গল্প : ভবেশ দাস
হলুদ পরিযায়ী
‘আবার দাম বাড়লো’ হতাশার সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো আনোয়ারের মুখ দিয়ে।
রবি আনোয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে পাশে বসা আরিফুলকে কনুই দিয়ে ঠেলে ইশারা করলো। আরিফুল মন দিয়ে ছিলে কেটে নকশা তুলছিল কিন্তু রবির আলতো ঠেলায় হাতের টোকনাটা (ছোট্ট ছেনি) পড়ে গেল। মুখে একটা অস্বস্তিভাব ফুটিয়ে আরিফুল রবির দিকে তাকাতেই, রবি চাপা গলায় বলল, ‘দ্যাখ আনোয়ার চাচা কী বলছে?’ এতক্ষণে আরিফুলের হুঁশ ফিরল। আসলে আরিফুল যখন নতুন নকশা তোলে গয়নায় তখন বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। নিজের কাজের প্রতি এতটাই নিষ্ঠা আরিফুলের।
আরিফুল আনোয়ার চাচার চিন্তিত মুখ দেখে বলল, ‘কী হল চাচা! এত ভাবছো কেন?’ আনোয়ার বিষন্ন মুখে বলল, “ভাবনা কী সাধে আসেরে। আজকের পেপারটা দ্যাখ। সোনার দাম আবার বেড়েছে। কাজের বাজার খারাপ হবে মনে হচ্ছে। এমনিতেই নোটবন্দির পর থেকে আমাদের অবস্থা কাহিল। ”
মুম্বাইয়ের জাভেরী বাজার এলাকা। স্বর্ণশিল্পের খনি বলা হয় এক কথায়। বড় বড় বিল্ডিংয়ের মধ্যে ছোট ছোট ঘুপচি ঘরে হলুদ ধাতুর রমরমা ব্যবসা। পুরো এলাকায় পশ্চিমবঙ্গের লোক থিক থিক করছে কারিগর হিসাবে। আনোয়ার আলি চল্লিশ বছর আগে নিজেও লেবার হিসেবেই এসেছিল এখানে। তারপর কাজ শিখে নিজেই ব্যবসা ফেঁদেছে বিশ বছর হল। তখন থেকেই বছরে একবার গ্রামের বাড়ি বেগুমপুর এলে পাড়া থেকে
দু’একজনকে নিয়ে আসে এখানে। হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে রুজিরুটির ব্যবস্থা করে দেয়।
বছর আটেক আগে আরিফুলকে সঙ্গে এনেছিল। রবি এসেছে তার দু’বছর আগে। বেগুমপুরে আরিফুলের আব্বা তাঁত বুনতো। অল্প একটু জমি জিরেতও ছিল। কিন্তু তাঁতের বাজার আগের মতো না থাকার দরুন সংসারে নিত্য অভাব লেগেছিল। আরিফুলের ওপরে দুই দিদি। নীচে একবোন। ছটা পেট টানতে গিয়ে আরিফুলের আব্বার বেদম অবস্থা। তাই ক্লাস সিক্সে পরীক্ষা দিয়েই আরিফুল আনোয়ার চাচার সাথে যোগাযোগ করে এখানে চলে এসেছে। প্রথম প্রথম মন বসতো না কাজে। রবি তখন বন্ধুর মতো সাহচর্যে পাশে থেকেছিল। যদিও এখন রবির থেকেও আরিফুলের কাজের কদর বেশি। কাজের জায়গায় হালকা রেষারেষির সঙ্গে বন্ধুত্বটা রয়ে গেছে অমলিন।
বছর তিনেক আগেও দুই বন্ধু ছুটির দিনে আরবসাগরের হাওয়া খেতে যেত। মুম্বাইয়ের নৈশযাপন উপভোগ করতো। কিন্তু আজকাল নিজেদের এলাকা ছাড়া বের হয় না। আনোয়ার চাচা নিষেধ করেছে। জাতীয়তাবাদের বদ হাওয়া চলছে দেশে। বাঙালি যদি মুসলমান হয় তবে বাংলাদেশী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে উঠতি দেশপ্রমিকরা। প্রথমে হ্যারস তারপর মারধর। প্রয়োজনে খুন হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। খাদ্য দিয়ে বিচার হচ্ছে দেশপ্রেম।
আরিফুল মন দিয়ে কাজ করে। এই কাজ করেই দুই দিদির বিয়ে দিয়েছে। ঘরদোরে শ্রী ফিরিয়েছে। গতবার যখন গ্রামে এসেছিল, মায়ের কথায় বড়দুলাভাইয়ের সাথে শাদির জন্য মেয়ে দেখে এসেছিল। সাকিনাকে এক দেখায় পছন্দ হয়েছে আরিফুলের। ফোন নং লেনদেন হয়ছে। কথা হয় রোজ সাকিনার সাথে। রবি এই নিয়ে ফাজলামি করে আরিফুলের সঙ্গে। এবছর ভালো করে কাজ তুলে দিতে হবে, আরিফুল সেটাই ভাবে। এবারে গ্রামে গেলে তার শাদি পাক্কা।
চলতি কাজের দিনে আনোয়ার চিন্তিত মুখে বলল, “মনে হয় এখানকার পাততাড়ি গোটাতে হবে।” রবি স্বভাব সুলভ রসিকতায় বলল, “কেন চাচা, গাঁয়ে গিয়ে কাজি হবে না কি? এখন তো ইমাম ভাতাও মেলে ভালোই।” আরিফুল চুপ করে চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোট্ট দোকানের গুমোট ভাব আরো একটু ভারী হয়ে গেল বাতাসের স্বল্পতায়। আনোয়ার গম্ভীরভাবে বলে উঠলো, “এন,আর,সি নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে চারিদিকে। কখন যে কি হয়ে যায়। পেটের টানে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে আছি। আল্লার দেওয়া প্রাণটা কোনদিন না বেঘোরে চলে যায়।”
আরিফুল চুপ করে রইলো। রবি আরিফুলকে শুনিয়ে আনোয়ার চাচাকে বলল, “সেই ভালো চাচা। সব গুটিয়ে চল গাঁয়ে ফিরে যাই। তোমার কাছে কাজ করে যেটুকু পয়সা জমেছে তাতে একটা টোটো কেনা হয়ে যাবে। সেই টোটোয় আরিফুল ও সাকিনাবিবিকে চাপিয়ে গাঁয়ের হাওয়া খেয়ে বেড়াবো।” আনোয়ার হেসে ফেলে রবির কথা শুনে। রবির সরস ফাজলামির জন্য আরিফুলের কান লাল হয়ে যায়।
এইভাবেই হাসি,ঠাট্টা দুশ্চিন্তায় দিন কাটে তিনজনের। মুম্বাইয়ে ঠান্ডার রেশ তেমন থাকে না সমুদ্রের কোলঘেঁষা শহর বলে। মার্চ মাসের ওয়েদারে এক অজানা ভাইরাস পুরো দেশটার সাথে মুম্বাইকে ভয়ের হিমেল স্রোতে ডুবিয়ে দিল। চওড়া ছাতির নেতা হঠাৎ দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষনা করে বসলো। মার্কেট বন্ধ। ছোট ছোট ঘুপচি ঘরে আনোয়ার চাচার মতো আরো অনেক দোকানদার লেবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। প্রথম প্রথম পুঁজি ভেঙে খাওয়া। তারপর পুঁজিতে টান পড়লে একবেলা আধপেটা। অন্যবেলা পেটে গামছা বাঁধা।
আনোয়ার চাচা ফোন করেছিল তার মহাজনকে পুরনো পাওনা টাকার জন্য। ওদিক থেকে জবাব এসেছিল, “আনোয়ারজী অভি কাঁহাসে রুপিয়া আয়েগা। সব বন্দ পড়া হ্যায়। এক্সপোর্ট কা অর্ডার ভি ক্যানসেল হো গ্যায়া। লকডাউন উঠনে দি জিয়ে। তব যোগাড় দেখতে হে।” বয়স্ক আনোয়ারের প্রেশার উর্দ্ধমুখি। দরদর করে ঘেমে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই কপাল চাপড়ে বলে, “হায় আল্লা, গাঁয়ের ঘরে খাবার ফেলে ছড়িয়ে খায় বাড়ির লোক। দুটো পয়সা রোজগার করতে এসে, ভুখা পেটেই কবরে যাবো না কি!”
পরিস্থিতি বুঝে রবি দু’একদিন মার্কেটের বাইরে বেরিয়ে কিছু চাল,ডাল সংগ্রহ করে এনেছিল এন.জি.ও দের কাছ থেকে। রবির দেখাদেখি আরিফুলও একদিন গিয়েছিল কিন্তু পুলিশের লাঠিচার্জ ও কুকুরতাড়া ছাড়া অন্য কিছু জোটেনি কপালে। দুই বন্ধুর বাড়ি থেকে ফোন আসে। কেউ এখানকার ঘটনা জানায় না বাড়িতে। পাছে চিন্তা করে। সবার নজর এখন টিভির নিউজে। কবে লকডাউন ওঠে। মহারাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে এদের জন্য হাত ধুয়ে ফেলে দিয়েছে। পরিযায়ীদের ভোট হয় না যে।
দিনে দিনে আনোয়ার চাচার জন্য চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গেল রবি ও আরিফুলের। রবি বলল আরিফুলকে, “এখানে আর কিছুদিন থাকলে চাচাকে বাঁচানো যাবে না ভাই। গাঁয়ে ফেরার ব্যবস্থা করতেই হবে। ওখানে আর যাই হোক, না খেয়ে মরবো না। কিছু না পাই, জব কার্ডের কাজ নেবো পঞ্চায়েত থেকে।” আরিফুল চুপ করে থেকে ভাবতে লাগলো কী ভাবে যাওয়া যায়। আরিফুল দুটো সোনার কানের বানিয়েছিল নিজে হাতে করে সাকিনার জন্য। সেটাই শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে দিল এক দোকানে। টাকাটা যখন গুনলো আঙুল দিয়ে তখন সাকিনার প্রতি ভালোবাসায় দু’চোখ দিয়ে জল টপকে আঙুলের ডগায় লেগেছিল।
এক অসম লড়াই লেগেছে কোরনা ভাইরাসের সৌজন্যে। পেটে দানা নেই। পকেটে নামমাত্র টাকা নিয়ে শুধুমাত্র মনের জোরকে সম্বল করে জাভেরী বাজার থেকে কুড়িজনের একটা দল বেরিয়ে পড়লো নিজেদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। একটা পন্যবাহী লরি ভাড়া করে আরিফুলদের দল রওনা দিয়েছে মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে।
ইতিমধ্যে খবরের কাগজে, লাইনের উপর শুকনো রুটি পড়ে থাকার ছবি আসুমদ্রহিমাচলের বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক অবস্থা দেখে। কিছু রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর রাসায়নিক স্প্রে প্রয়োগ করা হয়েছে করোনা ভাইরাস মারতে। সে সব ছবি মোবাইলে ভাইরাল হয়েছে। তা দেখে ট্রাকের মধ্যে বসে থাকা আরিফুলের বুক কেঁপে উঠছে অজানা ভয়ে। অতিরিক্ত ভয় পেয়ে রবিকে আরিফুল জিগ্যেস করে, “আচ্ছা আমাদের পরিযায়ী শ্রমিক কেন বলা হচ্ছে বলতে পারিস রবি?”
রবি একটু চিন্তা করে বলল, “ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় দেখিসনি সাইবেরিয়া থেকে যে পাখি উড়ে আসতো তাদের পরিযায়ী পাখি বলতো। “আরিফুল ক্লিষ্ট হেসে বলল, “সেতো ভিনদেশী পাখি শীতে বেড়াতে এসে আবার গরমে চলে যায় তাই পরিযায়ী বলে। আমরা তো নিজেদের দেশেই কাজ করছি!” রবি বলল, “আমরা অশিক্ষিত মানুষ। পেটের জন্য খেটে খাই। আমরা কী আর নেতা মন্ত্রীদের মতো অতো বুঝতে পারি আরিফুল। এই দ্যাখনা, সব খবরের কাগজেই শিক্ষিত লোকেরা আমাদের পরিযায়ী বলে দাগিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের সেটাই মেনে নিতে হবে। ওরা সব জ্ঞানী গুণি মানুষ।”
দু’জনের কথার রেশ শুনে ট্রাকে বসা অন্য মানুষরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আনোয়ার চাচা আরিফুলকে শ্বাস টেনে বলল, “আর যাই হোক বেটা কবরটা যেন নিজের গাঁয়ের মাটিতেই হয়। জাভেরী বাজারে মরলে আমি শান্তি পেতাম না।” আরিফুল আনোয়ার চাচার শীর্ন হাতটা নিজের মুঠোয় ধরলো। ট্রাক চলছে গড়গড়িয়ে জাতীয় সড়ক ধরে রাতের আঁধার চিরে। ট্রাকের খোলে কুড়ি জন মানুষ পেটে খিদে নিয়ে ধকলের চোটে ঝিমুচ্ছে। হঠাৎই সামনে একটা বড় গাড়ির হেড লাইটের আলোয় চোখ ঝলসে উঠে ট্রাকের ড্রাইভারের স্ট্রিয়ারিং কেঁপে উঠলো।
পরের দিন খবরের কাগজে প্রথম পাতায় ছবিসহ হটলাইন, “মুম্বাইয়ের স্বর্ণশিল্পীদের মৃত্যু ভয়ানক ট্রাক দুর্ঘটনায়।”
কয়েক মাস পর।
টোটো চালিয়ে আরিফুল বেগুমপুরের রাস্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। পেছনে বসে আছে সাকিনা। বিকালের অস্তমিত সূর্যের ম্যাড়মেড়ে হলুদ রঙের আলো সাকিনার মুখে পড়ে আর একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রাস্তার ধারে চায়ের দোকান দেখে টোটোটা সাইড করল আরিফুল। সাকিনা গলায় আদর মাখিয়ে বলে উঠলো, “তোমাকে কষ্ট করে এক পায়ে আর নামতে হবে না। আমি চা নিয়ে আসছি।” দু’জনে টোটোয় বসে চা খেতে লাগলো।
হঠাৎ ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আরিফুল বলল, “সূর্যের আর এক নাম রবি, তাই না সাকিনা। রবি আমাদের ছেড়ে আনোয়ার চাচার মতো পুরোপুরি চলে যায় নি। ওই সূর্যের সাথে মিশে গেছে। তাই এমন সোনার মতো হলুদ আলো পড়েছে তোমার মুখে।”
Posted in: June 2020 - Cover Story, STORY