রাত্তির ঘন হলে জমে উঠতে থাকে শব : বিষাণ বসু

রাত্তির ঘন হলে জমে উঠতে থাকে শব – দুদিন আগেই বর্জন করেছিলে যাকে, সেই প্লাস্টিক ব্যাগ তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে – বরফের পিচ্ছিল বিছানা থেকে উঠে এই দমচাপা অর্ধস্বচ্ছ পলিথিন – প্রিয়জন ঘরে বন্দী – রাষ্ট্রীয় রক্ষীর সাথে ভ্যানে চড়ে চলেছ এমন দূরে, আর ফিরে আসা নেই – সে এক সময় যা দুশ্চিন্তা গিয়েছে, চুপ করে বসে, মনে পড়ে আর?

তারপর একদিন এমনি করেই মুখোশ বেঁধে আমরা খেতে বসলাম রেস্তোরাঁয় – আর ওয়েটার দস্তানার আড়াল থেকে বের করে আনল মেন্যুকার্ড – মনে আছে, তুমি ভয় পেয়ে গেছিলে, কেননা এমন দস্তানার আড়াল থেকে হামেশাই ঝলসে ওঠে ছুরি – আর এই আড়াই মাস ধরে আর কিছু না হোক, ওর’ম সিনেমা তুমি দেখে ফেলেছ হাজার।

অথচ, অস্ত্র মাত্রেই সর্বদা দৃশ্যমান হবে, এমন তো নয়। তুমি তো জানতেই, লুকিয়ে থাকা মারণাস্ত্রের খোঁজে ঘটে গিয়েছে আস্ত যুদ্ধ সব – ঠিকই, সেসব মিথ্যে ছলনা – তবু, তার পরেও ভেবেছিলে, অস্ত্র যখন চোখে পড়ছে না, অত ভয়ের কিছু নেই। ব্রতকথার শেষে ছোলাটুকু ভিজছিল স্যাভলনের জলে – ছোলা ফুলে উঠছিল স্যাভলনে আর তোমার নিশ্চিন্ততায় – সে এক দেখার মত ব্যাপার বটে!!

তার আগেই অবশ্য আমরা দেখেছি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে মানুষ – আর পুলিশ তাদের তাড়া করেছে। তখন রেললাইন দিয়ে হেঁটে চলেছে মানুষ – ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে লাইনেই – রেলগাড়ি এসে তাদের চাপা দিয়ে চলে গিয়েছে। প্রখর রৌদ্র এড়িয়ে যখন হেঁটে চলেছে মানুষ আর রাত্তিরকে বেছে নিয়েছে বাড়ি ফিরবে বলে – নাইট কার্ফ্যু জারি করে দেওয়া গিয়েছে দিব্যি।

বিরক্ত লাগছিল, সত্যি বলছি, একঘেয়ে লাগছিল – আর চালিয়ে যেতে পারছিলাম না – রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা রুটি – রেলস্টেশনে মৃতা মায়ের শরীর ধরে ঝাঁকাতে থাকা শিশু – ওই রেলের গাড়ি, ওই স্টেশন ধরেই কতবার ছুটে গিয়েছি স্বপ্নের দেশে – তখনও তো এরা ছিল, এই দেশে, এই আমাদেরই আশেপাশে – জানতেও পারিনি।

এ সব কিছুর অনেক আগে, আমরা নিজেদের কথা স্যানিটাইজ করতে শিখেছিলাম। অর্থাৎ কী বললে ভালো শোনায়, কেমন মুখে কোন কথাটা বললে মানায় দিব্যি – সময় ও পরিস্থিতি বুঝে কোনটি বলতে পারলে নিজের ক্ষতি নেই, এসবই ছিল আমাদের আজীবন শিক্ষাক্রমে। কাজেই, যখন হাত স্যানিটাইজ করতে বলা হল, ঘাবড়াই নি একেবারেই। এই তো সেদিনই হাসতে হাসতে বলছিলে, মুখটাকেই যখন আটকাতে পেরেছি, হাত তো নস্যি!!

অতএব, আমরা হইহই করে বাসে চেপে বেরিয়ে এলাম জাদুঘর – ডোডোপাখির দিকে চোখ টিপে বললাম, সি ইউ দেন – চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জিটা আমাদের দেখে হইহই করে উঠল, মানুষ না দেখে দেখে বড্ডো ক্লান্ত ছিল সে-ও – ভিক্টোরিয়ার ঘাসগুলো বেড়ে উঠেছে অনেকটা এরই মধ্যে, বসতে গেলে একটু অস্বস্তিই হয় – সে হোক, আমাদের হাতে দস্তানা, মুখে ঢাকনা আঁটা।

আসলে, ভুলে গেছিলাম, মারণাস্ত্র সব সময় দৃশ্যমান নয় – না হলেও চলে।

আসলে, ভুলিয়ে দিয়েছিলে, মারণাস্ত্রের কথা সবসময় বলতে থাকলে শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়।

আসলে, অনেক অনেক দিন ধরে দম আটকে বেঁচে থাকতে থাকতে সবাই ভয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল – আর ভয় ব্যাপারটা সংস্কারে গিয়ে ঠেকেছিল, যা মানলেও হয়, আবার না মানলেও আধুনিকতার হাততালি মেলে।

অতএব…

রাত্তির ঘন হলে জমে উঠতে থাকে শব – দুদিন আগেই বর্জন করেছিলে যাকে, সেই প্লাস্টিক ব্যাগ তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে – বরফের পিচ্ছিল বিছানা থেকে উঠে এই দমচাপা অর্ধস্বচ্ছ পলিথিন – প্রিয়জন আর ঘরে বন্দী নয় – তবু রাষ্ট্রীয় রক্ষীর সাথে ভ্যানে চড়ে চলেছ এমন দূরে, আর ফিরে আসা নেই…

Facebook Comments

Leave a Reply