জয়দীপ মৈত্র-র কবিতা

বহুদিনের গদ্য

কত পিঁপড়ে জল ঢেলে স্নানঘরের ফুটো দিয়ে অন্ধকারে ঠেলেছি। জলের সাথে অতটুকু প্রাণী লড়তে পারে? পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে একের পর এক পড়ছিলো গর্তের অন্ধকারে। সেখান থেকে ট্যাঙ্কের ভেতরে। পাইপের ভেতর দিয়ে টপাটপ পড়ছিলো মৃত্যুর মুখে। গর্তের কিনারা থেকে দেখলাম কেউ প্রাণপণে বেঁচে গেল। স্নানঘরের দেওয়াল বেয়ে অতি কষ্টে আবার সে উঠছিল। যত্ন করে ফের তাকে পা দিয়ে লাথি মেরে নামিয়ে আবার জলে ফেলেছি। ওদের ফেরার ঘর ছিলো। ওদেরও সেদিন যেতে হতো কোথাও। ওরাও সেদিন সকালে উঠে হাওয়ায় দুলতে দুলতে বেরিয়ে পড়েছিলো খাবার খুঁজবে বলে। আমার কোনও মহর্ষি থাকলে এই কথাটা আমাকে কিছুটা শাস্তি দিয়ে বোঝাতেন হয়তো। উনি পিঁপড়েদের লক্ষ্য করতেন। উনি আমার স্নানঘর। এতবার আমার মহর্ষি মুছে দিয়েছে, তবু মা ওদের কখনো দেখতে পায়নি। মায়ের চোখে ছিলো আমার ছোটবেলার স্নানের ছবি। এর সাথেই ফড়িঙের ডানা ছেঁড়া ছিলো। পথের ধারে, বড় দরিদ্র এক অসুস্থ লতাগাছ একটানে ছিঁড়ে দেওয়া ছিলো। রৌদ্রজ্জল দুপুরে গরমের ছুটিতে এসব আমার শৈশব ছিলো। ভাগ্যিস ওই পিঁপড়েগুলোর মতোই সেসবও আর কখনো ফিরবে না। এই কথাটাই একদল ফকির পিঁপড়ে আমাকে শেখালেন। এইতো স্নানঘরে আলো আসছে। এই লেখা পড়তে পড়তে ঠিক এই মুহূর্তে যে অন্ধকারে আমার দুঃখ নামছে, তার পিঁপড়েতম ভেতরে দেখা যাবে, জীবন থাকলেও জলের কোনও ঘর নেই। যেন পিঁপড়ের শিশু আমরা কেউ দেখিনি। সেটা পিঁপড়েকে ছোট করে দেখা নয়।

দূরপাল্লার গাড়িতে বসে আছি। রাস্তা পার হওয়া হাঁসের বাচ্চা প্রায়ই আসে চাকার তলায়। ছটফট করতে করতে মরতে দেখি। কষ্ট হয়। কষ্টের রঙ নীল। কে জানে কোথা থেকে পাথর আসে। পাথরের পর পাথর। ধুলোর পর ধুলো। পথ বদলে যায়। নীল মুছে লাল। লাল থেকে হালকা হলুদ। বাড়ি ফিরে কুসুম খাই চেটেপুটে। ডিম আমার প্রিয়। ডিম নিয়ে কবিতা লিখি। এইতো দুঃখের গাছ। দুঃখের ভ্রুণ। নিঝুম দুপুরের ক্ষত মেখে পাপ মেখে হস্তমৈথুন মেখে কাকেরা বসে থাকে। প্রথম উড়তে শেখা বুলবুলির বাচ্চা ছটফট করে কাকের ঠোঁটে। কষ্ট হয়। মা বুলবুলি হয়তো অল্পেই ভুলে যায়। আমাকে ভুলতে দেয়না আমার অহংকার। প্রচন্ড রাগ হয়। কেন কাকের গায়ে পাথর ছুঁড়তে গিয়েও আলগা হয়ে আসে মুঠো। অন্যমনস্ক হয়ে আকাশ দেখি। আকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে একা লাগে। তাই তাড়াতাড়ি সৌন্দর্যবোধ ডেকে আনি।ঔদাস্যকে শিস দিয়ে ডাকি। ওই যে বললাম, মা বুলবুলি ভুলে যায়, আসলে দুঃখের বিরুদ্ধে হেরে গিয়ে অহংকারকে অস্ত্র করে দর্শনের দিকে এগোই। মা বুলবুলির শিশুকাল এগিয়ে যাচ্ছে এক ছোট্ট অসহায় কেঁচোর দিকে। কেঁচো অন্ধ বলে বুলবুলির ওপর আর রাগ হয়না। দুঃখ হয়না। বরং নিপুণ হয়ে ওঠে দুঃখবোধ। ভাবি একদিন কোনও অন্ধ মানুষ চাকার তলায় আসার আগেই পথ পার করে দেব। কিন্তু এভাবে নিজেকে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করা যায় কি?

তছনছ হয়ে যাওয়ার পরে কেউ এসেছিলো। মা তাকে দেখতে পায়নি। সাদা রঙের রাস্তায় অজস্র সাদা পোশাকের মানুষ। চক দিয়ে হিজিবিজি লাইন টানছিল যে পাগল, তারও সর্বাঙ্গে শ্বেতী। ব্যাঙের ছাতায় ভরে উঠেছিল বটগাছ। কতকাল আয়নার সামনে এসে মাকে খুঁজে গেছে সিঁদুর। কাচের গায়ে লাল টিপের রঙ উঠে এসেছে প্রায়। কাচের ওপারেই উলটে যায় ঘড়ি। উলটে যায় মানুষ। বাবার উলটো ছায়া দেখে কাঁদতে কাঁদতে ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছে মা। বাবার শরীরেই কি তাহলে মা আটকে রাখতো ওই প্রিয় লাল টিপগুলো? গতরাত্রে বাবার মাথার মধ্যে পায়চারী করেছিলো। ব্যান্ডেজে লেগে আছে মুছে যাওয়া আলতার দাগ।  সাদা গাড়িটার ভেতরে শুয়ে বাবা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো, অ্যামবুলেন্স কথাটা কাচে কেন উল্টো করে লেখা থাকে।

Facebook Comments

Leave a Reply