রবীন্দ্র গানে জেন্ডার ফ্লুইডিটি : একটি অতিসংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ – অপূর্ব ঘোষ
রবীন্দ্র গানে জেন্ডার ফ্লুইডিটি : একটি অতিসংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
শিল্প মাধ্যমে জেন্ডার ফ্লুইডিটি ও উভলিঙ্গত্বের অস্তিত্ব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রসংগীত-কে গবেষকরা তাদের ক্ষেত্র হিসেবে দেখতেই পারেন, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের ও কিছুটা প্রেম পর্যায়ের গান এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পূজা পর্যায়ের বেশিরভাগ গান গুলি উৎসর্গ করা হয়েছে একজন অ্যাবসোলিউট ডিভাইন বা স্বয়ম্ভু দেবতার প্রতি, যিনি একান্ত ভাবেই পুরুষ। কারণ সেই দেবতাকে ‘প্রভু’, ‘প্রিয়’, ‘পরম পতি’, ‘জীবন বল্লভ’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অন্যদিকে কবির সত্তা বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পোয়েটিক সেল্ফ’ কখনো পতিব্রতা স্ত্রী, কখনো প্রেমিকা, কখনো বা রাধিকার রূপ পরিগ্রহনণ করেছেন। এই অবস্থা কোথাও গিয়ে যেন সেই জেন্ডার ফ্লুইডিটির ধারণার দিকে নির্দেশ করে। কুইয়্যার কমিউনিটির অনেক গবেষক বা অ্যাক্টিভিস্ট রবীন্দ্র সংগীতে এই জেন্ডার ফ্লুইডিটির উপাদান সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার আরো এক ধাপ এগিয়ে রবীন্দ্রনাথের যৌনতা বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন তোলার আদেয় কোনও যৌক্তিকতা আছে কিনা তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে আলোচ্য প্রবন্ধে।
প্রথমে পূজা পর্যায়ের কিছু গানের ওপর আলোকপাত করা যাক:গীতবিতান- এর পূজা পর্যায়ের ৩৪ নম্বর গানে দেখা যায় কবির সত্তা নববধূর সাজে সজ্জিত হয়ে স্বয়ম্বর সভায় যাচ্ছেন সয়ম্ভু দেবতা তথা পরম পুরুষকে স্বামী হিসেবে বেছে নিয়ে মিলিত হতে: “তোমায় আমায় মিলন হবে বলে/ যুগে যুগে বিশ্বভূবনতলে/ পরাণ আমার বধুর বেশে চলে চিরস্বয়ম্বরা।“ ৪৭ নম্বর গানে কবির নারী সত্তা গাইছেন: “ আমার সন্ধ্যা ফুলের মধু/ এবার যে ভোগ করবে বঁধু(বন্ধু)।” নিজেকে বন্ধু /প্রেমিক দেবতার কাছে সঁপে দিচ্ছেন কবির নারী সত্তা। কবির নারী সত্তা ৪৮০ নম্বর গানে পরম দেবতাকে সম্বোধন করছেন ‘জীবন বল্লভ’ বলে: ”ওহে জীবন বল্লভ, ওহে সাধন দুর্লভ/ আমি মর্মের কথা অন্তর ব্যাথা কিছুই নাহি কব/ শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহো সব/ আমি কি আর কব।“ প্রেম পর্যায়ের ৬৮ নম্বর গানে কবি দেবতাকে সম্বোধন করছেন ‘প্রিয়’, ‘ প্রভু’, ও ‘পরম পতি’ বলে: “প্রভু আমার প্রিয় আমার পরম ধন হে/ চির পথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে/ তৃপ্তি আমার, অতৃপ্তি মোর, মুক্তি আমার, বন্ধন ডোর/ দুঃখসুখের চরম আমার জীবন মরণ হে/ আমার সকল গতির মাঝে পরম গতি হে/ নিত্য প্রেমের ধামে আমার পরম পতি হে।“ আবার ৯৩ নম্বর গানে কবির নারী সত্তা নিজেকে পরম পুরুষ -দেবতার কাছে নিজেকে বন্দি করতে বা মিলন কামনা করছেন:“ সব বাঁধনে তোমার সাথে বন্দী কর মোরে/ ওহে আমি বাঁধন- কামী।“ প্রেম পর্যায়ের একটি গানের কবি সত্তা নারীর কন্ঠে গাইছেন: “এসো এসো ফিরে এসো, বঁধু হে ফিরে এসো/ আমার ক্ষুধিত, তৃষিত তাপিত চিত, নাথ হে, ফিরে এসো/…আমার চির বঞ্চিত এসো/ আমার চির সঞ্চিত এসো/ ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন, ভুজবন্ধনে ফিরে এসো/ আমার বক্ষে ফিরে এসো/ আমার চক্ষে ফিরে এসো/…আমার চোখের সলিলে এসো/ আমার আদরে আমার ছলনে,আমার অভিমানে ফিরে এসো।” রবীন্দ্রনাথ ৩৯ নম্বর গানে বলছেন যে, পরম পুরুষ তাঁর নিজের দেহের মধ্যে হৃদয়ের গোপন গহ্বরে শুয়ে আছেন এবং রবীন্দ্রনাথ সেই পরম পুরুষের সাথে মিলন কামনা করছেন: “মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে/ একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-‘ পরে/ প্রিয়তম হে জাগো জাগো/ রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়িয়ে আমি/ আর কতকাল এমনে কাটিবে স্বামী-/ প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।”
শুধু গানেই নয়, ছিন্নপত্রাবলী-এর একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে উর্বরা পৃথিবী বা ‘প্রকৃতি’ তথা নারীর সাথে এবং সূর্যকে ‘পুরুষ’এর সাথে তুলনা করেছেন: “এক সময় যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম, যখন আমার ওপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূর দূরান্তর কত দেশ দেশান্তরের জল স্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধ শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরৎ- সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে-একটি আনন্দরস একটি জীবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকান্ড বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে-আমার এই যে মনের ভাব এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব।“
রবীন্দ্রনাথ যে জেন্ডার ফ্লুইডিটি ও উভলিঙ্গত্বের বিষয় তাঁর গানে বা সৃষ্টিকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন তার ধারনা সম্ভবত তিনি পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে জেন্ডার ফ্লুইডিটি ও উভলিঙ্গত্বের বিষয় চলে আসছে। এগুলি আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ। শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বিষ্ণুর মোহিনী অবতার, মহাভারতের শিখণ্ডী চরিত্র, এ ছাড়াও রামায়ন, মহাভারত, পুরাণের বিভিন্ন ঘটনা বা কাহিনি জেন্ডার ফ্লুইডিটি ও উভলিঙ্গত্বের অস্তিত্বকেই প্রমাণ করে। রবীন্দ্রনাথ যে প্রাচীন ভারতের এই সব জেন্ডার ফ্লুইডিটির ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাঁর নরনারী, মন ও অখণ্ডতা নামক প্রবন্ধে। তিনি বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হন প্রাচীন ভারতীয় সাঙ্খ্য দর্শনের ‘পুরুষ’ ও ‘প্রকৃতি’ র ধারণা থেকে। এই দর্শন মতে পুরুষ ও প্রকৃতি(নারী) একই দেহে পরস্পরের সাথে মিলিত হতে পারে।অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পুরুষ ও প্রকৃতির উপাদান আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অখণ্ড নামক প্রবন্ধে লিখেছেন : “প্রকৃতির মতই রমনীর আছে কেবল ইচ্ছেশক্তি…… মানুষের মধ্যে দুটো অংশ আছে- একটা অচেতন, বৃহৎ, গুপ্ত এবং নিশ্চেষ্ট, আরেকটি সচেতন, সক্রিয়, চঞ্চল, পরিবর্তনশীল।“ রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত বিশ্বাস করতেন, যেভাবে প্রকৃতি পুরুষের সাথে মিলিত হয়, ভক্তকেও সেই একই ভাবে দেবতার সাথে মিলিত হবার আকুলতা থাকতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের উপর গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রভাবও পড়েছিল যা তাঁর বিভিন্ন লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন অনুয়ায়ী বিশ্বব্রহ্মন্ডে একজনই পরম পুরুষ – ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি হলেন রাধা। এই হ্লাদিনী রূপিনী রাধা হলেন প্রেমরূপা স্বরূপিনী। তাই রাধাই হলেন ভক্তশ্রেষ্ঠ। তাই কৃষ্ণকে পেতে হলে ভক্তকে রাধার মাধ্যমে, বা রাধা হয়ে পেতে হবে। কারণ এই কৃষ্ণপ্রেমে কৃষ্ণ বিষয়, কিন্তু রাধা হলেন আশ্রয় বা মাধ্যম। অর্থাৎ, ভক্তকে তাঁর ভেতরকার নারী সত্তাকে জাগ্রত করে নিজেকে পরম পুরুষের কাছে সঁপে দিতে হবে। এখান থেকেই রাধাভাব ও সখীভাবে সাধনার উৎপত্তি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পূজা পর্যায়ের গানেও কিন্তু কবির নারী সত্তা রাধার মতই পরম পুরুষের প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছেন।
একজন শিল্পীর থাকে অবাধ স্বাধীনতা। তাঁর শিল্পকর্মে প্রকাশিত লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক গন্ডী বা ব্যাখ্যা সবসময় তথাকথিত মূলধারার সাথে নাও মিলতে পারে। শিল্পমাধ্যমে প্রকাশিত শিল্পীর লিঙ্গ-যৌন চেতনা সবসময় কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই শিল্পীর লিঙ্গ চেতনা বা যৌনতার( বলা যেতে পারে সেক্সুয়াল প্রেফারেন্স) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না-ও হতে পারে, আবার হতেও পারে। তাই রবীন্দ্র সংগীতের জেন্ডার ফ্লুইডিটির উপাদানের উপর নির্ভর করে রবীন্দ্রনাথের যৌনতা বা লিঙ্গ চেতনা নিয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তাঁকে সমকামী বলে দাগিয়ে দেওয়া আর যাই হোক খুব বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না। বরং ক্যুইয়ার কমিউনিটি রবীন্দ্রনাথের গানকে তুলে ধরে দেখাতেই পারেন যে কিভাবে একজন তথাকথিত মূলধারার মানুষ রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের শিল্পকর্মে জেন্ডার ফ্লুইডিটি ও উভলিঙ্গত্বের বিষয় তুলে ধরেছেন’ যা ক্যুইয়ার গোষ্ঠীর অবস্থান তথা মূলধারার সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবিকে আরো জোরালো করতে পারে বলেই বিশ্বাস।
[লেখক – কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রান্তীয় লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ে গবেষণারত]