কবিতা বিষয়ক আলোচনা : প্রশান্ত গুহমজুমদার

অখন্ড, অক্ষয়

“কোথাও আরম্ভ নেই, শেষ নেই। তবু মানুষের দেশে ঢেউ/ মানুষেরা কুলোর বাতাস নাড়িয়ে নাড়িয়ে তোলে…”
যাপনের এক পর্বে যিনি এমন জানবেন, যার কলম, ভাবনা বিস্মিত করবে দশকের পর দশক কাব্যপ্রেমীদের, সেই মানুষ, কবি মণীন্দ্র গুপ্ত শিলীন্দ্র পত্রিকায় তাঁর কবিতার সূচনা সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে কি বলছেন, সামান্য পরিসরে দেখে নেওয়া যেতেই পারে।
‘একজন দোয়েল কবে গান গাইতে শুরু করেছিল? একজন উদ্‌বেড়াল কবে সাঁতার কাটতে শুরু করল? একজন মৌমাছি কবে কেমন করে চাক বাঁধতে শিখল? এ সব প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে? মনে পড়ে, চেতনা জাগার পর থেকেই নিসর্গ আমাকে দারুন মুগ্ধ করত। নিসর্গের সৌন্দর্য আমি অনুভব করতে পারতাম- মন কেমন করত- মন আকুবাকু করত। …অপরিচিত অর্ধপরিচিত যুবক যুবতী বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মুখ ও আকৃতি আমি বিস্ময়ের সঙ্গে নিরিক্ষন করতাম। তাদের ঐ বাইরের খোলস, নড়াচড়ার ভঙ্গী দেখে দেখে ক্রমশ আভাস পেতাম তাদের জীবনের, রহস্যের। ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম, মৃত্যু, সময়, মহাকাশ নিয়ে নানা দার্শনিক চিন্তা মাথায় ঢুকল। এই সময় আমার মনে হত, আমি হয়ত চিত্রকর এবং ভাবুক, এক সময় আর পাঁচটা ছেলের মত লিবিডো আমার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল । হতে পারে তারই তাড়নায় আমার কবিতায় মনোনিবেশ।…ক্রমে কবিতাই আমার পরম আশ্রয় হল।‘
এই অনন্য কবি বেড়ে উঠেছিলেন প্রকৃতির কোলে। যেন বা প্রকৃতিরই আরেক সন্তান। যেখানে নদী খাল নিরন্তর খেলে চলেছে অনন্ত কাটাকুটি খেলা আর সেই জলপথ যা ছিল প্রায় একান্ত যাতায়াতের উপায়, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলায় তেমনই এক পৈত্রিক গ্রামে তিনি জন্মের পর থেকে অর্থাৎ ১৯২৬ সাল থেকে ক্রমে বড় হয়ে উঠছিলেন। পাশেই কীর্তনখোলা নদী। বৃক্ষ, অরণ্য, জল আর জঙ্গল, এই ছিল তাঁর পরিবেশ। তিনি মণীন্দ্র গুপ্ত, তিনি যেন বা কালের রাখাল। পাঠ করা হোক এই লেখাটি:

অশ্রু
পাখির মরণ যখন ঘনিয়ে আসে
তখন তাঁর ডাকের মধ্যেও ব্যথা ফুটে ওঠে।
মাঠের কাকতাড়ুয়ারাও তা বোঝে, সারা রাত তাদের হাড়িমাথায়
শিশির পড়ে পড়ে ভোরবেলায় চোখ ভিজে উঠেছে।
হেমন্তের ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে তারা দেখে-কৃষক আসছে
গোরু আসছে। ওদের চুনে আঁকা চোখ কি শেষ পর্জন্ত
আমার জ্যান্ত চোখের চেয়েও অনুভূতিপ্রবণ হল!
আমার কেউ আসে না, যায়ও না।
রাত্রে গোরের থেকে যারা ওঠে, তাদের কান্না কে শুনেছে!
যাবার আগে, আমার শেষ সান্ধ্যভোজের শক্ত পাউরুটিটুকু
অন্তত যাতে ভেজে,
আমি সেইটুকু চোখের জলের অপেক্ষায় আছি।

তাঁর ‘লাল স্কুলবাড়ি’ বইয়ের বেশ কিছু কবিতাও তাঁর এই যাপিত জীবনের ভালবাসায় সবিশেষ স্নিগ্ধ।
জীবনের শুরু থেকেই নানাবিধ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ তিনি অতিক্রম করলেও পারিপার্শ্বিকতা বিষয়ে তাঁর মগ্নতা, ভালবাসা কখনো নষ্ট হয় নি। আট বছর বয়সে কবি তাঁর পিতামহকে হারান। সেই শৈশবে ঠাকুমার বৈধব্যের জীবনযাপন কত গভীর ভাবে অবলোকন করেছিলেন, সেটা তাঁর আত্মজীবনী ‘অক্ষয় মালবারি’তে মর্মস্পর্শী ভাষায় কথিত। তিনি বলছেন, ‘…ঠাকুমা কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। যেন তিনি ম্যাটমেটে লাল পাড় শাড়ি আর মোটামোটা শঙ্খের জোরেই এতদিন হাঁকডাক করতেন, সংসার শাসন করতেন-এখন শাঁখা ভেঙ্গে থান পড়ার পরে একেবারে নির্বাক হয়ে গেছেন। এখন যে যা করতে বলছেন, তাই করছেন। বাকি সময় কাদায় ভেজা অনাথ বেড়ালছানার মত ঘরের অন্ধকার কোনটিতে বসে থাকেন, আর নিশুত রাত্রে নিস্তব্ধ স্বরে চমক ভেঙ্গে বলেন, ঐ ঐ দ্যাখ, দরজার ফাঁক দিয়ে বুড়া আমাকে ডাকে! দাদুর মৃত্যুর চোদ্দ দিনের মধ্যে ঠাকূমা মারা গেলেন।…’
এরপর তাঁকে চলে যেতে হল শিলচরে।
১৯৪১-এ স্কুলের পাঠ শেষে চিরকালের মত বরিশাল শিলচরের সঙ্গ ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। ১৯৪৩-এ ইন্ডিয়ান আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে লাহোর ক্যান্টনমেন্টে তাঁর পোস্টিং হল। সেও এক বিরল অভিজ্ঞতা। ১৯৪৬-এ শেষ হল সৈনিক জীবন।
১৯৬৯ সালে প্রকাশ করলেন ব্যতিক্রমী পত্রিকা ‘পরমা’। এ বছরেই প্রকাশিত হল আরো দু জন কবির সঙ্গে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিল পাহাড়ের আকাশ’। ১৯৮১ সালে তিনি প্রকাশ করলেন আত্মজীবনী তিন খন্ডের ‘অখন্ড অক্ষয় মালবেরি’র প্রথম খন্ড। এর পর আমরা পেলাম ‘মৌপোকাদের গ্রাম’, ‘আমার রাত্রি’,‘ছত্রপলাশ চৈত্রে দিনশেষ’, ‘লাল স্কুলবাড়ি’, ‘শরতমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু’ , ‘কবিতা সমগ্র’, ‘নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ’, ‘টুংটাং শব্দ নিঃশব্দ’, ‘বনে আজ কনচের্টো’, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘বাড়ির কপালে চাঁদ’, °মৌচুষি যায় ছাদনাতলায়’, ‘এক শিশি গন্ধহীন ফ্রেইগ্র্যান্স’, ‘নিরক্ষর আকবর’। এ ছাড়াও তাঁর কলম থেকে আমরা পেয়েছি প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘চাঁদের ও পিঠে’, ‘তাহারা অদ্ভুত লোকে’, ‘গদ্য সমগ্র’, ‘দ্রাক্ষাপুঞ্জ, শুঁড়ি ও মাতাল’, ‘রঙ কাঁকড় রামকিঙ্কর’, ‘প্রেম, মৃত্যু কি নক্ষত্র’। এ ব্যতীত তিনি কবি রণজিৎ সিংহকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচ খন্ডে সম্পাদনা করলেন ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭২-১৯৭৬), তিন খন্ডে ‘আবহমান বাংলা কবিতা’। এ সবের বাইরেও তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী।
২০১০-এ মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘টুংটাং শব্দ নিঃশব্দ’র জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হলেন। ২০১১তে ‘বনে আজ কনচের্টো’-র জন্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মান। গত বছর ফেব্রুয়ারী মাসে পঃবঃ বাংলা অ্যাকাডেমি আয়োজিত কবিতা উৎসব–এ তাঁকে লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হল। এই সব সম্মান, পুরস্কার কবিকে কতখানি প্রীত বা উদ্বুদ্ধ করেছিল, জানা নেই। কিন্তু ক্ষুদ্র পত্রিকার সঙ্গে জড়িত তাবৎ সাহিত্যপ্রেমী বাঙালী পাঠকের কাছে মণীন্দ্র গুপ্ত যে বড় প্রিয় মহৎ একজন কবি এবং ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, তা বলাই বাহুল্য।
তরুন কবি এবং প্রাবন্ধিক রমিত দে নিজস্ব অনুভব জানাচ্ছেন এ ভাবে, ‘…দশকচিহ্নিতহীন কবিতার পিঠে চেপে শিবপিথেকাস, রামপিথেকাস, পিকিং মানুষের ফেলে দেওয়া ভাঙ্গা হাঁড়ি-সরার খেলাঘর গুছিয়ে ত্রিমাত্রিক চেতনায় মেতেছে তাঁর অনতিক্রম স্বাতন্ত্র। প্রকৃত অর্থে তিনি একজন পরিব্রাজক।’
৪২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রাক্কালে বুধবার রাত্রে তাঁর স্ত্রী কবি দেবারতি মিত্র, অজস্র কবিতাপ্রেমী এবং ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকার সমস্ত শোকার্ত পরিজনকে ঐহিক বন্ধনে রেখে প্রিয় কবি মণীন্দ্র গুপ্ত ইহলোক ত্যাগ করলেন। আমরা বিষন্নতায় ডুবে যেতে যেতে বারবার পড়ব,

এক লক্ষ বছর থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কিনা
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে,
চলো খেয়ে আসি।…

কখনো গোপন অবসরে পাতা উল্টোতে উল্টোতে চোখ রাখব এই পংক্তিসমূহে,
আমি পারি না, কিন্তু তোমরা প্রত্যেকটা পরিবার বাড়ি তৈরি করো
আনন্দময় বাড়ী
আমি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যান করে দেব,
নিজে দেখাশোনা করে বানিয়ে দেব।…
অথবা আমরা পড়ব,
বাউলের মত আমি ভিতরে জ্বালাব বাতিঃ এই অলীক
ঘুরিয়ে মেরেছে বহুদিন। বহুদিন এই জন্যে নির্বাপিত থেকেছি আঁধার
ঐ টিমটিমে নিজস্ব বাতির জন্য এত লোভ! এই এক অভিমান, মায়া।
তবু ভাগ্য, ঈশ্বর আমাকে ফিরিয়েছেন ঠিক পথে-রোদ্দুরে, কাদায়, জলধারে,
মোষের মতন পাঁকে, সাপের মতন পদ্মবনে, সন্ন্যাসী-বাঁদর-অভিমানে।

ভাগ্যিস জ্বলে নি আলো, তাই এখন বিশালতা ছুঁতে পারিঃ
নীলের গহন অভ্যন্তরে ফুটে ওঠে সুদূর মন্দির। এখন মেঘের দেশে
বেলা যায়। ভেসে যায় স্নেহে দশদিকে তোমার হাসির মুখখানি ।

আমি বিকেলবেলার সুর্যে মুখ রেখে, অবাস্তব এখন মিলিয়ে যেতে পারি,
যাই নীরব রোদ্দুরে।

যত দিন বাংলা কবিতা পঠিত হবে, আমরা বারবার দেখব, যেমন রমিত দেখেছেন, উতরোল সমুদ্র জীবনে গোলাপি পায়ের পাতা হাঁসের মতই বট পাকুড়ের ব্যাপারী কোথাও শূন্য থেকে লাফিয়ে নেমেছেন শ্রমনে আবার কখনো শূন্যের উন্মুক্তিতেই ভাঙা জানলার ছবি আঁকতে আঁকতে দৃশ্য সাদৃশ্যে কবিতামন্থনে শেকড় বাকড় চারিয়ে বিস্ময় থেকে বিযুক্তি থেকে একীভূত পরিণামে স্রষ্টাকে পেরিয়ে যাচ্ছে কবি মণীন্দ্র গুপ্তের অলখ অনুগত যাত্রা।

Facebook Comments

Posted in: May 2020, PROSE

Tagged as:

Leave a Reply