অশ্বত্থামা হত : অলোকপর্ণা
“পরিযায়ী” এক রোম্যান্টিক মোড়ক যার আবডালে দুটো শুকনো চোখ জ্বলজ্বল করছে হায়নার আশ্লেষে। “পরিযায়ী” এক পেয়ালা তিক্ততাকে দুচামচ চিনির মিষ্টি করে তোলার ফন্দি। “পরিযায়ী” এক রোদচশমা, যা চোখে পরে নিলে সব কিছু মায়াবি ঠেকে। “পরিযায়ী” এক সত্যঘটনা “অবলম্বনে” নির্মিত চলচ্চিত্র, যেখানে ২+২= ৫ হলেও হতে পারে। “পরিযায়ী” এক নো ম্যান্স ল্যান্ড, যেখানে সাদা বা কালো কারোর আধিপত্য নেই, বরং “পরিযায়ী” এক যুদ্ধবিরতির মত শীতকাল, যেখানে না আমি না তুমি স্পষ্টভাবে আঙুল তুলতে পারছি, উপরন্তু আমাদের আঙুলে লেগে যাচ্ছে ফুলের পরাগ, আর আমাদের আঙুল ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, আমরা যাদের আঘাত করতে চেয়েছিলাম, তাদের আর আহত করতে পারছি না। “পরিযায়ী” এক শিকারি পাখি যে আমাদের তর্জনি ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে উঁচু পাহাড়চূড়ায়, সেখানে তার বাসায় ছড়িয়ে আছে, ছিটিয়ে আছে মিথ্যেকথার হাড়গোড়। সে আমাদের তর্জনি গিলিয়ে দিচ্ছে তার হবু শিকারি সন্তানদের। “পরিযায়ী” এমন এক মরীচিকা, যার ছায়ায় এলে ঠিক দুদন্ডের শান্তি মেলে, আর একচুল বেশি নয়, একরত্তি কমও না। “পরিযায়ী” এমন এক ওভারকোট, যার তলায় চাপা পড়ে আছে জামার যাবতীয় ছিদ্র। অথবা “পরিযায়ী” এমন এক বর্ষাতি, যার নিচে আদৌ কোনো বস্ত্র আছে কিনা জানার প্রয়োজন পড়ে না। “পরিযায়ী” এমন এক লাইমলাইট, যার চারপাশ নিকষ অন্ধকার।
“পরিযায়ী” এমন এক অজুহাত, যাতে সাত খুন মাফ করা যায়। “পরিযায়ী” এমন এক অছিলা, যাতে অসম্ভব ছুটিও মনজুর হয়ে যায়। “পরিযায়ী” এক সিনেমার সেট, যাকে অনেক পেরেক ঠুকে খাঁড়া করা হয়েছে, তবু শুটিং শেষে যার কোনো কদর থাকবে না। “পরিযায়ী” মধ্যবিত্ত মানুষের চোখের জল, বারবার উবে যাওয়ার জন্য যার জন্ম হয়েছে, জন্ম হয়েছে বারবার ঝরে পড়ার জন্যেও,- যে কারণে মধ্যবিত্ত মানুষ বাদে আর কেউ কোনোদিন মুখ মুছতে পকেটের রুমাল ব্যবহার করেনি। “পরিযায়ী” এমন এক কার্পেট, যার আবডালে পুষে রাখা যায় সাপ, বিছে, ইত্যাদি বিষধরদের। “পরিযায়ী” এমন এক ওষুধ, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমরা গণ্য করিনা, অথচ তাই আমাদের কাবু করে ফেলে। “পরিযায়ী” এক ছেলেভুলানো খেলা, যা ঘরের ভিতরের হাতিটার থেকে আমাদের নজর সরিয়ে রাখে। “পরিযায়ী” এক দিবাস্বপ্ন, যা ভেঙে গেলে আমাদের আফসোস হবে আমরা জানি। “পরিযায়ী” এমন এক জল, যার মিশেলে মাদকটি সহনীয় হয়ে ওঠে। অথবা “পরিযায়ী” নিজেই এমন এক মাদক,- হ্যাঁ “পরিযায়ী” এমন এক মাদক, যা আমরা আর সেবন করবো না ভাবি আগামিকাল থেকে, কারণ আমরা এও জানি আমাদের আগামিকাল বলে কিছু নেই।
“পরিযায়ী” এমন এক শব্দ যাতে “পরি” আছে বলে রূপকথার নিমেষ আছে। “পরিযায়ী” এমন এক শব্দ যাতে উড়ান আছে, তাই আছে অসংখ্য হাওয়া যা, সমস্ত ভাবনা এলোমেলো করে দিতে জানে। “পরিযায়ী” এমন এক শব্দ যা প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে রাখে। “পরিযায়ী” এমন এক অন্ধজন,- অন্ধত্ব যার সাজ। “পরিযায়ী” এমন এক চাদর, যার তলায় কিশোর ছেলেটি কাঁদছে না হস্তমৈথুন করছে ঠাহর করা যায় না। “পরিযায়ী” শব্দটি আজকাল হাওয়ায় খুবই উড়ছে, কারণ আমরা জেনে গেছি স্তিমিত হওয়া হাওয়ার ধর্ম। “পরিযায়ী” শব্দটা পাখির চোখ, যার দিকে ক্যামেরা তাক করে আছে তামাম মিডিয়া, আর তার পাশে দুয়োরানীর মত একাহারী পড়ে আছে “শ্রমিক” শব্দটি। পরিযায়ী- র মধ্যে পা গলিয়ে দিতে পারলেই পথের নুড়ি কাঁকড় আর উত্যক্ত করে না। “পরিযায়ী” এক রঙচঙে মুখোশ, যার আড়ালে আমার, তোমার, সবার আসল চেহারাটা লুকিয়ে রাখা আছে, অথবা “পরিযায়ী” এমন এক রঙচঙে মুখোশ, যা জ্ঞানত আমরা নিজেদের মুখ আড়াল করতে ব্যবহার করছি। “পরিযায়ী” আমাদের অভিসন্ধি, “শ্রমিক” আমাদের কয়েদ করার ফাঁদ। “পরিযায়ী”,- টাকিলা শটগ্লাসে লেগে থাকা নুনের আস্তর। “পরিযায়ী” আলমারিতে লুকিয়ে রাখা কঙ্কাল, যা অনেক অনেক অনেএএএএক গল্প জানে। একটু বেশিই গল্প জানে। “পরিযায়ী” এমন এক শব্দ যাতে “ফেরা” আছে, উড়ান তেমন না হলে পাখিও তো “পরিযায়ী” নয়। “পরিযায়ী”- বহিরাগত। অনাত্মীয়। পর।
“পরিযায়ী” যা-ই হোক না কেন, রেললাইনের ধারে কিছু শুকনো রুটির লাশ চিরকাল পড়ে থাকবে। ওই লাশ সৎকার করার ক্ষমতা কোনো সরকারের নেই, ওই লাশ হজম করার শক্তি পৃথিবীর কোনো সুবিধাবাদীর হয়নি, তাই “পরিযায়ী” এমন এক ডেরা, যেখানে আত্মগোপন করলে আত্মাও নিজের খোঁজ পাবে না। তাই “পরিযায়ী” এমন এক ভেক, যা এখন আমাদের চামড়া হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র “শ্রমিক”, কেবলমাত্র “শ্রমিক” বলতে আমাদের গলা আটকে যাচ্ছে, আমরা গিলতে পারছি না। “পরিযায়ী” এমন একদলা নুনভাত, যা দিয়ে গলায় আটকে থাকা সেই কাঁটা গিলে ফেলা যায়। “পরিযায়ী” আমাদের “অশ্বত্থামা হত”, বাকিটুকু বলার ক্লেশ সবাই জানি আমরা,- কখনোই নেবো না।
Posted in: June 2020 - Cover Story, PROSE