অর্ঘ্যদীপ রায়-র কবিতা

অন্তরীণ

(১)

পেরিয়ে যাওয়া দিনকাল দেহলীতে, ফুরিয়ে আসা গবাদি স্নেহ। যে শিলালিপি রেখে আসি তোমার পথের দুধারে, তারা রোদ পোহায় বাসন্তী বিকেলে। তাদের চামড়ার রঙ ফেরে। অপেক্ষা করে থাকে তারা কখন তোমার স্পর্শ পাবে। তোমার পায়চারি, টহল ও সান্ধ্যবিহারের পার্থক্য বুঝতে বুঝতে তারা হাসবে, কাঁদবে ও রেগে যাবে। গৃহবন্দী তুমি। তোমার বাহারি জুতো ও আজন্মলালিত প্রজ্ঞা গৃহবন্দী। চায়ের কাপে চামচ নাড়াতে নাড়াতে বিষণ্ণ হয়ে উঠছো তুমি। ভাবছো, একটি ছত্রাকের নিচে বসে বসে কিভাবে ক্লান্ত হয়ে ওঠে ব্যাঙ। ভাবে, এই বুঝি বৃষ্টি আসে আকাশ ভেঙে। বন্যা হয়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্থাবর মাদুরগুলি। চরাচর উপচীয়মান হয়ে ওঠে মানবিক স্মৃতিচিহ্নগুলিতে।
এমন তো হতেই পারতো যে আজ আয়নায় অচেনা লাগলো নিজেকে। ড্রেনের জলে বয়ে যাওয়া শ্যাম্পুর শ্যাশের পাতা মিশে গেলো সমুদ্রে। এমন তো হতেই পারতো, একটি কাক মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে কারো কানের দুল। আর তুমি চর্যাপদ থেকে একটা লাইন চুরি করেছি বলে একে মৌলিক কবিতা বলা যায় কিনা তা ভাবতে বসেছো। এমন তো হতেই পারতো, ফুল এসেছে আকন্দ গাছে। সবার বাড়ির সামনে ফোটে রক্তকরবী। অথচ তুমি আকন্দ দেখলে না তাই একটি ফুল ফোটা থেকে বঞ্চিত করলে নিজেকে। এমন তো হতেই পারতো, যে পাড়ার কলে এখনো সময়মতো জল আসে। একটা কুকুর তাতে তৃষ্ণা মেটায় এবং তুমি অপেক্ষা করছো কখন কুয়োর জল ভরে যাবে ছাদের ট্যাঙ্কিতে।
পূর্ণিমা এলো। নারকেল কোরা বঁটি ফেলে তুমি কি চাঁদ দেখতে চাইবে ? অথবা আজানুলম্বিত একটি ওয়েব সিরিজ ফেলে কি তোমার মনে পড়বে বাতপতাকার কথা ? হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিতো তাকে। ওখানে একটি সমুদ্রসৈকত ভাবো। ওখানে একটি ঝাউবন। যা কাঁকড়া-অধ্যুষিত হয়ে ওঠে রাত হলে। দেহাতি যুবক গামছা পরে বেরোয় নিশাচর মাছগুলিকে খুঁজে নেবে বলে। ওখানে আরো কিছু উষ্ণ সময় কাটাতেই পারো তুমি। ওখানে তুমি পরিত্যক্ত নৌকার বুকে আরো কিছুক্ষন শুয়ে থাকতে থাকতে তারা দেখতে পারো আকাশভরা। এ পৃথিবী বিভ্রমের ,তাকে মাৎসর্য্যে হারিয়ে ফেলোনা।

(২)

নৌকাময় দিনগুলি পেরিয়ে বিভ্রম মুছে ফেলো তুমি বেলোয়ারী বেসিনে। তার ছিদ্রান্বেষী প্রহরগুলি দিয়ে বয়ে যায় একটি অসহনীয় বর্তমান। সকালের টিয়াপাখি আসছে না পেয়ারা ডালে বিগত কিছুদিন। মনে হয় তার পায়ের দাগ স্থায়ী হয়ে গেছে একটি ডালে। যেন হাজার বছর পাখিটি না এলেও সেই চিহ্নগুলি মুছে দেওয়া যাবে না। মশারি দিয়ে ঢাকা আছে কুয়ো। কিছু ব্রততীও জন্মেছে তার কপালে। ওই দিকে কেউ খুব একটা যায় না আর। একটা পোষা কচ্ছপও ছিল। বালির বুকে পেতে রাখা ডিম ফুটে সে হারিয়ে যেতে পারেনি অসীম সমুদ্রে। তবু পিঠে জন্ম নিয়েছিল একটি প্রাকৃতিক খোলস। জ্যামিতিক আদিম কিছু অঙ্ক কষা ছিল সেখানে। ঘটনাচক্রে, শহরের চৌবাচ্চায় স্থান পেতে হলো তাকে। কোনো নুলিয়ার জালে মৃত্যুর চেয়ে ভালো ছিল কি সে যাপন ?
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নততলে। তুমি ভাবছো, মেঘলা দিনে ডাক্তার চেম্বার খুললো কি ? তুমি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে ভ্রমণ করছো, তবু অপরিবর্তনীয় সে চেম্বার। কতগুলো শিশি, ঢাউস সাদা বোতল, বর্ণহীন তরল, ছোট খাম, নামমাত্র ভিজিট। যেন কোনো আদি অনন্ত কাল ধরে সে বসে আছে উপশমের সূত্রগুলি নিয়ে। বারবার তার কাছে যেতে হয়, রোগ সারে না। তবু সে আশ্বাস দেয়, হোমিওপ্যাথি তো, সময় লাগবে। এই আশ্বাসে একটি জীবনকাল পার করে ফেলো তুমি। এই আশ্বাসে আরো কয়েকটি আউস ধানের মরসুম পার করে ফেলো তুমি। দূরে মাঝে মাঝে দ্বীপ মনে হয়, ধড়মড়িয়ে উঠে বসো।
একদিন যেন সত্যিই দ্বীপ হয়ে আসে স্বপ্নগুলি। সেখানে মনুষ্যেতর প্রাণী। নীল ত্বকের অনাম্নী জানোয়ার ছুটে বেড়ায় সেখানে। অচেনা সব গাছপালা। মৃগনাভির সুবাস। সবুজ টিয়াটার কথা মনে পড়ে তোমার। এখানে কোনো টিয়া নেই। নেই শিরিষ গাছের ডালে ঝোলানো আগুন পোহানো আমড়া চাটনির হাঁড়ি। সব অর্জন ব্যর্থ মনে হয়। মনে হয়, যে ঘর দেওয়ালের ভারে ন্যুব্জ ছিল তা বুঝি বেশি সুখকর ছিল এই পাণ্ডববর্জিত অজ্ঞাতবাসের থেকে। যে ঘরে ঢুকলেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় হাত চলে যেত সঠিক সুইচে, তার টিমটিমে আলোর বিদ্যুৎপ্রবাহ অনেক বেশী শিহরণ জাগাতো শরীরে। নতুন দ্বীপে আলো আছে ,অভ্যেস নেই। তোমার ইচ্ছে করছে নিবিয়ে দিতে রাতপ্রহরীগুলিকে। মনে হচ্ছে চায়ের কাপে অধঃক্ষেপ পড়া চিনির দানাগুলি কি ভীষণ প্রিয় ছিল।
অসম্পৃক্ততার একটা শান্তি আছে। অধঃক্ষেপের একটা সহমর্মিতা আছে। কলপাড়ের শ্যাওলার একটা অসম্পৃক্ততা আছে। হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের একটা অধঃক্ষেপ আছে। তবু তার আশ্বাসবাণীর মতো ঠিকই একদিন ব্যালকনি থেকে টিপ করে ফেলা সিগারেট টুকরোরা পাঁচিলঘেঁষা নালায় গিয়ে পড়বে। গ্রীষ্মদুপুরে শুকনো নালায় একটা কুকুর এসে শুঁকে যাবে তাদের। একদিন এই অজ্ঞাতকুলশীল টুকরোরাও উষ্ণীষ পেয়ে যাবে। তুমি দ্বীপের বাস্তবে বিভোর হতে হতেও দেখবে কিভাবে মোরামপথ মিশে যাচ্ছে তোমার মাথার পেছনে ঘটে চলা সূর্যাস্তে। তারই কমলা আলোর কেন্দ্রবিন্দু থেকে একটা টিয়া উড়ে এসে তোমার নাকে ঠোঁট রাখবে। অভ্যেস অধিবর্ষের মতো। সময়মতো তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু একদিন আকস্মিকভাবে আবার নামতা পড়তে শুরু করে সে। বোঝা যায় , ঐহিক পৃথিবীতে ঐকিক ভালোবাসাগুলি এখনো চক্ষুষ্মান হয়ে আছে।

(৩)

হারিয়ে যাওয়া টিয়াপাখি ফিরে পেয়েছো তুমি। রোজ সকালে পেয়ারা ডালে সে তোমার সাথে গল্প করতে আসে। বিছানা বালিশ ফেলে ছুটে যাও তুমি বারান্দায়। বুঝে নাও, যে পাখি খাঁচায় থাকে না, তার খালি বাটি মটরদানায় ভরে দেওয়ার দায় থাকে না কোনো। সে ঘুরে বেড়ায় ক্রন্দসী জুড়ে, নিজেই খুঁজে নেয় নিজের প্রাতঃরাশ। দেওয়াল-কার্নিশে তোলা থাকে অতীত, প্রাচীন কাঁসার থালার মত। কখনো তা বের করে আনলে দেখা যায় খোদাই করে লেখা আছে কারো নাম।
আসমুদ্রহিমাচল ঘুরেও খুঁজে পাইনা তোমার পছন্দের ফুল। অথচ প্রতিদিন রাতেই ড্রেনে দু একটা শুঁয়োপোকা পায়চারি করে। তাদের প্রজাপতি হবার ইত্যবসরে পাঁচিল ভরে উঠলো শ্যাওলায়। স্বস্তি পেল অপাঙ্গ। যে মেঝে পায়ের ছাপকে উদ্বায়ী হতে দেয় না, তার বুকে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকি। দেখি তোমার থেকেও প্রিয় হয়ে ওঠে তোমার চিহ্নগুলো। যে সকাল এক চোখ ক্লান্তি ভাসায় বেসিনে, তার কথা কেউ মনে রাখে না। মনে থাকে পরিপাটি আঁচড়ানো চুলের কথা, বেঁধে নেওয়া খোঁপার কথা। নুনহীন তরকারি বিনুনি হয়। আলুলায়িত আলুসেদ্ধ ডাল।
তবু এই এবড়ো খেবড়ো রং, বরং, রেখে আসি গ্রিলে। কোনো সালোকসংশ্লেষ পেরিয়ে তাদের মোক্ষলাভ হয়। ঘুম ভেঙে দেখো, এত রং ছিল না চাদরে। ছিল না এত মেঘ সিলিঙে। বৃষ্টি আসবে খুব শিগগিরই তোমার ঘরে। কিছু গেলাসে জমিয়ে রেখো মুহূর্তগুলি। টাঙিয়ে রেখো ভেজা হৃদয় আলনাতে। রাত জেগে শোনো মকমকি। অকুতোভয় হয়েছো তুমি , বারান্দার বোলতার চাককেও ভয় পাওনা আর। কখনো স্বপ্নভ্রমে ভ্রমর ভেবে বোসো তাদের।

Facebook Comments

Leave a Reply