রাজস্থান ডায়েরিস : সিন্ধু সোম

পর্ব-১০

রাজস্থান ডায়েরিস—১৯

একটা সাদা গাধা। কাল আবর্জনার স্তূপে। সংঘবদ্ধ জটিলতা। টানা হেঁটেছে ষোল বছর। আজ বিদায় চাঞ্চল্য ঝুরিঝুরি। উদয় সিংহের সঙ্গে করমর্দন করে আমি বেরিয়ে আসি রাস্তায়। ফুটছে কেটলির স্বীয় ঘনত্ব। ডট ডট ডট ডট। পথ ভাগের বিভক্তিতে ঘর বাঁধে। বালিয়াড়ির ওপর চোরাবালি শুষে নিচ্ছে একটা কুকুর। নীল সাদা ছাদের পিছনে উঁকি দিচ্ছে পাহাড়। ভীরু ভীরু দৃষ্টিতে। স্কার্ফ। কানে ফোন। এক পলক তাকালে। বিবর্তিতার মাপ হাত। আপেল ঝাড়ে ‘গঁড়পতি মেডিক্যালস’। সদ্য ঘুম ভাঙালে মুখে বিছানা লেগে থাকে। পাশ হাতড়াই। কেউ নেই। উঠে বসি। সচকিত। ওপাশের পর্দাটা নড়ে ওঠে। নগ্ন হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায় বিবাহিতা। ব্যালকনির নতুন আলো লজ্জা পেয়ে ছায়াকে পথ করে দেয়। ওর পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে সোনা। আমি একটা গোল্ড ফ্লেকের ধোঁয়া জমাই ডাকবাক্সে। “কখন উঠলে?” “এই তো! কিছুক্ষণের বাসি চোখ-জাগা! ওশরুম গেছিলাম। গা ভিজিয়ে এলাম একটু।” চাদরটা সরিয়ে দিই। “বোসো।” ও আলতো করে বসে। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই সুন্দর সেইখানে সেই মুহূর্তে। ‘চিরাচরিত’-এ বড্ড মিথ্যের গন্ধ। সময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে বিবাহিতার দিকে। কাঁচের জানালার আলোচনায় রোদ বিবাহিতাকে বিবাহিতা করে যথাসাধ্য।

শ্বাস। আহ্। খড়ম বুনছে খেজুর পাতা। আখের লালে মশার রক্তের মতো আকাঙ্ক্ষা লেগে থাকে। ভোর আসে তার নিষ্পাপ পথের হিসেব নিয়ে। জাবদা খাতা। আঁকড়ে ধরে স্থাপত্য। বিবাহিতার চুলে অস্তমিত চিরুনী। চুলের কাঁটা ঠোঁটে চাপা। চেরি জীবনের বাঁক। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,”দাঁড়াও একটু! জানোই তো আমার একটু সময় লাগে! ঝড়ের মতো ছুটতে পারি নে।” ফেটে যায় হাসি। দাঁতে দাঁত চেপে বলি,”দাঁড়ালে পায়ে ঘুন ধরে যায়।” দুই পাহাড়ের বুকের মাঝে সরু পথে হলুদ কাঁথাসেলাই। কেঁপে ওঠে। মাথায় হাড়ি। চকচক। বাড়ি ফেরে জলের সন্ধানী। পাহাড়ি রাজকন্যে। বিবাহিতা আমার দিকে দুষ্টুমির কলকে নিয়ে তাকায়। আমি থম হয়ে থাকি। সময় হাসতে থাকে জোরে। পাগলের মতো। কে পাগল? কথক না কথিত? জোরে টিন পেটানোর শব্দ হয়। বাস এল বোধহয়। আমি সময়কে বলি, “তুমি নিয়ে এস ওকে সঙ্গে করে! আমি এগোলাম।” “অ্যাই দিদি! এতক্ষণ কি করছিলিস বলতো!” আস্তে আস্তে হাওয়া হালকা হয়ে আসে। আমি রোদকে নিয়ে এগিয়ে যাই। জানলাটা নিতে হবে। তবে তো আকাশের চারুপাঠ শুরু হবে!

কলাগাছে জাবর কাটে অনামিকা। চিতোর থেকে শম্ভু মিত্র হেঁকে ওঠেন,”জাগতে রহোওওওওওও”! পাথরের আঁকাবাঁকা অঙ্গরক্ষক। প্রতাপের পঁয়ত্রিশ কিলোর বর্শা। দোকানদার নোনতা বিস্কুট লাগা গোঁফ নিয়ে উল্টোদিকে দেশীর দোকানের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। মাঠ বুজিয়ে রাস্তা হয়। খাঁজে খাঁজে বালির মাশকারা। সাদা চকের একপাশে জলের ট্যাঙ্কি। রোদের দিকে বেঁকে যাওয়া গাছের মতো মোড় ধরে পথ। পরিখার পার্থেনিয়াম ঢেকে দিয়েছে ডায়ান্থাস। নদীর ওপর চাকা। ছলাৎ। বিবাহিতার পাথরে লোভ নেই। বাবলার জঙ্গল ওর বেশি পছন্দ। দুপুর গড়িয়ে যায় কাঁটালো ছায়ায়। মূল পথ থেকে যা বিচ্যুত করে, ছায়ার পরিসর তারই স্বরে বেশি।
বিকেলের ভাঙা ঘর। চুন হলুদ। এগিয়ে দেয় মোনালিসা। আমি সময়কে দেখাই। ও পছন্দ করে না। কোথাও একটা খিটিমিটি আছে ওর সঙ্গে মোনালিসার! আসলে আধিপত্যের একটা নেশাত্মবোধ থাকে। সন্ধিপূজোর মতো সংক্ষুব্ধতা নামে আকাশে। পরিত্যক্ত কাঁটাতার। আঙুল কেটে আঁঠার শিষ নামে। বর্ণালীর প্রত্যাখানে সন্ত্রস্ত পাহাড়। তারের অবয়ব গলায় পরে জোনাকি। কাটা গাছের পাশে শুয়ে থাকে ভাঙা পাথর। স্কুল। পোশাকে ফুল কাটে একদল সুন্দরী। তাদের নাভির থেকেও গোলাপী সুরে কর্ষনের সূর্যাস্ত। অস্তমিত মোষের পিঠে আলতো ভর দেয় রোদ। নৌকো ভেসে আসে ঘোমটা টেনে। কাশের স্বপ্ন দেখি আমি। বিবাহিতা দূরভাষে আলো মাপে। সময় মোনালিসার আঙুল ছুঁয়ে হাঁটতে থাকে অন্ধকারের কোণ ধরে। যন্ত্রানুসঙ্গের মতো যন্ত্রণা লেগে থাকে ঝিলে। প্রতিদিন পথ চলার শেষে এখানেই ফিরে আসে কৃষ্টি। কথা দেওয়া আছে। দাবার ছক পেতে আমাকে হারিয়ে দিতে বসেছেন অখিল বন্ধু ঘোষ। চেক চেক। মেটের কাছে জমেছে বহুদিনের ঝুল। রক্তের বাসি গন্ধ ধুয়ে দেয় নেশা। মদন ভস্মের দিন। রতিও কি এই রঙ পেয়েছিল মুঠোভরে? আমার সামনের রেলিঙে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ। তাঁর ঠোট নড়ছে না। চোখের জলের দাগ ছড়িয়ে দিচ্ছে স্তব্ধতা। ভেসে আসছে, “তখন আর গান শোনাতে আসবে না তো…”! পথের বাম পাশটা আমার জন্মান্তরের স্মৃতি কুড়োয়। আমি চার্লি চ্যাপলিনের গলা জড়িয়ে ভানুকে কাঁদতে দেখেছি। এক আকাশ চুন হলুদ চোখে নিয়ে…

আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৩০শে অক্টোবর ২০১৮
সকাল ৯টা ১১

ছেনির ঠোঁটের থেকে ধারালো অন্ধকার, প্রতি খাঁজে পাথর কেটে রক্ত তুলে আনে, শ্যাম পদচিহ্নিত আলতালতা

জানলালি অরণ্যে শাল্বরোদনের পরে, একটুকরো স্বপ্ন এসেছিল, ক্ষয়িষ্ণু প্রত্যাক্ষরে ক্ষরণরচিত লিপি খর খরতর

রাজস্থান ডায়েরিস-২০

মার্বেলের দোকান। শকুনটা মটমট করে আঙ্গুল মটকালো। ফেনার মতো উপনিবেশ। রসুনের পাহাড় কোলে ঘাঘরার পসার। পায়ে দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে মোনালিসার অপভ্রংশ। কলকে গাছের হলুদ দুল। মোড়ে একটা একা অশ্বত্থের ছায়া। পাউরুটি আর ঝোলাগুড়। বিড়ালে মুখ দিয়ে গেল। আমি রুমালের মধ্যে লেগে থাকি। রায়বাড়ির কড়চায় লেগে থাকে মিষ্টির রস। ক্ষীর। নেমন্তন্ন খেতে আসে বুড়ো কাতুকুতু। নিমের ডাল থেকে মালগাড়ি সরে সরে যায় ফাঁকা মাঠে। এ পথে শব্দ রাখি বাঁধে আলোর হাতে। চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সভ্যতা। দুটো লাইনের ফাঁকে আটকে পড়ে বাস। নড়ে না। গতিরহিত। বিবাহিতা আর সময় আলো চালের গল্প করে। মোনালিসার কোলে বসে লিওনার্দো আঙুল চুষছেন। আমায় বলেন, “এইসময় একখান গাড়ি এলে না! বেশ হয়! ছবি দেখব।” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “পয়েন্টিলিজম আপনার অনেকটাই পরে। সুরা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা কি আপনার পোষাবে?” উনি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “অ! পোষাবে না, না? তবে থাক।”

আমি মালগাড়ির পাশে। বিবাহিতা হাত বাড়ায়। ধমকে উঠি। “কত জন্ম পেরোলো খেয়াল আছে? গতির অস্তিত্ব লোভ কুড়োয় এখনও?” জিভ কেটে ভেংচি। চোখ নামিয়ে বললে,”কি করি বল? স্বভাব! যেদিন শিবের মতো নীচে শোয়ার ভান করব, তখন তুমিও অমনি জিভ কেটে দাঁড়িও! কেমন?” অন্যমনস্ক হয় হাওয়া। শাপলায় জড়ানো পুকুর আমার বুকে। কুটুস গাছ। সিংহদরজায় হেলান দেয় সময়। রোদ সোনালি করে তোলে ভবিষ্যৎ। একসময়ে পাহাড় হয়ে থাকা ছন্দ নিজেকে কুঁদে বের করে আনে। তখন শরদিন্দুর চশমার ফ্রেমে ইউক্যালিপটাসের ছায়া পড়ে। লম্বা বাগানের স্মৃতিতে লঙ্কা গুঁড়ো। বিটনুন কই? “কই রে?” বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে রোদ। গ্রীষ্মের আমেজ শীতের দুপুরে। পাতার উপর ক্রমাগত পাথরের গুঁড়ো জমে। একদিন পুকুরের সমস্ত সত্ত্বা উপুড় হয়ে পড়ে মরুভূমির পায়ের পাতার ওপর। শাপলার লাশে ঢেকে থাকে মোনালিসার ভ্রূ। হাসি আসে না আর।

রেললাইনের ওপরে দাঁড়ানো বাসের মতো আমি বিবাহিতার চোখে দেখি। বুকের বাঁদিক। দানা বাঁধছে আগমন। ভাঙার জন্যে কুলের প্রয়োজন নদীর। অস্তিত্বের জন্যেও। বিবাহিতা কনুই অবধি মেহেন্দি করিয়েছে। পেঁপেপাতার চরকা কাটছে আগাছা। ঘুপচি ছায়া। বন্দী দুই পৌঢ়া। সবজির মতো ফলছে ধূ ধূ মাঠ। উঁচু লাল ঘাস কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে বিবাহিতার। নলকূপ। চুইঁয়ে পড়ছে তৃষ্ণা। কালো দিগন্তের ছায়া। চিতোরগড় দূর্গ পেরিয়ে আজমীর। সন্দিগ্ধ খরস্রোতের হাত ধরে দাঁড়ায় লম্বা ঘোমটাহীন হোটেল। ক্লান্তি নামে ডালবাটি চুরমা-র গ্রাসের পেখম ধরে। দিতি থাকলে? ওকি মুচকি হেসে গাইত? “রজনিজনিতগুরুজাগররাগকষায়িতমলসনিমেষম্‌।/ বহতি নয়নমনুরাগমিব স্ফুটমুদিতরসাভিনিবেশম্‌।।” চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ভৈরবী রাগ। খণ্ডিতা দিতি? অসম্ভব! ও আমি মিলাতে চাইলেও মিলবে না।

আমাকে সময়ের পিঠে একটা তিল ছোঁয়াই ঠোঁটে। ধ্বংস স্তূপ। আলসেমিতে বাদুড়ের মতো বাসা বেঁধেছে ইতিহাস। প্রতাপের কাল। জরার চিহ্ন বস্তুনিষ্ঠতার চোখে মুখে। একজোড়া ঠোঁট। সদ্যভেজা মনে হল। ইতিহাসের‌ পর্দার আগে সূত্রধর। এক ফোঁটা জীবনের অনুভূতি। দীর্ঘ আবহমান ঝুঁকে এসে দাঁড়ায় এ দরজায়। লাল ফুল। আমি রানুকে খুঁজে পাই। বিবাহিতা আমার চোখ চেপে ধরে‌। কপটতার থেকে কাগজ ফোটার শব্দে অনেকটা দূরত্ব। খিলখিল করে হেসে ওঠে কেউ। শিউরে উঠি। দিতির মতোই সুর। আমার চোখে ভাসতে থাকে লাল মোরাম। নীল ফুল। রামকিঙ্করের বৃষ্টি দেখা। খসখস খসখস। মোটা কাগজে খাগের কলমে লিখে চলেছেন কেউ। মরুভূমির সাধনাই কি শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে? দিতিরা তবে? এগোনোই চায় ক্ষত্রিয়ের হারিয়ে যাওয়া অলংকার। বৈভাষিক মার্গে একদিন সমস্ত ইতিহাস কলাপাতার দোলা হয়। আর নতুনা সম্পৃক্ততা পায় প্রবীনের কন্ঠ হয়ে। ভেঙে যাওয়া স্তব্ধতা আঙুল তুলে বলে,”যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…”!

আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৩০শে অক্টোবর ২০১৮
দুপুর ২টো ৪৯

ইতিহাস প্রস্তরময়, মানবতানুগতিকতা তার রঙ নয়, ব্যঞ্জনা মাত্র

অসংখ্য করোটির দ্রাঘিমা পুঞ্জে পুঞ্জে আলুলায়িত, এভাবেই চূড়া ঘটমান, অংশীদারের শিরদাঁড়া ভার বয় শ্রান্তিক

জয়দেব

Facebook Comments

Leave a Reply