এই হাত আগুনের (মেটাফর): ভারতীয় প্রতিস্পর্ধী কবিতার অনুবাদ : তনুজ ও শর্মিষ্ঠা

এই হাত আগুনের (মেটাফর) : ভারতীয় প্রতিস্পর্ধী কবিতার অনুবাদ
নির্বাচন, অনুবাদ ও প্রাক-কথন : তনুজ ও শর্মিষ্ঠা

উৎসর্গ : এই দুনিয়ার সমস্ত শাহিনবাগকে

দ্বিতীয় কিস্তি

লাল সিং দিল-এর কবিতা
মূল ভাষা : পাঞ্জাবি
অনুবাদের সোর্স ভাষা : হিন্দি

পাঞ্জাবের সম্রালার এক দলিত পরিবারে জন্মানো লাল সিং ‘দিল’ (১১ এপ্রিল, ১৯৪৩ – ১৪ অগস্ট, ২০০৭) ছিলেন পাঞ্জাবি বিপ্লবী কবিতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।সন্ত রাম ‘উদাসী’, দিল ও তাঁর বন্ধু অবতার সিং সন্ধু ‘পাশ’-এর হাতেই পাঞ্জাবি কবিতার প্রকৃত লব্জবদল ঘটে এবং তা হয়ে ওঠে চূড়ান্ত রাজনৈতিক। নকশালবাড়ির ঢেউ যখন আছড়ে পড়ছিল সুদূর পাঞ্জাবে, তখন তিনি স্রেফ কবিতা লেখাই যথেষ্ট নয় মনে করে সক্রিয়ভাবে সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। যদিও পরে পার্টির জাতি পরিচয় নিয়ে অস্বচ্ছ অবস্থান তাকে দ্বিধাবিভক্ত করে, তাঁর মোহভঙ্গ হয় ও আরও পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
সতলুজ দি হওয়া (সতলুজের হাওয়া, ১৯৭১), বহত সারে সুরজ (অনেক অনেক সূর্য, ১৯৮২), আজ বিল্লা ফির আয়া (আবার বিল্লা ফিরে এসেছে আজ,২০০৭)-এই উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলোর পাশাপাশি তার আত্মজীবনী, ‘দাস্তাঁ’, পাঞ্জাবী সমাজের গভীরে প্রোথিত জাতি-বৈষম্য ও সেই সমাজের প্রান্তে নিবাসী এক কবির টালমাটাল জীবনের অসামান্য দলিল।
এখানে উপস্থিত কবিতাগুলি সত্যপাল সয়গলের হিন্দি অনুবাদ থেকে তর্জমা করা হয়েছে।

তিন হাজার চারশ’ শ্রমিক

তিন হাজার চারশ’ শ্রমিককে
কী করে কন্ট্রোল করা যায়!
তারা তো কথা বলছে,ভাষণ দিচ্ছে,
পাথরও ছুঁড়ে মারছে
তবে এত এত শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করছে কারা,
যে তারা এখনও ইনকিলাব করছে না?

সমাজতন্ত্র

ব্যক্তিকেই যদি না গুঁড়িয়ে
দিতে পারলো,
তবে সমাজতন্ত্র কী আর
দাঁড় করালো শেষমেশ?
মানে,মাছটা ভাজাও হবে
আবার ভাজা মাছটা জীবিতও থাকবে?

জুতি

ওই
শ্যামলা দেখতে মেয়েটি
যখনই খুব খুশি হয়ে যায়,
বলে ওঠে—
‘তবে আমি কিন্তু ভীষণ হারামি!’
সে অনেক কিছুই তারপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে
আমার মতন
আলকাতরার তলায় জ্বলতে থাকা আগুনে
মূর্তিটুর্তি,
বইপত্র,
নিজের জুতির ভেতর থেকে বার করে নিজের পা
আর সে ছুঁড়তে থাকে
ইঁট,ইঁট,ইঁট।

অবিদ্রোহী কবিতার খোঁজে

আমি একটা অবিদ্রোহী কবিতার ভাষা
খুঁজে চলেছি,
যাতে আমারও কিছু বন্ধুবান্ধব হয়।
আমি নিজের বিশ্বাসের নখগুলোকে
কেটে ফেলতে চাই,
যাতে আমিও কারোর সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি।
আমি আর সে তখন চিরকালের জন্য
মিলেমিশে এক হয়ে যাবো।
কিন্তু এমন কোনো বিষয়ই খুঁজে পাই না
যে বিষয়ে বিদ্রোহ নেই
তাই আমারও আর বন্ধু হল না কেউ।

তোমার যুগ

অসংখ্য সূর্য মরে গেলে পরে
তোমার যুগ আসবে,
তাই না?

মজা

আমাদের পাশের কাঙাল মহল্লার
লোভী টাউটটাকে
দুর্নীতি উপহার দিয়েছে
একটা ভাঙা গাড়ি,
যাতে আমার কবিতাকে আরো হাস্যকর
করে তোলা যায়!

বেশ্যারা

বন্ধুরা!
যত খুশি নিকৃষ্ট ভাবতে পারেন আমাকে,
কিন্তু এই বেশ্যা মহিলা ও মেয়েরা
আমারই মা,বোন আর মেয়ে।
আর আপনাদেরও।
এরা গাইয়ের পুজো করা ভারতবর্ষের
মা,বোন আর মেয়ে।
অহিংসা ও বুদ্ধের উপাসক এই দেশের
মা,বোন আর মেয়ে এরা।
এরা বড়ো বড়ো পুঁজিপতিদের
মা,বোন আর মেয়ে।
এবং যদি তা না হয়,
তবে এরাই আসন্ন ইনকিলাবের
মা,বোন আর মেয়ে।

প্রবাসী শ্রমিক

মোটা তারটাকে ঘষটে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়
প্রবাসী শ্রমিক ‘হেঁইয়ো,হেঁইয়ো’ গানের আলাপটা ধরে
আরো জোর লাগাতে, একসাথে তারা সবাই মিলে
গানের মত করে গায় ‘হেঁইয়ো,হেঁইয়ো’
আর তখনই তাদের পাশ দিয়ে নীল শাল গায়ে একটা মেয়ে
হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়।

ভিয়েতনাম

যেখানে গান্ধীদের অতটা ছাড় দেয়া হয় না
যে তারা ভগৎ সিং-র ফাঁসির বিষয়ে শলা-পরামর্শ করতে
শত্রুদের ক্যাম্পে চলে যেতে পারে।

কবিতা

খাদের অভাবে মৃতপ্রায় ক্ষেতটি কবিতা আর
খাদের ভেতর ধ্বসে যেতে থাকা ক্ষেতটিও
যেমন,কোনো মিল একটা কবিতা।
অত্যাচারীদের ছুরির নিচে আক্রান্ত কবিতা
আর সেই ছুরির খরশানতাও
রথের চাকার মতন গতিশীল,
ভারি ভারি রেলগাড়ির চাইতেও ভারি,
একেকটা মিল যেমন কবিতা।
বরফ বিক্রেতা যে জট্ট ছেলেটার শরীর
জ্বলছে ভীষণ জ্বরে,সে একটা কবিতা
আবার কোনো জ্বলন্ত জঙ্গলও কবিতা
আমার বাবার হাসির ভেতরেও যেমন,
নিহিত রয়েছে কবিতাই।
যে চলে যাচ্ছে এবং হাসতে হাসতে
চলেছে যেদিকে,তাই শুধু নয়,
যে কথাতে হেসে উঠছে সে,তাও কবিতা
এবং ছাদের দিকে মুখ করা ফালা,
সেই ফালার মুখটাও।
মেলায় বরফ চুষতে থাকা
ছোটো ছোটো বাচ্চারা কবিতা
যে পালোয়ান ভাবছে
স্বাস্থ্য ভেঙে গেলে ছেড়ে দেবে কুস্তি,সেও
যেমন,মিল একটা কবিতা।
আজ কেরল কবিতা আর
বাংলাও যেমন একটা বিশুদ্ধ কবিতা কোনো
পাথরের অন্তঃস্থলে যা,তাও কবিতা
লোহার অন্তরে যা,তাও
আমার গভীরে রয়েছে সেই কবিতা,কবিতাই
হ্যাঁ,মিলও যেমন একটা কবিতা।
পাথর টানতে টানতে,
ঢোল বাজাতে বাজাতে,
সরলতম ভাষায় কথা বলে চলেছে যারা,
তারাও কবিতাই।
সান্ধ্যপথ ধরে হেঁটে আসা গাধাওয়ালারা,
সাঁপ নাচিয়েরা,
মাঠাওয়ালারা কবিতা
সব,সবই কবিতা
যেমন,মিলও একটা কবিতা।
অত্যাচারীর ছুরির নিচে আক্রান্ত কবিতা
অত্যাচারীর গর্দানের ওপরও ধরা আছে কবিতা
এছাড়া একেকটা মিল তো কবিতাই।

অদ্ভুত শহর

কবি কি কবিতাই
লিখে যাবে শুধু?
নাকি কখনও লিখবে চিঠিও,
কিন্তু কাকে?
মালমন্ত্রীকে এখনই লিখে না জানালে,
ব্যাপারটা কিছুতেই এগোবে না।
পরের কথা পরে।
মন্ত্রীসাহেব,আপনি তো নতুন এসেছেন,
কিন্তু প্রাক্তন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল।
দলিতদের প্রাপ্য জমিন,
সেই প্রাক্তন মন্ত্রী তার
চাকরদের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলেন
আর যেদিন পাটোয়ারীরা
চারজন স্কুলের মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়,
যাদের মধ্যে একজন কুয়োতে ঝাঁপিয়ে পড়লেও
বাকি তিনজন তাদের হাতে ধরা পড়ে যায়–জীবন্ত,
এবং পরে পরেই ঘটনাটাকে ধামাচাপা দিতে
যখন ওই অকুতোভয় মন্ত্রীটির কাছে সাহায্য চাইতে যায় তারা,
মন্ত্রীমহাশয় তাদের পরামর্শ দেন যে
দেখুন,এই মামলাটামলা সবই সামলানো যাবে।
আপনারা শুধু সেই অনুর্বর জমিগুলো,
যা আপাতত আমার চাকরদের নামে লেখা আছে,
শিগগিরই আমার নামে লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
অথবা আমার পোষা কুকুরদের নামে।
কারণ আমার ছেলেমেয়েদের নামে
কমপক্ষে একটা করে জমিন তো লেখা হয়েই আছে।
ব্যস,রফা হয়ে গেল।
খবরের কাগজের মুখে কোনো রা নেই
থানায় জোর নেই
লোকেদের মধ্যে একতা নেই।
আমি সেই মালমন্ত্রীর কথাই বলছি,
যে তার এলাকার একপ্রান্তে কলেজ ও
অন্য প্রান্তে আই.টি.আই বানিয়ে দিয়েছিল,
যাতে সেখানে স্টেশন বানানো না যেতে পারে আর
রেলগাড়িটা যাতে তার দুদিকে বিছানো ক্ষেতগুলোর
ওপর দিয়ে চলে যেতে সাহস না করে।

নাচ

যখনই শ্রমিক মহিলাটি
তাওয়ায় নিজের কলিজা ফেলে
রান্না শুরু করে,
গাছের ফাঁক থেকে হেসে ওঠে চাঁদ।
ছোটো ছেলেটাকে তার বাপ
থালা-বাসন বাজিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখে
আর বড়ো ছেলেটা সহসাই যখন
তার কোমরে বাঁধা
ঘুঙুরে রুনঝুন
বোল তোলে ও
নাচতে শুরু করে,
এই গানগুলো সহজে মরে না,
না হৃদয়ের এই নাচ মরে।

ক্লান্তি

একটা কিছু করার
এবং কিছুই না করারও
ইচ্ছে হয় না।
বন্ধ পোকার মতন চিন্তা এগিয়ে যেতে থাকে।
যদি কেউ এসে বলে,
‘তোমার প্রেমিকা গাড়ি চাপা পড়েছে’,
তখনও বোধহয়…
যদি জানতে পারি
ভাইটা পাগল হয়ে গেছে,
মনে হয় একটু কষ্ট পাবো।
যদি কেউ এসে জানায়
‘তোর মাকে পুলিশ ন্যাংটো করে…’,
সেই মুহুর্তটাকেও হয়তো সাধারণভাবেই কাটিয়ে উঠব
গাড়ির চাকার মতন,
নির্বিকার।
ক্লান্তি শুধু শরীরে,অঙ্গে,প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে যায়,
যেতে থাকে।
প্রদীপের আলোতে
চমকে ওঠে গাইয়ের চোখ,
যার গোবর কুড়োতে গিয়ে রোজ
নিজেকে শেক্সপিয়ার,ইত্যাদি ভেবে বসি
এমন এক শেক্সপিয়ার,
যার অগুণতি সকাল-সন্ধ্যা
মলমূত্রের গন্ধ শুঁকেই কেটে গেছে।
আর আমার হাতের জোর,
তা কমছেও না,বাড়ছেও না
বিপন্ন ক্রোধের যে তিমিরে মন ছিল,
সে তিমিরেই আছে
ইচ্ছে করে,পাহাড়-পর্বত গুড়িয়ে দিই
রাস্তাঘাটের সব বাড়ি-ঘর-ভবন-অফিস-আদালত
ভেঙে ফেলি।
কুত্তারা ডেকে যায়—
‘আমার ঘর,আমার ঘর!’
মনসবদার রগ উঁচিয়ে বলে—
‘আমার গ্রাম,আমার আদালত!’
লিডার চিৎকার করে—
‘আমার দেশ,আমার দেশ!!’
আর লোকজন?তারা সেই এক
‘আমার ভাগ্য,ভাগ্য আমার’,তাই বলে যাচ্ছে
এতকাল ধরে।
ভাবছি,আমি কী বলি?
কিছু করতে
কিছু না করতেও
ইচ্ছে করে না।
আমার ভাই,আমার বন্ধু,আমার প্রেমিকা,আমার দেশ,
কিছুই নয় একান্ত আমার
বিপন্ন ক্রোধের যে তিমিরে মন ছিল,
এখনও সে তিমিরেই আছে।

মাতৃভূমি

ভালোবাসার কোনো কারণ থাকে নাকি?
কিংবা,সৌরভের কোনো মূল?
তবে সত্যের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকুক
আর নাই থাকুক,
মিথ্যা কিন্তু কখনও উদ্দেশ্যহীন হয় না।
তোমার এই নীলরঙা পাহাড় অথবা
সুনীল জলধারার জন্য নয়,
যদি তারা বুড়ো মায়ের চুলের মতন
আড়ম্বরহীন,ধূসরও হত,
তবুও আমি তোমাকে একইরকম ভালোবাসতাম।
যদি কিছু নাই বা থাকত তোমার,তখনও।
এই সম্পদ,তোমার এই খাজানার
কোনোই প্রয়োজন নেই আমার।
এই ভালোবাসার কোনো কারণ হয় না
তবে মিথ্যাও হয় না কখনও উদ্দেশ্যহীন।
তোমার অমূল্য খাজানার ওপর বসে
আজ সাপেরা তোমার বন্দনা করে চলেছে,
সেই বন্দনায় তোমাকে
সোনার চিড়িয়া বলছে তারা।

সমর্পণ

কত সুরেলা,
‘ঈশ্বরে সমর্পিত’,এই শব্দ দুটো।
আমি চাই,
আমার উচ্চারিত শেষ বাক্যটি যেন হয়,
‘তোমার ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আমার।’
আমি চাই,
ওপরের এই শব্দগুলোকে সরিয়ে রাখতে
ইনকিলাবের জন্য।

————————

তনুজ – কবি,অনুবাদক ,গদ্যকার ও সম্পাদক, ‘হারাকিরি’।
শর্মিষ্ঠা – অনুবাদক, ইদানীং ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় প্রতিস্পর্ধী কবিতা অনুবাদ করে চলেছেন।

Facebook Comments

Leave a Reply