গল্প : তমাল রায়

কোভিড সময় ও একটি সাজানো খুন!

ভোর চারটে সাতান্ন। পুলিশ এ সময়ে ঘুমোয়! অফিস যেতে হবে৷ আজ মর্নিং শিফট। হাইকোর্টে যেতে হবে অফিস ঘুরে। পি আই এল, তথ্য লুকনোর রায় দেবে কাল।

– এসেছি। অর্চনা বিশ্বাস পাঠিয়েছেন।
– দৈনিক নিরানন্দবাজার থেকে?
-হ্যাঁ
– বিশ্বাস করুন, আমি গত ত্রিশ বছরে কখনও চায়ের দোকানে যাইনি! আড্ডা মারা দূর চা খেতেও বেরোয়নি। সকালে উঠে বাজার করেছি, একার জন্য যা সামান্য প্রয়োজন। একাই তো! কি আর এত প্রয়োজন! অফিস গেছি। ফিরেছি সোজা বাড়িতে। আমার বন্ধু নেই বান্ধব নেই,আত্মীয় পরিজন নেই৷  একেবারে একা! কেবল ওই ফোনে একটু…

-কান্না থামান। বুঝতে পারছি ‘না। ওই একটু কী?
-সে কিছুনা। অর্চনার সাথে কথা! ব্যস ওইটুকুই।
– অর্চনা বিশ্বাস আপনার কে?
– আমার প্রাক্তন স্ত্রী।
– মানে?
-মানে, আমার সাথে পোষায়নি বলে, সে ছেড়ে চলে যায়, তার অফিসের বসের সাথে। সেও পনেরো বছর হল প্রায়৷ সেদিন আমার জন্মদিন ছিলো!
– তাহলে?
– তাহলে কী? বিশ্বাস করবেন কি’না জানিনা, আমি একজন আত্মসুখী বা আত্মদুঃখী মানুষ। পাড়ায়,অফিসে আমার কোথাও বন্ধু নেই। একাই!
-তো?
– তো! কিছুনা। ওরা যখন এলো দরজায় কোয়ারান্টাইন এর স্টিকার লাগালো আমি বাঁধা দিইনি।
– হুম! তারপর?
– তারপর পাড়ার লোকজন দল বেঁধে এলো। বললো, এ পাড়া ছেড়ে যেতে হবে। আমি কোথায় যাবো? আর আমি তো কিছু অন্যায় করিনি। ছেড়ে যাবো কেন? আর দেখুন গত ২৬ দিন হল, জ্বর, খুকখুকে কাশি৷ এতো আমার সারা জীবনের সঙ্গী। নতুন কিছু তো নয়। তবু টিভিতে দেখছি, কাগজে পড়ছি। ফোনে মেসেজ আসে, তাই নিজেই আইডি হাসপাতালে চলে যাই। ওরা বললো, বাড়িতেই ১৪ দিন থাকতে। আমি শুনেছি। ওষুধ যা দিলো, খেয়েছি। তবু পাড়ার লোকজন, মানে প্রতিবেশীরা বললো বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। ক’টাকা মাইনে পাই! কোথায় যাবো? আর গেলেই বা আমায় তারা এ সময়ে রাখবে কেন?
– তারপর?
-আমি গোটা জীবনে কখনও ঝগড়া করিনি।
-বুঝেছি। তারপর বলুন।
– আমার মাথাও ঘুরছিলো। সকাল থেকে লুজ মোশন!
– তারপর?
– ভাগ্যিস ওরা এলো, বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়। মানে স্বাস্থ্য দফতরের লোকজন ইয়া পেল্লাই একটা এম্বুলেন্স নিয়ে এলো। কতগুলো লোক, নেমে এসে বললো, উঠে পড়তে। আমি উঠলাম।
– নিয়ে গেল হাসপাতালে?
-হ্যাঁ।
– আপনি তো বিদেশ…
– আরে দাদা, বিদেশ দূর। আমি এ রাজ্য কেন, নৃপেন বোস এভিনিউতে থাকি, বাগুইয়াটিতেই কখনও যাইনি। কিন্তু আমার তো সেই ছোটবেলা থেকেই রক্তের রোগ! তাই দিন কুড়ি আগে, ব্লাড নিতে গেছিলাম ব্লাড ব্যাংকে।
– তারপর? চিকিৎসা শুরু হল?
– কই হল? যেই ওরা জানলো, মাইলো ফাইব্রোসিস। বললো প্লেটলেট কত? বললাম ৩০০০০। বললো বাড়ি চলে যান।
– জিজ্ঞেস করেন নি কেন?
– বললো, বয়স কত? বললাম ৫৯। বললো লাভ নেই। অহেতুক সংখ্যা বাড়বে৷ স্টেট তা চায়না।
– চলে এলেন?
-কি করবো?
– আর পাড়ার লোক বাড়িতেও ঢুকতে দিলো না। তাই তো?
-হুম। গোটা দু’দিন দু রাত গঙ্গার ধারে বসেছিলাম।
– খাবার তো দূর! ঢিল মারছিলো। এই দেখুন কপাল ফেটেছে। হাতে গর্ত।
– কিন্তু?
– কিন্তু কি? আমি তো বাইরেও কোথাও যাইনি। বাজার দোকান। গতকাল শেষ রাতে বাড়ির দরজায় গিয়ে দেখলাম, স্টিকারটা তুলে দিয়েছে পুলিশ এসে৷ দরজায় আমার তালার ওপর তালা লাগিয়ে দিয়েছে পাড়ার লোক।
– ওয়ার্ল্ড ৫০৫৪৭৮৮। ভারত ৫০৪৭৫। রাজ্য ৫৩৯। আপনি তো ৩৮৯?
– না, নই। ছিলাম। কাটা গেছে।
– কি চান?
– খাইনি লাস্ট ৪ দিন।
– খাবেন কিছু?
– না,যেটা বলেছিলাম এনেছেন?
– কী? চার বোতল ফিনাইল?
– হুম। যদি না মরেন?
– মরবো। দিন না প্লিজ। কিছু খাওয়াও হবে৷ আর দুটো অনুরোধ।
– কি বলুন। স্টোরি করতে হবে?
– ধুর! এ স্টোরি ছাপলে আপনাদের কাগজে সরকারি এড বন্ধ হয়ে যাবে।
– তাহলে?
– আমায় গঙ্গাতেই ভাসিয়ে দেবেন। কেউ কোথাও তো নেই! নইলে অর্চনাকেই সেই ঝক্কি পোহাতে হবে৷ এ সময়ে ওর বেরুনোও রিস্ক। বেচারা স্বামী পুত্র নিয়ে সুখে ঘরকন্যা করছে।
– আর একটা?
-বাড়ির দোতলায় আমার ঘরে যে আলমারিটা, ওর ড্রয়ারে, দলিলটা আছে। অর্চনার নামেই মিউটেশনের কাগজটাও। জানিয়ে দেবেন।

অম্লানকুসুম ঘোষ দস্তিদার। বয়স ৫৯। কোভিড ১৯ পজিটিভ। পেসেন্ট আইডি- ৩৮৯। না নয় নম্বর কাটা গেছে। ঠেলে ফেলে দিলাম গঙ্গার জলে। এখন রাত চারটে সাতান্ন। পুলিশ এ সময়ে ঘুমোয়! অফিস যেতে হবে৷ আজ মর্নিং শিফট। হাইকোর্টে যেতে হবে অফিস ঘুরে। পি আই এল এর কেসটা। তথ্য লুকনোর রায় দেবে কাল।

কাগজের অফিসে চাকরি করছি প্রায় কুড়ি বছর। অনেক কিছু করতে হয়েছে। কাউকে নিজে হাতে হত্যা করতে হল এই প্রথম। খুনী। খুনী আমিই? আলো ফুটছে। কোভিড সকাল হচ্ছে… সকাল!

Facebook Comments

1 thought on “গল্প : তমাল রায় Leave a comment

  1. কী নির্মম এই গল্প। মন খারাপ হয়ে যায় কেবল।

Leave a Reply