানে না। এখানে থাকলে না খেতে পেয়েই মরে যাব সব।
আজ খবরে শুনলাম আমাদের জন্য নাকি স্পেশ্যাল ট্রেন দেবে! এতদিন কেন দিলো না তাই ভাবছি! কাল খবর পেয়েছি পাশের মহল্লার এক বয়স্ক কাকা হেঁটে হেঁটে বাড়ি যেতে গিয়ে রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। বিহারে বাড়ি কাকার। আমি দেখেছি মানুষটাকে। ছট পরবের পর মেলা ঠেকুয়া এনে খাইয়েছিল। আমরা যে বন্ধুগুলো একসঙ্গে থাকি তাদের মধ্যে দুজন বিহারের। কাকা ওদের এলাকার লোক।
এসব শুনেটুনে এত ঘাবড়ে গেছি যে ভয়ে আর কেউ হেঁটে যাওয়ার নাম করেনি। কোনোরকমে যদি দুটো সাইকেল জোগাড় হয়, তাও বেড়িয়ে পড়ব ভাবছিলাম। এইসব করতে করতেই কালকে খবরটা পেলাম যে, ট্রেন দেবে। আজ বিকেলে মাইকে বলে বেড়াচ্ছিল, “যো লোগ বাহারসে হ্যায়, ঘর লওটকে জানা চাহতে , উনলোগ আধার কার্ড লেকে লোক্যাল থানে মে সম্পর্ক করে।“ তাহলে নাকি টিকিট করে দেবে।
সবাই মিলে একটা বুদ্ধি করলাম, একসাথে থানায় যাব না। ভিড় করে গেলে যদি তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আবার এটাও ভাবছি , যাদের আধার কার্ড নিয়ে যাবো, তারা না গেলে তাদের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে কি! আধার কার্ড যার তাকে নিশ্চয় দেখতে চাইবে পুলিশে। দেখা যাক কি হয়! যেমন করে হোক টিকিট জোগাড় করতেই হবে। দরকার হলে পুলিশের হাতে পায়ে ধরব। বলব, আমরা কোথাও ঘুরি না। কোনো রোগ নাই আমাদের। শুধু আলু, নুন ভাত নাহয় ডাল, ভাত খেয়ে ঘরেই থেকেছি।
২৬শে মে, ২০২০
কালকে ট্রেনে চাপব শুনে বাড়ির লোক সব হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। যা শুনছি, যদিও ট্রেন থেকে নেমে সোজা বাড়ি যেতে পাবো না। ১৪ দিন বাইরে কোথাও রেখে দেবে তাই বলছিলো। তাও ভালো। বাড়ির আশেপাশে কোথাও থাকতে তো পাবো। কত কান্ড করে টিকিট হলো। থানায় আধার কার্ড নিয়ে গেলাম । সেখানে নাম , ফোননম্বর সব জমা নিলে। নিয়ে বললে, সব জমা থাকল। তোমাদের নম্বর এলেই ফোন করে ডাকা হবে। সেই থেকে বসে আছি তো আছিই। ডাক আর আসে না।
তখন আবার চিন্তা হতে লাগলো বাড়ি যাওয়া হবে তো! এদিকে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটা শুরু হলো। সরকার সিস্টেম চালু করলে। আমরা তখন বুঝতে পারছি না, নিজেরা টকিট কাটব নাকি! এদিকে থানায় সব জমা দিয়া আছে। বলেছে সরকার থেকে টিকিট করে দেবে। কিন্তু কবে টিকিট করে দেবে, কত দেরী তার ঠিক নেই। তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম হাতে যা টাকা আছে, অনলাইনেই টিকিট কেটে নিই। তারপর যেটা আগে আসবে তাতেই বাড়ি যাব। আমাদের বাড়ি ফেরা নিয়ে কথা।
আজ সকালে থানা থেকে ফোন করেছিলো। বলছে, এস, আর কদিন পর তোমাদের টিকিট হবে! এখন আর সরকারের থেকে ফ্রি টিকিট নেওয়ার মন নাই, নিজে টিকিট কেটেছি, বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি। কাল ভোররাতে বেড়িয়ে পড়তে হবে। স্টেশনে পরীক্ষা হবে, করোনা রোগ আছে নাকি! তারপর সার্টিফিকেট দিলেই বাঁচলাম। ভয়ে এখন বুক দুরদুর করছে। শেষ মুহুর্তে আবার যাওয়া আটকে না পড়ে।
লাইনে প্রথমের দিকে দাঁড়াবো গিয়ে। তবে তাড়াতাড়ি জানতে পারব, আমার বাড়ি যাওয়া হবে কি না!
৩১শে মে , ২০২০
গতকালকে গাঁয়ে এসে পড়েছি। গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলে বারোজনকে রেখেছে। সবাই চেনা এখানে। এই গাঁ আর আশপাশের গাঁয়ের। ট্রেনে চাপার দিন ভোর রাতে উঠে স্টেশনে গিয়ে দেখি কী ভিড়! সেটাই হওয়ার কথা। সবাই তো বাড়ি ফিরতে চাইবে। ভেবেছিলাম কত পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে, নতুন রোগটার জন্য। তা কিছুই নাই, শুধু হাতে খানিক ডেটল জল দিয়ে কপালের সামনে বন্দুকের মতো ধরল! আমি ভাবছিলাম কত না জানি পরীক্ষা করবে!
লাইনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, অনেকের জ্বর ছিলো, চোখ লাল, কাশছে । কই কাউকে কিছু ওষুধ দিলো না তো। বলল, মুখে কাপড় দিয়ে থাকো, কাশছ! তারপর তো গাদাগাদি করে ট্রেনে চাপলাম। পকেটে খানিক পয়সা আছে, কিন্তু খাবার কোথায় পাবো জানিনা! ট্রেন চলতে লাগলো। সন্ধ্যেবেলা সবাইকে প্যাকেট দিলে খাবারের। পুলিশ ছিলো মেলা। জলও দিলে। ট্রেনে ওঠার আগে রাত্রে প্যাকেট খুলে দেখলাম শুকনো লুচি আর ছোলা। ঐ খানিক খেলাম, পেট তো জ্বলছে।
এত খিদে পেয়েছিলো যে ঘুম এসে গ্যালো। সকালে উঠে দেখলাম বাথরুমে জল নাই, দরজা খোলা যায় না এত গন্ধ! যে পেরেছে , পায়খানা করে রেখেছে! মুখ ধোওয়ার জল নাই, খাওয়ার তো কিছুই নাই! সকাল আটটার দিকে একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। ট্রেনের ঠিক দরজার মুখেই জলের বোতল, ছোলার প্যাকেট, বিস্কুট রাখা। সবার খিদে পেয়েছে বলে কাড়াকাড়ি, মারামারি লেগে গ্যালো।
আমি বিস্কুট, ছোলা ওসব পাওয়া যাবে না বুঝেই জলটা আগে নিলাম। খিদে পেটে তাও দুদিন থাকা যাবে, কিন্তু জল না পেলে বাঁচব না যে! আর তো একটু। বাড়ি পৌঁছাতেই হবে যেমন করে হোক, তার আগে মরলে খুব আপশোস হবে। এরপর থেকে শুধু একটা করে জলের বোতল নিতাম।
এই করে দুদিন পর হাওড়া এলো। হাওড়া ঢুকতে না ঢুকতেই দেখছি চার পাঁচজন এক একজায়গায় জড়ো হয়ে গুজগুজ ফুসুফুস চলছে। ট্রেন হাওড়াতে সন্ধ্যের পর ঢুকেছিলো । তার খানিক পর আবার হঠাৎ ট্রেন থেমে গেলে অবাক হলাম। কোনো স্টেশন নাই, মাঠের মাঝে ট্রেন দাঁড়িয়ে, কিছু লোক হুড়মুড় করে নেমে পালাচ্ছে। দু একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। বলছে,
“না পালালে পুলিশ আবার কোথায় নিয়ে গিয়ে ভরে দেয় তার ঠিক নাই! টিকিট কেটে ট্রেনে ফিরছি তাও খাবারের জন্য মারামারি। গলা শুকিয়ে কাঠ। বাথরুম যাওয়া যায় না। আমরা কি কুত্তা নাকি! মরি মরব! বাড়ি গিয়ে সব একসাথে মরব!”
১৩ই জুন, ২০২০
আজ ছাড়া পেলাম। চোদ্দ দিন আগে বাস থেকে নামার সাথে সাথেই বাড়ির লোক বিছানা, জল, খাবার নিয়ে এসেছিল। কটা সিভিক পুলিশ ছিলো, ওদের হাতে সব দিয়ে মা বলে গেছিলো প্রতিদিন বাড়ি থেকে খাবার পাঠাবে। চারদিন ধরে না খেতে পেয়ে তখন কথা বলার ক্ষমতা নাই আমার।
পরের দিন ভাবলাম, আমার বাড়ি থেকে ভাত, ডাল, তরকারি প্রতিদিন এলে অন্যদের খারাপ লাগবে। যাদের দূরে বাড়ি তারা কষ্ট পাবে। তাই ঠিক করলাম যার পকেটে যা পয়সা আছে নিজেরা রেঁধে বেড়ে খাব। সিভিক পুলিশ আর পঞ্চায়েতের লোক চাল, ডাল, আলু, সবজি দিয়ে যেত। আমরা পয়সা দিয়ে দিতাম। নিজেরা রেঁধে বেড়ে খেয়ে ভালোই ছিলাম। প্রথমদিন পঞ্চায়েত থেকে নার্স দিদিরা দেখতে এসেছিলো কারো জ্বর আছে কিনা! আর বলে গেছিলো পরে কারো জ্বর এলো কিনা বলতে! তা তারপরে কারো জ্বর আসেনি।
যার সাথে আমার বিয়ে হবে সে ফোন করেছিলো আজ। আমাকে বলছে, “এইবার দেশ ঘরেই কাজ খুঁজে লাও, আর বিদেশ যেয়ো না!” নাইন পর্যন্ত পড়া মেয়ে মুম্বাইকে বিদেশ বলছে! হাসলাম খুব। খানিক রঙ্গ, তামাশা করলাম। বললাম, এখানটাও ভারত , মুম্বাইও ভারত।
তবে, নিজের গাঁ ঘরের আরাম আর কোথাও নাই, তা বুঝেছিলাম। এখানেই যদি কাজ পাই ভালো, আর কোথাও যাব না।
Posted in: June 2020 - Cover Story, PROSE
পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, থাক মনের ভিতরে এই অনুভূতি টা সযত্নে রেখে দি। এই লেখার সাথে নিজেকেও ভীষণ ভাবে কানেক্ট করতে পেরেছি, আরে আমরাও তো এক প্রকার পরিযায়ী। হয়ত সেই অর্থে এখনও ঐ প্রকার পরিস্থিতির মধ্যে পড়িনি তবে ভবিষ্যতে যে পড়বো না তারও কোন গ্যারান্টি নেই। আর পড়লে অবস্থা হবে ওর চেয়েও করুন । বড্ড ভালো লিখলি