গল্প : তপোন দাশ
বিষ
গোটা পৃথিবী জুড়ে মানুষের নিরাপত্তাই দরিদ্র হয়ে পড়েছে। সামান্য জীবাণু যুদ্ধে মানুষ কেন এতো পিছু হাটবে? এই প্রশ্ন কি প্রযুক্তিকে করা যায় না ! সমস্ত শ্রেণির মানুষকে বোতল বন্দী করা জিন হয়ে এসেছে করোনা। এবার নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য মানুষ দশ গুণ খরচ করতেও পিছুপা হবে না। ব্যাঙ্কের সুদ কমলেও কর্মবিরতির ডাক দেবে না।ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে সরব হবে না। সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন করবে না। যে মানুষ একটা পরজীবির ভয়ে সমস্ত স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ত্যাগ করতে পারে, সে তো এককোষীরও অধম! রাষ্ট্র কোন রকম দায় না নিয়ে, কোন যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা না করে মানুষকে যে ঘরবন্দী করে দিতে পারে তা প্রমাণ হয়ে গেল। আজ হয়তো করোনা এলো, আগামী দিনে আরও কেউ কেউ আসবে। মানুষ বারবার ঘরবন্দী হয়ে হয়তো অনিশ্চিত জীবন থেকে বাঁঁচবে,তবে নিশ্চিত সে অনেক কিছু হারাবে, বিশেষ করে প্রতিবাদের ভাষা অর্থাৎ লড়াই করার মতো মানসিক শক্তির বিলুপ্ত ঘটবে।
এমনও দিন গেছে যেদিন স্কুলের রেজাল্ট এনে সে কাউকে দেখাতে পর্যন্ত পারেনি। একা একাই রেজাল্ট দেখে জমা দিয়ে দিতো। মনে কোন প্রশ্ন এলে জিজ্ঞেস করার মানুষ ছিল না। মা বাবা সর্বদাই ব্যস্ত। তাদের কোন রবিবার নেই। তার সাথে কথা বলার ফুরসত ছিল না কারো। ছুটির দিনে বাবা আরও বেশি ব্যস্ত থাকে অফিসের কিছু কলিগ আর ক্লাব পার্টি নিয়ে। ওই সব দিনে বাবা যখন ফেরে তখন সে বিশেষ একটা গন্ধ অনুভব করে। সেই গন্ধ নিয়ে বাবা সোজা নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। আর ডিনার করতে নামে না। মা’ও ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের ঘরোয়া কাজ গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকে। চিমনি পরিস্কার থেকে শুরু করে পুরো রান্নাঘর ধোয়ামোছা, বিছানা ঠিক করা,পর্দা পাল্টানো,ঝুল ঝাড়া কতো রকমের কাজ থাকে মায়ের। কৃষ্টির জন্য তেমন কারো সময় নেই। সে একা একাই বড়ো হয়েছে। স্কুলের বন্ধুদের সাথেও সেভাবে কথা হয়না। টিফিনের সময় সামান্য দেখা হলেও বাকি সময়টা শুধু ক্লাস চলে। আর ছুটির ঘন্টা বাজতেই যে যার পুলকারে উঠে পড়ে। এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেছে আট নয় বছর। ক্লাস ওয়ান থেকে নিজের মতোই বড়ো হয়েছে সে। প্রথম দিকে তার খুব কষ্ট হতো। স্কুল থেকে ফিরে মা বাবাকে দেখতে পেতনা।কাজের মাসি খাবার খাইয়ে, আদর করে ঘুম পাড়িয়ে চলে যেতো। মা অফিস থেকে ফিরে বড়জোর এক ঘর থেকে আর এক ঘরে কোলে করে তাকে রেখে আসতো। ঘুম থেকে উঠে এই পরিবর্তন সে বুঝেও কিছু বলেনি কোনদিন। মাকে ডেকে ডেকে সাড়া পাওয়া যেতো না। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতো, বাবার অফিস যাওয়ার তাড়া, মায়ের নিজেরও রেডি হওয়ার থাকতো। ওই কাজের মাসিই তাকে মুখ ধুইয়ে কিছু খাইয়ে দিতো। তার কিছু পরে স্নান করে স্কুল যাওয়া। এইভাবেই আস্তে আস্তে নিজেকে নিজের অজান্তেই মানিয়ে নিয়েছিল কৃষ্টি। কয়েকটা বছর পর থেকে সে আর মা বাবার অভাব উপলব্ধি করতে পারতো না। সারাদিনে মা একবার খেতে ডাকতো আর রাতে সে নিজেই খেয়ে নিতো মাসির কাছে। বাবা সেভাবে কোন দিন কিছু বলতো না। যখন সে ক্লাস এইটে উঠলো বাবা একটা অফিস থেকে পাওয়া স্মার্টফোন তাকে দিয়েছিল। এই এক দেড় বছর ধরে বাবা মা সারাদিনে দু’তিন বার ফোন করে খোঁজ নেয়, এই খাওয়া হয়েছে কিনা,স্কুল থেকে কখন ফিরলো,শরীর ঠিক আছে কিনা, কাজের মাসি কখন গেল ইত্যাদি কয়েকটি প্রশ্নই তাকে নিয়মিত করা হয়। হ্যাঁ না বলে রিপ্লাই দেয় কৃষ্টি। বিশেষ কোন প্রয়োজন না থাকলে সে নিজে কখনও কাউকে ফোন করে না,মা বাবাকেও না। ওই ফোন আসতো, সে রিসিভ করে দু’এক মিনিট কথা বলে রেখে দিতো। বাবা মায়ের সাথে বেশিক্ষন কথা বলতে ভালো লাগতো না। কোন কোন দিন মা বাবার মনেও থাকতো না ফোন করার কথা। কখনও ঘুমিয়ে পড়লে ফোন বেজে যেতো পুরানো সেই দিনের কথায়।
সন্ধের পর কৃষ্টির একায় ফোনটা ভালোই সঙ্গ দেয়। তখন বেশির ভাগ জানলা গুলো বন্ধ থাকে। তার নিজের জানলাটাও চারপাশের অন্ধকার দেখতে চায়না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর সে বেশ কিছু নতুন অ্যাপ ডাউনলোড করেছে। কিছু গেমস আর কয়েকটা সোশ্যাল সাইট। কয়েক মাস গেমস খেলার পর খুব বোরিং লাগতো। অনলাইনেও চলছিল,একদিন হঠাৎ করেই সমস্ত গেমস সে আনইনস্টল করে দেয়। খুব একঘেয়ে লাগতো একই রকম খেলা, ওই স্কোর করা, ছাপিয়ে যাওয়ার এক আনন্দ তাকে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছিল ঠিকই কিন্তু সে নিজেই সেটা বুঝতে পেরেছিল। বরং গুগলে সার্চ করে গল্প পড়ে অনেকটা রিলিফ পেতো সে। কুমেরু দুনিয়া, তেপান্ত নদীদের গল্প তাকে অনেক বেশি আনন্দ দিতো। বন্ধ ঘরে থেকেই সে বড়ো হয়েছে, ফ্রকের সাইজ বেড়েছে,ভাবনায় তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রং বিনিময়। শূন্যে ভাসমান বারান্দায় বসে মাঝে মাঝে সে তারাদের ছাড়িয়ে চলে যেতে পারে আরো অনেক আকাশে। সে সমস্ত নির্জনতা ভেঙে তাকাতে পারে। বারান্দায় চোখ হামেশাই হারিয়ে যেতো। ইন্দ্রিয়ে নানান স্পর্শ জাগতো। এই সব ভাবনা থেকেই সে একটা ফেসবুক প্রোফাইল বানিয়েছে “অতল পৃথিবী” নামের। সেখানে সকলেই ভ্রাম্যমাণ বন্ধু। স্কুলের কোন বন্ধুকে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখেনি। আপার্টমেন্টেরও কেউ নেই। এমনকি মা,বাবা, আত্মীয় স্বজন সমস্ত রকম পরিচিতদের সে ব্লক করে দিয়েছে। তার এই জগতে সকলেই অপরিচিত,সে তাদের জানতে চায়। কৃষ্টি অনেকের সাথেই মাঝে মধ্যে চ্যাট করে। তাদের নানা রকম কৌতূহল সে বোঝার চেষ্টা করে। নিজের কৌতূহল গুলোর সাথে মিলিয়ে এক অন্য রকম মজা তাকে খুব তৃপ্তি দেয়। কেউ খুব গভীর ভাবে জানতে চায় কৃষ্টিকে। কেউ কেউ তাদের মনের সমস্ত কষ্ট উজাড় করতে চায়। তবে কেউ যদি তার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানতে চায় সে তৎক্ষনাৎ তাকে বা তাদের আনফ্রেন্ড করে দেয়। পারিবারিক কথা তার একদম সহ্য হয়না। নিজেও সে কোন দিন কাউকে পারিবারিক বিষয়ে কিছু বলতে চায় না। বরং বেশ কিছু পেজ লাইক করেছে, সেই সব পেজ এ নানা রকম বিষয়ের উপর কথাবার্তা, আলোচনা, ব্যাখ্যা তার অনেক ভালো লাগে। কৃষ্টির কাছে পৃথিবীটা অতল। শূন্যে ভেসে বেড়ানো এই গ্রহটা একদিন চাঁদের কাছেও চলে যেতে পারে,এমনকি পৃথিবীটা সে সমুদ্রের নিচে বা নিজের জানলার কাছেও দেখতে পারে বলে কল্পনা করে। এই রকম একটা অনুভাবনা সে ড্রয়িং করেছিল একদিন। ওর কাছে নিজের পৃথিবীটা সামান্য সচল হয়েছে স্মার্ট ফোনটার মাধ্যমে এই সব সোশ্যাল সাইটে। নিজে নিজে বড়ো হওয়া খুব কঠিন, মানসিক বিকাশ থমকে দাঁড়ায়। মনের ভিতর গজিয়ে ওঠা কৌতূহল গুলোর কেউ সমাধান করার নেই। প্রতিদিন কতো রকম প্রশ্ন তৈরি হয় মনে, সে সব মিলিয়েও যায়। ফেসবুকে সে নানান সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়।অচেনা মানুষ গুলোর পোস্টে বিভিন্ন বিষয় জানতে পারে। ভাবনার জানলা গুলো অন্যরকমে খুলে যায়। ক্লাস নাইনে ওঠার পর অ্যাপ গুলো তার খুব কাছের হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, ওয়াটস অ্যাপ এ সারা দিন ধরে কতো বার্তা আসে। কোনটা সত্যি,কোনটা মিথ্যে, কোনটা আজগুবি, কোনটা কাল্পনিক, কোনটা আবার প্রচন্ড হাসির। তবে দুঃখের কথা গুলো সে না পড়েই ডিলিট করে দেয়। এই সব কিছু পড়তে পড়তে সে অনেক কিছু বুঝতে শেখে। দুনিয়াটা নিজের মতো চিনতে শেখে। মানুষদের ভাবনা গুলো নিজের দৃষ্টিকোন থেকে অনুভব করতে শেখে। কৃষ্টি এইভাবেই এই এক বছরে আরো অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে।
এই সব ভাবার মুহূর্তে হঠাৎ করে কলিং বেলটা গেয়ে উঠতেই চমকে গেল কৃষ্টি। বাইরে থেকে তো তালা দেওয়া আছে। তাহলে এখন কে এলো! কাজের মাসি! দরজা খুলে দেখবে কি,বাইরে থেকে ডোরবেলটাও লাগানো। সে জানলার কাছে এসে লনটা দেখার চেষ্টা করলো যদি কাউকে দেখা যায়। এবার সজোরে ডোরবেলটা খোলার শব্দ, দরজার কাছে এগিয়ে গেল কৃষ্টি
– বাইরে থেকে যে লক করা ছিল ভুলেই গেছিলাম অতীন,কলিং বেল বাজিয়ে ফেলেছি!
-নাও নাও ব্যাগ গুলো আগে ঠিক করে রাখো,কাঁচা আনাজ গুলো ধুয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও
– ওয়েট,আগে আমি স্নান করবো, তার আগে এগুলো একটু জলে ভিজিয়ে রেখে দি,তুমি স্নানে যাও,আরো দুটো ফেসওয়াস কিনে রাখলে ভালো হতো। এই যাঃ কন্ডিশনার তো নেওয়াই হলো না,কি যে খালি ভুলে যাই
– তোমার মেকাপের জিনিস কিনতেই তো আধা ঘণ্টা কেটে গেলো! তাও বলছো এখনও বাকি আছে। খাবারের জিনিসের থেকেও বেশি লম্বা লিস্টি বানিয়ে ছিলে মেকাপের
– দেখলে তো মেকাপের দোকানেই সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছে! নানান ঝামেলায় এতো কিছু মাথায় থাকে কারো তোমারও তো ওই লিস্টে হেয়ার কালার,সেভিং ক্রিম দুনিয়ায় জিনিস ছিল দূর ভালো লাগে না, কন্ডিশনার ছাড়া কি হবে কে জানে!
– থাক,বাকি যা আছে কাল সকালে আবার আনা যাবে। এখন তো আর অফিস যাওয়ার তাড়া নেই, আর ওটা কেনা হয়েছে তো?
– ওটা মানে?
– উফ্ আরে প্রবালী বুঝতে পারছো না?
কৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অতীন বললো ফিসফিস করে, কিন্তু কৃষ্টি সেটা শুনতে পেলো। ইশারা বুঝতে পেরে প্রবালী বললো – ওটা তুমি ওষুধের দোকান থেকে নিয়ে এসো, এই দোকানে নেই, কয়েকটা প্যাকেট এনো
কৃষ্টি দাড়িয়ে সব শুনছিল। সেও হয়তো বুঝতে পারলো এই ওষুধের দোকান থেকে কোন প্যাকেট আনার কথা বলছে মা! সামান্য ইতস্তত বোধ করে সে মা বাবার কথার মাঝখান থেকে উঠে গেল নিজের ঘরে। আচমকা সে দাড়িয়ে গেছিল তাই, তা না হলে ওদের কোন কথার সামনেই থাকতে চায় না কৃষ্টি। সে যে মানসিক ভাবে অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে সেটা বোধহয় তার বাবা মা এখনো বুঝতে চায় না। সমতল থেকে অনেক নেমে যাওয়া ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলো দেখতে থাকে কৃষ্টি। জানলায় ফেরার দিন ছাড়িয়ে আধভাঙা দৃশ্য গুলো চলে যাচ্ছে। কিছুটা উপর দিকে চলে আসা বিষন্ন গাছ গুলো রোদে মেতে উঠছে। হাওয়া দিলে ঝরা পাতা গুলো কেমন এঁকেবেঁকে পড়ে সে পুরো ফাগুন দেখেছে। ফুরফুরে নীল জমা মেঘ যেন দলবেঁধে স্কুল যায়। অলীক কল্পনায় ডুবে থাকতেই ভালবাসে কৃষ্টি। সেভাবেই তার ঘুম ভরে ওঠে। মাথার পাশে বয়ে যায় অসংখ্য নদী। ভূগোলটা সে নিজের মতোই বেঁধেছে। জানলা থেকে সে গোটা বিশ্ব দেখতে পায়। কাশ্মীরের সাদা শীত সে গায়ে মাখতে পারে এই ঘরে বসেই। একা একা থাকতে গিয়ে পশ্চিম পাতায় সে দেখতে পায় চাঁদের হুল্লোড়। আয়নার এই পরিবর্তন কিছু মুহূর্তের জন্য তাকে মুক্তির আনন্দ দেয়। জানলার সামনে একা দেখা আকাশটা অসীম শূন্যতা বেয়ে উড়ে যায় বহুতলী নীল বরাবর। মহাকাশ বিদ্যা নিয়ে পড়তে চায় কৃষ্টি। মহাকাশের সমস্ত রহস্য পান করবে একদিন। গুগলে সে হামেশাই সেই সব আকাশ চড়ে দেখে। গ্রহণের সময় চাঁদ আর সূর্যের চারপাশে যে আলোরেখা ঘুরতে থাকে সেটাই এতো দিন সে করোনা বলে জানতো,ওই রশ্মি তো মানুষকে ঘরে থাকতে বলে না!