ঝুরোগল্প : কাজল সেন

নির্ঝরিণী

পোশাকি নাম নির্ঝরিণী। কিন্তু স্কুল ও কলেজের রেজিস্ট্রারে পোশাকি নাম যতই শোভা পাক না কেন, বন্ধুরা সম্বোধনের সুবিধের জন্য নির্ঝরিণীকে কাটছাঁট করে রিনি নামেই ডাকত। নির্ঝরিণীরও তাতে কোনো আপত্তি ছিল না, বরং সে খুশিই হয়েছিল তার নামের এই সংক্ষিপ্তকরণে। কিন্তু স্কুলে পড়াকালীন, যখন যৌবনের ইশারাগুলো একে একে উঁকি দিতে শুরু করেছে তার শরীর ও মনে, রিনি নিজের কিছু আচরণে ও ভাবনায় নিজেই রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। এতদিন বন্ধু হিসেবে ছেলেবন্ধু ও মেয়েবন্ধুর মধ্যে কোনো বিশেষ তফাৎ খুঁজে পায়নি। কিন্তু শরীরে যৌবন অঙ্কুরিত হতেই খুব স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই রিনি ছেলে ও মেয়েবন্ধুর সান্নিধ্য ও সংস্পর্শে আলাদা আলাদা উত্তেজনা অনুভূতিতে শিহরিত হয়ে উঠল। বিশেষত রিনি একান্তে নিজেকে যাচাই করতে গিয়ে বুঝতে পারল, সে ছেলেদের প্রতি আদৌ কোনো আকর্ষণ বোধ করছে না, বরং তার শরীরে ও মনে মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ।

বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কটা খোলামেলা থাকলে যৌনতা নিয়ে আলাপ আলোচনা হতেই পারে গোপনীয়তা বজায় রেখে। রিনির বন্ধুরা তা মাঝে মধ্যেই করে। কিন্তু সেইসব যৌনতা বিপরীত লিঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে। রিনি ভেবে পায় না, সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের আলোচনা সে কীভাবে শুরু করবে! নিজেকে নিজে বোঝায়, এ বড় গোপন কথা, একথা কাউকে বলা যায় না, বললে সে সবার বিদ্রুপের শিকার হবে। হয়তো বা বন্ধুত্বেও ফাটল ধরবে।

স্কুল জীবনটা এভাবেই নিতান্ত সংগোপনে কাটাতে হয়েছিল রিনিকে। কিন্তু কলেজে পড়াকালীন যখন যৌনতাকে আর কিছুতেই বেঁধে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, রিনি রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে কথাটা জানিয়েছিল স্কুল ও কলেজেরও প্রিয়বন্ধু তিন্নিকে। তিন্নি শুনে প্রথমটা খুব ঘাবড়ে গেছিল। হাঁ করে তাকিয়েছিল রিনির মুখের দিকে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, ‘তুই কী চাস আমার কাছে রিনি?’ রিনি মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘না, কিছুই না’। তিন্নি একটু উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, ‘তাহলে তুই আমাকে এসব কথা বলতে এসেছিস কেন?’ রিনি সঠিক কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘আর কাকে বলব বল! তুই আমার বন্ধু, ছোটবেলা থেকে বন্ধু!’ তিন্নি বলেছিল, ‘হ্যাঁ বন্ধু, কিন্তু তুই কি আশা করে এসেছিস যে আমিও তোর মতো? ভেবেছিলি আমিও তোর মতো সমকামিতায় আগ্রহী? তুই আর আমার কাছে আসিস না।

রিনি একরকম দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল তিন্নির সামনে থেকে। আপাদমস্তক জুড়ে শুধু লজ্জা। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল রিনির। কিন্তু রিনি তো কোনো পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিন্নিকে এসব কথা বলেনি। সে তো জানত, তিন্নি তার মতো নয়। তিন্নি সম্পর্কে জড়িয়ে আছে একটি ছেলের সঙ্গে, যাকে রিনিও চেনে। তিন্নি তো সেই ছেলেটির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্কের কথা রিনিকে প্রায়ই বলে। খোলাখুলি বলে। তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাই বলে। আর রিনি তো সেই ভরসাতেই প্রিয়বন্ধুকে তার এতদিন মনের গভীরে জমিয়ে রাখা আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছিল। নিজেকে হাল্কা করার জন্য বলেছিল। তিন্নির শরীর তো সে কামনা করেনি। তাহলে!

Facebook Comments

Posted in: May 2020, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply