করুণা ও করোনা নিয়ন্ত্রিত বাংলা থিয়েটার : নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়

মহামারীর সঙ্গে মোকাবিলা বাংলা থিয়েটারের এই প্রথম নয়। উনিশ শতকের একেবারে শেষভাগে করাল প্লেগের কবলে পড়েছিলো কলকাতা। তার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলো না থিয়েটারও। কিন্তু সেই সংকট কালে বাবুদের কলকাতা ছেড়ে কাশীবাসী হওয়া অথবা পশ্চিমে পালিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয় অদ্ভুত ভাবে তার থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছিলো বহু বাংলা থিয়েটার, তা মূলত Babu’s theatre হয়েও। কেবল তাই নয় মহামারী মোকাবিলায় স্টার, ক্লাসিক, মিনার্ভার মতো থিয়েটারগুলি অথবা গিরিশ ঘোষ বা অমরেন্দ্রনাথ দত্তের মত ব্যক্তিত্বের অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা দেখা যায়। বাকি থিয়েটারের অনেকটাই কলকাতা শহরে প্লেগ এড়াতে সে সময়ে ঢাকা শহরে প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও স্টার, মিনার্ভা এবং বিশেষত অমরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ক্লাসিক থিয়েটার একের পর এক চ্যারিটি নাইট করেন এই প্লেগে জর্জরিত কলকাতাতেই তাঁদের নিজেদের থিয়েটার বাড়ি চালু রেখে এবং তার থেকে প্রাপ্ত অর্থ প্লেগ রুগীদের সাহায্যার্থে দান করা হয় অমরেন্দ্রনাথ দত্ত তো শোনা যায় নিজে হাতেই প্লেগ রুগীদের সেবায় মগ্ন থেকেছিলেন। যদিও আগত দর্শকের সংখ্যা সেই সংকটে প্রচুর ছিলো এমন নয়। কাজেই একথা বলাই যায় মহামারীজনিত দুর্ভোগ বাংলা থিয়েটারে অনেক আগেই পুইয়েছে।

কিন্তু এই করোনা কালের সঙ্গে তার তফাৎ হলো সে সময় মহামারীও বাঙালিকে সামাজিক দূরত্বের কোনও সরকারি নিদেন দিতে পারেনি। অথবা লকডাউন শব্দটি তখন বাঙলা ডিকশেনারিতে স্থানযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে যার সম্ভবনা প্রবল। করোনা জনিত ভয় ও দীর্ঘ লকডাউন বাংলার তো বটেই পৃথিবীর সামাজিক,মানসিক ও অর্থনৈতিক ধরণে এ মুহূর্তে একটা অপ্রত্যাশিত বদল এনেছে। গভীর অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে প্রায় পৃথিবীব্যাপী সমস্ত জীবিকার মানুষকে। কাজেই বলাইবাহুল্য বাংলা থিয়েটার বিশেষত বাংলা প্রসেনিয়ম থিয়েটারও আজ গভীর অনিশ্চয়তায়।

যদিও একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় বাংলা প্রসেনিয়ম থিয়েটারের নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ কোনও কালেই তেমন ছিলো না। একেবারে ১৭৯৫ অর্থাৎ লিয়েবেদেফের করা প্রথম বাংলা প্রসেনিয়ম থিয়েটারের সময় থেকেই তা সত্য। এমন কী উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতকের সত্তর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত সময়ক যদি বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণ যুগ বলে দাবিও করি তবু এ কথা হলফ করে বলা যায় সে সময়েও থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কাল খুব নিশ্চিত ছিলো না। তবু এই অনিশ্চয়তা নিয়েও ক্রমশ ধুঁকতে বাংলা থিয়েটার টিকে গেছে। কয়েক দশকে সেই অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। এবং এসময়ে এই অনিশ্চিত অবস্থাকে আরও একটু গাঢ় করেছে মহামারী করোনা থেকে উদ্ভুত পরিস্থিতি।

গত চারমাসে দীর্ঘ লকডাউনের ফলে ধুঁকতে থাকা বাংলা থিয়েটার একেবারে বন্ধ। লকডাউন উঠে গেলেও বাংলা প্রসেনিয়ম থিয়েটার এখনই খুব সচল হয়ে উঠবে না আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি থেকেই তা আন্দাজ করা যায়। প্রথমত থিয়েটার কখনই অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠেনি বাঙালির জীবনে। কাজেই করোনা কালের অন্তে রুটি রুজির যোগানে ব্যস্ত মানুষ খুব বেশি থিয়েটারের পুর্নবাসন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না বলেই মনে হয়। এমনিতেই বাকী শিল্প মাধ্যমগুলির নিরিখে জনপ্রিয়তার বিচার বা চাহিদা অনুসারে থিয়েটারকে শেষের সারির বললে অভিমান হতে পারে কিন্তু অসত্য হবে না। দ্বিতীয়ত যদি থিয়েটারের মানুষেরা কোনও দৈবীবলে লকডাউন ওঠার পরই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করেন তবুও করোনা যে সামাজিক ঘনিষ্ঠতার ভীতি আগামী কয়েক প্রজন্মের জন্য স্থির করে দিয়ে গেছে তার থেকে বাংলা নাটক রেহাই পাবে এমন আশা দেখিনা। বিশেষত কলকাতায় হলমুখী বাঙালি দর্শকেরদের সামাজিক মেলামেশার ভীতি আপাতত বাষ্পীভূত হবার সম্ভবনা বেশ কম।

এখন বাংলা থিয়েটারের এই বন্ধ বর্তমান এবং অচিরেই সচল হবার সম্ভবনাহীন ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত কারা হবেন! নিঃসন্দেহে মানসিক ক্ষতি এবং আর্থিক ক্ষতি দুটিই প্রত্যক্ষভাবে থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকেদেরই হবে। কারণ বাংলা থিয়েটারের বড় অংশের দর্শকও কোনও না কোনও ভাবে থিয়েটারেই যুক্ত।

আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি দলগুলো হবেন যদি সরকারি অনুদান বদলে যাওয়া পরিস্থিতির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অনুদানের প্রাথমিক শর্ত তো থিয়েটারের প্রদর্শন। সেটা যদি থিয়েটার কর্মী এবং থিয়েটার হল সাহস করে করতে পারেন তবে হওয়া সম্ভব। আর দর্শকের আনাগোনা মনে হয়না লকডাউন উঠলেও অচিরেই সম্ভব হবে। যদিও ইদানিং বাংলা থিয়েটারে দর্শকের চাহিদা থাকলেও দর্শক নির্ভরতা একেবারেই ছিলো না। বিরাট হলে চারটি দর্শক নিয়ে দু ঘন্টার থিয়েটার বাংলায় আকচারই হয়। কাজেই লকডাউন পরবর্তী কালেও তিন চারজন সাহসী দর্শক বাংলা থিয়েটার পাবেনা অতটা হতাশ আমরা হলাম না।
একমাত্র অনুদান লব্ধ দলগুলির কয়েকটি ছাড়া মঞ্চ নির্ভর বাংলা থিয়েটারের আর্থিক ক্ষতির বা অর্থ আমদানির অপরাগতার অভ্যেস বহু বছরের। কাজেই এ নিয়ে নতুন করে বিচলিত তাঁরা হবেন না বলেই আশা করা যায়। অধিকাংশ অভিনেতা, পরিচালক এবং নাটককারের থিয়েটার থেকে অর্থের মুখ দেখা গত কয়েক দশকে একমাত্র দিবাস্বপ্নেই সফল হতো কাজেই অর্থনৈতিক ভাবে এঁদেরও থিয়েটার বন্ধ থাকার কারণে অকূলপাথারে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে না। থিয়েটারের সঙ্গে মানসিক প্রেম এবং একে ঘিরে বেঁচে থাকার অভ্যেস অবশ্য এঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আগামী ভবিষ্যতেও হবে অবশ্যই।

এই মুহূর্তে সত্যকার আর্থিক ক্ষতির মুখে বাংলা থিয়েটারের টেকনিশিয়ানরা। কারণ থিয়েটারের এই দুরবস্থার সত্ত্বেও তাঁদের মূল রোজগার থিয়েটার কেন্দ্রিক। আলোর মানুষ, মিউজিকের মানুষ , সেটের মানুষ, হলের পরিচালনে যাঁরা আছেন সকলেই গভীর সংকটে এ সময়ে কোনও সন্দেহ নেই। এর ওর সাহায্য থেকে প্রাপ্ত সামান্য অনুদানে এ সংকট মেটার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং থিয়েটার দুজনকেই বিকল্প ভাবনা অথবা জীবিকার সন্ধান এঁদের দিতেই হবে।

এককালে এই বাংলা থিয়েটার নিজে সামাজিক বদলে অথবা এক অর্থে উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। যে কোনও সামাজিক সংকটে অনিশ্চয়তা নিয়েও বাংলা থিয়েটার চিরকাল সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে গেছে। প্লেগের সময়ে এর ভূমিকার কথা তো আগেই হয়েছে সেখানে মহামারী মোকাবিলায় থিয়েটারকে সামান্য হলেও আর্থিক ত্রাতার ভূমিকায় দেখা যায়। কিন্তু করোনা কবলিত পৃথিবীতে বাঁচবার একমাত্র নিদানই যখন সামাজিক দূরত্ব তখন বাংলা থিয়েটারের সামাজিক মঙ্গলার্থে থিয়েটারকে হাতিয়ার করা অত্যন্ত কষ্ট কল্পনা, কিন্তু যদি তা কোনও কারণে সত্যও হতো, তাও বর্তঅমান বাংলা থিয়েটারের আর্থিক মেরুদণ্ড নিয়ে কতখানি আর্তের সেবায় লাগা সম্ভব ছিলো খুব সন্দেহ। কেবল মহামারী নয় পতিতা মেয়েদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া, নীল চাষের মতো শোষনের বিরুদ্ধতা, স্বাধীনতার বোধ জাগরণ থেকে গণনাট্যের মাধ্যমে সমাজকে সমানাধিকারের ধারণা দেওয়া সবেতেই ভারতীয় থিয়েটারে বাংলার ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য, অন্তত বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস তেমনই বলে। কিন্তু করোনা, লকডাউন ইত্যাদি মিলিয়ে বর্তমান উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মানবিক জীবনের আর সমস্ত ঘটনার মতোই থিয়েটার নিজেই বদলের শিকার। কাজেই তার ভূমিকা নিয়ন্ত্রকের, পরিবর্তকের আর থাকা সম্ভব নয় বলেই আমাদের ধারণা। এছাড়াও অন্যান্য বিনোদন মাধ্যম জোরালো হবার সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারের প্রতি প্রেম এবং আকর্ষণ ফিকে হয়েছে অনেক। যাঁরা বর্তমানে থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁদের বড় একটা অংশেই থিয়েটারকে ঘিরে সামাজিক বদলের স্বপ্ন খুব বেশি দেখেন এমন নয়। কাজেই এসময়ের বাংলা থিয়েটার খুব বেশি নতুন দিশা দেখাচ্ছে এমনটা নয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু বহুলাংশে এইটে সত্যি। এছাড়াও করোনা মানুষের আত্মবিশ্বাস দুর্বল করেছে, বদলে দিয়েছে মনের গতি। মানুষ এ পরিস্থিতিতে সামাজিক হওয়ার চেয়ে বেশি আত্মপর হতে বাধ্য। থিয়েটার ব্যতিক্রম হবেনা তো বটেই। এর ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আমফান নামক সাইক্লোন কলকাতা নির্ভর জীবনের ওপর আরও একটা ধাক্কা।

তবুও এতসব লেখা সত্ত্বেও একথা বলা যেতেই পারে এতোক্ষণ যা কিছু বললাম সবটাই শহর কেন্দ্রিক মানুষের ধরণ এবং বিনোদনকে মাথায় রেখেই। কিন্তু কলকাতা ও গুটিকয় শহর ও মফস্বল বাদ দিলে বাংলা থিয়েটার বলতে আমরা যা বুঝি গোটা বাংলার সে থিয়েটারের সঙ্গে সংস্রব সামান্যই। এখনও বাংলার গ্রামে গ্রামে লোকনাট্য, যাত্রার জনপ্রিয়তা খুব কম হয়ে যায়নি। এখনও স্যানিটাইজ সোসাইটি একমাত্র বাংলা নাট্যের পথ নয় অথবা কুশীলব বা দর্শকও নয়।

সমস্ত ঝঞ্জা, মহামারী, লড়াই, ধ্বংস এসবকে মোকাবিলা করেও মানুষ কখনও বিনোদন ছাড়া বাঁচেনি। অভিনয় ছাড়া তো নয় বটেই। একেবারে আদিম গুহাচিত্রেও তার প্রমাণ আছে। সমস্ত নেতিবাচক দিকের পরেও বলতে পারি নাটক বেঁচে থাকবে গ্রামীণ জীবনে, সারল্যে। শহুরে থিয়েটার তার থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন দিশা পাবে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়া ভীত থিয়েটার থেকে এমন কেউ একজন অথবা কিছু একটা জেগে উঠবে যার থেকে তৈরি নতুন কোনও থিয়েটারের ধরণ। সবটাই এখনও অব্দি আশা এবং কল্পনা হলেও কিঞ্চিৎ আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলনও বটে। কাজেই অনিশ্চিত বর্তমান নিয়ে দিব্য টিকে থাকা বাংলা থিয়েটার অনাগত অনিশ্চিত ভবিতব্যের কল্পনা করে ভীত হবে না এই তো স্বাভাবিক। আগামী পৃথিবীতে বাংলা থিয়েটারের করুনা এবং করোনার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি ঘটবে এই আশা রাখি।

[লেখিকা সাংবাদিক, নাটককার, নির্দেশক। বিভিন্ন গণ মাধ্যমে সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন নির্মাণ প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। নাটক লেখক হিসেবে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। বিভিন্ন নাট্যদলে নাটককার ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ও সংযোগসূত্র নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত। নীলার লেখাপড়া নাটক ও গণজ্ঞাপন নিয়ে। বর্তমানে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও লেখালেখিকে।]

Facebook Comments

Leave a Reply