করোনাভাইরাস ক্রান্তিকালে নিউ ইয়র্ক থেকে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য : পার্থ ব্যানার্জী
তৃতীয় সুর, ষষ্ঠ সুর — গুপী চললো বহুদূর।
(করোনাভাইরাস ক্রান্তিকালে নিউ ইয়র্ক থেকে জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।)
এক এক সময়ে মনে হয়, আমি বোধহয় গুপী। আমলকি গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া গুপী।
আর তখন সেই গানটা মনে পড়ে। “তৃতীয় সুর, ষষ্ঠ সুর (২ বার গাইতে হবে), গুপী চললো বহুদূর … বহুউউউউ দূর।” আমি যেন সেই গাধার পিঠে বসে গ্রাম থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাওয়া গুপী — শেষবারের মতো। গ্রামের কিনারায় চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকা আমার অসহায় বাবা। পাশে অদ্ভুত একটা বিষাদের সুর।
আমি গাইছি, “চলি চলি চলি চলি, পথের যে নাই শ্যাষ … কেবল আছে ভাবনা ভাবনা … সন্ধে হৈলে বনবাদাড়ে বাঘে যদি ধরে … গুপী যদি মরে?”
প্রথম যখন শুনেছিলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। আজ, “প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যদি খসে এ দেহ-আকাশ হতে” ক্রান্তিকালে মধুকবির কথা মনে হয়। আর ওই তৃতীয় সুর ষষ্ঠ সুরের কথা।
নিজেকে তাড়িয়ে দেওয়া গুপীর মতোই লাগে। আমেরিকায় এসে পঁয়ত্রিশ বছর থেকেও মিলিয়নেয়ার হওয়াও হলোনা, আবার এদিকে এই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যদি জিজ্ঞেস করেন, “হা হা এখন কেমন লাগছে?” বলবো, “চমৎকার। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হয় রে জীবননদে?”
মানে, সোজা বাংলায় যাকে বলে, “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
এক্ষুণি মরার প্ল্যান নেই মোটেই। সে করোনা বলুন, আর মগনলাল বলুন, কারুর হাতেই নয়।
*****
সত্যজিৎ রায় আর রবীন্দ্রনাথ আর বিভূতিভূষণ বাঁচিয়ে রেখেছেন। লীলা, সুকুমার, সন্দেশ। আর ব্যোমকেশ বক্সী। আর শঙ্কুর বিজ্ঞান।
তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ হলেন জীবনের ধ্রুবতারা। “এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা। যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো, আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।”
বিভূতিভূষণ হলেন মায়াময় সন্ধ্যাতারা। ওই সর্বজয়া, হরিহর, ইন্দির ঠাকরুণ, আর হারিয়ে যাওয়া দুর্গা। আম আঁটির ভেঁপু, আর কাশবনে রেলগাড়ির দৌড়। রুপো কাকা, ভণ্ডুলমামা, শংকর, আর ডিয়েগো আলভারেজ।
আর সত্যজিৎ, তারার জোনাকি। সারা আকাশ জুড়ে ঝিকমিক করে চলেছে সারা জীবন ধরে। সে তারায় দীপ্তি আছে, কিন্তু অতিরিক্ত উজ্জ্বলতা নেই। দারুণ বুদ্ধি আছে, কিন্তু শো-অফ নেই। আপাদমস্তক বাঙালিত্ব আছে, কিন্তু উগ্রতা মোটেই নেই।
আমার এই সামান্য বাংলার বাঙালি আর ভারতীয় বাঙালি জীবনদর্শন তৈরী করে দিয়ে গেছে — বাড়িয়ে বলছি না — অপু, ফেলুদা, আর গুপী।
*****
আর ছোট ছোট গল্পের অদ্ভুত সব চরিত্র। পটলবাবু ফিল্মস্টার। বঙ্কুবাবুর বন্ধু। বাতিকবাবু। অনাথবাবু। রাজেনবাবু।
আসুন, একটা খেলা খেলি। দেখি, কেমন খেলতে পারেন। সব কটা সত্যজিতের চরিত্র। সিনেমার আর গল্পের।
বলুন তো, শীতলাকান্ত রায় কার নাম? বলুন তো, বারীন ভৌমিক ট্রেনে কোন নজরুলগীতি গেয়েছিলেন? বলুন তো, জটায়ুর আবির্ভাবের আগে ফেলুদার সহযোগী কমিক চরিত্র কে ছিলেন? বলুন তো, ত্রিপুরাবাবু কার নাম? বলুন তো, প্রফেসর হিজিবিজবিজ গল্পে গোপালপুরের হোটেলের মালিকের নাম কী ছিল?
বলুন তো, বাতিকবাবুর সারনেম কী? সেপ্টোপাশের খিদে গল্পে লেখক চরিত্রের নাম কী? তার বন্ধুর নাম? বন্ধুর কুকুরের নাম?
কুকুরের কথায় মনে পড়লো, অসমঞ্জবাবুর কুকুরের নাম কী ছিল বলতে পারেন? আর সেই লোভী মার্কিন সাহেবের নাম, যে সেই চিরসঙ্গী কুকুরকে কিনে ফেলতে চেয়েছিলো?
কোনোটাই কিন্তু বই দেখে বললে চলবেনা। আর, প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দশ সেকেণ্ডের মধ্যে বলতে হবে। না হলেই অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমার মেমরি গেমের মতো আপনি আউট।
রবি ঘোষ কেন রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স আর ক্লিওপেট্রার পর অতুল্য ঘোষের নাম বলেছিলেন কালো চশমা পরে?
রবি ঘোষ সত্যজিতের কতগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন? সেই চরিত্রগুলোর নাম বলতে পারেন?
*****
এই রকম হাজার মজা। হাজার হাজার ডক্টর হাজরার মতো হাজার হাজার আশ্চর্য বর্ণময় চরিত্র। তারা সবাই বলে, শিক্ষা আগে, ধর্মান্ধতা নয়। তারা বলে, ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যসঙ্কটে বিজ্ঞান চাই, তাগা তাবিজ মাদুলি চরণামৃত নয়।
তারা সবাই বলে, এসো আমরা সবাই মিলে ঘুরঘুটিয়া থেকে জয়সলমীর, আর কাশী থেকে কাঠমাণ্ডু পর্যন্ত খুনি, জাল ওষুধের কারবারি, আর স্মাগলারদের শায়েস্তা করি। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত মিডিয়ার মালিকদের মুখোশ খুলে দিই। হীরক রাজার মূর্তি ভেঙে ফেলি।
তিনি চীৎকার করে, শ্লোগান দিয়ে এসব কথা বলেননি। তিনি তাঁর মতো করে, ওই আকাশজোড়া তারার ঝিকমিক আলোর মতো বলে গেছেন।
আমরা যারা আকাশের দিকে এখনো মাঝে মাঝে তাকাই রাতের অন্ধকারে, তারা দেখতে পাই। শুনতে পাই তাঁর কথা।
আর যারা চোখ বুজে থাকি, কান চাপা দিয়ে থাকি, মুখ বন্ধ করে থাকি, তাদের চোখে আলো জ্বালাতে, হৃদয়ে গানের সুর পৌঁছোতে, আর মুখে ভাষা ফিরিয়ে দিতে বোধহয় কোনো গুপী গায়েন পেরে উঠবেনা।
আমাদের আশা — যারা এখনো ওই দারুণ মজার ধাঁধাগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে — তাদের নিয়ে।
বাকীরা — আপনারা অন্ততঃ তৃতীয় সুর, ষষ্ঠ সুর — এই ধাঁধাটা চেষ্টা করুন। কারণ, আত্মপরিচয় লাভ করবেন।