গল্প : অদ্বয় চৌধুরী

একটি আত্মহত্যামুখী গল্প

কোনো এক অচিন পাখির দেশের প্রতিটা কোণায়— জাতীয় সড়কে, রেল লাইনে, মায় সুপ্রিম কোর্ট ও পার্লামেন্টের খোলা চত্বরে, পাখিদের মৃত্যুদৃশ্যের এই যে বিপুল সমারোহ, তা নিয়ে মূলত দুটি সরকারি বক্তব্য শুরুতে উঠে এসেছিল। প্রথমত, কোনো এক অজানা রোগের কারণে পাখিরা বায়ুর চেয়ে বেশি ভারী হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব হ্রাস পেয়েছে। প্রথম যুক্তিটির সাপেক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি মৃত পাখিদের দেহ ময়না তদন্তের মাধ্যমে। অতএব পরীক্ষা সাপেক্ষে তা বাতিল হয়ে গেছে। দ্বিতীয় যুক্তিটি খারিজ হয়ে গেছে পরীক্ষার আগেই। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব হ্রাস কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট এলাকায় হতে পারে। কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে পাখিদের মৃতদেহ ঝাঁক ঝাঁক বর্শার মতো নেমে আসছে সারা দিন এবং দিনের পর দিন।
তাহলে পাখিদের মৃত্যুর কারণ কী? খাদ্যের অভাব? বাসস্থানের অভাব? এই দুটি অভাবের কারণেই তাদের লাগাতার উড়ানের বাধ্যবাধকতা এবং ফলস্বরূপ ক্লান্তি থেকে মৃত্যু? তাহলে কি এই মৃত্যু আসলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা? পাখিদের প্রতি কি রাষ্ট্রের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? পাখি কি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে? তারা কি নিশ্চিতরূপে ওই দেশেরই নাগরিক? পাখিদের বা অন্য যেকোনো মৃত্যুর কারণ সুনির্দিষ্ট আকারে পেশ না করতে পারাও তো রাষ্ট্রেরই এক ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে?
এইসব অস্বস্তিকর প্রশ্নের সন্ধানে ওই দেশের সুপ্রিমো ও তার একান্ত সহায়কদের জরুরি বৈঠকে তৃতীয় একটি যুক্তি উঠে আসে। পাখিদের গণ আত্মহত্যা। এই যুক্তিটি সহজগ্রাহ্য ও সহজপাচ্য। এই ঘটনা সম্ভব কারণ তা পরীক্ষা সাপেক্ষ নয়। অতঃপর এই মৃত্যু আসলে পাখিদের আত্মবলিদান এবং এই আয়োজন পাখিদের ব্যক্তিগত বিষয় বলেই প্রমাণিত হল।
বৈঠক শেষ হয়। গল্পটাও শেষ হতে পারত এখানেই। কিন্তু হয় না। পাখিদের মৃত্যু অব্যাহত থাকে। তাদের মৃতদেহগুলি অসংখ্য প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঝরে পড়তে থাকে মাটিতে। এহেন গণহারে আত্মহত্যা পাখিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব নয়। এই বিপুল আয়োজনটি একমাত্র সম্ভব যদি তারা কারওর নির্দেশ হিসেবে তা পালন করে থাকে। কে সেই মহাশক্তিধর আদেশদাতা? পাখিদের শাসনব্যবস্থায় ওই দেশের সুপ্রিমোর থেকেও ক্ষমতাশালী জাদুকর কেউ আছে তাহলে?
বৈঠক শেষে সবাই চলে গেলে সুপ্রিমো ভাবতে থাকে একা। ইশ! ওই দেশের গণ্ড মূর্খগুলো যদি এভাবেই গণ আত্মহত্যার নির্দেশ পালন করত! ওই দেশের মানুষগুলোকে যদি এতটাই বাধ্য ও বশ করা সম্ভব হত! ইশ! গণ আত্মহত্যার নির্দেশের প্রচলন ঘটাতে পারলে ‘গণহত্যা’ শব্দবন্ধটি মুছে ফেলা যেত চিরতরে।
সুপ্রিমো ভাবতে থাকে… ভাবতে থাকে কীভাবে আরও মায়াবী করে তোলা যায় তার শাসন, কীভাবে আত্মহত্যামুখী করে তোলা যায় দেশকে।

***

## ভার্হিলিও পিনেরা-র ‘দ্য ডেথ অফ দ্য বার্ডস’ গল্পটি থেকে আংশিক অনুপ্রাণিত।

Facebook Comments

Posted in: May 2020, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply