গল্প : দূর্বাদল মজুমদার
হন্তারকের ফুলবাগান
ঘটনা ১
লোকটার হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পা’দুটোও। তাঁকে এত মারা হয়েছে যে থ্যাতলানো রক্তলেপা মাথাটা ঝুলে আছে,সশস্ত্র লোকগুলো তাকে একটা জোয়ালের সাথে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এলো। রাস্তায়, পথের দু’পাশে লোক তাকে দেখতে এসেছে।কে সেই লোক, এত সাহস তার যে চার্চকে অপমান করছে, সে নিশ্চয় বিরাট বলশালী কোন পুরুষ!
মাটিতে ঘষা খেয়ে লোকটার পায়ের আঙুলগুলো চেটো পর্যন্ত ক্ষয়ে গিয়ে সারাপথে রক্তের লাল দাগ ছড়িয়ে এসেছে।এখানেও অনেক লোক জুটেছে মজা দেখবে বলে। সবার মধ্যে উত্তেজনা, কী হয়! কী হয়!
গোল হয়ে যাজকেরা দাঁড়িয়ে আছে। একজন লোকটার গলায় হাত রেখে দেখল, তখনো নাড়ি চলছে। মানে লোকটা বেঁচে যেতে পারে।লোকটার মাথা তুলে ধরে তারা শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করল, তুমি চার্চকে অসম্মান করেছো। এখনো বলো, বাইবেলের কথা ঠিক না তোমার বিজ্ঞানের?
লোকটা গলায় জমাটবাঁধা ঘড়ঘড়ে রক্তের ভিতর দিয়ে যা বলল, তাতে সে তার সিদ্ধান্তে এখনো অটল।
তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে, আগুন জ্বালালো।তারপর তাকে সেই আগুনের ভেতর ছুঁড়ে ফেলল।
লোকটার নাম গিয়াভানো ব্রুনো।
ঘটনা ২
কাশ্মীরের এক দুর্গম গিরিবর্ত্মে অবস্থিত “ছোটি সি কসবা”। গোপন আস্তানায় চোখমুখ থ্যা্তলানো হাত-পায়ে কালসিটে দাগ নিয়ে রক্তাক্ত একটা লোককে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকটাকে মারের সঙ্গে যা-ই জিজ্ঞেস করা হয় মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সে শুধু বলে, ” আল্লাহু আকবর! কাশ্মীর কা আজাদী, ভারত কা বরবাদী “!
এখানে পুলিশ ও সেনাবাহিনী অনেক এরকম ছোট ছোট গোপন আস্তানা বানিয়ে রেখেছে। এখানে আজ এক “আজাদ কাশ্মীর” সাপোর্টার, প্রায় দুই শতাধিক খুন করা এক মিলিট্যান্টকে ধরে আনা হয়েছে।
শেষবার ইন্টারোগেশন করা হয়ে গেছে। উর্দি পরা লোকগুলো তার কাছ থেকে প্রচুর বিস্ফোরক,ও একটি সিগএলএমজি ছাড়া অন্য তথ্য পায়নি।সাইলেন্সার
লাগানো পিস্তলের গুলিতে চেয়ার সমেত পড়ে গেল লোকটা।
ওর নাম আবু হানজুল্লা।
ঘটনা ৩
এই ছেলেটি যুবক, ২৪ বছর বয়স। তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল উন্মত্ত জনতা। ছেলেটার মাথা থেকে গড়িয়ে নামছে রক্তের ধারা , তার চোখ ঘুষির চোটে ফুলে কালসিটে হয়ে আছে। গাল কেটে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে মুখমণ্ডল। ঠোঁটের কষ বেয়ে নামছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।চোখে রক্ত আর অশ্রু মেখে,হাটুমুড়ে বসে হাত জোড় করে কান্নাভেজা-গলায় সে, প্রানভিক্ষা চাইছে, “তোমরা আমাকে মেরো না, তোমরা যা ভাবছ আমি তা করি নি, আমি গরুর মাংস লুকিয়ে রাখিনি। ”
মারমুখি-জনতা সমবেত গলায় ভয়জাগানো আওয়াজ তুলল, “জয় শ্রী রাম!”
যুবক ততই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। একজন ষন্ডা মতো লোক তার চুলের মুঠি ধরে তার ভয়কাতর বিভৎস মুখটা তুলে ধরল জনতার দিকে, বলল,”বল্ জয় শ্রী রাম! ”
ছেলেটা বলল, “জয় শ্রী রাম “।
লোকটা বলল,বল্ ” আর কখনো গরুমাংস খাবো না “!
ছেলেটা তাই বলল কাতর আর্তনাদ করে। তারই মধ্যে একজন জনতার ভেতর থেকে ছেলেটার ঘাড়ে লাথি কষাল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে।
এইসময় একটা জিপ থেকে লাফিয়ে নামল পুলিশ। উন্মাদ জনতা জয় শ্রী রাম ধ্বনি দিতে লাগল।
কয়েকদিন পর ছেলেটা মারা গেল এই গনপিটুনি সহ্য করতে না পেরে।
ছেলেটার নাম আফরোজ আনসারি।
ঘটনা ৪
সিনেমাহলের বারান্দা থেকেই ওরা দেখল প্রায় শুনশান হয়ে গেছে রাস্তা।মলের বাইরে এসে বুঝতে পারল অনেকেই পার্কিং জোন থেকে বাইক বা গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।নাইট শো, তাই দেরি হয়ে গেছে। ছেলেটা আফশোস করতে লাগল, কেন সে আজ বাইক নিয়ে বের হল না। নির্ভয়া তার নিজের দিকেই দোষটা টেনে নিল, আমিই তো তাড়াহুড়ো করলাম, তোমার দোষ নেই।
ওরা বড়ো রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল যদি কোন বাস বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যায়। তার পরের গল্পটা সবার জানা।
ওরা পাঁচজন ছিল। ছেলেটাকে বাসের সিটের রডের সঙ্গে বেঁধে ওরা পরের পর তাকে মেরে যাচ্ছিল। মেয়েটা চিৎকার করছিল বলে ওরা ওর মুখে ওরই রক্তমাখা ওড়নাটা গুঁজে দিল। তারপর পরের পর ওকে ধর্ষণ করতে লাগল। ছেলেটার হাত মুচড়ে সিটের লোহার রডের সঙ্গে পেঁচিয়ে ভেঙে দিল একজন। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠা গোঙানি ছাড়া তার মুখ দিয়ে চিৎকার করার সামর্থ্য নেই। মেয়েটা ক্রমাগত বিভৎসতায় নিস্তেজ হয়ে গেল। তার পা দিয়ে গড়াতে লাগল রক্ত।
একসময় তারা বিদ্ধস্ত শরীর দুটোকে ছুঁড়ে ফেলল বাসের জানালা দিয়ে রাস্তায়। না, কেউ কোথাও নেই। নিওনজ্বলা মেট্রোপলিশ-রাত তাদের অচৈতন্য মুখের উপর ঝুঁকে থাকল। ####
ঘটনা ৫
বস্তার জেলার পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে এক আদিবাসী গোন্দদের গ্রাম।বন থেকে কাঠ পাতা মূল সংগ্রহ করে গাঁয়ের সবাই ফিরে এসেছে। মাটির ঝুপড়ির দাওয়ায়, পাতা-ছাওয়া ঘরের ভেতর অনেকে বিশ্রাম নিচ্ছে। যুবক-যুবতীগন একদিকের গ্রামপ্রান্তে শিরিশ গাছের ছায়ায় হাঁড়িয়ার বাটি নিয়ে বসেছে। অপর দিকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগন। তাদের মধ্যে অল্প রসের কথার খুনসুটি চলছে মৃদুস্বরে। দূরে পাহাড়ের ওপার থেকে হাওয়ায় ভাসছে মাদলের শব্দ। সূর্য এখন মাথার উপর।
আগামীকাল মিটিং আছে বন-পার্টির। পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে হাজার হাজার লোক আসবে কুন্দাপেটার ফাঁকা বনঘেরা মাঠটায়। মাদলে- লাগড়ায় শিঙায় গুমগুম করবে বিরবুরু! লাল লাল পতাকায় ছেয়ে যাবে বনের সবুজ।সবুজরঙের জামা-প্যান্ট পরা ছেলে-মেয়েরাা ভাষন দেবে গা-গরম করা।
হঠাৎই পশ্চিমের মুরাম রাস্তা ধরে একটা পুলিশের জিপগাড়ি এল ধুলো উড়িয়ে। তার পেছন মিলিটারির গাড়ি।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠাট্ ঠাট্ ঠাট্ ঠাট্ করে শব্দ হল আর শিরিশ গাছে হেলান দেওয়া দিগর মারিয়ার মুন্ডুটা থেঁতলে গেল গাছের গুঁড়িতে লাল রক্তের ছিটে ছড়িয়ে। একটা কড়কম্ তৈরি হল মানুষগুলোর মধ্যে। চিৎকার করতে করতে তারা যে যেদিকে পারল ছুট মারল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধুপধাপ পড়ে গেল শুখা-টাঁড় জমির শক্ত মাটির উপর। বসতির ভেতর থেকে আর্তনাদ আর চিৎকার।
তারই মধ্যে একটা ঝুপড়িকে ঘিরে ধরল পুলিশ, বাঁশের তৈরি দরমার দরজায় লাগানো শিকল তুলে দিল বাইরে থেকে। তারপর ডিজেল আর পেট্রোল ছড়াতে লাগল সারা ঝুপড়িটায়।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আগুন লাগিয়ে দিল তাতে। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল ঘর। তারমধ্যেে হিলা মারিয়া জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠল,”ইনকেলাব জিন্দাবাদ” “বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক” “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”! আর তার বৌ বাচ্চার মরিয়া চিৎকার আর্তনাদে পরিনত হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত চিৎকার আর শ্লোগান সমেত পুড়ে খাক হয়ে গেল হিলা মারিয়ার গোটা পরিবার। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল রক্তাক্ত কিছু লাশ।
ঘটনা ৬
আটচালায় আজ বিচার বসবে। রুলিং পার্টির চারটে ছোকরা মাথায় ফেট্টি বেঁধে সাইলেন্সার খোলা মোটরসাইকেলে প্রচন্ড আওয়াজ করতে করতে বাড়ির দরজায় এসে বলে গেল, “সুবল কই রে! ওকে আজ আটচালায় সন্ধ্যাবেলায় থাকতে বলবি! “দাদা” বলেছে! শালার মাংস খাব আজ। “যেন বজ্রাঘাত হল সুবলের পরিবারে।
চলেযাওয়া মোটরসাইকেল থেকে একজন বলল, “সুবলের বৌ টা কিন্তু মাল একটা। কুচুকুচু!”
সুবলের পরিবারে হঠাৎই অ্যানিমিয়া হয়ে সবাই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সুবলের বউ মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেঝেতে । মা তোমার কী হল গো! বলে তার দুটো ছেলেমেয়ে মায়ের উপর কেঁদে পড়ল। গ্রামের আটচালা জমজমাট। কৌতুহলী মানুষের ভিড়। কিন্তু সবার মুখ থমথমে, ভীতিজড়ানো। দাদা একটা চেয়ারে বসে আছে। সুবল হা্টুমুড়ে বসে আছে মেঝেয়, প্রার্থণার ভঙ্গিতে। দাদা বলল স্নেহমাখানো গলায়, “কী রে সুবল! তোকে কিষান-কার্ড করে দিইনি? তোর জমির জল আটকে দিচ্ছিল লোকে, তখন ফয়সালা করে জল ছেড়ে দেওয়া করাই নি! তোর কাকাদের সাথে পাঁচিল নিয়ে সমস্যা ছিল। সেটা মিটিয়ে দিই নি? এতসব কাজ আমার পার্টির কাছ থেকে পেয়েও তুই অন্যপার্টিতে নাড়া বাঁধলি! তোরা কি রে! একেই বলে সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়! এবার ত জনগন ক্ষেপে গেছে তোদের বিরুদ্ধে! কী করবি এবার? তোদের মতো শ্রমিক-কৃষকের রক্তেই তো রাঙানো রে এ পার্টির পতাকা।
যাহোক! যা ভালো বুঝবি কর্। কইরে রামধন্,!আমাকে একটু পার্টি-অফিসে ছেড়ে দি এসবি চ। বলে দাদা উঠলেন।
তিনি চলে যেতেই একটা চ্যালা-কাঠ হাতে একটা লোক আটচালায় উঠল। রাজু দিগার। সুবলের ভেতরটা আসন্ন মার-খাওয়ার ভয়ে কেঁপে উঠল। এই রাজুর সাথে সে কতবার রাতে একসঙ্গে জমির ফসল পাহারা দিয়েছে। কত সুখ-দুঃখের গল্প, তার হিসেব নেই। সে ডুকরে কেঁদে উঠল, রাজু,ভাই আমার, আমি কী এমন অপরাধ করেছি রে! পার্টি করাটা কি অপরাধ? ” ওমনি আর একটা ছেলে উঠে, “অত কথার কী আছে! ” বলে সুবলের পিঠে এক মোটা লাঠি সপাটে বসিয়ে দিল, তারপর সবাই রে রে করে উঠল। কেউ কিল কেউ ঘুষি কেউ লাথি মারতে লাগল। রাজু তার হাতের চ্যালা-কাঠ দিয়ে সুবলের পায়ে সজোরে আঘাত করল। কড়াক্ করেএকটা শব্দ হল, সুবল পায়ের উপর হাত চেপে ধরে, “ও মাগো ” করে চেঁচিয়ে উঠেই মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেয়। তার মুখমন্ডল তখন রক্তাক্ত, বিভৎস। একটু ছটপট করেই শান্ত হয়ে গেল সুবল। এদের মধ্যে একজন উপস্থিত জনতার দিকে আঙুল তুলে বলল,”সবাই শুনে রাখো,যে যে পাটির বিরুদ্ধে কথা বলবে তার এরকমই অবস্থা করে রেখে দিব, স্-শাল্লা!”
সুবল রে! ও আমার সুবল! বলে একটা আর্তনাদ করে আলুথালু শাড়ির এক মহিলা সুবলের নিথর দেহটার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
তিনি সুবলের মা।
ধীরে ধীরে আটচালা ফাঁকা হয়ে গেল। গোটা পাড়ার উপর একটা অসহ্য নীরবতা লোহার শিশির হয়ে নেমে আসলো ।
ঘটনা ৭
এরকমটা ক’দিন ধরেই চলছিল।
“প্রতিদিন এভাবে আর পারা যায় না, মা! ওর বাবা তো খুব বড়োমুখ করে তখন বলেছিলেন,দু’মাসের মধ্যেই সব দেনাপাওনা মিটিয়ে দেবেন। গাড়ি দেবেন বলেছিলেন। এদিকে আমি তো নিজে গাড়ি নিয়ে এলাম ডাউনপেমেন্ট দিয়ে। কই, তেনাকে তোমার বৌমা বলুক এখন ইএমআই টা অন্ততঃ দিক!” বলে, রাগে গজরাতে গজরাতে অফিস বেরিয়ে গেল
সুমন।
ওদের বিয়ে হয়েছে তিনমাস হল। এর মধ্যেই বাড়িতে নিত্য অশান্তি।শাশুড়ি-বইএ ছোটোখাটো খেঁচাখেঁচি দিয়ে শুরু হয়, থামে একেবারে সপ্তমে গিয়ে।
“বাবা তুমি আমাকে নিয়ে যাও এই নরক থেকে। নতুবা ওদের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দাও। আর না হলে একদিন সত্যি সত্যিই তোমরা আমার মরামুখ দেখবে বলেদিলুম। ”
এরকম ফোন মাঝে মাঝেই আসতে লাগল। বড়ো আশা নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন সুশীল।সমর্থ ঘর, সুচারু পাত্র। সরকারি অফিসার। দাবি-দাওয়া একটু বেশি থাকলেও সুশীল ভেবেছিলেন, পিএফএর টাকায় সব হয়ে যাবে। একটিমাত্র মেয়ে!
এদিকে পিএফএর টাকাটাও উঠছে না। মরমে মরে থাকেন তিনি। কম চেষ্টা তো করছেন না, যাতে পিএফটা তোলা যায়।
আজ সকালে ফোনটা এল। না মেয়ের নয়, তার শাশুড়ির। “বেয়াইমশায় আপনাকে এখুনি আসতে হবে,সঙ্গে বাবুকেও নিয়ে আসবেন “! তার গলার স্বরে আনক্যানি কিছু-একটা ছিল যেটা সুশীলকে বিপর্যস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। তার হাত থেকে ফোনটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাবু,তার একমাত্র ছেলে বাকি কথাগুলো শুনল।
তারপর তারা এসে দেখলেন—- তখনো রান্নাঘরের মেঝেয় স্তুপিকৃত পোড়া শাড়িজামার ভেতরে তার মেয়ের শরীর থেকেও ধোঁয়া উঠছে। পোড়াগন্ধ ছেয়ে ফেলেছে সারা আবাসন। চেনা যাচ্ছেনা মেয়ের মুখ। কিন্তু তার মেয়ের গলায় আধপোড়া পেঁচানো শাড়ির আঁচলটা তখনো পুড়তে বাকি ছিল। কেউ জল ঢেলে দিয়েছে তার উপর।
ঘটনা ৮
প্রতিদিনের বাজার। ছোট মফস্বলি শহর। সাইকেল মোটরসাইকেল রেখে যে যার বাজার করে। মানুষের ভিড় হয় ভালোই।
এখানেও একটা ২০-২২ বছরের ছেলে সাইকেল চুরি করে পালাচ্ছিল। দোকানদারদের সন্দেহ হওয়াতে তারা ছেলেটিকে আটকায়। লোক জুটে গেল বিস্তর। দুজন হেন্টো মতন লোক ছেলেটিকে ল্যাম্প-পোস্টে বেঁধে ফেলল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ বলল হাতদুটো কেটে ফ্যাল, কেউ বলল পা কেটে দে। তারই মধ্যে চড় থাপ্পড় পড়তে লাগল এলোপাতাড়ি। ঘুষির চোটে চোখদুটো গর্তের ভেতরে ঢুকে গেল। কপাল ও নাক কেটে রক্ত গড়াতে লাগল।পেছনদিকেে বাঁধা হাত দুটোকে ধরে কেউ মুচড়ে আঙুল ভেঙে দিল। ছেলেটির আর্ত চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল গোটা বাজার এলাকায়। ছেলেটির নাম ঠিকানা পাওয়া গেল না। কেউ বলল বাঁধগোড়ায়,তো কেউ বলল হলদিপাড়ায়। সবাই মারছে,হাতুড়ে ডাক্তার, কেরানী, মাস্টার। এভাবে কাউকে সুযোগে পেয়ে মারতে কেমন লাগে সেই অভিজ্ঞতাটাও আর বাকি থাকে কেন!বউএর সঙ্গে ঝগড়া করে মাগ্যি-গন্ডার বাজারে আসা আমিও দিলুম দু’চার ঘা। হাতে একটু লাগল বটে কিন্তু মেরে মনটাকে একটু শান্ত করা গেল। পড়ে পাওয়া তিনআনা।
ধীরে ধীরে নেতিয়ে ঝুলে পড়ল ছেলেটির মাথা। তারই মধ্যে পুলিশ এল, নিয়ে গেল ছেলেটিকে। দুদিন পরে খবর এল মারা গেছে ছেলেটি। যাক্, একটা আপদ বিদেয় হল।
ঘটনা ৯
ঠিক সন্ধ্যে হওয়ার মুখ। সূর্য অনেকক্ষণ ডুবে গেছে যখন মাস্টার পড়াচ্ছিল ছেলে-মেয়েদের। তাদের ছুটি দিয়ে সুখেনের চা দোকানে এককাপ চা খেয়ে আসতে আসতেই সাঁঝ নেমে গেল। সুখেনের দোকানে এইসময় হেটো লোকদের ভিড় থাকে, একটু রাজনৈতিক-সামাজিক আলোচনাও হয়। কিন্তু আজ ভিড় তো নেই-ই, বরং যে দু’তিনজন ছিল তারাও কেমন করে তার দিকে তাকাচ্ছিল।
রাস্তায় আসতে আসতে মনে পড়ল, ক’দিন আগেই সুনীল চুপিচুপি বলছিল,”মাস্টার তোমাকে জঙ্গলপার্টি পছন্দ করছে নি গো। তুমি না কি এখনো রুলিং-পাটি ছাড় নি! তার উপর বড় নেতাদের খবর দিয়েছ তেনাদের সম্পক্কে!কাজটা ভালো করলেনি! ”
বনের ভেতর গ্রাম, কখন কী হয়, ভাবতে ভাবতেই ওরা জঙ্গল-ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, সশস্ত্র, ইউনিফর্মড।” মাস্টার্!,আমাদের কথা মেনে চললে ভালো হত। সবচেয়ে বড় ভুল করেছ আমাদের খবর পুলিশের কানে পৌঁছে দিয়ে।” তাকে ওরা টেনে নিয়ে চলল,গ্রামের ভেতর যেখানে আরো অনেক সশস্ত্র বন্দুকধারী অপেক্ষা করছিল। মাস্টার তখন কাঁদছে আর অনুনয় করছে,”তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি পুলিশ বা পার্টির লোককে কিছু বলিনি! আর আমি পার্টি ছাড়লেও ওরা আমাকে ছাড়তে চাইছেনা। ক্ষমা করো! ক্ষমা করো তোমরা! আমি কালই পার্টি ছেড়ে দেব! বাঁচাও আমাকে! আমার মা অসুস্থ, বৌ-ছেলে আমার মরে যাবে গো!তোমাদের পায়ে পড়ছি, ছেড়ে দাও! ”
গ্রামের গুটিকয়েক মানুষের সামনে বিচার হল, তারপর ওরা তাকে মৃত্যুদন্ড দিল। টেনে নিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতর।
গুড়ুম! গুড়ুম্! করে দুটো শব্দ হল। তারপর সব শান্ত, নিঝুম, স্তব্ধ!
কেবল ঝিঁঝি পোকারা কেঁদে কেঁদে, কেঁপে কেঁপে থেমে গেল একসময়। রাত নামল জঙ্গলের গ্রামে,ফালি করা চাঁদ উঠল বিরাট এক তেঁতুল গাছের মাথার উপর।
ঘটনা ১০
গোপালকাকা তিনদিন পর বাড়ি ফিরলেন।ফিরেই পোষাক-আশাক না ছেড়েই তাঁর একরত্তি ছাদে গিয়ে উঠলেন। উঠেই বিকট চিৎকার।”আমার ফুল কে ছিঁড়ল!কে ছিঁড়ল, হে!”
মরসুমি ফুলগাছ সংগ্রহ করে ছাদের টবে খুব যত্ন নিয়ে রোপন করা ও ফুল ফোটানো তাঁর পুরনো ব্যামো। মানে রোগ আর কি।কেউ কেউ বলেন বাতিকগ্রস্ত। ইংরেজিতে একেই Rough বলে হয়তো। বাংলায় বলি খ্যাপামো।
এমনিতেই গ্রীষ্মকাল, প্রচন্ড রোদ, এইসময় ফুল ফোটানো মানে, গাছ বাঁচিয়ে কী পরিমান যত্নআত্তি করতে হয় সে রাজনৈতিক দিদি-দাদারাই জানে! এতটা যত্ন কোন ভোটারকেও কখনো করতে হয়না। সে তো এতদিন কম রাজনীতির দাদা-দিদিদের চরায়নি যে তার গম্যি হবে না!
মা, বউ, ছেলে সবাই পায়ে পায়ে উঠেএল ছাদে। ভয়ে ভয়ে।
“কী ছেলেমানুষী করছিস্!” বলল মা।
বউ বলল,”রোদে বোঁটাশুকিয়ে পড়ে গেছে মনে হয়। তুমি কিছু খাবে? শরবত?চা?ছাতু?”
তারপর আর খাবার জিনিস কী কী হতে পারে, তা আর মনে পড়ছিলনা ওর বউ এর।
ছেলে বলল,” আমি ছিঁড়িনি বাবা। গাছগুলোয় জল দিয়েছিলুম!”
মা বলল,”ও বাড়ির বাচ্চাগুলো খুব দুষ্টু হয়েছে রে বাবা,কেউ বোধয় ছিঁড়ে ফেলেছে। আচ্ছা, তুই জামাকাপড় ছেড়ে নিচে আয়, আমি খাবার দিচ্ছি। “মা জানে তার ছেলে ফুলগাছগুলোকে কীরকম ভালোবাসে!
সবাই তাকে ছেড়ে নিচে চলে গেল, ভয়ে। পাছে সে কিছু বলে, দোষারোপ করে কারুকে।
গাছের কুঁড়িগুলি সে চিনত। কবে কোনটা ফুটবে, সে ওরা কানে কানে বলে দিত। বৃতি থেকে কিভাবে কুঁড়ি হয়, কেউ জানে? কুঁড়িরা বলে কাউকে, কিভাবে ফুটবে সে? কোথা থেকে গন্ধছোটে ফুলের, কেউ বলতে পারবে?কোন ডাল কাটলে গাছ খুশি হয়, কোন ডালে পোকা লেগে যন্ত্রণা হয় গাছের, জানে কেউ?
সে রেগে গেল। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল সে। কেন পাশের বাড়ির ফুলহত্যাকারীদের ঢুকতে দিল ওরা?
কেন ফুল ছিঁড়ে দিল ওরা?
হঠাৎ তার মনে হল ওই বাচ্চাগুলোকে হাতে পেলে ফুলের মতোই মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলবে সে ওদের মুন্ডু!
গলায় পা দিয়ে ফুলহত্যার প্রতিশোধ নেবে সে। ভয়ঙ্কর একটা হত্যাকাণ্ড না হলে তার শান্তি নেই।
ঘটনা ১১
— এই তোমার বীরত্ব, লক্ষ্মণ! তুমি জানো না, নিরস্ত্রকে হত্যা করা মহাপাপ! তাছাড়া এ তো চৌর্যবৃত্তি! এ তোমাকে শোভা পায় না।আর আমার এই খুল্লতাত , বিভীষণ, যিনি তোমাকে আমার গোপন দুর্বলতার খবর দিয়েছেন, তোমার এই পাপকার্যের সমান অংশভাক। তোমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল।আমি অসহায়, আমাকে সুযোগ দাও রণসাজে সজ্জিত হওয়ার।
— তুমি বোধহয় জানো না ইন্দ্রজিৎ, যুদ্ধে ও প্রেমে সবকিছুই সম্ভব, সবকিছুই রণকৌশল। আমরা তো নিমিত্তমাত্র। যা কিছু ঘটছে তার উপর কেবল বিধির হাত। তোমার পিতার পক্ষ নিয়েছো তুমি। তোমার পিতা,রাবন, তিনিও তো সীতাকে অপহরণ করার সময় এই কৌশলই প্রয়োগ করেছিলেন।নিরস্ত্র অসহায় সীতা। ছলনা করে,রামের সাথে সম্মুখ-সমর এড়িয়ে চৌর্যবৃত্তিই গ্রহণ করেন। সেটাকে তুমি কী বলবে? একচক্ষু হয়োনা ইন্দ্রজিৎ! প্রকৃতিকে বিকৃত করে যে পথ তুমি অবলম্বন করবে, সেই পথই ফিরে এসে তার সন্তুলন রক্ষা করে।অতয়েব প্রস্তুত হও।
ঘটনা ১২
—-ইয়াজিদ, তোমাকে খলিফা হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। তোমার আব্বাজান কিন্তু কথা দিয়েছিলেন, যে খলিফাগন নবীর কথামতো তার নীতিতেই জাহান শাসন করবে। কিন্তু তুমি বে-ইমান হয়ে আজ আমাকেই অস্বীকার করতে চাইছ। এমন কি আমাকে হত্যা করতে পারো এমন খবরও আছে আমার কাছে।
—- হুসেইন, তুমি ভুলে যাচ্ছ, নীতি কবুল করা এক, আর তখত্ হাসিল করা আর এক। তামাম আরবের মানুষ, নবী আর তাঁর বংশধর হিসেবে তোমাকে যে গুরুত্ব দেয় তাতে, তুমি ইচ্ছে করলেই আমার বংশকে খলিফার তখত্ থেকে সরিয়ে দিতে পারো।ইনশাআল্লাহ, একজন জাঁহাবাজ হিসেবে আমার থেকে ভালো আর কে বুঝবে এই খলিফার ইমান?
—- কিন্তু এ তো গুনাহ্, ইয়াযিদ! তোমার কাছে শক্তিশালী বাহিনী আছে। আমি নিরুপায়। মাত্র ৭৮ জন নারী-শিশু আমার কাফেলায়। এ গুনাহ্ ইয়াযিদ, এ গুনাহ্!
—- তুমি যুদ্ধের নিয়ম ভুলে যাচ্ছ হুসেইন। সুযোগ বারবার আসে না। জাঁহাবাজ যোদ্ধা যদি জাহান দখল করতে চায়, তবে এই তার কাছে আল্লাহর পয়গাম। এ সুযোগ আমি হাতছাড়া হতে দিতে পারি না। তৈয়ার হও হুসেইন, আমি আসছি, সেনা এগিয়ে আসছে।তৈয়ার হও। তারপরে একদিন বহু লড়াই শেষে হুসেইনের ধড়হীন ছিন্নমুন্ড নিয়ে কারবালার ঊষর মরুপ্রান্তর জুড়ে কাফেলা চলল, ইয়া্যিদকে উপহার দিতে।
ঘটনা নেই
টিভিতে দৃশ্যটা দেখছিল ঋতবান। রেললাইন জুড়ে ছড়িয়ে আছে লাশের টুকরো আর তাদের
ব্যবহৃত জিনিসের সঙ্গে রুটি। এদের নাম দেওয়া হয়েছে পরিযায়ী-শ্রমিক। যেন ওদের দেশ নেই। যেন সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হিমালয় পেরিয়ে উড়ে এসেছে ওরা। এই দেশ ওদের ঘর নয়।
—তোমার কি মনে হয় না, এটা একটা হত্যাকাণ্ড! নিজের মনেই যেন কথা বলল ঋতবান।
—-হয়তো সেরকম নয়। ওরা যদি রেললাইন ছেড়ে পাশের কোন গাছতলায় শুয়ে পড়ত তাহলে তো এটা ঘটত না। তবে ওদের আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হল কেন! নিশ্চয় সে নিরাপত্তার অভাব ওরা টের পাচ্ছিল, তাই, অনিশ্চিতের পথেই বেরিয়ে পড়া। হ্যাঁ, সেদিক থেকে এটা হত্যাকাণ্ডই বটে। বলল সুলগ্না।
—-তোমার কথায় মনে হল আর একটা দিকও বোধহয় আছে। কী সেটা?
—- আসলে সিস্টেমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ক্ষমতা। সেটা হাসিল হওয়ার পর আসে নৈতিকতার প্রশ্ন। পৃথিবীতে যত লড়াই, সবই ক্ষমতাদখলের জন্য। আর পায়ে মাড়িয়ে মরে এই উলুখাগড়ারা।
—- উলুখাগড়া? তুমি ওদেরকে উলুখাগড়া বলছ! যারা রক্ত-ঘাম দিয়ে তিল তিল করে এদেশের সম্পদ বানায়, খাবার বানায়, যাদের শক্তি ও যত্নের উপর নির্ভর করে গোটা দেশ এগিয়ে চলে তারা উলুখাগড়া!
— না তো কী। ওরা সম্পদ তৈরি করে, খাদ্য দেয় কিন্তু সে সম্পদ বা খাবারে ওদের অধিকার পায়না। একটা দেশে যত ছোটবড় ঘটনা ঘটে সবের এফেক্ট তো ওদেরকেই সহ্য করতে হয়। সে বিপ্লব হোক বা নোটবন্দী। একটা দাঙ্গা হলে বা বোমাবিস্ফোরণে কারা মরে? সাধারণ মানুষ, আর যারা সেটার প্ল্যানিং করে মানে মাস্টারমাইন্ড যারা, তারা দিব্যি বহালতবিয়তে থাকে। ভোটের সময় যে গনহত্যা হয় তাতেও তো ওরাই মরে,কোন নেতা-নেত্রীকে মরতে শুনিনি । যে আত্মঘাতী জঙ্গি বিস্ফোরন ঘটাল সে মরে, যার কথায় ও নীতিতে সে এ কাজ করল সে বেঁচে যায়। ভয় হয়, হয়তো কখনো ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে, বাচ্চার স্কুলে বা ট্রেনে যেতে যেতে আমরাও একদিন….. বলে থেমে গেল সুলগ্না।