চিঠি, যা নরম ছিলনা, মাংস ছিলনা.. : স্বপন রায়

চিঠি, যা নরম ছিলনা, মাংস ছিলনা..

চতুর্থ পর্ব

[দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) শুধু যুদ্ধ ছিলনা। মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধও সংঘটিত হয়েছিল নাৎসি পার্টির নেতৃত্বে। হিটলারের ‘ন্যাশনাল সোশালিজম’ খাঁটি আর্য রক্তের বাইরের সবাইকে চিহ্নিত করেছিল হীন জাতি হিসেব। প্রথমে আক্রান্ত হয়েছিল ইহুদিরা। তারপর কমিউনিস্টরা। সোশালিস্টরা তারপর। ডেমোক্র্যাট , লিবারেল একে একে সবাই। পোল্যাণ্ড আক্রমণের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর ইওরোপ জুড়ে ইহুদি নিধন যজ্ঞ। প্রায় ছয় লক্ষাধিক ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে লক্ষাধিককে মেরে ফেলা হয়েছিল গ্যাস চেম্বারে। সরাসরি হত্যা করা হয়েছিল তিন লক্ষাধিক সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা দুনিয়ায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক কোটি মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ইওরোপ এবং এশিয়ার বহুদেশ। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল দুনিয়া জুড়েই। আর এরফলে মারা গিয়েছিল আরো কয়েক লক্ষ মানুষ। এরপরেও যুদ্ধ থামেনি। হত্যালীলা চলেছেই। আমাদের দেশেও যুদ্ধবিলাসী লোকের অভাব নেই। যাইহোক, যুদ্ধ তো কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। ব্যক্তিমানুষ, যতই অরাজনৈতিক বা নিরপেক্ষ হোক না কেন, যুদ্ধ তাকেও ছাড়েনা। তার ব্যক্তিজীবন, সাংসারিক জীবনে গভীর ছাপ ফেলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা চূড়ান্তভাবে হয়েছিল। এই লেখাটা ওই যুদ্ধে নিয়োজিত দু’ জন কাল্পনিক কবিকে নিয়ে , একজন জার্মানির আরেকজন সোভিয়েত । একজন কবি যখন তার প্রেমিকা বা বন্ধুকে চিঠি লিখতো, কী থাকতো সেই চিঠিগুলোয়? এরকম কিছু চিঠির নমুনা আছে ইন্টারনেটে। তবে সেগুলো চিঠিই, কবিতা নয়। আমি একটু গভীরে গিয়ে ভেবেছি একজন তরুন কবির প্রতিক্রিয়াগুলো। আর লেখার চেষ্টা করেছি তাদের কাল্পনিক প্রেমিকা আর বন্ধুর সংগে, তাদেরই বয়ানে চিঠি আর কবিতার আদানপ্রদান । হ্যাঁ, পুরোটাই আমার বানানো। তবে যুদ্ধটা নয়। যেদিন আমরা বুঝতে পারবো যুদ্ধ কাদের বানানো সেদিন সারা দুনিয়ায় আর যুদ্ধ হবেনা।]

কাল্পনিক চরিত্রলিপি:

স্কোল ফিশার কবি। জার্মান যুবক। প্যানৎজার ডিভিশন-৬ এর সদস্য। এই ডিভিশন পোল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্সে যুদ্ধ করার পর ১৯৪১-১৯৪৫ অবধি ‘ইষ্টার্ণ ফ্রন্টে’ নিযুক্ত হয়। এই গোটা ডিভিশন যখন স্তালিনগ্রাদে ‘রেড আর্মি’র কাছে ঘেরাও হয়ে পড়ে ‘হিটলার’ এই বাহিনীর প্রধান ‘ফ্রেডরিখ উইলহেলম এর্নেস্ট পাউলাস’কে আত্মসমর্পন করার নির্দেশ না দিয়ে লড়াই জারী রাখতে বলে। ‘পাউলাস’কে ফিল্ড মার্শাল করে দিয়ে অপ্রত্যক্ষভাবে বলা হয় আমৃত্যু লড়াই করে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে। ‘পাউলাস’ হিটলারের নির্দেশ না শুনেই ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘রেড আর্মি’র কাছে আত্মসমর্পন করেন। আমার কাল্পনিক চরিত্র স্কোল ফিশার এই এই হতভাগ্য ডিভিশনের সদস্য ছিল।

সোফিয়া ওয়াগনার – স্কোল ফিশারের প্রেমিকা।

বেন বেকার – কবি। স্কোল ফিশারের বন্ধু। যুদ্ধের সময় গেস্টাপো বাহিনীতে যোগ দেয় বুদ্ধিজীবি প্রচারক হিসেবে। গেস্টাপোর প্রধান কার্যালয় ছিল ‘নিয়েদেরকির্শনারস্ত্রাবে’ তে। স্ত্রাবে মানে রাস্তা। বেন এখানেই কর্মরত ছিল।

আলেক্সেই ফেদোরভ (আলিওশা) – সোভিয়েত রাশিয়ার সেনাদলের ২৮ নম্বর ডিভিশনের সদস্য। কবি। পলিটিকাল কমিশার, যাদের কাজ ছিল নাৎসি আক্রমণের যাবতীয় ভয়ংকরতার মধ্যে লাল ফৌজের মনোবল অটুট রাখা। হিটলারের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল পলিটিক্যাল কমিশারদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে গন্য না করে ধরা পড়লেই গুলি করে হত্যা করার।
তানিয়া- আলেক্সেই ফেদোরভ-এর প্রেমিকা।

আলেক্সেই ফেদোরভ, আলিওশার  কাল্পনিক চিঠি / কবিতা

তানিয়া,

আজ ১৮ নভেম্বর, নির্দেশ আছে কাল থেকে আমরা জার্মান বাহিনীকে দুটো দলে ভাগ হয়ে ঘিরে ফেলার লড়াই শুরু করবো। রাশিয়ার বিখ্যাত শীতের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। কমরেড স্তালিনের ২২৭ নম্বর নির্দেশ এখন আমাদের জ্বালানি। আমরা তেতে আছি। স্তালিন যে নির্দেশ দিয়েছেন তার শেষ লাইনে রয়েছে, ‘এক পাও পিছনে যাওয়া যাবেনা, কোন জমি নেই আর, স্তালিন।’ ডন নদী। ব্রীজের মুখে সিগারেট ধরালাম। আজ ১৯ নভেম্বর, ১৯৪৩। শুরু হবে একসাথে, অপারেশন ‘ইউরেনাস’ আর ‘মার্স’। দু দিক দিয়ে আক্রমণ করা হবে, এতটা জানি। জেনারেল রোকোসসোভস্কি, মার্শাল জুকভ আর কমরেড স্তালিন বাকিটা জানেন। আজ বাঁচলে কাল আবার লিখবো। কিন্তু এ কদিনের লেখাগুলো আবার তোমায় পাঠালাম। যত্ন করে রেখো, না ফিরলে উড়িয়ে দিও, চিঠিগুলো যেন পাখনা পায় তখন। জার্মানরা আমাদের দেশে এসেছে, আমরা যাইনি।লক্ষ লক্ষ রুশীদের মৃত দেহ পেরিয়ে এই নাৎসি বর্বরের দল স্তালিনগ্রাদে এসেছে, এবার শোধ নেওয়ার পালা। কাল থেকে ওদের প্রতিটি ধর্ষণ, লুঠ, আর হত্যার হিসেব চোকাতে হবে। যদি বেঁচে থাকি, লেখায় লেখায় আমরা কথা বলে যাবো। যাবোই।

ইতি, তোমার আলিওশা, আলেক্সেই ফেদোরভ

…..

কবিতা

….

শাদা, ফিনফিনে শাদা
যুদ্ধ আর লাল নয়, শাদা
আমি খ্যাপাটে তুষারের মধ্যে
আমি বেঁচে আছি
তোমার শাদা রঙের গাউন, সেই বিয়ের জন্য বানানো গাউনটা জড়িয়ে

…..

সাইরেনের শব্দে ভোল্গাও কাঁপলো, ভোল্গা আমার মা বলতেন, আমি
আর আমি বলতাম, মা

……..

স্নাইপারদের জানলা, গর্ত, দরজার ফাঁক আছে
এটাই ঠিকানা
জানলা, গর্ত, দরজার ফাঁক এই ঠিকানায়
ফুল যা, তানিয়াও তাই
একটা বুলেট
একবারই নক্‌ করে
চিঠি হয়ে
জানলা, গর্ত, দরজার ফাঁকে, ওই একবারই
ফেরেনা কিন্তু!

তানিয়া,
আজ ২৪ নভেম্বর, ১৯৪৩। ‘ডন’ নদীতে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে। তানিয়া, বেঁচে আছি আমি আর দেখতে পাচ্ছি আমাদের হাতে আটকে পড়া জার্মান বাহিনীর দুর্দশা। রাশিয়ার এই শীত আমাদের সহায়ক হয়ে উঠল। রণকৌশল ঠিক থাকলে আর ঠাণ্ডা মাথায় তাকে প্রয়োগ করলে এমন সাফল্য আসতে থাকবে। তানিয়া আমরা দুটো দিক দিয়ে আক্রমণ করে জার্মানীর প্রায় তিন লক্ষ সৈনিককে ঘিরে ফেলেছি। কোনও বাধা মানিনি। আমি বেঁচে আছি ঠিক কথা, তবে মরেও যেতে পারতাম। হাজার হাজার লাল ফৌজের সেনা এই চারদিনে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু থামানো যায়নি আমাদের। আজ এই সকালে ডন ছুঁয়ে থাকা ‘কালাচ’-এ আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছি। এখানেই দু দিক থেকে আসা লালফৌজের দুটো অংশ কাল মিলিত হয়েছে। জার্মানদের হার শুরু হল তানিয়া। চারদিকে শাদা তুষার আর মৃতদেহ। পাশাপাশি শুয়ে আছে সোভিয়েত আর জার্মান সেনারা। তুষারে জমাট রক্ত। কারো পা নেই, হাত উড়ে গেছে। পাকস্থলী বেরিয়ে আছে কারো। কারো বা মাথার খুলি বিদীর্ণ। যুদ্ধ, এত অমানবিক আর এসবই একজন উদ্ধত উন্মাদ জাত্যাভিমানীর অবদান। তুমি জানো, তার নাম। আমরা সবাই জানি। যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে ততদিন ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হবে হিটলারের নাম। আর এসবেরই ভেতরে আমি বিধ্বস্ত অবস্থায় লেখা চালিয়ে গিয়েছি, তোমার জন্য। তুমি আমার চিঠি পাবে, খুশি হবে, ভাববে আমায়, তানিয়া এর চেয়ে সুখের আর কী আছে?

তোমার, আলিওশা

……..

তানিয়া,
যুদ্ধের আগে দুটো নদীর জল থেকে নিয়ে হিমের পরশ আমরা রেললাইনে ছড়িয়ে দিতাম। ভোল্গা আর ডন। তোমার স্কার্টে নিঝুম বাদামের রঙ আর দেদার ডানা মেলা আস্কারা। সবই যুদ্ধের আগে। হিটলার চাইছে ককেশিয়ার দখল নিতে। বাকু’র তেলের খনি তার চাই। জার্মান সেনাদের একটা অংশ ককেশিয়ার দিকে যাচ্ছে। ওদের স্তালিনগ্রাদও চাই। তাহলে ককেশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হাতের মুঠোয় এসে যাবে। স্তালিনগ্রাদের শিল্প তালুক ককেশিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে। ওরা চাইছে আমাদের অর্থনীতির দখল নিতে।স্তালিনগ্রাদ আমাদের শিল্প শহর। ‘রেড অক্টোবর’ ইস্পাত কারখানা, ‘ব্যারিকেডি আর্মস ফ্যাক্টরি, ‘স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর ফ্যাক্টরি’ সবইতো এখানে। জার্মান বোমায় সবকিছুই এখন ধ্বংসস্তূপ।  তানিয়া, একজন উন্মাদ নেতা সারা দুনিয়ার দখল নিতে গিয়ে শুধু আমাদের নয় জার্মানীরও সর্বনাশ করে ছাড়বে দেখে নিও। হিটলার জানেই না যে ককেশিয়ার সংগে আমাদের যোগাযোগ শুধু রাস্তাবাহিত নয়। সাহিত্য, সঙ্গীত আর খাওয়া দাওয়াতেও ককেশিয়া আর স্তালিনগ্রাদ জড়িয়ে আছে। তানিয়া, মুভি বা অপেরা দেখে ফেরার পথে আমরা ককেশিয়ান ‘সালগুনি’ আর গরম ‘খাচাপুরী’ রুটি খেতাম, তারপর কফি। দিনগুলো, হায়! এই যুদ্ধটা যদি শেষ করতে পারি, আমি আর তুমি হানিমুনে ককেশিয়ান পাহাড়ে যাবো। আর গেয়ে উঠবো ককেশিয়ান লোকগীতি:

‘এই হল ককেশিয়া
পাহাড়িয়া
রোদ আদুরে
শিক কাবাব আর হালওয়া
ককেশিয়া ককেশিয়া..’

এই গান অবধি বেঁচে থাকা যাক, কী বলো?

তোমার, আলিওশা। ২৫ নভেম্বর,১৯৪৩

পুনঃ লিখছি কিন্তু। এই লিখে যাওয়াটাই আমার যুদ্ধ, জিততে হবেই আমাদের। গতকাল আমি আমার প্রিয়বন্ধুকে হারিয়েছি। সাশা। তুমি দেখেছ ওকে। লম্বা। একহারা। সব সময় হাসতো। একর্ডিয়ন বাজাতো। সাশা নেই তানিয়া।  তোমার জন্য  ওকেও কিছুটা দিলাম এখানে:

১.

আমি নদীর পার ধরে আছি, শুনছি চ্ছলাৎ চ্ছলাৎ
মনে হয়নি জল আমাদের চোখেও
মনে হল যখন
সাশা খসে পড়ল, আমাদের গর্তে
একটা বুলেট
ওর বুক পকেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা রক্ত
সেই রক্তে আমার চোখের জল
বন্ধুত্ব!

২.

রাত বাড়ছে
সাশা ভারী হচ্ছে
সহ্য করছে পৃথিবী

৩.

আমি একটা স্কুলের বারান্দায়
সাশাও
দু সপ্তাহ আগে স্কুলটা উড়ে গেছে
আজ সাশা..

৪.

আমি সাশার আঙুল থেকে ট্রিগার খুলে নিলাম
মৃত সাশা
মৃত আঙুল
জ্যান্ত ট্রিগার, যুদ্ধ এরকমই

৫.

সাশা আমার বন্ধু

……

….

..

.

ছিল…

……………

স্কোল ফিশারের শেষ চিঠি:

 

সোফিয়া,
আর তোমার সংগে দেখা হবেনা। লাল ফৌজ আমাদের ঘিরে ফেলেছে, আমরা এখন বিচ্ছিন্ন। জার্মানী থেকে বারোশো মাইল দূরে বিধ্বস্ত স্তালিনগ্রাদে পুরো ছ’নম্বর বাহিনী অনিবার্য মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। সোফিয়া, এর জন্য আমরাই দায়ী। একজন জাতিবিদ্বেষী একনায়ককে আমরা জার্মানরা বেছে নিয়েছিলাম। আর সে, লক্ষ লক্ষ জার্মান ইহুদীদের পুড়িয়ে মেরেছে, খতম করেছে নাৎসি বিরোধীদের নির্মম ভাবে, আক্রান্ত দেশগুলোয় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ করা হয়েছে। যুদ্ধবন্দীদের ‘জেনেভা কনভেনশনে’র তোয়াক্কা না করে চরম অত্যাচার আর খুন করা হয়েছে। সোফিয়া, এতো আমাদেরই নির্বাচন, আমাদের! আমার বাবা আমায় জোর করে নাৎসি পার্টির সভ্য করেছিল। তাঁর বিশ্বাস ছিল জার্মানির যে সম্মানহানি হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিরাই সেই সম্মান আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে।যেদিন আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম, বাবার আনন্দ দেখে কে? মা কিন্তু কাঁদছিল। আমার দুই মামা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল। বাবা মা’কে বলল, তোমার ছেলে দেশের জন্য লড়তে যাচ্ছে। তোমার গর্বিত হওয়া উচিৎ! মা গর্বিত না হয়ে কেঁদেই চলল। জার্মানির ঘরে ঘরে তখন হিটলার পূজিত হচ্ছে। ‘হেইল হিটলার!’ উচ্চারিত হচ্ছে গর্বের সঙ্গে। জার্মানির মানুষ, নাৎসিদের ইহুদি-নিপীড়ন, কমিউনিষ্ট দমন নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজী ছিলনা। তাদের একমাত্র পছন্দ তখন হিটলার। আর  তার ফল আমরা এখন পাচ্ছি। যতক্ষণ জিতছিলাম ততক্ষণ সব কিছুই ঠিক ছিল। ‘গোয়েবেলস’-এর অবিরাম মিথ্যা প্রচারের অভিনব পুরো জার্মানি প্রভাবিত ছিল, আমরাও ছিলাম। এখন স্তালিনগ্রাদে হারের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের বাহিনীর একজনও আর ‘গোয়েবেলস’-এর মিথ্যে প্রচারে কান দিতে রাজী নয়। এখনো সে আর তার দলবল আমাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা প্রচার করে যাচ্ছে আর ছেড়ে দিয়েছে  সোভিয়েত বাহিনীর হাতে। হিটলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদের জন্য কোন সাহায্যকারী বাহিনী পাঠানো হবেনা। সাহায্য নাকি আসবে ‘লুফৎওয়াফা’র বিমানে, আকাশ পথে! মাথামোটা, হামবাগ এয়ার চিফ মার্শাল ‘গোয়েরিং’ বলেছে সে আকাশপথে খাদ্য, ওষুধপত্র, পাঠাতে সক্ষম। প্রতিদিন সাতশো টন সামগ্রী লাগবে। প্রথম দিন এল একশো সাতাশ টন। দ্বিতীয় দিন আরো কম। তৃতীয়তে আরো। লালফৌজ যে দুটো বিমান অবতরণ ক্ষেত্র ছিল, সে দুটোরও দখল নিয়ে নিয়েছে। খাদ্য নেই, জল, নেই, চিকিৎসা নেই। টাইফাস, ডায়েরিয়া, অপুষ্টিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে বিখ্যাত ৬ নম্বর বাহিনী। আর এর মধ্যেই লড়াই চলছে। আজ শুনলাম, আমাদের বাহিনীর প্রধান পাউলাসকে হিটলার ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদে উন্নীত করে আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যেতে বলবে। পাউলাস কী করবে জানিনা। আমি আর পারছি না, সোফিয়া। যদি সত্যিই হিটলারকে সামনে পেতাম, আমার রাইফেলের সব কটা বুলেট ওর বুকে নামিয়ে দিতাম। সোফিয়া, ভাল থেকো। আমি আর লিখতে পারছি না। এই মাইল মাইল ধরে পড়ে থাকা মৃত্যু আমার লেখা কেড়ে নিয়েছে। বিদায়!

তোমার, স্কোল ফিশার। সকাল-১০টা, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩

…….

আলেক্সেই ফেদোরভ, আলিওশা’র  কাল্পনিক চিঠি / কবিতা

তানিয়া,
আজ ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩। আজ জার্মানরা আত্মসমর্পণ করবে। আমরা স্তালিনগ্রাদে জিতেছি তানিয়া। সকাল থেকে কোন গোলাগুলির আওয়াজ নেই। স্তালিনগ্রাদ ধ্বংসস্তুপ এখন।খোলা আকাশের নিচে বহুদিন পরে মাথার হেলমেট নামালাম। আমি আর আমার কয়েকজন কমরেড এবার যাবো মৃতদেহগুলোকে কবর দিতে। তানিয়া, আমি নিজে একজন জার্মান সেনাকেও কবর দেবো আজ। অদ্ভুত ঘটনা, জানো! গতকাল বিকেলে প্রবল গোলাগুলি চলছিল। আমরাই আক্রমণ করছিলাম। যাইহোক বেশ কিছুক্ষণ পর জার্মান শিবির থেকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা সাবধানে আমাদের হাইড-আউট থেকে বেরিয়ে এলাম খোলা চত্বরটায়। বেশ কিছু জার্মান সেনার মৃতদেহ পড়ে আছে।কিছুটা এগোবার পরে আমি দেখলাম একজন যন্ত্রনাকাতর জার্মান সেনা আমায় ডাকছে। আমি এগিয়ে গেলাম। ও আমায় ওর পাশে বসতে বলল ঈশারায়। জিগগেস করল, সিগারেট আছে কিনা। আমি এগিয়ে দিলাম, ওর বাঁ পা উড়ে গেছে। মুখ রক্তাক্ত। আমি ওর পাশে বসে সিগারেট এগিয়ে দিলাম। বুঝতে পারছিলাম ও বাঁচবে না।। ও আমায় ওর পার্স আর একটা ব্যাগ , যা ওর পিঠে ছিল , নিতে বলল। আমি সিগারেট ধরলাম ওর মুখে। ও টান দেয়ার চেষ্টা করল। ঈশারায় বলল পার্সটা খুলতে। খুলে দেখলাম একটি একুশ বা বাইশ বছরের মেয়ের ছবি, পেছনে নাম, ঠিকানা। ও আপ্রাণ চেষ্টায় বোঝাতে চাইছিল আমি যেন এই পার্স আর ওই ব্যাগটা এই ঠিকানায় পৌঁছে দিই। আমি আর কী বলতাম! তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সেই আলোয় আমি ওকে বললাম, দেবো, যদি বেঁচে থাকি। ও আরেকটা টান দেয়ার চেষ্টা করল, একটু হাসল, তারপর মরে গেল। তানিয়া,  আজ সকালে আমি আমাদের ইউনিটের জার্মান ভাষা জানা একজন কমরেডকে দিলাম ওই ঠিকানা আর ব্যাগের একতাড়া কাগজের পাঠোদ্ধার করার জন্য। সেই কমরেড জানালো, মৃত সৈনিকের নাম, স্কোল ফিশার। বয়স ছাব্বিশ। ঠিকানাটা বার্লিনের। আর ওই একতাড়া কাগজে রয়েছে স্কোলের লেখা কবিতা, যা সে তার প্রেমিকা সোফিয়াকে পাঠাতো। আমি ওই কাগজগুলো হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম, একজন কবি! অথচ এসব জানার আগেই আমি কাল মাঝরাতে এই  লাইনগুলো লিখেছিলাম:

‘কাল একটা জার্মান, কপালে গুলি, মরবে এক্ষুনি। আমি সিগারেট খাচ্ছিলাম। ও সিগারেট চাইল। দিলাম। মুখে। টানলো। মরে গেল।

সিগারেট মৃত্যুর কারণ কেন বুঝতে পারলাম।’

আজ আমি এই জার্মান তরুন কবিকে কবর দেবো। চারদিকে তুষার। তাপমান মাইনাস দশ। মৃতদেহ অবিকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। আমি ওর পাঠাতে না পারা  চিঠি আর কবিতাগুলো সেই কমরেডকে দিয়ে পড়িয়েছি তানিয়া। স্কোল ফিশার তার প্রেমিকা সোফিয়া আর কবিবন্ধু বেন’কে যেগুলো লিখেছে কিন্তু স্তালিনগ্রাদে আটকে পড়ায় আর পাঠাতে পারেনি জার্মান তরুনদের হিটলার কিভাবে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে বলি দিয়েছিল স্কোলের চিঠি পড়লে বোঝা যায়। শেষের চিঠিগুলোয় বিশ্বাস আর স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার, আমিও পড়তে পড়তে এই জার্মান তরুনের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছিলাম। স্কোল একজায়গায় লিখেছে, ‘ঘৃণা আমার নিশ্বাসে ছিল, শেষ নিশ্বাস ঘনিয়ে আসার আগে বুঝতে পারছি, ভালবাসাই সব, সে আমায় ডাকছে সোফিয়া, আমার দম নেই আর।’ তানিয়া, আমিও জানিনা আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা! আমি সৈনিক। মাতৃভূমির জন্য আরো অনেক লড়াই আমার সামনে, তোমার সামনেও। যদি দেখা হয় আমাদের, যদি বেঁচে থাকি, আমরাও এই পুরনো ভালবাসার গল্পগুলোই আমাদের পরের প্রজন্মকে নতুন করে শোনাবো। তাদের বলবো, ভালবাসো। মনে রেখো বাচ্চারা, যে কোনও সময়েই এক হাজার বছরের ঘৃণা মুছে দিতে পারে এক মুহূর্তের অমল ভালবাসা।

স্কোল’কে কবর দিয়ে ফিরে এসে তোমার জন্য এই লাইনগুলো লিখলাম তানিয়া:

‘তানিয়া, ফুল কোনও বিকল্প নয়, বিকল্প একটা বাজে শব্দ
যা ফুলের হয়না, তোমারও তো হয়না
যুদ্ধে এটাই আমার শান্তিপ্রস্তাব
ফুল
আর তুমি ফুটে উঠবে, আমরা পতাকা হেলিয়ে মার্চ করে যাবো…’

……….

যুদ্ধ মর্মান্তিক হয়। আমি কিছু চরিত্র বানিয়ে তাদের চিঠি, কবিতা ইত্যাদিও আমার বকলমে লিখে দিলাম। তবে আলেক্সেই ফেদোরভের (আলিওশা) সঙ্গে তানিয়ার দেখা হবে কিনা, আমি জানিনা। এই অংশটাও আমি বানিয়ে লিখতে পারতাম। পারিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে মারা গিয়েছিল প্রায় পঁচিশ লক্ষ মানুষ। আলিওশা আর তানিয়ার একটা মিলনান্তক দৃশ্য বানিয়ে কিছু কবিতা দিয়ে ‘মেলোড্রামা’ তৈরি করতে পারতাম।কিন্তু যুদ্ধ কখনোই মিলনান্তক হয় না। দু’জন ব্যক্তি মানুষ শেষ দৃশ্যে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেও হয় না। অজস্র মৃতদেহ আর ধ্বংসের গন্ধ থেকে যায়। হাহাকার আর অশ্রু শকুনের ডানা হয়ে স্থির অচঞ্চলতায় ভেসে বেড়াতে থাকে। পাঠক, শেষটা আপনারাই ঠিক করুন। এই পৃথিবী থাকবে কি থাকবে না, ঠিক করুন আপনারা।


(সমাপ্ত)

Facebook Comments

Leave a Reply