‘পরিযায়ী’ কোন পরিচয় নয় : দেবাশিস দত্ত

‘পরিযায়ী’ শব্দটা অভিধানে ছিল না তা নয়, ছিল। কিন্তু তেমন মাত্রা পায়নি। যাদের নিয়ে এই শব্দের ব্যবহার তারা কিন্তু অনেক কাল ‘ধরেই ‘ঘরছাড়া’ হয়ে আছে। তবুও শব্দের ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। ব্যবহার মূল্য তেমন ছিল না ঠিক আজকে যেমন। আজকের প্রেক্ষিতে শব্দটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রেক্ষিতটা হল লাখে লাখে মানুষ, যে যেখানে থাকুক, একসাথে কাজ হারিয়েছে, আস্তানা সহায় সম্বল, যা কিছু ছিল সব একই সাথে হারিয়েছে, নিয়োগ-কর্তাদের দায় অস্বীকার, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যর মনোভাবও ছিল একই রকম, সব বাহন চলাচলও বন্ধ থাকায় আটকে থাকার অভিজ্ঞতায় তফাত নেই, দূরত্ব দুশো অথবা দু হাজার মাইল হতে পারে, কিন্তু ‘ঘর’ ফেরার যে তাগিদ অনুভূতি সেও এক রকম, নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানিতে কোন জাত-পাত-ধম্মের কথা নেই প্রভেদ নেই, সবার জেদ জেহাদ মিলেছে এক বিন্দুতে, একের বিরুদ্ধে – মৃত্যুকে আমল না দিয়ে, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষে মরতেও ‘রাজি’ হয়ে ‘ঘরে’ ফেরা এক ‘সা’ থেকে আরেক ‘সা’ এর পারম্যুটেশন কম্বিনেশন যে মহাসংগীত সৃষ্টি করেছে তাতে অত্যাচার ও অত্যাচারীর স্বরূপ খুলে পড়েছে, এর মধ্যে কোনটাই ‘পরিযায়ী’ নয়। প্রতিটি অবস্থান মজুর এর স্বাভাবিক ন্যায্য অবস্থান ও তার প্রত্যয়ের এক একটি ‘স্বর’ ধ্বনি’ – সব মাত্রার যোগফলে একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে দাঁড়িয়ে গেল, দাঁড়াল কিনা সে অন্য কথা, তবে নিশ্চিতভাবেই চিহ্নিত হয়ে গেল ‘পরিযায়ী’ বলে। ‘পরিযায়ী’ ঢেকে দিল ‘মজুর’কে তার পরিচয়কে সত্ত্বাকে, তার অদম্য শক্তি আর সৃষ্টিকে, তার সংঘর্ষকে, আর রক্ষা করল, নিদেনপক্ষে আড়াল করল একটা দৈত্য অথবা দানবকে, তার প্রবৃত্তিগুলোকে, নৃশংসতা অমানবিকতা তথা লুণ্ঠনের প্রণালীকে ! ‘মজুর’এর পরিচয় হয়ে যাবে ‘পরিযায়ী’ বলে? রাষ্ট্রসংঘ থেকে শুরু করে অনেকে এমনকি স্বজনেরাও বিভ্রান্ত হবে, নিদেনপক্ষে অস্বীকার করবে নস্যাৎ করে দেবে একটা পরম সত্যকে, রূঢ় বাস্তবকে — মানা যায় না। ‘লকডাউন’ এর পরে রাষ্ট্রসংঘ ‘দৈহিক দূরত্ব’-কে [‘ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং’] ‘সামাজিক দূরত্ব’ [‘স্যোশাল ডিস্ট্যান্সিং’] বলে নিদেন হাঁকল। মানা যায়! দুটো কি এক নাকি একটা বিপদের সময়ে এই শব্দ-বন্ধের মধ্য দিয়ে চিন্তা চেতনায় বিচ্ছিন্নতার একটা বার্তা ঢুকিয়ে দিল যা দেশে দেশে শাসকরা লুফে নিলো আর মিডিয়া লক্ষ উচ্চারণে ছড়িয়ে দিল কোটি কোটি মানুষের কানে !

কে পরিযায়ী? উৎস কোথায়? পরিযায়ী মজুর বটে কিন্তু তারও আগে দেশের একজন নাগরিক। দেশে রয়েছে সংবিধান, রয়েছে গণতন্ত্র। রয়েছে একটা ব্যবস্থা তার নাম ধনতন্ত্র যার উল্লেখ সংবিধানের কোথাও নেই। নাগরিক অর্থ কোন না কোন রাজ্যে তার একটা স্থায়ী বা অস্থায়ী বাসস্থান বা ঠিকানা আছে – আর আছে সংবিধান অনুসারে দেশের যে কোন স্থানে যাবার কাজ পাবার বসবাসের অধিকার । দুর্ভাগ্য এই দেশে ‘গণতন্ত্র’ এক হাতে জনগণকে সব অধিকার দেয়, অন্য হাতে অর্থাৎ ধনতন্ত্র সব অধিকার কেড়ে নেয়। ফলাফলে দেখা যায় বেকারি কমে না প্রবল থেকে প্রবলতর হয় । দারিদ্র অনাহার অপুষ্টি মজুরের নিত্যসঙ্গী হয়। বাস্তব হল যেখানে মজুরের স্থায়ী/অস্থায়ী বাস বা ঠিকানা, যেখান থেকে তারই ছাপে সরকার তৈরি হয়, হয়ে গেলেই উচ্ছিষ্টের মত ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়, সেখানে পর্যাপ্ত কাজ নেই আর যেখানে কাজ সেখানে স্থায়ী/অস্থায়ী বাসস্থান নেই, অতিমারি মহামারির মত ঘটনা ঘটে গেলেও সেখানে বেঁচে থাকার মত নূন্যতম কোন রকম সহায়তা নেই। এটাই হল বর্তমান ব্যবস্থার সারকথা। অথচ গণতন্ত্র’র যাত্রা শুরুই হয়েছিল ‘রোটি কাপড়া মকান’ [শিক্ষা স্বাস্থ্য যুক্ত হয়েছে] দিয়ে যাত্রা শুরু করার পর থেকে বহু দিন মাস বছর যুগ কেটে গেলেও আজও দূরত্ব থেকে গেছে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে যেমন ‘খাবার’ থাকে অধরা অথবা সেই দূরত্ব বেড়েছে, অবস্থার বুনিয়াদি কোন পরিবর্তন হয় নি, আর্থিক সামাজিক অসাম্য বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। প্রমাণ দুই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকা যেখানে ১% ধনীর হাতে ৪০% আর ভারতে ১০% ধনীর হাতে ৭৩% সম্পদ কুক্ষিগত আর দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারীদের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। এই করোনার ধাক্কায় জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না। ভয়ংকর চেহারা ধরা পড়েছে রাষ্ট্রসংঘের সমীক্ষায়। এই ব্যবস্থায় নিয়োগ কর্তার সুবিধে সবচেয়ে বেশি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার এই ব্যবস্থায় মজুর সংগঠিত হয় না, হতে পারে না, দরকষাকষি করতে পারে না, দেয় মজুরি মেনে নিতে হয়, থাকতে হয় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়। সম্পদ সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অবদান যাদের তাদের ‘পরিযায়ী’ বলা হচ্ছে যাদের স্থায়ী বলতে কিছুই নেই। এতদসত্ত্বেও মজুর মজুরই থাকবে, পরিযায়ী হতে যাবে কেন? ‘পরিযায়ী’ নামের আড়ালে তাদের লড়াইটা ঢেকে দেওয়া বা খাটো করা কেন, অস্তিত্ব মুছে দেবার চেষ্টা কেন? শাসক আর নিয়োগকর্তার অমানবিক চেহারা চাপা দেওয়া বা সায় দেওয়া কেন?

লকডাউন মজুরের দুর্গতি, সর্বহারার করুণ চেহারাটা তুলে ধরেছে। এখন ওদের নিয়ে কমবেশি অন্বেষণ অনুসন্ধান চলছে। এই সর্বহারা মজুরের সংখ্যা কত? কারও কাছে সঠিক তথ্য নেই। কেউ রাখে না ওদের হিসেব। কেউ ভাবে না ওদের জন্যে, সরকারি কোন হিসেব ও পরিকল্পনার মধ্যে ওরা পড়ে না। ওদের চাকরির বা কাজের নির্দিষ্ট কোন শর্ত নেই – আইন বা বিধি নেই। কাজ, কাজের সময়, কাজের ধরণ, বেতন, ছুটি, অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সামাজিক সুরক্ষার কোন বালাই নেই, উচ্ছিষ্টের বিনিময়ে কেবল গতর দেবার সামর্থ্য নিয়ে এরা বেঁচে থাকে। একটা হিসেবে দেখা যায় এরা দেশের মোট শ্রমসম্পদের ৮৮-৮৯% (কমবেশি ৪১৮ মিলিয়ন) এবং এরাই হল আইএলও’র পরিভাষায় ‘অসংগঠিত শ্রমিক’। শ্রমসম্পদের বাকি ১১-১২% হল ‘সংগঠিত শ্রমিক’ যাদের রয়েছে চাকরির নির্দিষ্ট শর্ত, সুবিধা, অধিকার ও সামাজিক সুরক্ষার নানা বিধি। অর্থাৎ মজুর যারা মজুরির বিনিময়ে বা শ্রমিক বা যারা শ্রমশক্তির বিনিময়ে কাজ বা উৎপাদন করে তারা বিভাজিত দুটি ভাগে – সংগঠিত এবং অসংগঠিত অথবা স্থায়ী এবং অস্থায়ী সম্মিলিতভাবে একটা শ্রেণি। এই শ্রেণিকে বিভাজিত করে দেখানোয় একমাত্র স্বার্থ রয়েছে মালিক, শোষক ও শাসকের যারাও পরস্পরে ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু মিলিত ভাবে একটি শ্রেণি। এই দুই শ্রেণির মধ্যে সম্পর্ক বৈরিমূলক। দেশের মধ্যে এমনকি দেশের বাইরেও পুঁজির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমের চলাচল আজ অতি স্বাভাবিক এক চিত্র। উন্নত পুঁজিবাদী সব দেশে এমন কি আমেরিকায় সস্তা সুবাদে কৃষি থেকে উন্নত প্রযুক্তি পর্যন্ত বিস্তৃত বিভিন্ন পেশায় এমন মজুরের উপস্থিতি সেদেশের আভ্যন্তরীণ আর্থিক সামাজিক সঙ্কটকে তীব্র করে তুলেছে। আইএলও প্রকাশিত সংখ্যাতথ্য অনুসারে এমন অস্থায়ী বা ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকের সংখ্যা ২৪৪ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার ৩.৩%। সুতরাং নানা ধরণের উৎপাদনে এ ধরণের মজুর বা শ্রমিকের উপস্থিতি আজকের বিশ্ব প্রেক্ষিতে, শোষণ ব্যবস্থায় এক অতি বাস্তব চিত্র একে কোনমতেই উপেক্ষা করা যায় না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা ও বাজার দখল করার নামে উৎপাদন খরচ কমাতে গিয়ে সমস্ত ধরণের অমানবীয় কোপ পড়ে এই শ্রেণির মজুরদের ওপরে কারণ আভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পরিসরে শক্তি হিসেবে এরা ক্রমবর্ধমান কিন্তু আজও তেমন সংগঠিত শক্তি নয়।

কর্পোরেট যখন তার পুঁজি এক শিল্প থেকে অপর কোন শিল্প বা এক দেশ থেকে পুঁজি যখন দেশান্তরে যায় আমরা কি তাকে ‘মাইগ্রেটেড’ বা পরিযায়ী পুঁজি বলি? অবশ্যই বলি না যদিও পুঁজির বিভিন্ন অবস্থান বা প্রকার ভেদ রয়েছে যেমন ব্যক্তি পুঁজি, মুৎসুদ্দি পুঁজি, শিল্প পুঁজি, রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজি, লগ্নী পুঁজি, ফাটকা পুঁজি, লুটেরা পুঁজি ইত্যাদি যা পুঁজির উত্তরণ বোঝায়। উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে কৃষি সবচেয়ে প্রাচীন। শিল্প অপেক্ষাকৃত নব্য ব্যবস্থা। কোন এলাকায় শিল্প সংস্থাপনে যখন মজুর জন্মলাভ করছে তখন তারা এসেছে বিভিন্ন এলাকা থেকে, সে অর্থে সবাই অর্থাৎ সব মজুর বা শ্রমিকই পরিযায়ী। চা, খনি, চট, সূতা, রেল, ইস্পাত বা যে কোন শিল্প পত্তনের সময়ে যারা কাজে যোগ দিয়ে মজুর বা শ্রমিক হলেন, তাদের মধ্যে ভূমিপুত্র থাকলেও, বেশিরভাগটাই পরিযায়ী। বিভিন্ন শিল্পে সংগঠিত শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক, স্থায়ী শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক, ঠিকা শ্রমিক, ভাগা শ্রমিক, চুক্তি শ্রমিক – সকলেই একটি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। বিভাজনের মধ্য দিয়ে সুবিধা অধিকার কেটে নিতে কেড়ে নিতে শোষককেই সাহায্য করে। এই শ্রেণিকে শ্রেণি হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয়। শ্রেণি হিসেবে সবার লড়াইটা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘শোষণ ব্যবস্থা’ উৎখাত করাই শ্রেণিগত ভাবে একমাত্র লক্ষ্য। আলাদা করে দেখলে ‘পরিযায়ী’ হিসেবে দেখলে সেই লড়াইটাই খাটো হয়। সুতরাং …

শ্রমিক বা মজুর একটা ব্যবস্থার কলিজা বা জান, তথাপি যথোচিত মান বা স্বীকৃতি আজও অধরা, সমাজে অবস্থান এখনও অনেকটাই তলায়! বিশ্বায়নের নিয়মে দুনিয়ার কোণে কোণে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে দিল্লি বা ওয়াশিংটনকে পাঙ্গা নিতে যারা মহড়া দিচ্ছে তারা মজুর, ওরা কবর খোঁড়ে, এটাই তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

[লেখক – ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, প্রাবন্ধিক, আলোচক, সম্পাদক।]

Facebook Comments

Leave a Reply