দীপ শেখর চক্রবর্তী-র কবিতা

অথচ,তোমার অবাধ্য দুটি হাত

চিলেকোঠার কাক

প্রতিটি চিলেকোঠার ঘরের একটি নিজস্ব কাক থাকে-
একটি পুরনো ভাঙা দরজা থাকে-
যা সহজে বন্ধ হতে চায়না।
অথচ তার সামান্য নির্দেশ পেলে-
বিদ্যুতের মতো দূরে সরে যেতে পারে আপাত নিষিদ্ধ দুটি শরীর।
চিলেকোঠা ঘরের এমন একটি জানলা থাকে
যেখান থেকে-
পৃথিবীর প্রায় সমস্তটা দেখা যেতে পারে।
তাই এই ঘর কেবলই দর্শক
অথবা
নীরব শ্রোতামাত্র।
এমন টিউবের আলোর নীচে বসে সে যৌনশিক্ষা লাভ করেছে
যার দুটো হাত অসাড় হয়ে গেছে।
ভুলে যাওয়া ইস্তেহার থেকে ইঁদুরেরা বিপ্লব শিক্ষা পেয়েছে এখানেই
অথবা লাইন ভেঙে যে দুয়েকটি পিঁপড়ে অন্য পথে গেছে
আমি নিশ্চিত,তাদের অনুসরণ করলেই
পাওয়া যাবে অসময়ে হারানো সম্পর্কগুলোকে।
যদিও সম্পর্ক হারানো সর্বদা অসময়
চিলেকোঠা ঘরের জন্য সামান্য যেটুকু বরাদ্দ ছিল-
জল দাঁড়ানো ছাদ,বিষণ্ণ গাঁদাফুল,জলের ট্যাঙ্কির দুরূহ কোণটি
কতগুলি ভিজে জামাকাপড়ের অহেতুক দোল খাওয়া হাওয়া
অথবা সামান্য ভাগ্যবান হলে
সন্ধের আশ্চর্য মায়ার ভেতর এক কিশোরীর অদক্ষ হাতের
হারমোনিয়াম।
একটি চিলেকোঠার ঘর জানতে চায় কখন সে ছাদে উঠে আসে-
এই অপেক্ষাতে-
মানুষ ও চিলেকোঠার ঘরকে
একই পংক্তিতে চোখ বুজে আমি বসিয়ে দিতে পারি।
প্রতিটি চিলেকোঠার ঘরের একটি গোপন অসুখ থাকে-
একটি নিজস্ব কাক থাকে-
সারারাত চুপুচুপু ভিজেও সে অনন্তকাল তাকিয়ে রয়েছে
জীবনের মুগ্ধতার দিকে।

সাঁতার শিক্ষাপদ্ধতি

মাঝে মাঝে বহুদিন পর একটা ড্রয়ার খোলা হলে
জীবনের হারানো এক সুখ খুঁজে পাওয়া যায়।
অথবা খাটের অন্ধকার কোণ থেকে বহুদিন আগে পাওয়া আনন্দ
বেরিয়ে আসে ।
সারাদিন নিজের ভেতরেও এমন একটি
ড্রয়ার,অন্ধকার খাটের কোণ খুঁজে চলি আমি।
অথচ রবার ঘষে ঘষে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারিনি
পেন্সিলের একটা দাগও।
– জীবন এভাবেই কথা বলে –
একটা দিনও সম্পূর্ণ শেষ করতে পারিনি আজও।
একটা মানুষকেও সম্পূর্ণ ফুরিয়ে যেতে দেখিনি।
এই এতগুলো বছর কেবল সারাঘর জুড়ে-মায়ের গানটা
উন্মাদের মতো শুনে গেছি-
গানটি বেজে চলেছে-গোটা বাড়ি জুড়ে-
অথচ মায়ের সামান্য ঠোঁটও কাঁপছে না।
এই গানটি আজীবন কতভাবে বলে যাবে আমাকে-
সাঁতার ভুলিনি আমি কখনও,সেসব কেউই ভোলে না, শুধু-
ধীরে ধীরে পুরনো হয়ে যাচ্ছে আমার সাঁতার শিক্ষাপদ্ধতি।।

একটি চেয়ারের মুগ্ধতা

অর্থহীন একটি দুপুর ঠিক জীবনের মাঝে রয়ে যায়-
কেউ কোনো কথা বলছেনা।
একটা আনন্দও না,একটা অভিমানও না।
হাতে কাঁচা হয়না যে জামাকাপড়গুলো,এমন দুপুরের ছাদে
অভিমানে ঠিকমতো দোল খায়না।
যারা বড় হতে বলেছিল আমাকে-
তারা বলে যায়নি ঠিক কতটা বড় হলে,বেদনাহীন
সয়ে নেওয়া যায় সমস্ত দূরে চলে যাওয়া।
জীবনের থেকেও বড় এক জীবনের কাছে ফিরে যেতে
আমি সমস্ত সামান্যের কাছে হাত পেতে থেকেছি।
-পাওয়া বা না পাওয়া-
সকলই আরেকটু কাছে যাওয়া মনে হয়।
তার কাছে ফিরে যাওয়ার সময় অতিক্রম করে গেলেই
সবথেকে সহজ হয় তা।
যে দুপুরের দরজা খোলে,তার চোখে-
বিস্ময় না বিরক্তি কিছুই বোঝা যায়না।
কিছু কিছু না বোঝা এভাবেই জীবনকে সহজ করে তোলে-
জানি,অর্থহীন দুপুরের ভেতরে আমার বসার জন্য
কোথাও পাতা রয়েছে
একটা হাতলবিহীন চেয়ারের মুগ্ধতা।
জীবন জানিয়েছে আমাকে-
নিঃশব্দ মানে পুরোপুরি শব্দহীনতা নয়
একটি পা ভাঙা চেয়ারের মুগ্ধতা
এত অপমান- এত তাচ্ছিল্যের পরও সে কিছুতেই
আপোষ করে নিতে চায়নি বাঁধানো মেঝের মসৃণতার সাথে।

Facebook Comments

Leave a Reply