এই হাত আগুনের (মেটাফর): ভারতীয় প্রতিস্পর্ধী কবিতার অনুবাদ : তনুজ ও শর্মিষ্ঠা
প্রথম কিস্তি
হর্ষ ভরদ্বাজের কবিতা
মূল ভাষাঃ ১নং কবিতাটি ইংরেজি, বাকি কবিতাগুলি হিন্দি ।
অনুবাদের সোর্স ভাষাঃ ১ নং কবিতাটির ক্ষেত্রে ইংরেজি, বাকি কবিতাগুলির ক্ষেত্রে হিন্দি।
এই সভ্যতাকে বন্দুক দেখানোর দায়ে প্রত্যেকবার যাকে মেরে ফেলা হয়, ফোর্বসগঞ্জের সেই তরুণ কবি হর্ষ ভরদ্বাজের বয়স মেরেকেটে উনিশ কিংবা কুড়ি। এবং এই সিরিজ ও সিলসিলার সর্বকনিষ্ঠ কবি তিনিই। তবে যে তটস্থ আত্মমগ্নতায় তিনি লিখে চলেছেন, বললে অত্যুক্তি হবে না যে তার জামার আস্তিন থেকে ইতিমধ্যেই হিন্দী প্রতিস্পর্ধী কবিতার বিরল তাসটি উকি মারতে শুরু করেছে। হিন্দী ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই সাবলীল হর্ষকে প্রভাবিত করেছেন পাশ, বিদ্রোহী, শমসের বাহাদুর সিং, মুক্তিবোধ, লাল সিং দিল, রাজকমল চৌধুরী, ফার্নান্দো পেসোয়া প্রমুখ। পাশ ও হিন্দী কবিতার বিপ্লবী ঘরানার ভাব-সম্প্রসারণকারী হর্ষের লেখা আমাদের সেই সারসত্যের সম্মুখেও দাঁড় করায় যে সাহিত্যের ভবিষৎ-প্রস্তাবনা নিহিত রয়েছে সাহিত্যের অতীতেও। হর্ষ ইদানীং দিল্লিতে পড়াশোনা করছেন। এই অব্দি তার কোনো কবিতার বই নেই।
১
শুধু সিসিফাস নয়,
আমি সেই পাথরটাও, যা সে
বারবার টেনে তুলতে থাকে
এবং আমি সেই পাহাড়টাও।
২
কী কী করা যেতে পারে
একটা দেশের স্বাধীনতার
সত্তরতম বর্ষপূর্তিতে?
স্বাধীনতার সত্তরতম বছরে
স্বাধীনতার সঠিক অর্থ কি, কীভাবে
বোঝানো যেতে পারে দেশপ্রেমিকদের
আর অন্তত আজকের দিনে
যারা নিজেদের হেডমাস্টারকে
গালাগাল দেয় না, সেই স্কুলের শিশুদেরই বা
দেশের উদ্দেশ্যের বিষয়ে কী বলা যেতে পারে?
ইতিহাস বইয়ের পাতায় একটা পা রেখে
কী আজ লাফিয়ে চলে যাওয়া যাবে
এই সরকারি দেয়ালগুলোর ওপারে,
যেখানে রয়েছে আদিবাসীদের বস্তি,
যেখানে বিরসা মুন্ডার কবরে
কাল সন্ধ্যায় সেট করা হয়েছে
একটা বিশালকায় মেশিন?
দেশের সত্তরতম বর্ষপূর্তির অজুহাতেই হোক না কেন,
আজ কী আমাদের নজরে পড়বে
অগুণতি বছর ধরে অদৃশ্য হতে থাকা
ওই লক্ষ লক্ষ মানুষ,
যাদের ঝুপড়ির বাঁশ থেকে ঝুলে আছে
ধূলোয় ঢাকা বিকাশের পুঁটলি
আর যাদের চোখ এখনও বিশ্বাস করতে চায় না যে
তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে?
তাদের কী আজ দেখা যাবে
কোনো বিশাল মিছিলের রূপে,
সে মিছিলে কী তেরঙ্গায় চুমু খেয়ে
গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাবেন তারা?
ছত্তিসগড়ের মহিলাদের কী
আজ কেউ ঢেকে দিয়ে যাবে তেরঙ্গায়
আর দেশের স্বাধীনতার সত্তরতম বর্ষপূর্তির
অজুহাতেই হোক না কেন,
তারা কী আজ বাঁচতে পারবে পুলিশের হাত থেকে?
আজ,এই স্বাধীনতার সত্তরতম বর্ষপূর্তির দিনে কী
এই দেশকে একটা যুদ্ধভূমির বদলে
একটা ক্ষেত হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে,
যেখানে আমাদের বাপ-ঠাকুর্দারা
আমাদের জন্য শস্য ফলিয়ে রেখেছেন?
যেখানে আজ কোনো সরকারি স্কুলের ছেলে
আকাশের দিকে মুখ করে,
সূর্যের সাথে কথা বলছে যেন,
পাশের কবিতা গেয়ে যাবে।
আজকের দিনে কী জানা যেতে পারে
আধমরা সৈনিকদের কাছে যে
দেশ বলতে তারা ঠিক কী বোঝেন,
আর তাদের কী বুঝিয়ে বলা যেতে পারে যে
প্রত্যেকটা দেশই তার সরকার প্রচারিত
একটা ফোলানো মিথ্যে ছাড়া আর কিছু নয়?
আজ স্বাধীনতার সত্তরতম বর্ষপূর্তির দিনে,
এমনও কি হতে পারে
যে বেবাক ভাষায় কেউ লিখে দিয়ে যাবে,
এইসব সীমান্ত -টিমান্ত নিছকই গৌণ বিবাদ
তবে আফশোস এই যে,
তাদের নিয়েও আজকাল তর্ক হয় না আর।
আজ,স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে,
কেউ কতটা স্বাধীন হতে পারে?
৩
কী করি নি আমি,
আমার কবিতায়?
তারার মানচিত্র ঘেঁটে খুঁজে এনেছি
আমার মায়ের শুকনো চেহারা
আর তার হাতের তালুতে দৃশ্যমান
আরও শুষ্ক রেখাগুলোকে
টেনে নামিয়েছি এই পৃথিবীর পিঠের ওপর।
আমার বাবার বুকে বিঁধে যাওয়া গুলিকেও
আমি বার করে এনেছি আমার কবিতায়
আর কত কত বারই না
ছড়িয়ে পড়েছি
তার ক্ষেতে আর জমিনে
শিশিরের মতন।
আমি আমার কবিতাগুলোকে
মেহেন্দির মতন সাজিয়ে দিয়েছি
আমার হাজার হাজার নিরুদ্দেশ বোনেদের হাতে
আর আমার প্রেমিকার চুলে আটকে যাওয়া
নিমের চূর্ণ ডালটাকেও সরিয়ে এনেছি কবিতা ছুঁইয়ে।
আমি মারাও গেছি
সহস্র বার প্রেমে এবং দশহাজার বার যুদ্ধে।
আমার কবিতা
সেইসব যুদ্ধে শহীদ হওয়া আমার সাথীদের
স্ত্রীদের হাতের ভাঙ্গা চুড়ি,
যা আমাদের শক্ত পায়ের পাতা ফুঁড়ে দেয় না আর।
হ্যাঁ,আমার কবিতা
ওই অহেতুক মরে যাওয়া শিশুদের মায়েদের চোখে
চোখ রেখে কথা বলতে পারে না ঠিকই
তবে আমার কবিতাই তাদের হত্যাকারীর
মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয় রোজ।
*
আমি এই সভ্যতার সমস্ত পাপকেই
নিজের কাঁধে চাপাতে পারি না
আমার কবিতা পড়েই আমি শেষও হয়ে যাই না;
কবিতা লেখাকালীনও আমাকে মেরে ফেলা হয়
এই সভ্যতাকে বন্দুক দেখানোর দায়ে
প্রত্যেকবার আমাকে মেরে ফেলা হয়।
৪
আমি চাই
আমরা যেন ধরা পড়ি
আমাদের ভালোবাসার তীব্র মুহূর্তে
আর আমাদের যেন মেরে ফেলা হয়
কোনো বন্দুকের গুলিতে বিদ্ধ করে
অথবা কোনো চকমকে ছুরির আঘাতে
অথবা কোনো ভারি রড দিয়ে থেঁতলে।
আমি চাই
আমরা যেন মরে যাওয়ার আগে
জড়িয়ে ধরতে পারি একে অপরকে
আর ছুঁয়ে দিতে পারি নিজেদের নিঃশ্বাস,
প্রথমবারের মতন
আর আমাদের শরীরের বেঁচে থাকা শিহরণ
যেন একে অপরের
আধমরা,রক্তাক্ত শরীরদুটোকে
পুরোপুরি নিঃশেষ করে দেয়ার
কোনোরকম সুযোগ না ছাড়ে!
আমি চাই
আমাদের যেন দাফন করা হয়,
শরীরের ওপর শরীর সাজিয়ে
সেই আমবাগানেই,
যেখানে আমরা লুকিয়ে দেখা করতাম,
কখনও বিড়িও টানতাম দুজনে একসাথে বসে।
আমি চাই
আমাদের মেরে ফেলা হোক
কোলাহলহীন
এক ভীষণ নীরবতায়
আর তারপর যেন আমাদের খুঁজতে
না আসে কেউ।
আমি চাই না
আমাদের দাফন করা হাড়গুলোর ওপর
আজ থেকে দেড়শো বছর পরে কোনো গবেষণা হোক।
আমি চাই
আজ থেকে দেড়শো বছর পরে
যদি কেউ খুঁজে ফেলতেও পারে আমাদের কবর
আর খনন করে বারও করে আনে অবশিষ্ট আমাদের,
তখনও যেন আমার বুকের হাড় থেকে
ঝুলতে থাকে তোমার কানের ঝুমকাটা।
৫
কবিতা এমনি এমনিই
লেখা হয়ে যায় না!
খুঁজে বার করতে হয় তাকে,
যেমনভাবে আমার লন্ডভন্ড ঘরের
মেঝে হাতড়ে আমি খুঁজে নিই
আমার শার্টের ভাঙ্গা বোতামটাকে,
যা বোধহয় গতসপ্তাহে হারিয়ে গেছিল।
নিজের শ্রম বেঁচে ফেরত আসা
কোনো হতাশ মরদ তার বৌয়ের শরীরে
নিজের জন্য ঘুম খুঁজতে যায় না আবার।
স্বপ্নের মধ্যে বসে,সারারাত জেগে
নিজের গোড়ালির সাথে
সে সেলাই করতে থাকে কবিতা,
বন্ধক রাখে তার দিনের ক্লান্তি তার কাছে।
দুটো রুহের মাঝে যে জঙ্গল ঘনায়,তাও কবিতাই,
চিন্তার বিচিত্র গলিঘুঁজির পরিলেখও কবিতা।
অজানা কোনো ঘরে জেগে উঠলে
তাকে পাওয়া যায় বাসি শরীরের সুগন্ধে।
সিগারেটের ধোঁয়া যখন
অর্ধপরিস্ফুট চেহারার মতন ক্যানভাসে ভেসে ওঠে
আর হৃদয় উৎসারিত চিন্তার ভারে আমরা ডুকরে কেঁদে ফেলি,
তখন বন্দুকের নল থেকে গুলির মতন জোরে সে বেরিয়ে আসে
আর কানের গোড়া ঘেঁষে বইতে থাকা রক্তের সাথে রঙ মেলায়।
নিঃশেষিত হওয়ার সেই মুহূর্তে
নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।
৬
ভাষা এবং সংবিধানের ব্যাপারে
আমি এখন আর কিছুই জানতে চাই না।
না ভালোবাসা ও মনুষ্যত্বের প্রতি
আর কোনো আগ্রহ আছে আমার।
আমি শুধু তোমাকে এটুকু বলতে চাই যে
ইদানীং দুটো চোখের মাঝামাঝি
আমি দেখতে পাই একটা গর্ত,
যেখানে যে কোনো সময় একটা বা দুটো গুলি ভরে দেয়া যায়।
আমি জেনে গেছি—
একটা বোমা শুধুমাত্র তোমার কানের পর্দা ফাটিয়েই শান্ত হয় না
শুধু যে শরীরের ছাল-চামড়া তুলে নেয়,তাও নয়,
সে ঝাঁঝরা করতে চায় তোমার আত্মাকেও।
আর তোমার ভেতরের মানুষটা স্রেফ ততক্ষণই জীবিত থাকতে পারে
যতক্ষণ না তোমার কানের গোড়ায় বন্দুকটাকে বসানো হবে
আর তোমার ভেতরের নাগরিকটা?
সে জীবিত থাকবে ঠিক ততটা সময়
যতক্ষণ না আগামী যুদ্ধের রেখা
তোমার ঘরের চৌকাঠ থেকেই টানা হবে।
শিশুদের হাতও বন্দুকের গ্লানিতে,ভারে
স্রেফ ততক্ষণই থরথর করে কাঁপে
যতক্ষণ না তারা কারোর শরীর ছ্যাঁদা করে দেয়
আর মানুষের আত্মার ভার তুমি জানতে পারবে একমাত্র তখন,
যখন তা কারোর শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।
দেয়ালের রংচটা প্লাস্টার ছাড়িয়ে
ওই,ভাষাই দেখা যায়
তার জন্যই তুমি সহজে পড়তে পারো
বড়ো বড়ো অক্ষরে খোদাই করা
যুদ্ধ এবং সংবিধান,
যা তোমাকে মানুষ বানিয়ে রাখার এক অসম্ভব প্রচেষ্টা মাত্র
আর তোমাকে বাঁচাতে কিংবা পাল্টে ফেলতেই তো
সংঘটিত হতে থাকে সমস্ত যুদ্ধ!
৭
তোমার মতন আমিও
বিভিন্ন রঙের পাথর দেখেছি
কিন্তু তাদের সেই উজ্জ্বল রঙের
কোনোই অর্থ থাকে না যখন তাদের
তোমাকে নিজের পিঠে বসিয়ে
বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
—————-
[তনুজ –কবি,অনুবাদক ,গদ্যকার ও সম্পাদক (‘হারাকিরি’)
শর্মিষ্ঠা –অনুবাদক,ইদানীং ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় প্রতিস্পর্ধী কবিতা অনুবাদ করে চলেছেন।]
Posted in: April 2020, Translation