গল্প : প্রলয় নাগ
রঙিলা আসমান
।। এক ।।
লিখি, মানে সাদা পাতার ওপর মনের ইচ্ছে মতো যা খুশি আঁকিবুকি করি —এই একটা আমার পরিচয়। কেউ ট্যাঁরা, কেউ বেঁকা চোখে আবার কেউ-বা চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকায়।
বহু বছর আগে সবার কাছ থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আত্মীয়-পরিজন, পরিচিত মানুষ-জন, ভিড় জনপদ— এ সব হঠাৎ আমার কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে। নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম। যেখানে দাঁড়ালে বহুদূর পর্যন্ত জনপদ কেবল শূন্য মনে হয়, দূরে ঘর-বাড়ি-বৃক্ষ সমস্ত কিছু ছোটো ছোটো আকার নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, সেখানে। চারপাশে ধু-ধু করা চাষের জমি, যাতায়াতের একটা সুরু পথ ছাড়া মাঠের সমস্ত জমিটাতেই চাষ-বাস হয়। মাঠটার মাঝখান দিয়ে একটা পূর্ববাহিনী নালা। আর দু’পাশে সারি করে কিছু ফাঁকা ফাঁকা গাছ-গাছালি। নালাটাতে শুধু বর্ষাতেই একটু জল জমে, বাকি সময় শুকনো ঠন-ঠনা। পথ-টা যেখানে শেষ হয়েছে, মাঠের মাঝখানটায়, সেখানেই আমার দু’ঘর বিশিষ্ট বাড়ি। সবার থেকে আমি দূরে কেন ? — এ কথা অনেককেই বলেছি। আমাকে হয় কেউ পাগল, নয় মগজের নাটবল্টু কিছুটা ঢিলে আছে বলেই মনে করেছে।
এখানে এসেও কলম গুতোনো চলতে লাগল যথারীতি, কোনও বাধা নেই, বিপত্তি নেই, শুধু বর্ষার সময় মনে হয় কোনও এক নির্বাসিত দ্বীপের ভেতর বাস করছি। চারদিকে উঁচু উঁচু পাট ক্ষেত, ধান ক্ষেত — আর আমি একা একজন মানুষ। শীতকালটা উল্টো, শীতকালে শীতকালীন ফসল—সর্ষে, গম, তিল, তিসি, মুশুরি, খেসারি ফলে, হলদে সর্ষে ফুলে ভরে ওঠে জমি। হলদে সর্ষে ফুল দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
কেউ বলে লেখক, আবার কেউ আড়ালে বলে : ‘লোকটা পাগলা নাকি?’ জগতের হাজার বিষয় নিয়ে আমার উৎকণ্ঠা। আমার ঘরে অতিথির শেষ নেই, শহর থেকে আমার বন্ধুরা ছুটে আসে। রাতে আড্ডা জমায়, বিয়ার-হুইস্কি নিয়ে বসে, গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়, কবিতা পড়ে, চিৎকার করে বলে: ‘চারপাশে এ সব কি চলছে শুনি?’
— দেশটা কোনদিকে যাচ্ছে?
এরই মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করে:
”এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে: আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে: আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?’’
ওরা আমার এই জায়গাটা-কে ভীষণ পছন্দ করে। বলে, লেখালেখির জন্য এ চমৎকার জায়গা। আমি বারণ করলেও চলে আসে।
সব কিছুরই একটা অন্ত আছে, গন্তব্যও আছে। আর আমার ‘ক্ষ্যাপামি’রও হয়তো সেদিন শেষদিন ছিল, আমার মৃত্যু হল যে-দিন। তবে লোকের কাছে এখনও আমি নিরুদ্দেশ, নিরুদ্দিষ্ট একজন ব্যক্তি। মাঠের পূর্ব প্রান্তে নালাটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দুটো পুরনো গাছ আছে। কোন প্রজাতির গাছ কেউ জানে না। ছাল-বাকল হীন, বহু প্রাচীন। পূর্ণিমা অমাবস্যায় সে-গাছে লাল আলো জ্বলে থাকে। গ্রামে লোকশ্রুতি যে, ওইদিন ওই গাছ দুটি স্পর্শ করলেই মৃত্যু হয়, মানে অজগড় সাপের মতো গাছ মানুষকে গিলে নেয়। আমি গোয়ারতমি করে পূর্ণিমার এক রাত্রে ঘর-দুয়ার আলগা রেখে রহস্য উদ্ঘাটনে গিয়েছিলাম। আর ফিরতে পারিনি, সে-দিনের পর থেকেই গ্রামের মানুষের কাছে নিরুদ্দিষ্ট পরিচয় নিয়েই বেঁচে আছি, আসলে আমি মরেছি, গাছ আমায় গিলেছে। শতাব্দির সমস্ত ক্ষুধা জমে ছিল গাছের ভেতর, ওরা আমায় ছাড়েনি। তারপর বহুদিন ‘আমি নেই।’ এ পৃথিবীর ভোগবাসনা তো এই হতভাগার তখনও তৃপ্ত হয় নি। আমার অতৃপ্ত আত্মা তৃপ্তির খোঁজে গাছের বুক চিরে আবার একদিন বেরিয়ে এল, ঘর-দুয়ার আলগা করে রেখে যাওয়া বিছানা বালিশের মায়ায়, তেল চিপচিপে লম্বা চুলের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে নারী শরীর জড়িয়ে ধরে ক্ষণিকের আস্ফালনের লোভে। আস্ফালনে তো শান্তি নেই, কোনওদিন পাইনি। নিজেকে এখনও আমার বন্দি-ই মনে হয়।
।। দুই ।।
— লেখক দাদা বাড়িতে আছেন?
— কে…? ঘর থেকেই স্বরটা টেনে উত্তর নিলাম।
— আমি হরেণ, দাদা…! হরেণ হাঁপাচ্ছে।
—একটা কিছু দ্যান দাদা? জল খামু! দেখেন না কি রইদ উঠছে! আর থাকুন যায় না রইদে।
সত্যি, চারপাশ রোদে পুড়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ আছে, কিন্তু এরা নিষ্ঠুর মেঘ। বৃষ্টি দেবে না এক কণাও। বৈশাখ গেল, জ্যৈষ্ঠ গেল, আষাঢ় যাচ্ছে, তবুও বৃষ্টির দেখা নেই।
ঘর থেকে একটা জলের গেলাস এনে হরেণের হাতে দিলাম। হরেণ সোজা চলে গেল কলের পাড়ে, ফিরে এসে গেলাসখানা মাটিতে রেখে ভেজা হাত মুছতে মুছতে মাটিতেই বসে পড়ল, মুখে স্বস্তির কিছু শব্দ।
— কী করতাসেন দাদা?
— কী করব বল্..! অকাজ ছাড়া আর কী আছে?
— হুনলাম আপনের লেখা খবরের কাগজে বাইর হইছে। নদী নিয়া কত সুন্দর কইরা নাকি লেকছেন? ব্যাঙ নাকি পড়ছে।
এরই মধ্যে হুঁকোর কলকেতে আগুন দিল হরেণ।
— ও তো অনেক দিন আগেই লিখেছি, এতদিনে ছেপেছে। আসলে আমার লেখা ছাপতে চায় না। দল, বুঝলি সবকিছুতেই দলবাজি।
হরেণ আমার কথাগুলো বুঝতে পারে কি পারে না, জানি না।
—এহন কী লেখতাসেন?
— লিখছি, ঠিক কী লিখছি জানি না। সাপ ব্যাঙ কিছু একটা লিখছি। চোখের সামনে যা দেখছি তাই লিখছি। দু’জন মানুষকে নিয়ে একটা লেখা…!
— তাই নাকি?…কেডা?
— লিখতে দে, শেষ করি আগে! তখন বলব!
হরেণ হুঁকোয় টান দিল, হুঁকো গড়গড় শব্দ করে। আমার হাতে দিল। আমি দু’টান দিয়ে আবার হরেণের হাতে দিলাম।
— দাদা, লেখাটা একটু হুনানি যাইত না?
— যাবে না কেন? না-হলে ও লেখা লিখছিই-বা কেন? কিন্তু মুশকিল হল পুরোটা তো শুনতে পারবি না!
ঘরের ভেতর থেকে অগোছালো কতগুলো পৃষ্ঠা বের করে আনলাম। পড়তে শুরু করলাম:
“রঙিলা আসমান। দিক-বিদিক জুড়ে মেঘের আনাগোনা। রসুনের খোসার মতো মেঘগুলো সব। বাতাসে একবার এদিক আরেকবার ওদিকে যায়, বৃষ্টি আর হয় না। ক’দিন আগেও মেঘগুলো আকাশের অনেক উঁচুতে ছিল। ব্যাঙ যেই দু’হাত তুলে ডাক দিল ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’, সুড়-সুড় করে দু’দিন পরেই মেঘ নেমে এলো আকাশ থেকে নিচে। কালো হয়ে গুড়ুম গুড়ুম শুরু করে দিল। ব্যাঙের ডাকে সাড়া দিল, ক্ষণে ক্ষণে জল, টুপ-টাপ, টুপ-টাপ। ব্যাঙ বাঁশের মাতলা মাথায় দিয়ে জমির আল বাঁধতে শুরু করে দেয়। অম্বুবীচির আগে জমি জাবর দিতে হবে। অম্বুবীচিতে হাল চাষে বাধা। মাটি খোরায় বাধা। ‘কী সব আচার হিন্দুগুলার!’ সে তো ‘ভিন জাইত্যা’ তার এ সব না-মানলেও চলে। আসলে সব দেশাচার।
ব্যাঙ মিঞার সখা হরেণ, বহু বছরের। হাল-চাষের সেরা জুটি। দু’জনের দু’জোড়া তাগড়া বদল। বহু বছর ধরে দু’জনে এক সাথেই জমি চষে আসছে। হরেণের সাথে সাথে সেও পূর্ণিমা অমাবস্যা — এ সব মেনে চলে। এ সব দিনে হালে বাধা।
— তুই চাইলে হাল বাইতেও পারস। তর কিসু হইত না।
হরেণ ব্যাঙ-কে বললে ব্যাঙ জবাব দেয়,
— না না, সারা বছর তো হাল বাই। এই দুই তিনডা দিন না-বাইলে আর কি হবো!
ব্যাঙ মিঞার ডাকে মেঘ আকাশ থেকে নেমে আসে। জমি জবার দেয়। অবসর সময়ে বারান্দায় বসে কাঁঠাল বীচি চিবোতে চিবোতে ভাবে, অম্বুবীচি এলেই তার বউ-টার শরীর খারাপ হয় কেন? প্রতিটা বছর সে এই জিনিস লক্ষ্য করেছে। বছরে এই ক’টা দিন যেমন জমিতে লাঙল দেওয়া যায় না, তেমনি ব্যাঙ বৌয়ের কাছে ঘেঁষার সাহস পায় না। কাছে ঘেঁষলেই বৌ মা-মনসার মতো ফুলতে থাকে। প্রতি মাসে যা হয়, এই মাসে বৌ তার থেকে আলাদা হয়ে যায়। কিছুটা রুদ্র মূর্তি, তেমন কথাও বলে না। ব্যাঙ মিঞা একবার ভুল করে ছিল। ভুল করে জমির আলে কোদাল চালিয়ে দিয়েছিল, বউ সাপের মতো ফুসে উঠেছে। দিন সাতেক কথা বলে নি। ব্যাঙ যতই বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘এ গুলা তো আমরার নিয়ম না, হিন্দুরার, আমরা তো মুসুরমান মানুষ। আমরার তাতে কী?’ সত্যি, তাতে কিছু না। তবে হিন্দুগুলোর পাশে বসবাস করতে করতে ব্যাঙ মিঞা হিন্দু হয়ে যায়নি ঠিকই, সনাতনী রীতি-নীতিগুলো মানতে শুরু করে দিয়েছে কবে থেকে, তা নিজেরও জানা নেই। তাতে ব্যাঙ মিঞার জাত যায় নি। কিন্তু হঠাৎ করে চারপাশে জাত যে নিয়ে হুক্কা-হুয়া শুরু হয়ে গেছে, তা ব্যাঙ মিঞা টের পায়। মনে আশঙ্কার মেঘও জমতে শুরু করে।…” এইটুকু শুনিয়ে থামি : ‘বাকিটা আবার পরে শোনাব রে, লিখে শেষ করি আগে!’
হরেণ লেখা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে: ‘সত্যিই কথাই লেকছেন, এক্কেবারে সত্যি কথা। ব্যাঙ তো আর আমার আজকাইলের বন্ধু না— সেই ছোটোবেলা থেইক্যা, ইস্কুলের বেলা থেইক্যা।…..তবে লেখক-দাদা আপনে যে বৃষ্টির কথা লেকলেন, বৃষ্টি তো নাই। কবে হইব?’
— ধৈর্য্য ধর, হবে….!
— আইচ্ছা, এই বেলা আমি আসি। বাকিটুক যখন লেকবেন শুনাবেন কিন্তু?
হরেণ বিদায় নেয়। হরেণ না-জানলেও আমি জানতাম বৃষ্টি হবে। শীঘ্রই হবে। আমি যা লিখি তাই তো সত্যি হয়—–একদিন আগে হোক বা একদিন পরে হোক।
।। তিন ।।
“ক্ষুধার্ত হরেণ পান্তাভাতে কাঁঠাল ভেঙে নিয়ে বসেছে। জল কাদার লড়াই, প্রথমে জমি চষলো তারপর সেই জমিতে ধান লাগানোর চুক্তি তারা-ই নিয়েছে। ব্যাঙ বিছন ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে। তারপর আবার বৃষ্টি, যেথা সেথা শুধু জল আর জল। নালার জলে লুফিয়ে লুফিয়ে চ্যাং মাছ ধরার প্রতিযোগিতা চলছে। বৃষ্টি কমলে ব্যাঙ বিছন মাথায় করে জমির দিকে রওনা হল। পোঁদপাকা ছেলেগুলো ব্যাঙকে দেখেই চিৎকার শুরু করে দেয়:
‘বড়শিরে হুড়া টানিয়া তুলে বুড়া,
বড়শিরে হ্যাং টানিয়া তুলে ব্যাঙ।’
ব্যাঙ ধুপ করে বিছনের বোঝাটা মাটিতে ফেলে দিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তেড়ে যায়:
— পুংগির পুতেরা, ফাইজলামি পাইছো!”
ব্যাস…., এইটুকু লিখে আবার থেমে যাই। মাথায় কিছুই আসছে না। এ পথ যেন শেষ হবার নয়, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এরপর কী লিখব? কিছুই তো মাথায় আসছে না। মাঝে মাঝেই এমন মনে হয়, কেন হয়, জানি না। এ যাত্রায় থাক, পরে আবার লিখব! সকাল থেকে বাইরের পৃথিবীর মুখটা দেখিনি। চারদিকে শুধু জল। ডাবরিতে মানুষের ভিড় জমেছে, জমিতে লাঙল দিতে ব্যস্ত। চারদিকে যন্ত্রের ফট-ফট শব্দ, চাষের গাড়ি, আবার কোথাও জোড়া বলদ লাঙল টেনে চলেছে। ছোটোবেলায় পড়া ছড়াটা মনে পড়ল: ‘আমরা চাষ করি আনন্দে’। কে যে লিখেছিল এই মিথ্যে কথাটা! চাষ তো পেটের টানে করে, আর তাতে কষ্ট বেশি, আনন্দ কম।
দূরে ব্যাঙ হরেণ ঝুপ-ঝুপ করে ধানের গুছি কাদার তলায় গুজে দিচ্ছে। মেঘ-রৌদ্রের খেলা শুরু হয়েছে, হরেণ আর ব্যাঙের বাদামি পিঠের ওপর দিয়ে রোদ গড়িয়ে পড়ছে। ঘরে এসে কপাট দেই। ‘এ ভর বাদর মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর।।’ জানালার ওপাশে আরও দূরে নারী-পুরুষ মিলে ধান বুনছে। আমি ঘরে একা, অসহায়, কর্মহীন মানুষ। সকল লোকের মাঝেও আমি একা। কালো কালো মেঘগুলো আবার এসে চারপাশটা অন্ধকার করে দিল। কাঠের চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আবার কলম ধরলাম। ব্যাঙ হরেণ যে-ভাবে লাঙল ধরে, ঠিক তেমনি করে। এবার লিখব! কিন্তু কী লিখব?
“… ব্যাঙ ও হরেণ তাদের ধান রোয়া এ দিনের মতো শেষ করে ফিরে গেছে। ব্যাঙের শরীরে ক্ষণেক বৃষ্টি ক্ষণেক রোদে পুড়ে আশটে গন্ধ তৈরি হয়েছে। রৌদ্রে ঘাম শুকিয়ে চামড়ার ওপর সাদা লবণ জমেছে, পিঠখানা যেন সমুদ্র সৈকত। বারান্দায় যখন বসেছে তখন পোষা ছাগলখানা কাঁঠাল পাতা খাওয়া বাদ দিয়ে ব্যাঙের পিঠখানা চাটতে শুরু করে দিল। ব্যাঙের পিঠে সুড়সুড়ি লাগছে। ব্যাঙ আরাম পাচ্ছে, খসখস ছাগলের জিভের স্পর্শে। ব্যাঙ ঘুমিয়েও পড়ছে। ব্যাঙ ঘুমিয়ে পড়ল। ……”
— লেখক দাদা! ও লেখক দাদা!
পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছতেই আমার ঘুম ভাঙল। টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। উঠতে গিয়ে শরীরে যন্ত্রণা অনুভব করলাম।
দরজা খুলেই বাইরে আসতেই আমার তন্দ্রাচছন্ন চোখমুখ দেখে ব্যাঙ জিজ্ঞেস করে,
— এই সময়ে ঘুমাইতেসেন?
— কখন ঘুমিয়েছি টের পাইনি। অলস শরীরে কিছুটা অস্পষ্ট ভাবেই জবাব দিলাম।
ব্যাঙ তিন-চারটে কাঠি নষ্ট করে হুঁকোটাতে আগুন লাগাতে সফল হল। তারপর কয়েক টান দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— টান দিয়া লন ঘুম কাইট্যা যাবো!
আমি হাত বাড়িয়ে হুঁকো-টা হাতে নিলাম।
— তা… আমি হুনলাম আপনে নাকি আমরারে নিয়া কাহিনি লেকতাসেন। নাটক নাকি? হরেণ কইল। আরো কি লেকছেন? হুনতে আইছিলাম।
হুঁকোতে টান দিয়ে ব্যাঙের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। আমার আর কী কাজ, লিখব আর সে লেখা লোককে শোনাব। এই তো জীবন! টেবিলের ওপর থেকে অগোছালো কয়েকটা পাতা হাতে নিয়ে আবার টুলের ওপর এসে বসলাম।
— ধান রোয়া শেষ? হরেণ কোথায়?
— হয় নাই। বাকি আছে কিছুডা। ও-তো সইন্ধ্যার পরে বাইর হয় না, জানেন না?
— লিখতে তো শুরু করেছি, লেখা এগোতে পারছি কই!
— যে-টুকু লেকছেন হেইটুকুই শোনান!
— শুনবি…?
ব্যাঙ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
আমি পড়তে শুরু করি:
“… ঘুমিয়ে পড়লে ব্যাঙের ভেতর স্বপ্ন আসে। হরেণ এসে স্বপ্নের ভেতর ব্যাঙকে ডাকে: ‘কিরে যাবি না! বেলা হইয়া গেল? তর জন্য আর কত খাড়ইমু। অনেক জমি চষা বাকি!
ব্যাঙ আবার স্বপ্ন থেকে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। সে কিছুতেই হরেণের সঙ্গে যেতে চায় না। এ দুনিয়াতে তাঁর অনেক কাজ এখনও বাকি। হরেণকে সে এর আগেও বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। তবু হরেণ এসে তাঁকে বারবার টানা-হ্যাঁচড়া করে। হরেণ কোথায় নিয়ে যেতে চায়? আর যেখানে নিয়ে যেতে চায় সেখানে যাওয়ার সময় এখনও তাঁর হয় নি।…”
এইটুকু শেষ করে পরের পাতায় যাওয়ার আগে ব্যাঙ আমায় থামায়। জিজ্ঞেস করে:
—হরেণ কই গেছে লেখক-দা?
আমি চুপ করে থাকি। হরেণ আবার জিজ্ঞেস করে,
—কন?
আমি বলি: এ লেখায় হরেণ মৃত!
ব্যাঙ কথাটা শুনেই এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে: এইডা কী লেকছেন? যা খুশি লেকলেই হইল। আপনে যা খুশি লেকবেন আর আমরা বিশ্বাস কইরালমু? আপনার লেখা আর হুনতে চাই না!
ব্যাঙ বিদ্যুৎ গতিতে বারান্দা থেকে নেমে লুঙ্গির খসখসানি শব্দ তুলে চলে গেল। হুঁকোটা বারান্দায় পড়ে রয়েছে, কলকে থেকে ধোঁয়া উঠছে।
ব্যাঙের এই প্রতিক্রিয়ার নেপথ্যে কারণ রয়েছে। হরেণকে সে কিছুতেই হারাতে চায় না। সেও জানে আমি লিখেছি মানে, সেটা খুব দ্রুত সত্যি হয়ে যাবে। ক’দিন আগে বৃষ্টির কথা লিখেছিলাম, বৃষ্টি এসেছে। বৃষ্টি তো মঙ্গলের ছিল। সব সময় মঙ্গলের কথা লিখব, তা তো নয়? লেখায় কিছু অমঙ্গলও থাক। ভালো থাক, মন্দও থাক। ভালো লিখলে ভালো আর মন্দ লিখলে মন্দ হবে। ব্যাঙও দাঁতের পাটি চেপে ফিরে গেছে। সেও দেখতে চায়, অমঙ্গল কীভাবে হয়? মন্দকে সেও তো রুখে দিতে পারে। কালো আকাশটাকে যেমন ওপর থেকে নামিয়ে এনেছে, তেমনি আবার ওপরে তুলে দিতেও পারে। তার ভেতরেও তো লুকিয়ে রয়েছে সেরকমই এক শক্তি।
।। চার ।।
সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড ঢেলেছে, ডাবরিতে জল বেড়ে গিয়ে আমার ভিটে প্রায় ডুবু-ডুবু। বিষাক্ত, বিষহীন সাপেরা আমার পড়শি হয়েছে। সন্ধ্যা হলে অন্ধকার জমতে থাকে, একটা কি যেন বিরক্তিকর অনুভূতি আমায় গিলতে থাকে, এক তীব্র অতৃপ্তি, কোনও কিছুতেই শান্তি পাই না। আলো জ্বেলে আবার টেবিলে বসলাম। টেবিলের ওপর সারাদিনের লেখার অর্ধেকটা অংশ পড়ে রয়েছে। লেখাটাও আমায় টানছে না। আবার না-লিখলে নিজেকে কিছুটা অপরাধী লাগে, আমি যেন সবার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। বন্ধুরা কত কি লিখছে, কেউ বছরে চারখানা কবিতার বই, কেউ পাঁচখানা উপন্যাস। গাদা গাদা সব লেখা, গাদা গাদা পুরস্কার, আর আমি? —- সারাদিন ধরে এইসব সাত-পাঁচ ভেবে আবার কলম তুলে নিলাম, লিখতে শুরু করলাম। টিনের চালে ঝম্-ঝম্ বৃষ্টির শব্দে কানে তালা পড়ে যাচ্ছে। এই নির্জন পরিবেশে আমাকে যদি কেউ হত্যা করে? আপত্তি নেই। মৃতের আবার বাঁচা মরা! ব্যাঙ চলে যাওয়ার পরে সাবিত্রী এসেছিল। সাবিত্রী, আমার শৈশবের সাবিত্রী। এখন দু’ছেলের মা ডাক শোনা সাবিত্রী। সাবিত্রী আমার খোঁজ করে মাঝে মাঝে এসে— কি জানি আবার আমি মরে-টরে যাই নি তো? সাবিত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্কই-বা কিসের— না কিছুই না। কোনো সম্পর্ক নেই! এখন শুধু সাবিত্রীর মাটির সাথে সম্পর্ক। কাদা মাটি ছেনে এসে সাবিত্রী আমার কলের পাড়ে কাপড় হাটুর ওপরে তুলে পা ধোয়। কাদা সরিয়ে সাবিত্রীর শ্যামলা পা বেরিয়ে আসে। আমি সাবিত্রীকে দেখি। কৈশোরের, যৌবনের সাবিত্রীকে মনে পড়ে। আমার সমস্ত শরীর কেমন করে উঠে, এক তীব্র আকর্ষণ উল্কার মতো ছুটে যেতে ইচ্ছে করে— সাবিত্রী! আমায় একটু আশ্রয় দাও, আলিঙ্গন দাও, তৃপ্ত করো…! বাতাসের একটা ঝাপটায় ঘরের আলোটিকে নিভিয়ে দিল। আর আলো জ্বালাবো না! কি হবে জ্বালিয়ে? আবার তো না- লিখতে পারার বেদনা গিলে খাবে অথচ একটি শব্দও লিখতে পারবো না। তাল-তবাহীন একটা প্রাণীর মতো বসে থাকি, অলস নিরুপায় শরীর আবার ছেড়ে দিলাম বিছানায়।
।। পাঁচ।।
— এক রাইতে সব ভাসায়া নিল রে!
— এত জলে তো হাল চলবো না!
— আইজ চলত না, কাইল তো চলব?
— এখন তো সবার-ই একলগে লাগবো। কারটা থুয়া কারটা করমু।
ব্যাঙ আর হরেণ জমি চষতে এসেছিল। জমিতে জল বেশি থাকায় ফিরে যাচ্ছে। ঝিরি-ঝিরি বৃষ্টি আর ঘন-ঘন বাজ পড়ছে। গুড়ুম গুড়ুম। ‘দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম’! ঈশ্বর বার বার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে— হে মানুষ আরও দানশীল হও।
ব্যাঙ অনেকটাই আগে, হরেণ বেশ কিছুটা পেছনে পড়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড জোরে একটা বাজ পড়ার শব্দ হল। আকাশ থেকে যেন একটা সাপ নেমে এসে ছোবল মেরে আবার আকাশে উঠে গেল। হরেণ গোরু সহ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ভয়ঙ্কর হুংকার শুনেই ব্যাঙ পেছন ফিরে দেখে সর্বনাশ হয়ে গেছে। হরেণের ওপর বাজ পড়েছে! ব্যাঙ এক ঝটকায় ঘাড়ের লাঙল ফেলে পান্টি হাতে ছুটে আসে হরেণের কাছে। প্রচণ্ড জোরে গোরু দুটির পিঠে কষে ধিড়িম-ধিড়িম করে বাড়ি মারে। গোরু দু’টি আবার পুরনো গতি ফিরে পায়। লেজ তুলে দৌড় লাগায়। ব্যাঙ এবার হরেণের চারপাশে দৌড়তে দৌড়তে এক পাঁক, দু’পাক, তিন পাঁক দেয়। কানের কাছে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে: হরেণ….! এই চিৎকার হরেণের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে, শব্দ যেন আলোর গতিতে ছুটতে ছুটতে অনেক পথ অতিক্রম করে। তার শৈশবে পৌঁছে যায়। নদীর ঘাটে হরেণ তখন ‘কুমীর কুমীর’ খেলছে:
— এইটা কী?
— ভক্ত!
— কাটলে কী?
— রক্ত!
— মোর নাগাল ধরতো!
হরেণ জলের তলায় ডুব মারে আবার ভেসে উঠে। ব্যাঙের চিৎকার সেখানে গিয়ে সব খেলা এলোমেলো করে দিয়ে আবার ফিরে আসে। হরেণ চেতনা ফিরে পেতে পেতে একসময় সচল হয়। গোরু দু’টি তাকে পেছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। অনেকটাই পেছনে সে। হরেণ আবার হাঁটা দেয়। ব্যাঙ এক ব্যঙ্গ মিশ্রিত তির্যক সাফল্যের হাসি হাসে তার লেখক দাদার বাড়ির দিকে চেয়ে।
সে-দিন সন্ধ্যায় ব্যাঙ এসে তার বীরত্বের কথা জানিয়ে যায়, আমি বিজয়ীকে হুঁকো এগিয়ে দেই। ব্যাঙ বলে : কেউ কোনওদিন পারতো না, আমার কাছ থেইক্যা হরেণ-রে আলগা করতে?
।। ছয় ।।
ব্যাঙকে আবার দুঃশ্চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে দেখি, হরেণও কিছু একটা নিয়ে ভাবতে থাকে আর বসে বসে হুঁকো টানে। চারপাশে যা ঘটছে সব ওদের কানে আসছে। চুরি-চামারি দিন দিন এমন করে হঠাৎ বেড়ে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি। লোকজনের হাতে কাজ নেই, বিদেশ থেকে সব দল বেঁধে ফিরে আসছে। ঠিকা শ্রমিকেরা ফিরছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, ব্যাঙ-এর পাড়ায় অনেকে ফিরে এসেছে। ব্যাঙ তাদের জিজ্ঞেস করলে বলে: ‘আগের মতো কাম-কাজের সুবিধা নাই, কাকা। মালিক পয়সা কম দেয়, টাকা মাইরা যায় গা।’ এই চিত্রটা প্রায় সমস্ত গ্রামে। এই লোকগুলো আর কত বসে থাকবে। বাঙের মনে পড়ে, এক সময় গ্রামে পুরুষলোক বলতে কয়েকজন, বাকি সবাই বিদেশে থাকতো।
ব্যাঙ আর হরেণ আবার একদিন আমার বাড়িতে আসে। তাদের ভেতরে আগের উৎফুল্লতা নেই। আমি কীভাবে ওদের সান্ত্বনা দেব? আমিও তো অসহায়। আমার কথাই লোকে শুনবে কেন। আমি তো আগাগোড়া মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রাণী। প্রয়োজন ছাড়া মানুষের কাছে কখনও যাইনি। আমার তত্ত্ব কথা ওরা বোঝে না, আমিও যে সুবিধাবাদীর দলে, মানুষগুলো স–ব বুঝে গেছে, আমাদের চিনে নিয়েছে। আমার কথায় তো ওদের পেটের খিদে মিটবে না। ওদের কাছে পেটের খিদে সত্য। ওরা দেখছে আমরাও কীভাবে লোভীদের মতো পা চেটে চেটে বেঁচে আছি। কেউ জাদুঘর, কেউ নন্দন, কেউ চিড়িয়াখানা অথবা আকাদেমির চেয়ারম্যান হয়ে বসেছি। সরল মানুষগুলোর তাতে দোষ কোথায়, মানুষ তো ভালো করে বাঁচতে চায়, শান্তি চায়। আমরা কি তাদের এ সব এনে দিতে পারবো? আমাদের ক্ষমতালিপ্সু নগ্ন চেহারা তাদের জানা হয়ে গেছে।
আবার ব্যাঙ ও হরেণ-কে লেখার কিছুটা অংশ আবার শোনাই: “হরেণের বাড়ি উঠানে বসে ব্যাঙ, করিম, অন্নদা, আনন্দ, কার্তিক। হরেণের গাভিটা একুশ দিন হল বাচ্চা দিয়েছে। আজ গোরক্ষনাথের পূজা দিয়ে শুদ্ধ হবে। ছেলে-পিলেরা সব ভিড় জমিয়েছে। গোয়ালঘরের দরজা খোলা, ‘চান কাপাইলা’ বাছুর বাইরের দিকে চেয়ে লোকজনের রঙ্গ দেখছে। সামনে বিন্নারছোপ, শ্যাওড়ার ডাল, নতুন পাকানো পাটের দড়ি, একটি পান্টি, আসন, খইচিড়াদইফল। একপাশে রেকাবে সাজানো ক্ষীরের নাড়ু, ভাঙের নাড়ু। গোপাল ভাঁড় নামে একটি লোক এসে লাচাড়ি ধরল: ছেলেরা চিৎকার করে করে তার জবাব দিতে লাগল।
—কোদালে কাটিয়া মাটি!
— হেচ্ছ হেচ্ছ!
— বসাইলাম কুমার হাটি!
— হেচ্ছ হেচ্ছ!
— শোনো শোনো ও কুমার ভাই!
— হেচ্ছ হেচ্ছ!
— গোরক্ষ পূজায় হাঁড়ি আমার চাই!
— হেচ্ছ হেচ্ছ!
— হাঁড়ি যদি নাহি দিবে!
— হেচ্ছ হেচ্ছ!
— তোমার পাঁজা চুরমার হবে!
— হেচ্ছ হেচ্ছ! ইত্যাদি ইত্যাদি।
লাচাড়ি শেষ হলে গোপাল ভাঁড় ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম ঠুকে গিয়ে বসে বারান্দায়। ব্যাঙ মিঞার হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে কয়েক টান মারে। এ দিকে লাড্ডুর লোভে ছেলে-পিলের তর সইছে না। হরেণের গিন্নি মাথায় লম্বা কাপড় টেনে একটা প্রণাম ঠোকে। নাড়ুর থালা থেকে একটা নাড়ু ছুড়ে দিল গোয়াল ঘরের দিকে। এবার পেছন ফিরে: এই তরা পিছা, —-পিছা! গিন্নি এক মুঠো করে নাড়ু পূর্ব পশ্চিম উত্তর দিকে ছুড়ে দিল। শুরু হল নাড়ু নিয়ে কাড়াকাড়ি। ! ব্যাঙ এরই মধ্যে চেয়ে নেয়: আমারে একটা ভাঙ্গের নাড়ু দেইন!
ব্যাঙ হাতে নাড়ু পেয়েই মুখে পুড়ে নিল।
— দেখিস মাথা ঘুরায়া পইড়া যাইস না। গোপাল ভাঁড় রঙ্গ করে বলে।
— পরতাম না। ভাঙ খায়া অভ্যাস আছে।
এবারে খই-চিড়া-দই সব এক গামেলাতে ঢেলে মাখতে শুরু করল হরেণের স্ত্রী। সবাই যখন হাঁ-করে আছে প্রসাদের জন্য তখন-ই কোলাহলের একটা শব্দ সকলের কানে আসে। ব্যাঙ বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখে চিৎকার করতে করতে কিছুলোক ছুঁটে যাচ্ছে বটতলার মন্দিরের দিকে। ব্যাঙও ওই দিকেই দৌড় দেয়, ব্যাঙের পেছনে পেছনে বাকি-রা। সবাই আতঙ্কিত: ‘কী হইছে? কী হইছে?’ এই প্রশ্ন সবার। ঘটনা স্থলে গিয়ে দেখা যায়, বটতলার কালী মন্দিরে মৃন্ময়ী মূর্তির দক্ষিণ হস্ত আলগা হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। গায়ে অলংকার কোনো চিহ্ন নেই মাত্র নেই। সবাই টর্চের আলো ফেলে দেখছে: ‘কেডা করল? কেডা করল এমন কর্ম? এমন অনাচার!’ দেখতে দেখতে চারপাশে লোক আরও বাড়তে লাগলো। লোক-জনের চিৎকারের মধ্যে থেকেই আগুনের স্ফূলিঙ্গ বেরিয়ে এল। স্ফুলিঙ্গ এক-একটা মশালে রূপ নিল। সবাই ছুটছে, লক্ষ— কয়েক ঘর মুসলমান বাড়ি। মুহূর্তের মধ্যে আগুন আগুন চিৎকার, দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল বাড়িগুলো। নারী-শিশুর অসহায় চিৎকার চারদিকে, কে কোন দিকে ছুঁটছে অন্ধকারে বোঝা যায় না। এক মুহূর্তের মধ্যে যেন সব বদলে গেল। ক্ষোভ কী এতটাই ছিল যে, শেষপর্যন্ত আগুন লাগাতে হল! আগুনই-বা কারা লাগাল? মানুষ ক্ষোভে ছুটে গিয়েছিল ওই বাড়িগুলোর দিকে, কিন্তু আগুন তো তারা লাগায়নি। আগুন দেখেই বরং তারা এসেছিল, জল ঢেলে নেভাতে চেয়েছে।
ব্যাঙ আহত হয়ে পড়ে ছিল। তাঁর মাথায় কেউ বাড়ি মারে। হরেণ ছুঁটে আসে, বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে গেলে ব্যাঙ ক্ষিপ্ত হয়ে বলে: ‘যা যা… তরা সব-ই এক। এখন আমরাও এক হইতে হইব!’ ব্যাঙের এই কথায় হরেণ অবাক হয়ে যায়। কথাটা তাঁর কলজেতে লাগে। ব্যাঙকে বোঝাতে চেষ্টা করে, ব্যাঙ কোনও কথাই শুনে না, সে অন্ধকারে মধ্যে মিলিয়ে যায়।” — এখানেই থামলাম। আমার সামনে বসা নত মস্তক দু’টোর দিকে তাকাই, মাথা দুটো সোজা হয়ে আমার দিকে তাকায়। ভালোলাগা মন্দ লাগা কোনও কিছুই তাদের চোখ দেখে বোঝা গেল না। ব্যাঙ হরেণের চোখে শুধু অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। তারা উদ্ভুত পরিস্থিতি অস্বীকার করতে পারে না, কোনদিকে এগোচ্ছে তারা জানে। হরেণ, ব্যাঙ দু’জনেই চুপচাপ, উঠে দাঁড়াল, নিঃশব্দে তারা বাড়ি ফিরে গেল।
আকাশে তখন মেঘ নেই। শুকতারা জ্বল-জ্বল করছে। মনে মনে ভাবি, মানুষ চাইলে সব পারে। ওরাও পারবে। আমি আবার আমার অন্ধকার ঘরে বসে থাকি। নিজের হাতকেই ঘৃণা হয় আমার, যে-লেখা লোকের হিতে লাগে না, সে লেখা কেন-ই বা লিখি? কত লেখাই তো রাগ করে পুড়ে ফেলেছি। এ লেখাও নয় তাই…!
।। সাত ।।
সে-দিনের পর ব্যাঙ আর হরেণের সাথে আমার আর কোনওদিন দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। বাতাসে ভেসে আমার কাছে খবর এসেছিল, ব্যাঙ হরেণ পেরেছে। রাতের আঁধারে বটতলার কালী মন্দিরের দিকে কয়েকজন লোক এসেছিল, হরেণ দল বল নিয়ে তাড়া করে তাদের রুখতে পেরেছিল। এখন রোজ তারা পালা করে পাহারায় থাকে। কিন্তু কতদিনের সে পাহারা? ব্যাঙ আর হরেণের মতো লোক যখন থাকবে না, তখন?
আজ সকাল থেকে কত কী ভাবছি। মনটা অস্থির, সন্ধ্যার পরে জোৎস্না উঠেছে। পূর্ণ চাঁদ। চারদিকে শুধু আলো আর আলো। আকাশে মেঘ আবার অনেক উঁচুতে। সবুজ ধান গাছগুলোর গর্ভ হয়েছে। ধারালো পাতার আগায় রাত হলেই একটু একটু করে শিশির জমে। দূরে মানুষখেকো গাছগুলোয় আজ আবার আলো জ্বলে উঠেছে। সাবিত্রী আজ এসেছিল, আমার খোঁজ নিয়ে গেছে। ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, আজ পূর্ণিমা। যেন ভুল করেও ওই গাছের দিকে পা না-বাড়াই। পুরনো লেখাটা নিয়ে বসেছি। লিখছি: ” সাবিত্রীর মতো আকাশটার মতিও বোঝা ভার। এই রোদ এই বৃষ্টি। ডাবরির জমিতে এবার ধানের ঠিকি পড়েছে, সোনালি ধান। ব্যাঙ হরেণ মুঠি মুঠি ধান কাটছে আবার মাটিতে বিছিয়ে রাখছে। ধান শুকোলেই আঁটি বেঁধে আবার গোরুর গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে যাবে। …” থেমে যাই, কলম ধরা হাতটি এমে থেমে যায়। আবার হতাশা গিলতে থাকে আমায়। দু’হাতে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ি। কী পাইনি আমি? অনেক কিছুই, সুখ শান্তি সাবিত্রীকে কোনও কিছুই তো হলো না। লিখতে পারি না, যেটা বিশ্বাস করি না সেটা কলমের ডগায় আসে না। আমি ঘর থেকে বের হই। জ্যোৎস্নালোকিত চারপাশ, আমার মৃত শরীর, অতৃপ্ত আত্মা কেন বাঁচতে চায়? ভোগ বাসনা কী এক জীবনে তৃপ্ত হবার নয়? চাই—-চাই, আমার আরও চাই!
মানুষ খেকো গাছগুলির দিকে এগোতে থাকি, ফিরে যেতে থাকি আবার গাছের ভেতর। এক পা, দু-পা, তিন পা, চার পা করে এগোই, ক্রমশ গাছ আমার কাছে আসছে। ঘরের দরজা খোলা, টেবিলের ওপর রাখা আমার অসমাপ্ত লেখা। আগামীকাল হয়তো আবার বন্ধুরা আসবে। আবার গেলাসে গেলাসে বিয়ার, হুইস্কি ঢেলে নিয়ে বসবে। লেখা নিয়ে আলোচনা করবে, আড্ডা দেবে, চিৎকার করবে, কবিতা নিয়ে তর্ক করবে। কেউ একজন উঠে পড়তে শুরু করবে :
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি
কহিলা বীরেন্দ্র বলী, — ” ধর্ম্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি; — কোন্ ধর্ম্মমতে, কহ দাসে, শুনি
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি, —- সকলে দিলা
জলাঞ্জলি?….
ঋণ: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিদ্যাপতি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত।