মানবেন্দ্র সাহা-র কবিতা

সাধন ৪

পানিতে বঁড়শি চুবাইয়া বইস্যা থাকে রসিক মন আমার। সারাদিন বইস্যা থাকে। তারে ফকিরি শিখবারে কই, তারে সাধন শিখবারে কই। সে শোনেনা। শুধু ফাতনার পানে চাইয়া থাকে, আর দ্যাখে ক্যামনে সুয্যি হৃল্লেখবীজ থেইক্যা সইরা আসে আজ্ঞাচক্রের দিকে। চাঁদি পুইড়া যায় সাঁই, চক্ষু ধাঁধাইয়া যায়। সবকিছু দিয়া, কতো যতন কইর‍্যা বঁড়শি চুবাইছে সে পানির নিচে, তবু ফাতনা ডোবেনা। শুধু থাইক্যা থাইক্যা কিছু চুনোপুঁটি ঠুকরাইয়া যায়। ফাতনা নড়ে শুধু, শুধুই নড়ে, ডোবেনা। মাছ ধরা কি বিফলে গেল সাঁই, সাধনভজন কি বিফলে গেল! অথচ যখন রাত্তির হয়, তখন কত মাছ, কতো রঙিন মাছ ঘুরতি থাকে মস্তকের চারিদিকে । তারপর আজ্ঞাচক্র থেইক্যা হৃল্লেখবীজ, হৃল্লেখবীজ থেইক্যা কুণ্ডলিনীর দিকে যায় তারা। কুণ্ডলিনীর নিচে ঝুলতি থাকে একখান বঁড়শি। আর ঝুলতি থাকে বঁড়শিবিদ্ধ কাম। একখান দীঘল মাছ সে বঁড়শিখান টেইনে নে যায় রাত্তির গভীর অন্ধকারে। আমারে ধরো সাঁই, আমারে ধরো। আমার ফাতনা ডুইবা যায়। আমার কুণ্ডলিনী ডুইবা যায়, আমার হৃল্লেখবীজ ডুইবা যায়।

সাধন ৫

পূর্বাভাস তো ছিলোই
সেমতই ঝড়ও
আহামরি কিছু নয়
নিয়মমাফিক
কিছুটা ধুলো, চিটচিটে ঘাম
অসমাপ্ত বাগানের কাজ
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিফোঁটা
ভিজে মাটির গন্ধে
একতারায় ব্যাঙের ডাক
দূরদূর পর্যন্ত অন্ধকার পাড়ায় প্রজ্ঞাহীন চর্চা
অন্ধকারে ডুবে যায় নদীয়া
নির্ঘুম জোনাকি
হাজারো মুখচোরা অন্ধকার
ক্লান্তির ঘুম নিয়ে
তারপর অচেতন বালিকারা
ঘুমপায়ে হেঁটে চলে যায় চেরা বেদানায়
ধীরেধীরে রতির ঘরে তালা
জন্মান্ধ মাঝি একমনে দাঁড় বায় উজানে

সাধন ৬

একখান হলুদমণি পাখি বইস্যা থাকে শিয়রে। থাইকা থাইকা জিগায় কৃষ্ণ কোথা গো! আমি তারে অন্দরে ডাকি। সে আসে না। খালি নীল আকাশের পানে চাইয়া চাইয়া কান্দে। আমি যখন নায়র করি সে দাঁড়ের উপর বইস্যা রয়। নাও টানতে দেয়না। ভাঁটা টাইন্যা নে যায় আমারে। কও গোসাঁই আর কতদিন পর আমার এ ভাঙা নাও উজান বাইতে শিখবে। আর কতদিন পর এ ভাঙা নাও দাঁড় বাইতে শিখবে। একখান হলুদমণি পাখি নাওয়ের উপর আইসা বসে। অন্দরে আসেনা। শুধু থাইকা থাইকা জিগায় কৃষ্ণ কোথা গো?

সাধন ৭

ধূনির আঁচ কইমা এলে পর একটুখানি খোঁচা দিতে লাগে। গোসাঁই কন একথা। একটুখানি হাওয়া একটুখানি মন। একটুখানি দম ধরতে হয় কলজেয়। আমি সারারাত্তির ধূনি আগলাইয়া বইসা। কিন্তু আমি কি আর মোহান্ত গোসাঁই! আমার ঘরের চালচুলো ফুটা,আমার জানালা ফুটা, দরোজা ফুটা। দম ধরবো ক্যামনে। শীতকালের ভিজা হাওয়া, একদিক থেইক্যা ঢোকে, অন্যদিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। আর আলো আঁধারিতে দেখি একখান ঢ্যামনা সাপ বাতাবিগাছের গুঁড়ি আঁকড়াইয়া ভিজতাচে আপনমনে।

সাধন ৮

আর কোনো পথ নাই
পৃথিবীর সমস্ত পথ যেন ঘুরেফিরে
এই বাঁধানো ঘাট
সম্মুখে নীল শার্সি
মন শান্ত হলে পর বহুদূর দেখা যায়
নিচে
টুকটুকে লাল পদ্ম
অষ্টদল
পাপড়ি কেঁপে ওঠে
নিস্পন্দ মনের অতল
ঘাটের একপাশে যুবক চণ্ডীদাস
ছিপ ফেলেছে ভাবসায়রে
অন্যপাশে রজকিনী
রামী

বাকিটুকু “শাওন ঘনঘোরে ঘোর ঘনঘটা”

রামী দুইহাতে বস্ত্র তুলে ধরে
ফের আছড়ে পড়ে
পাথরের বুক
মন নড়ে ওঠে
কেঁপে ওঠে জল
নড়ে ওঠে ফাতনা
কবি ঘাই মারে জোরে
খিলখিল করে হাসে রামী
কবি ঘাই মারে
আবার মারে
জল ঘোলাটে হয়
অষ্টদল পদ্ম ধীরেধীরে অদৃশ্য হলে
সিঁড়ি বেয়ে বাড়ি ফিরে যায় ভানুসিংহ।

Facebook Comments

Leave a Reply