কৌশিক বাজারী-র কবিতা

পত্রগুচ্ছ

একটা চকচকে লাল মেঝের ঘর তোমার চাওয়া ছিল শুধু। দেয়ালে সাদা চুন আর কাঁঠালীকলার গন্ধ মম করবে ঘরময়। আমাদের ছোটবেলায় চুনের সাথে কাঁঠালিকলার রস আর ধুনোর গন্ধ মেশানো হত জানো! কাঠের জানলা খুলে দিলে পিছনের কাঠচাঁপা এসে পড়বে ঘরে। সকালে রৌদ্রের রঙ আর দুপুরে হাওয়া, এইটুকু চাওয়া ছিল? এখন তোমার হলুদ দেয়ালজুড়ে তীব্র খনিজ গন্ধে মাথা ঘুরে যাচ্ছে, পায়ের নিচে পিছল ইয়লো টালির শীতলতা!  ঘুম পাচ্ছে তোমার! জানলা খুলে দিলে অনেক উপর থেকে দিগন্ত দেখা যায়? এও একরকম দেখা! বল? জানলা খুলেছ? শীত শেষের বাতাস এসে পড়ল দেখ।  ঘুমোতে যাবে না? স্বপ্নের মধ্যে দেখ সেই লাল মেঝের উপর চাঁদ এসে পড়ছে দেখ,  যেন মিথ্যে স্বপ্ন! আমি বহুদূর থেকে ধুনোর ধুপ জ্বালিয়ে দিই?…


আমার লাল আমার সবুজ, তুমি আমার জন্য আজারবাইজানের আধখানা খেজুর তুলে রেখেছ মাটির থালায়। আমার মরু-প্রহর শেষ হলে সেই উদ্যান, যেখানে সেই নীল জলাশয় আর খেজুরের বন। তোমার আদরের দুম্বা দুটি করুণ চোখে চায়। আমি তাদের গলায় হাত রাখি। কখন পৌঁছব? ফালি চাঁদ আর তারকারা ভুল পথে নিয়ে গেছে বহুদূর।  ঘোররাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছি এক বার্খানের চুড়ায়। ও আমার লাল, আমার সবুজ, তোমার হাওয়া আসে রাত্রির উদ্যান পেরিয়ে, মরু-বার্খান সরে সরে যায়! স্বপ্নে দেখি মাটির থালা আর তোমার রেখে যাওয়া মেরুন খেজুর ওই ধুলায় লুটায়।


খুব যুদ্ধ হল। রক্তপাত। ঝড়-বাতাস হল।  মরুভুমি হল। কাপড়ে মুখ ঢাকা দস্যুদল, অপহরণ, আর উদ্ধার, আর মেঘ করে এল। খুব অন্ধকারে বিদ্যুৎ ঝলকে দেখা গেল সে চলে যাচ্ছে,  জল দুপাশে ফাঁক হয়ে সরে গিয়ে ফের বুজে যায়…যেন সবুজ, রহস্যময়, শান্ত নির্জনতা রাখা আছে একপাশে…

নিজস্ব চাঁদ-ভাঙা পৃথিবীর ভেতরে গিয়ে সে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে। একটা লাল স্বপ্নের ভেতরে সে জেগে উঠবে একদিন। সেই দৃশ্য তোমাদের নয়, তার ভাবনার ভেতরে রয়ে গেছে।


আজ সকালে ঘুম ভেঙে তোমার মন দুটুকরো হয়ে গেল হঠাত। একটা মন চা বানালো, খাবার বসালো পাশের ওভেনে। চানঘরে গিয়ে কল খুলে দিল। জলের সামনে নিজেকেও খুলে দিচ্ছ যখন, তখন অন্য এক মন এসে তোমার মতো তাকালো। বল্ল,  বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস।  অমনি চার দেয়াল খুলে গেলো। দু হাত জোড় করে উপরে তুলে তুমি উড়ে গেলে, খুলে রাখা শাড়ি, ঝরঝর উপচে পড়া জল, ওভেনে ফুটন্ত ভাত দরজার ভেতরে ফুটতে থাকলো। অনেক উপর থেকে তুমি দেখলে, তুমি চায়ের মগ হাতে শেষ বেলার ব্যস্ততা গুছিয়ে নিচ্ছ।। একঝলক। তারপর অনেক দূর একটা মেঘ এসে সমস্ত আড়াল হল। তোমার স্নান হল না, চা জুড়িয়ে পড়ে থাকলো, ওভেনের ভাত ফুটতে থাকলো।  তুমি সারাদিন আজ এই নগ্ন মনের থেকে বেরোতে পারলে না আর। সকাল সেই সকালের থেকে আর এক পাও বেলার দিকে গড়ালো না। এমন মেঘের আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম!  টের পেলে?

Facebook Comments

Leave a Reply