কোরোনা ও মানসচিত্র : সোমালী
কোরোনা ও মানসচিত্র
কোভিড-১৯ আমাদের দেশে দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের মত। দুহাজারের কেবল দশ শতাংশ সময়কাল যাপন করেও ইংরেজ বর্তমান ভারতের গঠনে, দেশীয় ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতিতে যেমন সুদৃঢ় ও নিশ্চল ছাপ রেখে গেছে, সেরকমই জীবনকাল যেমনই হোক কোরোনার ফলও সমাজে তেমনই সুদূরবিস্তৃত এবং নিশ্চল হতে চলেছে। ফলে শুধু সমাজবিজ্ঞান নয়, অন্যান্য সমস্ত স্তরে এই সময়ের সুস্পষ্ট শিলাস্তর রয়ে যাবে। তবে সব গোষ্ঠীর মধ্যেই এর প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কথা বলা বোধয় অনুচিত হবে। লকডাউনের মানসিক পরিস্থিতির যদি একটা স্থির-চিত্র দেখা সম্ভব হত, তাতে আশঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা, দোদুল্যমানতা এবং পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী, অনিশ্চয়তা সংক্রান্ত অস্থিরতা, একাকীত্ব, চেতনা ও আবেগের অসাড়তা, শোক প্রকাশের ব্যর্থতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, দিশেহারা মনোভাব এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য দেখা যেত।
বর্তমান অবস্থায় বিত্তপ্রভাব নির্বিশেষে মানসিকভাবে সবচেয়ে সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কাররা (ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা, পুলিশ, ব্যাঙ্কের কর্মীরা), পৃথকীকৃত বয়স্করা, হোম কোয়ারেন্টাইন অথবা আইসোলেশনে চলে যাওয়া বাচ্চা এবং শয্যাশায়ী ব্যক্তিরা। যদিও যেকোনো বয়সের বাচ্চারা, গর্ভবতী মহিলারা, মানসিক ও শারীরিক বিকলাঙ্গতার সাথে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করে চলা মানুষেরাও প্রায় সমান সংকটে রয়েছেন। সমস্যার সময়ে প্রথম স্বতঃসৃত ব্যবহার হল পরিজন ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ, তাদের আশ্বাসবাক্য, সর্বোপরি সামাজিক সুরক্ষার অনুভূতি। এহেন অবস্থায়, যা থেকে পৃথকীকৃত ব্যক্তিরা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। ফলস্বরূপ Geriatric (বয়স্কদের) এবং Childhood (কিশোর ও বাচ্চাদের) Depression ও Anxiety এর পাশাপাশি Panic অস্বাভাবিক নয়। ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের, বিশেষ করে পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে বহুক্ষণ একটানা কাজ করবার ফলে আবেগজনিত অসাড়তা – ‘বার্ন-আউট’ অবস্থার ফলে রাগ, বিরক্তি ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। বর্তমান অবস্থায় তাদের এর মধ্যেও অনবরত কাজ করে যেতে হবে, যা তাদের নিজেদের এবং সমাজের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে।
এর পরবর্তী সংকটজনক অবস্থানে রয়েছেন নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত আর্থসামাজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা। গোটা ভারত এবং বাংলা এই মুহূর্তে কন্টেইনমেন্ট জোনে ভেঙে রয়েছে। যোগাযোগ বিধ্বস্ত, এমনকি যাদের প্রতি মাসে নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন, তাদেরও যাতায়াতের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিত্তের প্রভাব এহেন অবস্থায় বহুলাংশে বিচার্য। প্রতিটি জোনে বিত্ত-প্রভাবে জীবনযাপন পৃথক ফলে যখন একই অঞ্চলের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত অংশের মানুষ কোন সমস্যা ছাড়াই লকডাউন মেনে যাপন করছেন, অপরদিকে বিত্তকাঠামোয় উল্টোদিকে অবস্থানকারী মানুষেরা সঙ্কট জেনেও দশ বাই দশ ফুটের ঘরে ৮ জন থেকেছেন, কেউ কাজ হারিয়েছেন, কেউ ভয় থাকা সত্ত্বেও রেড জোনে মিউনিসিপ্যালিটির গাড়িতে ময়লা আনতে গেছেন, কেউ ঝড়ে ঘর হারিয়ে এখন খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত, কেউ রাস্তায় পড়ে থাকা গাছ কাটার কাজ পেয়েছেন। ব্যক্তিমানস তিনটি ধাপে গুরুতর সমস্যার মোকাবিলা করে, Denial (অস্বীকার), Despair (অসহায়তা) ও Disorganization (বিশৃঙ্খলা) এবং সবশেষে Reorganization (পুনরায় নিজেকে সংগ্রাহিত করা)। যাদের চাকরি চলে গেছে, জমানো টাকা শেষ, মাথা গোজার জায়গা নেই, তাদের পক্ষে এই ধাপের প্রতিটি পার করা বিলাসিতা। অনেক সময় সরাসরি তৃতীয় ধাপে অবতীর্ণ হতে হয়। ফল তৎক্ষণাৎ বোঝা না গেলেও, Stressor বা সমস্যা কেটে যাওয়ার পর বোধগম্য হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। আগে চাকুরীরত মানুষজন সপ্তাহের অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ঘন্টা সময় কার্যক্ষেত্রে কাটাতেন, এছাড়া পাড়ার মোড়ের আড্ডা, খেলার মাঠ ইত্যাদি সামাজিক স্থানে দৈনন্দিন চাপের বাইরে কিছুটা সময় পেতেন। কিন্তু, এখন তার বদলে প্রায় পুরোটা সময়ই বাড়িতে থাকতে হচ্ছে, একসময় এড়িয়ে যাওয়া সমস্যাগুলি এখন কলহের কারণ তৈরি করছে। রিসার্চ বলছে এই লকডাউন চলাকালীন গৃহস্থালি ও পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে এবং বেড়েছে শিশুনিগ্রহের ঘটনাও।
মানসিক সুস্থতার জন্য মৃত্যু পরবর্তী এক সামাজিক প্রথা হল শোকসভার প্রথা। শোকের সামাজিক প্রকাশ বিলাসিতা নয়, বরং এক মানসিক প্রয়োজন, যা থেকে এক বিশাল অংশের মানুষ এই মুহূর্তে বঞ্চিত। শুধুমাত্র যাদের আত্মীয়রা কোরোনার কারণে মারা গেছেন, তারাই নন, স্বাভাবিক মৃত্যুতেও অনেকে পৌঁছতে পারছেন না প্রিয়জনের কাছে। কখনও নিজেরা আইসোলেশনে আছেন, কখনও বা অঞ্চল ‘সিলড’ বলে বেরোনর উপায় নেই। বিদায় বলতে না পারার কষ্ট চিরকালীন, যা মানসিক বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে, নিজেরই অজান্তে ঠেলে দিতে পারে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার দিকে।
সর্বোপরি বাংলায় যোগ হয়েছে ‘আম্ফান’ নামক ঝড়ের লীলারূপ। কোরোনা এবং ‘আম্ফান’ একসাথে আসায় আঞ্চলিক ক্ষয়ক্ষতি, জান-মালের ক্ষতির পাশাপাশি কোরোনার কারণে রাজ্যের যুবা বিচ্ছিন্ন এবং বিপর্যয়-মোকাবিলায় অভিজ্ঞতাহীন। এক অংশ যেমন ‘বার্ন-আউটে’ ভুগবেন, আরেক অংশের তেমন নিয়ন্ত্রণের অভাববোধে মানসিক অস্থিরতা, নিজেকে অযোগ্য মনে করা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। দক্ষিণবঙ্গের বিধ্বস্ত অবস্থায় যতটা সহযোগিতা প্রয়োজন ততটা যুবসমাজ দিতে পারছে কি? সিলড অঞ্চলের শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ তরুণ প্রজন্মের এক অংশ রাজ্যের বা শহরের অপর প্রান্তের সাহায্যে এগিয়ে আসতে গিয়েও, কখনও নিজেরই বিবেকের দ্বারা, কখনও প্রশাসন দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের বলয়ে, বাস্তব থেকে দূরে। তাদের কাছে খবরের মূল মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি, যা সঠিক ও ভুল তথ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ‘Conspiracy Theory’ ও ছড়িয়ে দিচ্ছে ফলে গুজব তৈরি এবং ‘খাওয়া’ হচ্ছে বিপুল পরিমাণে। কিন্তু প্রশ্ন হল মানসিক পদ্ধতি অনুযায়ী দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেকেই অপরাধী ভেবে ফেলবে না তো? সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী অসহায়তা, আশঙ্কা, পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণের অভাব, চাকরি-সংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতায়, দোষারোপ, পরিস্থিতিকে সহজপাচ্য করে তোলে। তার ফলস্বরূপ কোরোনার কারণে অনেকে পূর্বজন্মের পাপকে দোষ দিয়েছেন, কেউ প্রকৃতিকে, কেউ ‘অপর’ দেশকে, কেউ প্রতিবেশীকে, তো কেউ ভিন্ন মতের মানুষকে দোষ দিয়েছেন। কিন্তু যদি, রাজ্যের যুবার আত্মবিশ্বাসের অভাব বহুলাংশে মূর্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে লকডাউন উঠলেও রাজ্যের প্রধান ওয়ার্ক-ফোরস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কোরোনার প্রভাবে লকডাউন শুরুর প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জরুরী অবস্থায় মানসিক সমস্যা মোকাবিলার স্বার্থে একটি গাইডলাইন সম্বলিত বই প্রকাশিত হয়। এর মূল বক্তব্য ‘স্বাভাবিক’ মানুষের ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থির সম্মুখীন হওয়া – হিসেবে এই সময়কার মানসিক সমস্যাগুলিকে দেখতে হবে। এই বইটি ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক ভেদ নির্বিশেষে মানুষকে কয়েকটা মূল ভাগে বিভক্ত করেছে। যদিও এই মানসিক রোগ এবং মহামারীর পরিবেশকে একলাইনে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তবুও খানিক নির্দিষ্ট করে বলা যায়, এই পরিবেশের মোকাবিলায় ব্যক্তিমানসে চার ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। প্রথম অংশ, যারা একেবারেই চিন্তিত নন, জীবন-জীবিকা-সমাজ সংক্রান্ত বিষয় থেকে দূরেই রয়েছেন। দ্বিতীয় অংশ, যারা আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু মহামারী সংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন, এবং এই অবস্থাতেও ভালো থাকতে পারছেন। এদের ‘Worried Well’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তৃতীয় অংশ তারা, যারা চিন্তা করছেন, বারংবার, সোশ্যাল মিডিয়া এবং খবরের চ্যানেল খুলে দেখছেন, এবং আরও আরও খবর জানার চেষ্টা করছেন। কখনও জানতে চাওয়া ও না চাওয়ার দোদুল্যমানতায় নিজেদের মধ্যেই মানসিক বিরোধ তৈরি হচ্ছে। ফলে দুশ্চিন্তার প্রভাবে রোজকার কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। খাওয়ার সমস্যা (কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া) এবং ঘুমের সমস্যাও একই সঙ্গে থাকতে পারে। কিশোরবয়সীদের এই চিন্তার প্রভাবে খিটখিটে হয়ে যাওয়া, বড়দের কথা না শুনতে চাওয়া, রাগ ও বিরক্তি ইত্যাদি প্রকাশ পেতে পারে। চতুর্থ অংশ হলেন তারা যারা এই চিন্তার প্রভাবে মানসিক রোগের আওতায় চলে আসতে পারেন। দীর্ঘক্ষণ মন খারাপ থাকা, পছন্দের কাজও করতে ইচ্ছে না হওয়া, দৈনন্দিন কাজে তুলনামূলক শ্লথগতি হয়ে যাওয়া, অল্পেতেই ক্লান্তি, ঘুম এবং খাবারের অনিয়ম, আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজেকে অপদার্থ মনে করা, স্মৃতি ও মনোযোগের সমস্যা, ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চেষ্ট ও আশাহীন হয়ে পড়া এমনকি মৃত্যুচিন্তা এবং চেষ্টাও দেখা যেতে পারে। প্রথম তিন অংশের ভুক্তভুগী যারা, তাদের ক্ষেত্রে আশঙ্কার জিনিস যদি অপসৃত হয়, তবেই উপসর্গও চলে যাবে। কিন্তু চতুর্থ অংশের ক্ষেত্রে উপসর্গ এবং তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তবে নিজেকে বা আশেপাশের কাউকে শেষ দুটি অংশের অন্তর্ভুক্ত মনে হলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ বাঞ্ছনীয়।
মহামারী শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কিছু ব্যবহার যা মানসিক অসুস্থতার উপসর্গ হিসাবে গণ্য হত, স্বাভাবিক জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে যেতে পারে। যেমন, বারবার হাত ধোয়া, বাড়তি ওষুধ ও স্যানিটাইজার বাড়িতে মজুদ করে রাখা, ইত্যাদি। যদিও সবক্ষেত্রেই, Stressor (stress এর কারণ) চলে যাওয়ার সঙ্গেই তার প্রভাবে সৃষ্ট ব্যবহারেও বদল হয়, কিন্তু, প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সময় ধরে কোরোনার ওষুধ আবিষ্কার না হওয়া, এই পদ্ধতিতে চিরকালীন বাধা দিতে সক্ষম। এছাড়া অসহনীয় কোন মানসিক পীড়ন যদি বিনা চিকিৎসায় রয়ে যায়, তা পরবর্তীকালে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে পরিণত হতে পারে। যেকোনো দুর্ঘটনার পরিস্থিতিতে ব্যপক সামাজিক দোষারোপের ফলে স্টিগমার জন্ম হয় এবং নতুন স্টিরিওটাইপ তৈরি হতে পারে। অসুস্থ, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাঙ্ক ও পোস্টাপিসে কর্মরত লোক, সমাজকর্মী, বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মী এবং তাদের পরিবার এই মুহূর্তে ব্যপক সামাজিক দোষারোপের যূপকাষ্ঠে পড়েছেন। স্বাভাবিক মৃত্যুতেও প্রতিবেশীরা সন্দেহ করছেন কোরোনাই মৃত্যুর কারণ, এবং কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে পরিবার। সামাজিক দোষারোপ উদ্দিষ্ট্য ব্যক্তির কাছে মানসিক অত্যাচার হয়ে ওঠে। মঙ্গোলিয়ান মুখের ধাঁচ হওয়ার কারণে অনেকেই কোরোনা ডাকনাম পেয়েছেন, এবং মৌখিক ও মানসিক অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিদেশফেরত বিভিন্ন বয়সের মানুষজন, তাদের ছেলেমেয়েরা, তাব্লিগী জামাতের ঘটনার পরে বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকেও সামাজিক বয়কটের মুখে পড়তে হচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা সামাজিক প্রেক্ষিতে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। মানসিক রোগ, যত সহজে লক্ষ্য করা যায়, চরিত্রের এবং মানুষের জীবনদর্শন এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন অত সহজে লক্ষ্যণীয় নয়। ফলে এর পরিবর্তনেরও চট চোখে পড়া এবং গুরুত্ব আদায় করা মুশকিল। ফলস্বরূপ এই ধরনের মৃদুভাবের পরিবর্তন, দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়ে জীবনযাত্রার পরিবর্তন করতে পারে। এই পরিবর্তনের মধ্যে গুজবের প্রভাবে নতুন স্টিগমা এবং স্টিরিওটাইপ তৈরি, নতুন সাংস্কৃতিক আদবকায়দা ও ব্যবহারের প্রচলন, ছাত্র-শিক্ষক ও ঊর্ধ্ব-অধস্তন কর্মচারী সম্পর্কের মূল্যবোধের পরিবর্তন, শিক্ষার পরিবেশগত মূলবোধের পরিবর্তন, আত্মবোধ এবং ব্যক্তিপরিচয়ের পুনর্মূল্যায়ন ইত্যাদি থাকতে পারে। এছাড়া এতদিনের অদৃশ্য মুখোশ এতদিনে দেখা যাচ্ছে, তাও দীর্ঘস্থায়ী হলেও হয়ে যেতে পারে।
বর্তমান সমস্যার মোকাবিলার ব্যবস্থা হয়ত লুকিয়ে আছে দলগতভাবে লড়াইয়ের ফ্রন্টলাইন তৈরি তে। Authenticated source থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করুন এবং Depression ও Anxiety জাতীয় সমস্যা থাকলে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির এবং শ্রমিকদের হেঁটে বাড়ি ফেরার খবর এড়িয়ে চলতে পারেন। যদি ইমিউনিটি খারাপ না হয়, তবে সপ্তাহের একদিনের জন্য বেরিয়ে কাছাকাছির দুঃস্থ পরিবার ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যে হাত লাগাতে অথবা আর্থিক সামর্থ্য থাকলে সাহায্য করতে পারেন। যারা আইসোলেশনে বা রেড বা ইয়েলো জোনে রয়েছেন, তারা অনলাইনে বন্ধুদের সাথে রোজ যোগাযোগ রাখতে পারেন, সোশ্যাল এবং নিউজ মিডিয়া ব্যবহারের সময়সীমা বেঁধে পরিবারের সাথে বোর্ড গেম ও ঘরোয়া মজার খেলা, ছোট পরিসরে বাগান করা, রান্না, গান শোনা, বই পড়া এবং সিনেমা দেখায় অভ্যেস করতে পারেন। Healthy diet ও রোজ সময় বেঁধে এক্সারসাইজ শুরু করতে পারেন এবং রোজ ঘুমের অন্তত এক ঘন্টা আগে সমস্ত গ্যাজেট বন্ধ রাখতে পারেন।
পশ্চিমবঙ্গে বসে যদি কোরোনা পরিস্থিতির মানসিক মানচিত্র বুঝতে হয়, তবে অঞ্চলের, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে ছাড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। ফলে, মাথায় রাখতে হবে প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে বয়স্ক মানুষেরা কোরোনা এবং ঝড়ের পরিস্থিতির উদ্বেগ ও আশঙ্কায় কখনও মন্বন্তরের ‘ফ্যান দাও’, কখনও দেশভাগের কাঁটাতার-রায়ট-বাঙাল, কখনও একাত্তরের বাংলার লড়াই, কখনও আয়লার ঝড় মিশিয়ে ফেলবেন। বর্তমানে Inter-generational Studies ও দেখাতে শুরু করেছে, এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও থেকে যায়। সুতরাং যখন বাংলার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কোরোনা পরিস্থিতিতে মানুষের আবেগ ও চিন্তাকে বুঝতে হবে, তখন মাথায় রাখতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, গৃহহীনতা, ‘ক্ষুধা’, ঝড় ও বন্যার স্মৃতি, তাতে ওতপ্রোত মিশে রয়েছে।