জুয়েল মাজহার-এর কবিতা

বিষভল্ল: মনোশৈলচূড়ে

১.

কথা বললে চুপিসারে ঘুমন্তের স্নায়ুর ভেতরে

সেই থেকে গলছে বরফ। সেই থেকে কতো
পার্বত্য ঝরনা এসে হিম-জলে ধুয়ে দিলো
অভিমানী পাথরের জ্বরতপ্ত মাথা

উঁচু থেকে নিচে পড়ে ভেঙেছে পাঁজর। তার
প্রগাঢ় রক্তের বুব্দুদে এই কালো রাত্রি হয়ে উঠল লাল

দলছুট সেই একা-বনমানুষের মাথার উপরে তুমি
মেলে ধরলে ছায়ার ক্যানোপি;

অগাধ ঘুমের জলে দিলে তাকে অপার্থিব স্নান

বললে তাকে: হে পাগল, পদতলে ক্ষত নিয়ে এভাবে ছোটো না

নররাক্ষসের বনে, সর্পঘেরা এ-ঘোর জঙ্গলে
নগ্ন হয়ে একা হয়ে এভাবে ছোটো না!

—ইশারায় এই কথা বলে তুমি মৃদু হেসে অন্তর্হিত হলে

বিষভল্ল মনোশৈলচূড়ে বহু হননের উদ্যত কৃপাণ
তুচ্ছ করে, সে জানে না, অখিল শুশ্রূষা নিয়ে
তুমি তার শিয়রের পাশে এসে শান্ত বসেছিলে

রেখেছিলে হাসি ও অরোরা

তার ফাটা খসখসে ঠোঁটের নিকটে তুমি মায়া-পয়োধর
মেলে ধরেছিলে। দিয়েছিলে স্তনের আরতি
অমল ধবল গাঢ় ফোঁটায়-ফোঁটায় ;

দিয়েছিলে স্বাদু মোহ-মদ সারারাত

রাতুলাঙ্গ-নিদালির স্পর্শ দিয়ে
রতিরূপবিশল্য মাদুলি বুলিয়ে
অপরূপ লীলা তুমি সম্ভব করেছো,ওগো দেবী

একা সেই বনচারী। বুকের হাপরে যার জমা আছে অতি অল্প শ্বাস।
সে আসলে অর্ধেক নিহত তার ললাটলিখনে
অভিশাপে শিলীভূত ছোটো তার পরাণকুঠুরি

অথবা সে বোঁটা থেকে খসেপড়া আধপচা ফল
পাখির চঞ্চুর ঘায়ে ঝোপের আড়ালে ভূপাতিত

পথে যেতে তুমি তাকে তুলার বলের মতো কুড়িয়ে নিয়েছ
তুমি তাকে কোল পেতে অক্লেশে দিয়েছ ঠাঁই জঘনপ্রসারে

তাতে তার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল তরল আগুনে ভরা বীজ

ফেটে গেল ফেটে গেল
হলো তীব্র শ্বেত অগ্নিপাত
ছিটকাল মুহূর্মুহু ছিটকাল
লাবণ্য ও লাবণিক ক্ষার

দিগ্বিদিক ঝলকে ঝলকে!

ওম শান্তি!
ওঙ্কার!
ওম শান্তি!
ওঙ্কার!

ওওওওওম্‌ম্‌ম্‌ শান্তি !শান্তি!

২.

এরও বহু আগে সে যখন
কুঁকড়ে ছিল পারমা ফ্রস্টে ভয়াবহ শীতে
বহুযোনি, তুমি তাকে দিয়েছ কার্পাস
তুমি তাকে করেছো উদ্ধার। তার চারপাশে
রন্ধ্রহীন রক্ষাব্যূহ করেছো রচনা

অপরূপ লীলার ভেতরে তাকে করিয়েছ অপার্থিব স্নান;

নররাক্ষসের বনে বিষভল্ল তুচ্ছ করে তুমি
তার পাশে দাঁড়িয়েছ । তার ওষ্ঠে তীব্রতম করেছ চুম্বন
তারপর তার হাতে তুমি তুলে দিয়েছ কুঠার
তুমি তাকে বিষহর মন্ত্র শিখিয়েছ

অয়ি,পরমাপ্রকৃতি!
অয়ি, কাম্যযোনি!

তুমি বর্ম ও আয়ুধ নিয়ে তার পাশে ছিলে
তুমি সুহাসিনী, তুমি সৌগন্ধের নম্র পসারিণী

অপচ্ছায়ার প্রতি সদা অকরুণ তোমার ভ্রূকুটি

বহুছিদ্র-স্তনের বোঁটার শীর্ষে সঞ্চিত রেখেছ তুমি শিশুতোষ মদ
লাবণ্যের ক্রীড়া ও উদ্ভাস। ক্ষতে ও জখমে উপশম

ভোর অব্দি ঘুমন্তকে অমিত আড়াল দিয়ে রক্ষা করো তুমি

অয়ি কাম্যযোনি
অয়ি স্নায়ুশিখরে চিরসমাসীনা

তোমার হৃদয় যেনো অপত্যের অনবদ্য বীণা
পঙ্কজলে শুয়ে শুনি অমরার সে-সুরমূর্ছনা

রাত্রির কান্তারে তুমি অবিরত ছড়িয়ে চলেছো বসন্তের কুহু

মাতৃগাছেদের ছড়ানো পায়ের কাছে বসে
ঘাসের আড়াল থেকে, মাটির ফাটল থেকে
নানা সম্ভাবনা, নানা বিকাশের বীজ ও পরাগ
সযতনে আপন গর্ভথলিতে তুমি কুড়িয়ে এনেছো

ওই তো সমুদ্রশিয়র থেকে ধীরে ধীরে চোখ মেলছে
তোমার প্রণয়ে তৃপ্ত তীব্র লাল সূর্য ও গোলাপ

কাম্যযোনি

তোমাকে যে চায় তুমি হতে পারো তারও
অথবা তাদেরও; যদি, অনুকূল হাওয়া ধীরে বয়

খেলার ধরন চাল একমাত্র তোমারি চয়ন !

সুতনুকা, নক্ষত্রও এক দিক থেকে অন্যদিকে
ঋতুভেদে ক্রমে সরে যায়

বসন্তের দ্যুতক্রীড়া শেষ হলে পাতারা কর্কশ
বিবসন চণ্ডালিনী হয়ে নাচে গ্রীষ্মের দ্রৌপদী

কুহুকে ছাপিয়ে শুধু ঘোর কা-কা রব
রক্তহিম! ভয়ের বিস্ময় শুধু
উপহার দেবেন হিচকক

প্রতীচ্য নিয়মে জেনো, ঋষি-নাম তারাগুলি
সকলে ভল্লুক-নাম পরিগ্রহ করে

যদিও তখনও তারা সবখানে সমান ভাস্বর;

সুতনুকা, তোমারও নামটি হোক
কাম্যযোনি থেকে আজ ভস্মযোনি তবে!

ছাগাসুর

সে-রমণী, তাহাকে অল্পকাল চিনি। অশ্বেতর প্রাণীদিগের জন্য তাহার সে কী মায়া! প্রভাতে পুষ্পচয়নের পরিবর্তে শষ্প ও বিবিধ তৃণাহরণেই তাহার সকল মনোযোগ; তাহাও কেবল এইসব প্রাণিদিগের জন্য। হ্রেষার পরিবর্তে ইহাদের কেবল রহিয়াছে প্রহরের গাঁড়ফাটানো রাসভনিনাদ। কাকস্য পরিবেদনার সহিত এই রাসভস্বর মিশাইয়া বারান্দায় বসিয়া বিবিধ ককটেল বানাই। তাহা পান করি। গলদেশ দিয়া নহে, মন দিয়া, কর্ণকুহরে ঢালিয়া।

রমণীটিকে দেখিয়া কাম জাগে । এ-বিষয়ে তাহার প্রভূত প্রশ্রয় আঁচ করি। তবে কাহারো তরফে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় নাই।

ঈগলচঞ্চুর ন্যায় তাহার বক্র নাসিকাখানি তিলনিন্দিত। হাকালুকি হাওরের হাঁসিনীর গ্রীবার ন্যায় তাহার গ্রীবা। তদুপরি তাহার পাউটি লিপস। তাহার নিচে একখানি ডাঁশা জড়ুল। আর তাহার বগলে ঘাম। বগল ক্ষৌরহীন দেখিয়া সঙ্গত পুলক জাগে।

আমার বারান্দার লাল জবাটিকে দেখিবার অছিলায় তিনি ডাগর চক্ষু তুলিয়া তাকান। সেই চক্ষে অথির বিজুলি। তিনি শ্যামাঙ্গিনী। তাহার কম্বুগ্রীবাটি আহ্লাদে ঈষৎ কাত। এক্ষণে জবাফুলটি আরো গরিমাময়, আরো লাল হইল। হইলে হউক! তাহাতে আমার কি!

তাহার হস্তধৃত তৃণাদি মাতৃহারা খচ্চরশিশুটি খাইবে, সদা-ভ্যাঁ-ভ্যাঁ-করা বকরিদল খাইবে; খাইতে খাইতে ইহারা গুটলিময় নাদা ত্যাগ করিয়া ক্রমশ উঠান ভরিয়া তুলিবে। তাহাতেও রমণীর স্নেহ ও প্রশ্রয়।

ইহাদিগের মধ্যে একটি প্রাণিই কেবল ব্যতিক্রম। খাবারে ইহার মনোযোগ নাই। আঁচ করিলাম, প্রাণিটির ইচ্ছা মদীয় ইচ্ছার নিকটতর। এই কথা কাহাকেও কদাপি বলা যাইবে না। আপনাদিগকেও নহে। কেননা লোকে আমাকে ভালো লোক বলিয়া মান্য করে। কেহ কেহ ‘কত্তা কত্তা’ বলিয়া ষাষ্টাঙ্গ প্রণামে উদ্যত। মান্য লোকদিগের অঙ্গ হষরিত হওয়া বোধ করি অনুচিত। অন্তত অস্থানে। লোকে এমত ভাবে।

সংসারে লোকের ভাবাভাবিকে মূল্য দিয়া চলিতে হয়। আমাকে এবং— যিনি বুঝিয়াও না বুঝিবার ভাণ করিয়া খোঁপা বাঁধিবার ছলে কুচযুগ আন্দোলিত করিয়া আড়চোখে আমাপানে চাহেন——তাহাকেও। ইহাই রীতি । এই অতি শিষ্ট অণ্ডহীন, যোনিহীন মনুষ্যজঙ্গলে এই বিধান।এমত বিধানে যদিও এক মুষ্ঠি ধান্য ফলিবে না।

পাঁঠাটির সেই বালাই নাই। ইহা স্বাধীন , কেননা ইহা ছাগাসুর, তদুপরি তরুণ। আর ইহার অঙ্গের সে কী গরিমা। কী তেজ! জিভ বাহির করিয়া, মুখে তপ্ত ফেনা তুলিয়া, সে তাহার চর্মঘেরা, লোমশ খাপ হইতে দেমোক্লিতাসের তরবারিসদৃশ অঙ্গটি বাহির করিল। আচমকা। আর তাহা পেন্ডুলামবৎ দুলিতে থাকিল। লাল। এবং জবারও অধিক। সূর্যেরও অধিক। ইহার রঙ কেবল আসামদেশের কামরুপে ফলিত নাগা মরিচের রঙের সহিত তুলনীয়।

আমরা উভয়েই লজ্জাহেতু অন্য দিকে মুখ ঘোরাই। চকিতে তাহার মুখের একপাশ দেখিলাম। মনে হইল তিনি ঈষৎ বিব্রত; তথাপি তাদৃশ আমোদিত । ফটকদরোজা দিয়া তিনি অতি দ্রুত ভেতরবাটীতে অন্তর্হিত । আর আমি ছাগাসুরের দিকে অসীম তিতিক্ষা লইয়া তাকাই।

পাঁঠাটির প্রতি আমার গোপন ঈর্ষা হইল। এমন সময় প্রতিবেশীর ট্রেসপাসার নচ্চার হুলোবিড়ালটি কোথা হইতে আসিয়া আমার দিকে ‘আইবল টু আইবল’ তাকাইয়া কহিল ‘ম্যাঁও’।

Facebook Comments

Leave a Reply