নকশালদের শেলটার মাস্টার – কিছু খণ্ড স্মৃতি : সুশীল কুমার ঘোষ
নকশালদের শেলটার মাস্টার – কিছু খণ্ড স্মৃতি
চারু মজুমদার ডাক দিয়েছিলেন, “সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন।” কিন্তু সে বিপ্লব হয়নি। সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষক জনগণের মুক্তির মহাকাব্য এখনও অধরাই রয়ে গেছে। কিন্তু সেই অধরা মহাকাব্যের কিছু মহাকাব্যিক চরিত্র এবং মুহূর্ত আজও মানুষের মনে অমলিন থেকে গেছে। তার থেকে তৈরি হয়েছে নানান কাব্য, সাহিত্য, জন্ম নিয়েছে নানান আখ্যান, উপাখ্যান। কমিউনিস্ট বিপ্লবী বা নকশালপন্থীরা স্বপ্নরাজ্য বিচরণকারী মুক্তির দূত হিসাবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়েছেন। এবং সে হওয়ায় কোনো বাড়াবাড়ি নেই। তা হওয়াই তো উচিত ছিল। কতো ত্যাগ, কতো তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁরা বিপ্লবী জীবন যাপন করেছিলেন। কিন্তু সেই যাপনকারীদের সঙ্গে সেদিন জড়িয়ে ছিলেন আরও কিছু মানুষ, যাঁরা বিপ্লবের সেতুবন্ধনে কাঠবিড়ালির ভূমিকাটুকু পালন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁদের কথা সেভাবে আলোচিত হয়নি৷ বিপ্লবীদের ঔজ্জ্বল্যে ঢেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। আসলে, তাঁরা বড়ই সাধারণ। আমারই মতো মধ্যবিত্ত। সামান্য শেলটার মাস্টার।
বর্তমানে আমি অশীতিপর। কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি তখন আমি যুবক। অনেককাল আগের সেসব কথা, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হয়ে ‘ফুটওয়্যার সার্টিফিকেট’ কোর্স করেছিলাম। তার জোরেই চাকরি পাই, হয়ে যাই কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। বাংলার বাইরে যখন নকশাল আন্দোলনের প্রসার ঘটা শুরু হয়েছে, তখন, মানে ষাটের দশকের শেষে, জুনিয়র অফিসার হিসাবে আমি উত্তর প্রদেশের আগ্রায় পোস্টেড ছিলাম। মাইনে ছিল পাঁচশ টাকা। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা ছিলনা আমার। একটা ঘর ভারা করে থাকতাম, বাইরে খেতাম।
এমনই একদিন আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের একটা ধাবায় খাচ্ছি, রাত সাড়ে-নটা কী দশটা হবে, আলাপ হল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পাঠরত এক ছাত্রের সঙ্গে। বাঙালি। নাম – সুবোধ মিত্র। সুবোধ ইউনিভার্সিটি হোস্টেলের বাসিন্দা। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। পরে ও যখন সমাজতত্ত্বে এম.এ. পাশ করে, তখন পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ওর নাম স্বর্ণপদক বিজয়ী হিসাবে এনলিস্টেড হয়। কিন্তু ততদিনে ওর মাথার দাম পনেরো হাজার টাকা হয়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ তা আটকে রাখে। সুবোধও অবশ্য কনভোকেশনে আসার চেষ্টা করেনি। তবে সেই সময়টা ও কুলি বস্তি, কৃষকদের বাড়ি, এবং আমার ও সুত্রধর বাবুর বাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে থাকত। আচার্য বৌদি বলে একজন ছিলেন। তিনিও ওকে খুব স্নেহ করতেন।
তা এহেন সুবোধ মিত্রের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই বেশ ভালো লেগে গেল। দেরি হল না বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে। আসলে, ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগত। কথায় যুক্তি থাকত, থাকত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। একজন পাকা সংগঠক হওয়ার কারণে কথার জাল বুনে মানুষের কাছে যাওয়ার কৌশল ওর ভালোই জানা ছিল।
পশ্চিমবঙ্গে তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল! আমি অবশ্য অজয় মুখার্জী আর জ্যোতি বসু ছাড়া তেমন কিছুই বুঝিনা। একেবারেই যাকে বলে খালি হাঁড়ি। কিন্তু সেই খালি হাড়িতেই বয়সে ছোট সুবোধ আস্তে আস্তে সাম্যবাদের চাল ভরে রান্না আরম্ভ করলো। অনেক মোটা-পাতলা-চটি বই পড়তে দিয়ে মাস্টারের মতো প্রশ্ন করতো।
মাঝে মধ্যেই সুবোধ সংগঠনের কাজে পাঞ্জাবের ভাটিণ্ডা অথবা দিল্লী এবং আরও কোনো কোনো জায়গায় পারি জমাতো। কিন্তু আগ্রায় ফিরেই দেখা করতো। অফিস থেকে দু-তিন দিন ছুটি পেলেই আমাকে পাশের গ্রামে যেতে বলতো। আমিও চলে যেতাম। গ্রাম ভালোই লাগত। সেখানকার সোজা-সরল জেদি মানুষগুলোর মনে প্রশাসন এবং প্রধানের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকলেও ভয়ে এবং কিছু পাওয়ার লোভে তারা মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারতো না, চাইতও না। কখনো-সখনো খুব ঘনিষ্ঠ কারো কাছে নিজের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করতো, রাগে ফেটে পড়তো। কিন্তু ওইটুকই।
তবে অতি-দরিদ্র এবং দলিতরা, যাদের প্রাণ ছাড়া হারাবার আর কিছুই ছিল না, তারা মাঝে মাঝে মাথা চাগিয়ে উঠে দাঁড়াবার নিষ্ফল প্রয়াস করতো, যেমন তারা আগেও করেছে, এখনও করে চলেছে। হাতে নাতে ফলও পায় যদিও! প্রাণ হারায়, গ্রাম ছেড়ে পালাতে হয়, মিথ্যা মামলায় জেলে যেতে হয়… আরও কতো কী!
আগ্রার চারদিকে অনেক দূর দূর পর্যন্ত ডাকাতদের বিরাট প্রভাব ছিল। সে সময় যারাই একটু শিক্ষার আলো দেখত, তারা আর গ্রামে থাকতে চাইত না। কিছু যুবক আবার ডাকাত দলে যোগ দিত। কোনো কোনো গ্রামে দেখতাম মুখিয়াও ডাকাত! কিন্তু সাংগঠনিক কাজের সূত্রে সুবোধের এই ডাকাতদের সাথেও যোগাযোগ ছিল! একজন তো ওর কাছে প্রায় নিয়মিতই আসতো।
জাত-পাত, ধর্ম এবং কুসংস্কারের এক শক্ত জালে গ্রামগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতো। সেই জাল কেটে সাধারণ মানুষের পক্ষে বেরোনো সহজ ছিল না, আর তাই সাম্যবাদের ধারাবাহিক চিন্তা-ভাবনা সেই সব গ্রাম থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতো। আজও অবস্থা খুব কিছু পাল্টেছে বলে মনে হয় না। হয়তো কিছু আবরণগত পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু মৌলিক জায়গাগুলো আজও একই রয়ে গেছে।
কিন্তু মজা হল, এত অত্যাচার, এত নিপীড়ন সত্ত্বেও ভারতের সব গ্রামের মতো এই গ্রামগুলোতেও ভোটের চেহারা প্রায় এক ছিল। গ্রামের মহিলারা, যুবক-যুবতীরা ভোট উৎসব ভীষণভাবে উপভোগ করতো, এবং এর রেশ থাকত অনেক দিন।
ততদিনে আমি বিপ্লবের ভাষা একটু-আধটু বুঝতে শিখেছি। সুবোধও বুঝেছে আমি ক্রমে ক্রমে শিক্ষিত হয়ে উঠেছি রাজনৈতিক বিষয়ে। তাই মাঝে মাঝে অনেক রাতে অনেকের সঙ্গে স্টুডেন্ট হোস্টেলে আলোচনায় আমায় নিয়ে যোগ দিতে শুরু করে ও। মাঝেমাঝে বিশেষ কোনো প্রফেসরের বাড়িতে আমায় নিয়ে আলাপও করিয়ে দিত। হঠাৎ একদিন অসিত সেনকে আমার কাছে নিয়ে এলো। আমার ভারা বাড়িটা ছিল বড় রাস্তার পাশের গলিতে, মূল বাড়ির পেছনে, যাকে বলে গোপন আলোচনার আদর্শ স্থান। অসিতবাবু তিনদিন থেকে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অনেকানেক ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করলেন। বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমায় সমষ্টিগত গণআলোচনা করতে বলে গেলেন।
ফিরে গিয়ে আমার অফিসের ঠিকানায় অনেক বই পাঠিয়েছিলেন। পোস্টম্যানের ইশারায় সেই পার্সেল আমি ছাড়াইনি। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। সরকারি অফিসের ঠিকানায় কোনো রাজনৈতিক বই পাঠান কি আদৌ উচিৎ? এটা আদ্যন্তে একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছি। এতে করে শুধু যে আমার মতো একজন সরকারি চাকুরে বিপদে পড়ত তাই নয়, অসিতবাবুরাও এক নির্ভরযোগ্য শেল্টার হারাতেন। এই সামান্য বিষয়গুলো ওঁরা কেন যে সেদিন বোঝেননি তা আমার মাথায় ঢোকেনি।
কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য সংস্থা কর্তৃপক্ষ সব জানতে পারে এবং আমায় কাছে লিখিত ডিক্লারেশন চায় যে আমি নকশাল পার্টির সঙ্গে যুক্ত নই। আমি এর তীব্র আপত্তি জানাই। পরে অফিসের সবাইকে একটা ফর্মে লিখিতভাবে জানাতে হয় যে সে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে কোনো প্রকারে জড়িত নয়।
১৯৭১এর জানুয়ারিতে আমি আর সুবোধ কলকাতায় আসি। একসঙ্গেই আসি। আমার অফিসের কিছু কাজ ছিল। সুবোধ যাচ্ছিল কলকাতা। সেখান থেকেই সম্ভবত বোলপুর হয়ে নিজের গ্রামে যেত। ওই সময় ও আমাকে আমার বাড়ির এলাকা অর্থাৎ যাদবপুরে আশু মানে আশু মজুমদারের প্রতিকুল পরিস্থিতির ব্যাপারে সচেতন করে। আমিও ঠিক করি বাড়ি ফিরে আশুর সঙ্গে দেখা করবো।
সেদিন ট্রেনে এক্ষেত্রেই উঠেছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল দুটো ট্রাঙ্ক। অজস্র রাজনৈতিক বই ছিল তাতে। আমার ট্রাঙ্কের উপরের দিকে একটা আগ্রাই গালিচা ছিল, তার নিচে ছিল বেশ কয়েক প্যাকেট উৎকৃষ্ট বাসমতী চাল। সুবোধের ব্যাগে শুধুই বই ছিল।
সুবোধের মাথার দাম ছিল। ফলে পুলিশ লেগেই থাকতো। সেদিনও কোনোভাবে খবর হয়ে গেছিল যে ট্রেনে নকশালরা রয়েছে। আকস্মিকভাবেই বর্ধমানে গাড়ি খানাতল্লাশি হয়েছিল। পুলিশ এলে নিজের পরিচয় দিয়ে বলি যে দুটো ট্রাঙ্কই আমার, এবং সার্চ করার জন্য চাবি দিয়ে দিই। পুলিশ গালিচা আর চাল দেখে রেহাই দেয়। এই সময় সুবোধ আমার পাশে ছিল না, গাড়ি ছাড়লে তবে ওকে দেখতে পাই। এই ব্যাপারটাও, বলা বাহুল্য, আমি ভালভাবে নিইনি। বিপদের সময় নিজের কমরেডকে ছেড়ে যাওয়া কি ওর উচিত হয়েছিল?
কলকাতায় ফিরে অফিসের কাজ মিটলে একদিন আমি আশুদের বাড়িতে যাই। আশুর মা, দুই দাদার সঙ্গে অনেকের মতো আমারও আলাপ ছিল। সেদিন অসুস্থ মাসিমাকে দেখতে গিছিলাম। মাসিমার গা তখন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। আমাকে বললেন, “আশুটা বাঁচবে না রে সুশীল। ওর গায়ে আমার চোখ লেগেছে। কেমন কালো মোষের মতো দেখতে হয়েছে দেখিসনি!” সত্যি বলতে কি, রোগা আশুর চেহারা তখন কিছুটা ভালো হয়েছিল। টানা টানা চোখে সুন্দর দেখতে লাগত।
যাইহোক, অনেক চেষ্টার পর দুদিনের মাথায় আশুর সঙ্গেও দেখা হয় আমার। ও যে চারদিক দিয়ে বন্ধুবেশী শত্রু দিয়ে ঘেরা সেটা বোঝাবার চেষ্টা করি কারণ সেই লুম্পেনগুলোর অনেককেই আমি চিনতাম। ওকে আমি রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, তাই সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবও দিই। কিন্তু আশু ওঁর ছেলেদের ছেড়ে যেতে রাজি ছিল না। মরতে হলে সবার সঙ্গে মরবে এই বলে আমায় বিদায় দেয় সেদিন।
এর দিন দুয়েক পর, ভোরের দিকে, হঠাৎই ২০-২২ জন ১৫ কি ১৮ বয়েসের ছেলে আমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দিতে থাকে। আমি তৈরি হয়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রায় সবাই পালায়। পাড়ায় ভালো ফুটবলার এবং বক্সার হিসাবে আমার খ্যাতি ছিল। সম্ভবত সেই কারণেই…। তবে একজন, বিভু, কিন্তু পালায়নি। সে একটা আট ইঞ্চি লম্বা চাকু নিয়ে আমায় আক্রমণ করে এবং আমার সামান্য কিছু কসরতের কারণে সেটা আমার ডান পায়ের তলায় জমা দেয়। চাকুটা তুলে তখন বলি, “এবার কোথায় যাবি?” আমি দেখলাম বিভু ভয়ে কাঁপছে, ঘেমে গেছে। সামনের ডোবায় চাকুটা ছুঁড়ে ফেলে বললাম, “তোর দাদাকে বলিস যে সুশীলদা আমায় ছেড়ে দিয়েছ।” এদিকে এতক্ষণ দাদা চিৎকার করছিল, “তোরা সেম সাইড করিস না।” আসলে, এরা সকলেই আশুর হাতের বাইরে চলে গেছিল।
আমি আর দাঁড়ালাম না। বড়ি ছেড়ে তখনই সালকিয়া চলে গেলাম। রাত বারটায় ৮বি-তে ফিরে দাদার কাছে জানলাম আশু দুঃখ প্রকাশ করেছে। ছেলেটা বোকা। খবরের খোরাক পাঠিয়েছিল।
পরের পরের দিন তুফান ধরে কানপুর হয়ে আগ্রা চলে গেলাম। দিন পনের পর আবার যোগ দিলাম অফিসে। কিছুদিন পর সাদা পোশাকের এক পুলিশ অফিসার আমার অফিসে এসে সরাসরি আমাকে নকশাল বলে অভিযোগ করে থানায় নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্ত কোনো ওয়ারেন্ট দেখাতে না পারায় আমি থানায় যেতে অস্বীকার করলাম। পরে একে-তাকে ধরে পুলিশের ছোঁয়া থেকে বাঁচি।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে, বাসা পাল্টে ছিপিটোলায় চলে আসি। এখানেও সেই বড় রাস্তার পাশের গলি। অনেক বাঙালি পরিবার থাকত। একটা Bengali Schoolও ছিল। তখন আমার ঘর অবারিত দ্বার। সুবোধ তো আসতই। এমনকি রাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, পালিয়ে বেরানো সিপিএম ও সিপিআই(এম-এল) ক্যাডার, এমনকি কংগ্রেস অব্ধি প্রয়োজনে পালা করে ঘুমত। রাজনৈতিক তফাৎ সত্ত্বেও সবাই একে অপরের সঙ্গে ভাইয়ের মতোই ব্যবহার করতো। আসলে, বিদেশে নিয়ম নস্তি।
ছিপিটোলা তথা আগ্রার বাঙালিরা আমাকে এবং সুবোধকে খুবই পছন্দ করতো। সাহায্যও করতো।সুবোধকে সকলে ওখানে “ব্যানার্জী” নামে চিনত। ওই ছিপিটোলার বাসাতেই একবার এক ঘটনা ঘটল। সুবোধকে ঘরে রেখে সামনের দিকে তালা দিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম। হপ্তা খানেক পর দাদা-বৌদির সঙ্গে আগ্রাফোর্ট স্টেশনে নেমে একটা টাঙ্গায় উঠেছি, তা গতি বাড়াতেই দেখি পেছনে এক বাঙালি ভদ্রমহিলা প্রায় ঊর্ধশ্বাসে ছুটে আসছেন। টাঙ্গা দাঁড় করাই। আশ্চর্য হয়ে দেখি আগ্রার আরেক প্রান্তের বালকেশ্বর কলোনি থেকে আচার্য বৌদি ছুটে এসেছেন, পুলিশ আমার ঘর ঘিরে রেখেছে, তাই সতর্ক করতে! আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওরা খবর পেয়েছিল যে তালার আড়ালে সুবোধ ঐ ঘরে বর্তমান। কিন্তু ছিপিটোলার জলের ট্যাঙ্কির কাছে পৌঁছতেই একটা ছেলে বলল, “ব্যানার্জী (সুবোধ) পেছনের পাচিল টপকে স্টেট ব্যঙ্কের দিকে ন্যাড়াকে (লাবপুরের অল্পবয়সী একটা ছেলে) নিয়ে পলিয়েছে। আমি স্বস্তি পেলাম । দাদা-বৈদিকে নিয়ে ঘরের দিকে এগোলাম। নাগ বৌদি নামে এক পড়শি মহিলা বললেন পুলিশ চলে গেছে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
তবে খুব বেশিদিন সুবোধ আর আগ্রায় থাকেনি। ওর সঙ্গে শেষ দেখা আমার শীতকালেই হয়েছিল। সেদিন ও একটা মোটা কম্বল সারা গায়ে জড়িয়ে ধাবায় এসেছিল। আমি খাবার খাচ্ছিলাম। ওর চোখ দেখে চিনতে পারি। সে চোখের এক আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য এবং প্রাণশক্তি ছিল। আজকের সুবোধ মিত্রকে দেখে তা বোঝা যাবে না। দুই পায়ে দুটো দুই রঙের হাওয়াই চটি পরেছিল। আমি আমার চটিটা দিয়ে দিয়েছিলাম। সুবোধ সেটা পরে ডিনার শেষে বেরিয়ে যায়। তারপর আর ওকে দেখিনি। বছর দশ আগে অসীম বাবু (চট্টোপাধ্যায়) মারফত ওর যোগাযোগ পাই। কথা বলি। প্রথমে আমাকে চিনতেই পারেনি। পরে চিনতে পারে। কথা বলে কিছুটা দমেই গিয়েছিলাম। আগের সুবোধ ছিল ইস্পাতের মতো ধারালো, দঢ়। আজকের সুবোধ মিত্র তার প্রেতচ্ছায়াও নয়।
যাইহোক, বাড়ি পালটাবার কিছুদিনের মধ্যেই একটা ফোন এলো আমার। কানপুর থেকে। বক্তব্য – “আশুকে দশ তারিখ (মে ১৯৭১) ভোরে কালিকাপুরে গুলি করা হয়েছে, যাদবপুর থানায় ১১টা কি ১২টায় হত্যা করা হয়েছে।” আমি ভেঙে পড়েছিলাম। ভালো একটা ছেলেকে মেরে ফেলল এভাবে! বরানগর-কাশীপুরের ঘটনা, চারুবাবুর পুলিশের হাতে ধরা পড়া এবং লালবাজারে খুন। কোনো প্রতিবাদ নেই। কোনো আওয়াজ নেই। আজও না। প্রতিদিন তো মরছি আমরা, নাকি? কাটা পড়ার আগে শুয়োরটাও তো তারস্বরে চেঁচায়। কিন্তু আমরা? ভাল লাগে না, এই মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদ।
মন ভালো ছিল না। আবার কলকাতায় ফিরে এসেছিলাম। কাণ্ডও ঘটিয়েছিলাম একখানা! এক ঘুমন্ত মেয়ের দিদির বিয়ের স্বপ্ন ভাঙিয়ে পাঁচদিনের মাথায় তার সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়ে দিয়েছিলাম, এবং তা ওর দিদির মানে আমার বড় শ্যালিকার বিয়ের দিনে। তারপর কিছুদিন সস্ত্রীক আগ্রায় বসবাস, মধ্যে পুলিশী হুজ্জতি বৃদ্ধি, এবং ‘৭২এ কানপুরে বদলি নিয়ে চলে যাওয়া, সেখান থেকে কলকাতা ছুঁয়ে নয়া দিল্লী ও চণ্ডীগড় ঘুরে অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি ছেড়ে ১৯৮৮তে ‘সিটি অব জয়’-এ পাকাপাকিভাবে প্রত্যাবর্তন। বলা যায় পালিয়ে বাঁচা। এই হল আমার মধ্যবিত্তের বিপ্লব। আমি করব জয় একদিন!