করোনা মোকাবিলায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ ধনতান্ত্রিক দুনিয়া : সুকুমার মিত্র
‘এতটা নির্লিপ্ত না হলেও পারতে তুমি,
এতটা অসহায় না করলেও পারতে এই আকাশকে।’
করোনা ভাইরাস(কোভিড-১৯) বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে ২৭লক্ষ ২৬ হাজার ১৯৪ জন সংক্রমিত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন ১লক্ষ ৯১ হাজার ০৭৪ জন, সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ৭ লক্ষ ৪৯ হাজার ৬৬৬ জন। ভারতে এপর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন ২৩ হাজার ০৩৯ জন, প্রাণ হারিয়েছেন ৭২১ জন, সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ৫০১২ জন।পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন-১৫ জন।(এই নিবন্ধ লেখার সময় ২৪ এপ্রিল,২০২০ পর্যন্ত বেলা ১২ টা পর্যন্ত)।
অপরিকল্পিত লকডাউন দেশের শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা বাড়িয়েছে
করোনা মারণ ভাইরাস মোকাবিলা নিয়ে চিন্তায় ভারতের রাজ্য সরকারগুলি। দেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই নেই। নেই সাধারণ ও এন-৯৫ মাস্ক। নেই করোনা রোগির পরীক্ষার পর্যাপ্ত কিট। নেই প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, নেই পর্যাপ্ত ওষুধের সরবরাহ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।এই রকম যখন দেশের পরিস্থিতি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিতে দেশের করোনা চিকিৎসার ওষুধ পাঠানো হচ্ছে মার্কিন মুলুকে। সরকারের গুদামে মজুত খাদ্য শষ্য সর্বত্র গরিব মানুষদের মধ্যে আগামী দু-বছরের জন্য নিশ্চিত না করে সেই চাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ইথানল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্যানিটাইজার রপ্তানি বাণিজ্যের বাজারের দিকে তাকিয়ে এখন এই উদ্যোগ অসহায় দেশবাসীর সঙ্গে নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া আর কিছুই না।
করোনা রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দীর্ঘ নেই-এর তালিকার পাশাপাশি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি ছাড়া আকস্মিক অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে লক্ষ লক্ষ পরিয়াযী শ্রমিক তাঁদের ঘরে ফিরতে পারেননি। আর যাঁরা পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার চেষ্টা করেছেন তাঁদের ৩০ জন পথেই মারা গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে গ্রামে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের রাসায়নিক স্প্রে করে জীবানুমুক্ত করার অমানবিক, অবৈজ্ঞানিক ও অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সুরক্ষা পোশাক পরা একদল মানুষ পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর জীবাণুনাশক স্প্রে করছে। এই শ্রমিকদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে। রাস্তায় বসে থাকা অবস্থায় এভাবে তাঁদের ওপর স্প্রে করা হয়। হতদরিদ্র এই মানুষদের ওপর এভাবে স্প্রে করার সময় ঘটনাস্থলে হাজির ছিল পুলিশ। তবে পুলিশ ছিল নিছক দর্শকের ভূমিকায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘নিজেদের চোখ বন্ধ করুন। শিশুদের চোখ বন্ধ করে দিন।’ এ ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি জানিয়েছেন, ‘উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে আর্জি জানাচ্ছি, আমরা সবাই একসঙ্গে এই সংকটের মোকাবিলা করছি। দয়া করে এমন অমানবিক কাজ করবেন না। এই শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই অত্যন্ত ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে ঘরে ফিরেছেন। তাঁদের ওপর এভাবে রাসায়নিক স্প্রে করবেন না। এটা ওঁদের রক্ষা করবে না। বরং তাঁদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে।’ সবাইকে স্যানিটাইজ করাটা অত্যন্ত জরুরি বলে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকার প্রিয়ংকার আপত্তিতে কোনও আমল দেয়নি।
এসব পরিযায়ী শ্রমিক কেন এভাবে একযোগে ঘরে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন? পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গত আশঙ্কা ছিল, বড় বড় শহরগুলোতে রুটিরুজি হারিয়ে লকডাউনে তাঁদের না খেয়ে মরতে হবে। করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সরকারের নির্দেশ ছিল, যে যেখানে আছে আপাতত সেখানেই থাকুক। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোটি কোটি শ্রমিক, যাঁরা ছোটখাটো দোকান-রেস্তোরাঁয় কাজ করেন কিংবা নির্মাণ শিল্পে দিনমজুরের কাজ করেন তাঁরা এই নির্দেশ পালনের সাহস দেখাতে পারেনি। বস্তিতে বাড়িভাড়া কীভাবে দেবেন, এতগুলো দিন কীভাবে নিজের বা পরিবারের পেট টানবেন? এমন চিন্তা থেকেই তাঁরা পথে নেমেছিলেন। ট্রেন, বাস বন্ধ। তারপরও শত শত মাইল দূরে নিজের গ্রামের উদ্দেশে তাঁরা হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলেন। রাজস্থান থেকে বিহার–প্রায় ১২শ’ মাইল পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার ‘লং মার্চ’ অনেকে শুরু করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন হাইওয়েতে চোখে পড়েছে এই ধরনের অভুক্ত বা আধপেট খাওয়া মানুষের ঘরে ফেরার অসহায় মিছিল।
দেশের রাজধানী দিল্লি, গাজিয়াবাদ, মুম্বই, আমেদাবাদ, কেরালা, চেন্নাই, ভেলোর, ব্যাঙালুরু, হায়দ্রাবাদ, কোট্টায়ামের মতো বিভিন্ন শহরে কর্মরত অসংখ্য শ্রমিক নিজেদের গ্রামে ফিরতে চাইলেও তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। রাজধানী দিল্লিতে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় উপছে পড়ছে এমন দৃশ্য আমাদের সকলের নজরে এসেছে। কাঁধে, মাথায় বোঝা নিয়ে, কেউ কেউ কোলের বাচ্চাকে নিয়ে যে কোনও ভাবে একটা বাসে ওঠার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বাসে ফেরার সুযোগটুকু পাননি। আর এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বিভিন্ন রাজ্য সীমান্ত সিল করে দিতে বাধ্য হয়। করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ ছিল, যে যেখানে আছে আপাতত সেখানেই থাকুক। এই ঘোষণার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও কাঁচাবাজার পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার জন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনাও করেনি কেন্দ্র। পাইকারি বাজারগুলোতে কোনোভাবে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছাচ্ছে ঠিকই, তবে তা মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। কারণ রেল ও সড়ক পরিবহন বন্ধ। এর ফলে দেখা যাচ্ছে অনেক দোকানেই পণ্য শেষ হতে শুরু করেছে। বাজারগুলিতে সবজি সরবরাহ কমছে। যেটুকু থাকছে, তার দামও অনেক বেশি।এই সমস্যা মূলত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের সমস্যা। যাঁদের হাতে কিছুটা অর্থ আছে। সেইসব শহুরে মানুষের কাছে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে।কিন্তু এর বাইরে দেশের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ-যাঁরা দিন আনেন দিনে খান, অর্থাৎ রিকশা বা ভ্যান চালক, অটো ও টোটোচালক, গৃহকর্মী, প্রাইভেট আয়া, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিক, কৃষি মজুর, বাগিচা শ্রমিকদের অবস্থা কিন্তু বেশ শোচনীয়। লকডাউনের জেরে তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। এমনকি ট্রেন, বাস পরিবহন বন্ধ থাকায় গ্রাম থেকে শহর বা শহরতলিতে সেই সব মানুষের পক্ষে কাজের জন্য পৌঁছনোই সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের পর মুম্বই-এর বান্দ্রা রেল স্টেশনে প্রায় হাজার তিনেক পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফেরার জন্য জড়ো হয়েছিলেন। দুটি কারণ ছিল তাঁদের ঘিরে ফেরার তাড়না। প্রথমত, মুম্বই ও মহারাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যায় তাঁরা ও তাঁদের পরিবার শংকিত হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া তাঁদের খাবারের নিশ্চয়তাও ছিল না। অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটছিল। বলা যায়, একেবারে জান নিয়ে ফেরার তাগিদেই বান্দ্রা রেল স্টেশনে এসেছিলেন। তাঁদের কাছে খবর ছিল লকডাউন উঠে গেলে ট্রেন চলবে। দ্বিতীয়ত, এই সব পরিযায়ী শ্রমিকরা চাইছিলেন এলাকায় ফিরে কিছু না কিছু একটা কাজ জুটিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করতে হবে। কারণ মহারাষ্ট্রে তাঁদের কাজের জায়গা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। দিনমজুর অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই সব শ্রমিকদের ঘেরা ফেরার তাগিদ খুবই যুক্তিসঙ্গত।করোনা সংক্রমণকে প্রতিহত করতে এঁদের আন্তরিকতার কোনও ত্রুটি ছিল না। রাষ্ট্রের উচিত ছিল এই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের ও তাঁদের পরিবারের আহার ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা সুনিশ্চিত করা। সেই বিষয়ে কোনও বার্তা না দিয়ে তাঁদেরকে সামাল দিতে উল্টে লাঠিচার্জের পথ বেছে নেওয়াটা কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
দুমুঠো খাবার ছাড়াও বহু মানুষের প্রয়োজন চিকিৎসার। ওষুধের দোকান খোলা রাখা হচ্ছে ঠিকই শহরে। কিন্তু গ্রামের দিকে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে যাঁরা আক্রান্ত, তাঁরা নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে শহরে আসবেন কীভাবে? সেটা নিয়ে চিন্তায় আছেন অনেকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্ত দেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাতায়াত এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে পড়েছে। যদিও দারিদ্রসীমার নীচে থাকা ৮০ কোটি মানুষকে প্রতিমাসে সাত কেজি গম দু’টাকা দরে আর তিনটাকা কিলো দরে চাল দেওয়া হবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে। তবে রাজ্যগুলি কিন্তু আকস্মিক লকডাউনের ফলে বেশ সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। মানুষের মধ্যে সঙ্গত অসন্তোষও রয়েছে। কিন্তু এইসব মানুষ করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে যথেষ্ট ভীত ও সর্তক। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁরাও লকডাউনের বিধি নিষেধ মেনে থাকতে চান। এঁদের সদিচ্ছা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু ক্ষুধা বড় বালাই। সে তো করোনা মানে না। বাড়িতে শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাবা-মায়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতেই তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন এই সব মেহনতি মানুষেরা।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের জন্য মাসিক এক হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদানের কথা ঘোষণা করেছেন। ছয় মাসের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যশষ্য দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। এই ব্যবস্থা সর্বত্র স্বাভাবিক হতেও তা লক ডাউনের পর অন্তত দু-সপ্তাহ সময় লেগেই যাবে। ১০ এপ্রিল থেকে রাজ্যের সর্বত্র রেশন দোকান সপ্তাহে সাতদিন চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু রেশন তুলতে গেলে যে সামান্য অর্থ লাগে তা তো গরিব মানুষের কাছে আর সামান্য নয়। দৈনন্দিন মজুরির অর্থ না পেলে সংসারের অন্যান্য প্রয়োজন বা কীসে মিটবে? যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত এইসব শ্রমজীবী মানুষদের অন্তত ছয় মাসের রেশন বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য কেন্দ্র রাজ্য সরকারগুলিকে খয়রাতি দিক। এছাড়া পরিবার পিছু মাসে অন্তত ৩ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ করুক কেন্দ্রীয় সরকার। এই ব্যবস্থা অন্তত ছয় মাস লাগু রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে যে উদ্দেশ্যে লকডাউন তা যথাযথ বাস্তবায়িত হতে পারে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের এই চরম দুর্দশার জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মন কি বাতে’ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ভারতের স্বার্থেই এই লকডাউন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নইলে অন্য বহু দেশের মতো আমাদেরও করোনা ভাইরাসের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।’
ভারত কেন আগেই লকডাউন করেনি?
মানব সভ্যতার এই গভীরতম সংকেটর জন্য দায়ী কে? বিশ্বের তাবড় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় ক্রমশ সরব হতে শুরু করেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে খুব সহজেই তবলিগ জামাতকে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের জন্য দায়ী করে সুকৌশলে প্রচার শুরু হয়ে গেল। অথচ চিনে করোনা রোগ সংক্রমণের পর্দা ফাঁসকারী তরুণ চিকিৎসক ডাঃ ডাব্লু লি ওয়েইন লিয়াং সত্যিই কি করোনা আক্রান্তে মারা গেলেন? চিন ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে জানানো সত্ত্বেও কেনইবা জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক সীমানা নিষিদ্ধ করতে অনিচ্ছুক ছিল? কেনইবা তারা বিশ্ব ভ্রমণ সংস্থাগুলিকে সর্তক করে পর্যটকদের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি? অথচ, ৩১ জানুয়ারি দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশগুলিতে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়তে পারে এই মর্মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তা টেড্রোস অ্যাডনম গেব্রিয়াস সর্তক করার পরও কেন ভারতে বিদেশ থেকে প্রায় ১৭ লক্ষ যাত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তাঁদের হোম কোয়ারেনটাইন বা আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়নি। এমনকী ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তা গেব্রিয়াস সর্বোচ্চ সর্তকতা জারি করার পরও ২৬ দিন লেগে গেলে ভারতে লকডাউন ঘোষণা করতে।
ভারত করোনা ভাইরাস মহামারি হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কেন ১৩ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক করোনা নিয়ে ভারতের কোনও উদ্বেগ নেই এই মর্মে বিবৃতি দেয়। এদিকে পরিকল্পিতভাবে নিজামুদ্দিনে তবলিগ জামাতের দিকে আঙুল তুলে আসলে এনআরসি, এনপিআর, সিএএ দেশব্যাপী সহজে চালু করার প্রেক্ষাপটকে আরও শক্ত করাই কেন্দ্রের শাসক দল সেই লক্ষ্যপূরণে মাঠে নেমে পড়েছে। ১৪ মার্চ তবলিগ জামাতের দুদিন আগে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি ১২ মার্চ করোনা ভাইরাস মহামারির আকার নিতে পারে এই মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্যুইট করেছিলেন। এরপর ২২ মার্চ জনতার কার্ফু, খালি পেটে তালি তারপর ২৫ মার্চ থেকে দেশজুড়ে আকস্মিক লকডাউন।
তবে এটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, বহু আগেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কথা বিশ্বের বহু দেশই জানত।দিল্লিতে তবলিগ জামাতের অন্তত তিন মাস আগে বিশ্বের দেশে দেশে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ মহামারির আকার নিতে শুরু করেছে। সেই অনুযায়ী বিশ্বের বহু দেশ ভারতে লক ডাউন ঘোষণার অনেক আগেই লক ডাউন শুরু করে দেয়। তবলিগ জামাতে আসা বিদেশিরা তো বৈধ ভিসা নিয়েই এদেশে এসেছিলেন। ভারত সরকার যদি জানতো এঁদের থেকে সংক্রমণ হতে পারে, তবে কেন তাঁদের ভিসা বাতিল করা হয়নি? হরিদ্বার কেবলমাত্র গুজরাটের তিন হাজার তীর্থযাত্রী আটকে রয়েছেন। তিরুপতি মন্দিরে ৪০ হাজার ভক্তের সমাগমেও কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।রাজস্থানে ফরাসি পর্যটকরা আটকে পড়েছিলেন লকডাউনে। দেশে ২৮ হাজার গ্রেট ব্রিটেনের নাগরিক রয়েছেন। এঁদের থেকে সংক্রমণের কোনও সমস্যা নেই? আসলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজটি চালিয়ে যেতেই হবে সংঘ পরিবার ও বিজেপিকে।তাই কোভিড-১৯ কে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। উদ্দেশ্য তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক মন্দার ফলে প্রান্তিক ও গরিব মানুষের যে দুর্দশা তা যেন গণ বিক্ষোভের রূপ না নেয়। অত্যন্ত লজ্জা হয় যখন দেখি গুজরাটের আমেদাবাদে করোনা রোগিদের হিন্দু ওয়ার্ড ও মুসলিম ওয়ার্ডে ভাগ করে রাখা হচ্ছে এই সংবাদ জানার পর। দেশের শাসক বিজেপি যখন এই মারাত্মক ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি করছে তখন আমাদের দেশের চিকিৎসক, নার্স, আয়া, টেকনিসিয়ান, প্যাথলজিস্ট সহ সমস্ত স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রয়োজনীয় পিপিই না থাকা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন করোনা আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসার জন্য। পাশাপাশি গ্রাম-শহর ও গঞ্জকে আবর্জনামুক্ত করতে সাফাই কর্মীদের ভূমিকাও প্রশংসনীয়।
করোনা সংক্রমণ চিন থেকেই, জানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনুদান বন্ধের হুমকি আর ভারতকে হুমকি দিয়ে করোনা মোকাবিলায় ওষুধ আদায়ের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেদের স্বার্থপরতারই নমুনা রাখলেন। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চাপা গণ বিক্ষোভকে চাপা দিতে তিনি তাঁর চারিত্রিক অভ্যাসবশতঃ হুমকি ধমকির পথকেই বেছে নিয়েছেন।
অথচ চিন থেকেই সংক্রমিত করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দু’দিনের সফরে কেন ভারত ভ্রমণে এলেন? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের ১৭ দিন আগে ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বেলা তিনটের সময় চিনা চিকিৎসক ডাঃ ওয়েন লিযাং-এর মৃত্যুর পাশাপাশি একজন চিনা সাংবাদিক কুইশি কেন নিখোঁজ হয়ে গেলেন? কেনই বা তাঁর বন্ধু আর এক সাংবাদিক ফ্যাং বিন চুপ হয়ে গেলেন? চিনের সাধারণ মানুষের কাছে এই দুই সাংবাদিক করোনা সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করে দিয়ে চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছিলেন। উওহান সহ চিনের আরও দুটি প্রদেশের কোথায় কি ঘটছে তা বিশ্বের কাছে চলে আসছিল। ওই চিকিৎসকের মৃত্যু ও এক সাংবাদিকের নিখোঁজ হওয়ার পর এখন চিনের প্রকৃত অবস্থা সরকারি চিত্র যা তারা তুলে ধরছে তার বাইরে বিশ্ববাসীর কাছে কোনও তথ্য নেই।এই ঘটনার পরে ভবিষ্যতে জৈবিক মারণাস্ত্র সম্পর্কে সত্য প্রকাশ করতে অন্য কেউ যে এগিয়ে আসবেন না এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বিস্ময়কর ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের এই জৈবিক মারণাস্ত্র সম্পর্কে একটি কথাও বলেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেছিলেন তাতে চিন নির্দোষ এটাই বোঝায়। ট্রাম্প শুধু বলেছিলেন, ‘এটি চিনা ভাইরাস’।
এদিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ প্রর্যন্ত চিন দাবি করেছে,‘করোনা ভাইরাস আমরা তৈরি করিনি বা ছড়ায়নি।’ তাই এই ভাইরাসকে ‘চিনা ভাইরাস’ বা ‘উওহান ভাইরাস’ বলা ঠিক নয়। ভারতে নিযুক্ত চিনা দূতাবাসের মুখপাত্র জি রং আরও বলেছেন, চিন এই ভাইরাসের সৃষ্টিকর্তা নয়। তাঁর সাফ কথা, চিন এই ভাইরাস তৈরি করেনি বা ছড়ায়নি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই মার্কিন গোয়েন্দা কর্তা জানিয়েছেন, চিনে যে সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান চিন প্রকাশ করেনি। বিপরীতে সেই সংখ্যা অনেক কম করে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বের কাছে। সেই রিপোর্ট তাঁরা হোয়াইট হাউসে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে, মার্কিন আইনজীবী রাসায়নিক মারণাস্ত্র বিরোধী সংগঠনের অন্যতম সদস্য ড. ফ্রান্সিস বয়েলের দাবি, করোনা ভাইরাসের জন্মদাতা উওহানের বায়োসেফটি ল্যাবরেটরি। অভিযোগ উঠেছে, এই খবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানত। ফ্র্যান্সিসের দাবি, অতি গোপনে রাসায়নিক মারণাস্ত্র বানানোর প্রক্রিয়া উওহানে চলেছে। সেখান থেকেই ছড়িয়েছে এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ।
নোওয়াম চমস্কি সরাসরি দায়ি করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে। তাঁর মতে, ২০১৯ সালেই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সব জানা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প গুরুত্বই দেননি। পৃথিবীর এই দুর্দশার জন্য তিনি ট্রাম্পকে দায়ি করেছেন। গত অক্টোবর মাসে বিল গিটস, জন হপকিন্স সেন্টার ফর হেল্থ সিকিউরিটি, ওয়ার্ল্ড ইকনমি সেন্টার একটি প্রজেক্ট রিপোর্ট নিয়ে আসে। সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়েছিল ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেই রিপোর্টে কোনও গুরুত্ব দেননি। কঠোর সমালোচনা করেছেন গ্রেট ব্রিটেনেরও। নোওয়াম চমস্কির অভিযোগ, আমেরিকায় কোনও মানবিকতা নেই, নেই কোনও আবেগ। নোওয়াম চমস্কির মতে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের থেকেও খারাপ পরিস্থিতি এখন পৃথিবীর।
২০১৯ সালের শেষের দিকে করোনা ভাইরাস চিন থেকে সংক্রমণ শুরু হয়েছে অন্তত এ বিষয় নিয়ে কোনও বির্তক নেই। চিন সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও তা যে নিয়ন্ত্রণে থাকেনি আজকের দুনিয়ার চেহারা সেই বার্তাই দিচ্ছে। এরই মাঝে যে সংবাদগুলি প্রকাশিত হয়েছে তা কিন্তু চাঞ্চল্যকর ও ভয়াবহ। গত তিনমাসে দুটি চিনা মোবাইল কোম্পানির নাকি দেড় কোটি গ্রাহক সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এই সংবাদ যদি সত্য হয় তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়- কেন এই বিশাল সংখ্যক গ্রাহক হ্রাস পেল? এই হ্রাসের নেপথ্যের রহস্য বিশ্ববাসী কবে জানতে পারবেন কে জানে।
ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, চিনের অভিশাপ আজ বহন করছে গোটা বিশ্ব।আর এই মারণ ভাইরাস গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এপি সেন্টার হিসেবে কাজ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এক কথায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ চূড়ান্ত একটি আন্তর্জাতিক ব্যর্থতা। ইতিহাস ক্ষমা করবে না এই মহামারির জন্য যে অপদার্থতা, স্বার্থপরতা ও উদাসীনতা দেখিয়েছে চিন- সহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিকে। এমনকী ভারত সরকারও সময় মত দেশে লকডাউন না ঘোষণা করে। অনেক আগেই আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ না করে। সমাজ বিজ্ঞানীদের একাংশের মত, কোভিড-১৯ চিনা নয়া পুঁজিবাদের একটি ষড়যন্ত্র বা দুর্ঘটনার পরিণতি।যা আজ মহামারির আকার নিয়েছে। বিশ্ববাসীর সামনে এত বড় সংকট আর কখনও দেখা দেয়নি। উন্নত দেশগুলি এই মহামারি মোকাবিলায় কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। ভারত, কিউবা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে উন্নত দেশগুলির তুলনায় তৃতীয় দুনিয়ার এই দেশগুলি তুলনামূলকভাবে অনেক ভাল অবস্থানে রয়েছে।
ইতালি, ইরান, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে কোভিড-১৯ ভারতের সামনে ভয়াবহ আতংক হয়ে হাজির হয়েছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ভারত তার দায় দেশের মুসলিমদের দিকে সুকৌশলে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। মহামারির মধ্যে আর এক সামাজিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করছে। যার মর্মান্তিক পরিণতি কিন্তু কোনও সভ্য সমাজের কাছে কাম্য নয়। তাই তো কিউবা নিজের দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলার পাশাপাশি বিশ্বের ৩৭টি দেশে মেডিকেল টিম পাঠিয়েছে। ৪৫টি দেশ কিউবার কাছে ইন্টারফেরন আলফা ২বি ওষুধটি চেয়ে আবেদন করছে। কিউবার সমস্ত পোষাক তৈরির কারখানায় মাস্ক তৈরির কাজ চলেছে অবিরাম। বিশ্বের এই বিপদে কিউবার অবদান ইতিহাসে স্থান করে নেবে। পাশাপাশি জার্মানি তারা এই ভাইরাস মোকাবিলায় যে ওষুধ ব্যবহার করছে তা বিশ্ববাসীকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না। ফ্রান্সের মত দেশে ৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। সংক্রামিত হয়েছেন সে দেশের ২০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী। এটা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় ওই দেশের মানুষের কাছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫-এ চিনা ভাইরোলজি ইনস্টিটিউট, উওহান শহরে একটি মারাত্মক করোনা ভাইরাস সনাক্ত করে। উওহানের সেফটি লেভেল ফোর ওই ল্যাবরেটরিতে এই ভাইরাসটি ১৯৮১ সাল থেকে সযত্নে রাখা ছিল। এই সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। দ্রুত মানুষের মধ্যে মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে এই ভাইরাসটি চিন নিজের দেশে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে দরিদ্র মানুষদের উপর বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শত্রু দেশের উপর প্রয়োগ করতে পারে এমন চাঞ্চল্যকর সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৭-এ উওহানের ওই ভাইরোলজি ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষায় জানতে পারে চিনের ১০৬৭ টি বাদুরের মধ্যে ৭৩টির মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এই তথ্য প্রকাশের পরের বছর ২০১৮ সালের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত এক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কভিত্তিক ইকো-হেলথ অ্যালায়েন্সের সভাপতি ডঃ পিটার দাশাক। এই জাতীয় ভাইরাসের মহামারির প্রাদুর্ভাব সেই বৈঠকে আলোচিত হয়েছিল। ওই বৈঠকের পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই বিশ্ববাসীকে কেন সর্তক করেনি? এই প্রশ্ন তোলা কি খুবই অযৌক্তিক। আসলে চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আলোচনা চালাতে কোনও দেশ ভরসা পায়নি।
উপরোক্ত প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও বলা যায়, চিনের তরুণ চিকিৎসক ডাঃ ডাব্লু লি ওয়েইন লিয়াং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানোর অনেক আগেই এর ভয়াবহ বিপদের কথা তিনি চিনবাসীর মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ডিসেম্বর, ২০১৯-এ এই বিপদের কথা তিনি বন্ধু চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনার অপরাধে চিনা পুলিশ তাঁকে তিরস্কার করেছিল। সংবাদে প্রকাশ পাশাপাশি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডাররা তাঁর জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল। পর্দাফাঁসকারী তরুণ এই চিনা চিকিৎসক ডাঃ ডাব্লু লি ওয়েইন লিয়াং অবশেষে ৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা গেলেন। বিশ্ববাসী জানতে পারলেন করোনা সংক্রমণের ফলে ওই চিনা চিকিৎসকের জীবনাবসান হয়েছে। তবে এই মৃত্যুকে ঘিরে বহু প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। যেমন বিশ্বজুড়ে সরকারগুলির সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে এত সময় কেন লাগল? কেনই বা গ্রেট ব্রিটেন সহজভাবে এটিকে গ্রহণ করেছিল? খোদ সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাজকুমার তাঁরাও আক্রান্ত হয়ে গেলেন। দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণার পরও করোনায় কিছুই হবে না বিশ্ববাসী গ্রেট ব্রিটেনের এমন বেপরোয়া মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। ইরানও প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি। কেন, তা ইরান-ই জানে। আশ্চর্যজনকভাবে হলেও দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান এবং সিঙ্গাপুর, চিনের প্রতিবেশী হয়েও এই রোগটি নিয়ন্ত্রণে তারা অনেকাংশে সফল বলা চলে।
এ কথা আজ স্পষ্ট যে করোনা ভাইরাস কিন্তু মানুষের মধ্যে বিস্তার শুরু হয়েছিল চিনের উওহান শহরে। ভাইরাসটির প্রযুক্তিগত নাম ছিল সারস-কোভ-২। যা পরে কোভিড-১৯ এই নামে বিশ্বব্যাপী মহামারির রূপ নিয়েছে। কিছু মানুষের সন্দেহ যে, ভাইরাসটি উওহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। যদিও উওহানের সাথে যুক্ত চিনা বিজ্ঞানীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অস্বীকার করা যায় না যে, চিন দ্বারা জৈবিক মারণাস্ত্র উৎপাদন এবং এই ভাইরাসের দুর্ঘটনাক্রমে সংক্রমণের মধ্যে কিছু সংযোগ থাকতে পারে। চিনের লুকানো সামরিক কর্মসূচির কোনও ধারণা বিশ্বের কাছে কোনও সময় খুব একটা প্রকাশ পায় না। এই রকম সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যে চিনাদের জীবনযাত্রার অভ্যাসের কারণে ভাইরাস মানব দেহে পৌঁছে মহামারি সৃষ্টি করেছে। এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে চিন বিপ্লব রফতানি করতে না পারলেও তারা ঘাতক ভাইরাস রফতানি করতে সক্ষম। চাইনিজ বৈশিষ্ট্যযুক্ত ‘সমাজতন্ত্র’ যা নয়া কৌশুলী পূঁজিবাদী ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই না। সেই ব্যবস্থার এই কুৎসিত চেহারা প্রকাশ পেল এই কোভি়ড-১৯ সংক্রমণের ফলে। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ভাইরাসটি চিন থেকে এসেছে। এই মহামারী সম্পর্কে উদাসীন থাকার ফলে আজ তা গোটা গ্রহকে গ্রাস করেছে।
চিনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির খেসারত দিতে হচ্ছে ইতালি ও ইরানকে
কেউ কেউ মনে করেন, চিনের সাথে ব্যবসা করার জন্য আজ খেসারত দিতে হচ্ছে ইতালি ও ইরানকে।চিন তা অস্বীকার করল কি না তা অবান্তর। চিনের ওবোর উদ্যোগে ইরান পশ্চিম চিন পেরিয়ে ২ হাজার মাইল দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণের জন্য তেহরান এবং ইউরোপের তুরস্কের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ার প্রকল্প গ্রহণ করে।সেই সূত্রে চিনের ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদরা ইরানের বিকল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি মেরামতির কাজ করেছেন। অনেকের আশংকা, ইরানে কাজের জন্য ঘোরা চিনা বাস্তুকার, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা এই মারাত্মক ভাইরাসের বাহক। তারপর গোটা ইরান জুড়ে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুটা হলেও ভারত ভাগ্যবান এই কারণে যে চিনের সঙ্গে কোনও বৃহৎ ওই ধরনের প্রকল্পে আমাদের দেশ যোগ দেয়নি। অন্যথায় এই মহামারি আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই ভয়াবহ সর্বনাশ নামিয়ে আনতো।
হংকং বিদ্রোহ দমন করতে করোনা ভাইরাস প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় চিন
এই পরিস্থিতিতে চিনের পক্ষে সন্তোষজনক একটাই খবর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিউনোলজি এ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি অব স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট কোভিড-১৯-এর জিনোমিক বিশ্লেষন করে দেখেছে এটি ইঞ্জিনিয়ারড ভাইরাস নয়। অর্থাৎ করোনা মনুষ্যসৃষ্ট ভাইরাস নয়। এই মর্মে নেচার মেডিসিন পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। তড়িঘড়ি কেন এই প্রতিবেদন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করে। তাহলে কি চিনের সঙ্গে কোনও গোপন রফা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের? এদিকে খবর রটে যায় চিনের উওহানের একটি মার্কেটে একটি কাঁচের শিষি ভেঙে যায়। কি ছিল সেই কাঁচের শিষিতে? প্রচার হয়ে যায় ওই শিষিতেই নাকি রাখা ছিল করোনা ভাইরাস। এই সময় অর্থাৎ গত বছর ২০১৯-এর আগস্ট থেকে উত্তাল হয়ে ওঠে হংকং। জানা গেছে, হংকং-এর বিদ্রোহ দমন করতে এই মারণ জীবানু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় চিন। প্রথমে ছিল সেনা দিয়ে বিদ্রোহ দমন করা হবে। কিন্তু হংকং বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর জৈব হাতিয়ার প্রয়োগ করার অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়। হেলিকপ্টার থেকে এই জীবানু হংকং-এর উপর ফেলা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা তখনও করা হয়নি। সিদ্ধান্ত হয় প্রথমে পরীক্ষা করে নিতে হবে। চিন এই জীবানু অস্ত্রের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বন্দি ভিগার মুসলিম ক্যাম্পে হাত-পা বাঁধা মুসলিমদের উপর এই ভাইরাস প্রয়োগ করা হয়। এরা তুর্কি ভাষায় কথা বলে। চিন এদের বিদ্রোহী মনে করে। গিনি পিগ হিসেবে এঁদের ব্যবহার করা হয়। ভাইরাস টেস্টের ভয়াবহ রিপোর্ট চিনের হাতে আসে। জানা যায়, এই ভাইরাস মানুষের ঘাড়ের হাড়কে পর্যন্ত গলিয়ে দিতে সক্ষম। এই খবর চলে যায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র কাছে। তারা এও খবর পায় করোনা সংক্রমিত রোগিদের চিনে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এরপর মারণ এই ভাইরাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশাল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। চিন মার্কিনীদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র রিপোর্টে মার্কিন প্রশাসন ভয় পেয়ে যায়। ভবিষ্যতই এই বির্তকের অবসান ঘটাবে। পরিশেষে বলতেই হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মিলিত আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই পৃথিবীটা লুম্পেনদের একটি ক্লাব ঘরে পরিণত হয়েছে।
করোনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে চিনের নির্লজ্জ কারচুপির পর্দাফাঁস
মূলত দুটি গুরুতর অভিযোগ প্রথম থেকেই উঠেছিল চিনের বিরুদ্ধে। এক, উহানের পশু—পাখি বিক্রির বাজার থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ায়নি। ছড়িয়েছে উহানের কোনও গোপন ল্যাব থেকে। চিন জৈব অস্ত্র হিসাবে এই ভাইরাস ব্যবহার করতে চেয়েছিল কোনও এক সময়। কিন্তু পরীক্ষা চলাকালীন দুর্ঘটনার জেরে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। চিন এই অভিযোগ নস্যাৎ করেছে আগেই তা আলোচনা করেছি। খোদ আমেরিকার অভিযোগ ছিল, চিন করোনা নিয়ে অনেক তথ্য গোপন করছে। চিনে ডিসেম্বরে করোনা ছড়াতে শুরু করলেও বিশ্বকে সেই সময় এই ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিলে পরিস্থিতি এতটা ভয়ানক হতো না। সেইসঙ্গে, চিন করোনায় মৃতদের সঠিক তথ্য দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে চিন জানিয়ে দিল, করোনার সব মৃত্যু নথিভুক্ত হয়নি। কারণ হিসেবে তারা যা বলছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাদের মতে, ভাইরাস ছড়াতে শুরু করার পর স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সেই সময় উহানে বাড়িতে অনেক মানুষ মারা গিয়েছেন। চিকিৎসা নিয়ে প্রশাসন ব্যস্ত থাকায় সেইসব মানুষদের মৃত্যু নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের যে সংখ্যা চিন প্রকাশ করেছিল তা সঠিক নয়। করোনায় মারা গিয়েছেন আরও বেশি সংখ্যক মানুষ। সেই গুরুতর অভিযোগ এবার মেনে নিল চিন। মৃতের তালিকায় আরও ১২৯০ জনের নাম নথিভুক্ত করা হল। অর্থাৎ, এক ধাক্কায় কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে উহানে মৃতদের সংখ্যা বেড়ে গেল ৫০ শতাংশ। এই তালিকায় ১২৯০ জনের নাম নতুন করে নথিভুক্ত হওয়ায় গোটা চিনে করোনায় আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেল ৩৯ শতাংশ। এই সংখ্যাটাও সঠিক নয়। চিনে আরও বহু বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। চিনা প্রশাসন তথ্য গোপন করছে। এই অভিযোগ করেছে চিনের একাধিক সংবাদমাধ্যম। নতুন হিসাব অনুযায়ী করোনার কেন্দ্রস্থল কেবলমাত্র উহান শহরেই মারা গিয়েছেন ৩৮৬৯ জন।
করোনা প্রতিরোধ চুলোয়, আমেরিকা থেকে অস্ত্র কিনছে ভারত
২৪ ফেব্রুয়ারি ভারত সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২১ হাজার কোটি টাকার ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য হেলিকপ্টার ও অস্ত্র বিক্রির বাণিজ্য করে গেছেন। আর ঠিক এর পরই বিজেপির আইটি সেলের পক্ষ থেকে বাজারে চাউর করা হচ্ছে চিন ভারত আক্রমণ করতে পারে।কেন এই সময় এই খবরটি বাজারে ছাড়া হয়েছে? আসলে করোনা সংক্রমণে গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অবস্থা বেশ জটিল আকার ধারন করেছে।তার থেকে উত্তরণের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে কখনও মোদিকে ধমক দিয়ে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ নিয়ে গেলেন ট্রাম্প। দেশের মানুষের অভিমুখ ঘোরাতে করোনা সংক্রমণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুদান বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছেন। এসবই ট্রাম্প করছেন তাঁর দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে। ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাও ট্রাম্পের দোসর মোদির পক্ষেও সুখকর নয়। এই সময় মোদিকে আরও কাছে টানার সুর্বণ সুযোগ ট্রাম্পের। তাই চিনা জুজুর ভয় দেখানো ছাড়া যুক্তিসঙ্গত কোনও হাতিয়ার মার্কিনীদের কাছে নেই। ট্রাম্প মোদিকে এটাই বুঝিয়েছেন যে ভারতের অভ্যন্তরে যে অস্থির অবস্থা তা সামাল দিতে চিনা আক্রমণের আশংকাকে উস্কে দেওয়া। এর ফলে উভয় দেশেই দেশ প্রেমের দুর্বার ঢেউ তোলা সম্ভব হবে। এই কারণে চিন ভারতের উদ্দেশ্যে সমরসজ্জা তৈরি করছে এমন খবর বাজারে বিশ্বাসযোগ্য করে পরিবেশন করার পথে নেমেছে বিজেপির আইটি সেল। মার্কিন প্রশাসনের স্বার্থেই বিজেপির আইটি সেল তোড়জোর করে নেমেছে। ভারতের সঙ্গে চিনের বৈরিতার ক্ষেত্র যে একেবারে তৈরি হয়নি তা নয়। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের পাশে থাকার বার্তা গত বছর ৯ অক্টোবর দিয়েছিল চিন। ইমরান খানের সাথে এক বৈঠকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, ‘কাশ্মীরের বিষয়টি নজর রাখা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে পাকিস্তানের পাশে থাকবে চিন।” চিনা প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য প্রকাশ হওয়ার পরই ফের কাশ্মীর ইস্যুতে নিজেদের কড়া অবস্থান ব্যক্ত করে দেয় ভারত। বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রবিশ কুমার তৎক্ষনাৎ স্পষ্টতই জানিয়ে দেন যে, কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এবিষয়ে অন্য কোনো দেশ এনিয়ে কোনো মন্তব্য করবে না, এটাই ভারতের অবস্থান।”
এদিকে বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ নিয়ে চিন আন্তর্জাতিকস্তরে বেশ কোণঠাসা। সেখানে চিন নতুন করে ভারতের সঙ্গে এই মুহুর্তে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু বিশ্বাস যে করাতেই হবে। নতুবা বন্ধু মার্কিনীদের অস্ত্রগুলি কোথায় বিক্রি হবে? কে কিনবে? বন্ধুর এই বিপদের সময় মোদিজি চুপ থাকতে পারেন না। তাই করোনায় যখন গোটা ভারত আশংকিত তখন মার্কিন বন্ধু ট্রাম্পের কাছ থেকে পিপিই, এন-৯৫ মাস্ক, ভেন্টিলেটর মেশিনের বরাত না দিয়ে অস্ত্রের দেদার বরাত দিচ্ছে। ১৪ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন ভারত সরকারকে ১২০০ কোটি টাকার সমরাস্ত্র বিক্রি করবে, এই মর্মে ঘোষণাও দিয়েছে। পেন্টাগন জানিয়েছে যে, ওরা “জাহাজ বিধ্বংসী হারপুন ব্লক-টু ক্ষেপণাস্ত্র” যার এক একটির দাম মাত্র ৯ কোটি ২০ লক্ষ মার্কিন ডলার। এগুলির নির্মাতা বোয়িং কোম্পানি ও তার সাথে বিক্রি করবে যার একটির দাম ৬কোটি৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের “মার্ক-৫৪ লাইট ওয়েট টর্পেডো”। আসলে ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার অর্থনীতির সঙ্কট আজ যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানি ছাড়া অবস্থা সামাল দেওয়ার কোনও পথ নেই। অস্ত্র রপ্তানির জন্য প্রয়োজন বাজারের সম্প্রসারণ। আর এই অস্ত্রের বাজার নিজে থেকে তৈরি হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বৈরিতা যত বাড়ানো যাবে, যুদ্ধোন্মাদনা যত বৃদ্ধি পাবে ততই বিবদমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমরাস্ত্র সংগ্রহের প্রবণতা ততই বাড়বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই কৌশলেই তাদের অস্ত্রের বাজারকে কাজে লাগিয়ে থাকে। মোদিজি সাম্রাজ্যবাদী এই পরিকল্পনার জালে ক্রমশ দেশকে জড়িয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এটাকেও দেশাত্মবোধের মোড়কে মান্যতা দেওয়ার জন্য বিজেপি-র আইটি সেলের পক্ষ থেকে চিনা যুদ্ধ জাহাজ ভারত মহাসাগরে টহল দিচ্ছে ছবি ছেড়ে বাজার গরম করা হচ্ছে। এখানে প্রশ্ন তাহলে কোনটা ঠিক? ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ-এর প্রতিনিধি ১৬ এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন, চিন থেকে ভারতে ৫লক্ষ কোভিড ১৯ পরীক্ষার টেস্ট কিট আসছে। ইতিমধ্যে সে কিট ভারতে পৌঁছেও গিয়েছে। এই সময় ভারতের বিরুদ্ধে চিনের সমরসজ্জার ছবি। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে দেশবাসীর কাছে? হ্যাঁ, বিশ্বাসযোগ্য করতেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিজেপির আইটি সেল। করোনা সংক্রমণ ও তার চিকিৎসা, পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, খাদ্য সংকট এসবকে ছাপিয়ে এবার দেশ আক্রান্ত হতে পারে এই জিগির তোলা ছাড়া সমস্যা সামাল দেওয়ার বিকল্প কোনও সহজ পথ মোদির সামনে খোলাও নেই। এটা বুঝেই ভারতের অস্ত্রের বাজারের দখল নিয়েছেন ‘বন্ধু’ ট্রাম্প। সভ্যতার এই সংকটে এমন নিষ্ঠুরতম পরিহাসের ঘটনাও দেশবাসীকে নীরবে হজম করার জন্য সক্রিয় বিজেপির আইটি সেল। দেশবাসী যেন কোনও ভ্রান্ত প্ররোচনায় পা না দেন তার জন্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষদের বৃহত্তম মঞ্চ গঠন বিশেষ জরুরি।
ট্রাম্পের হুমকির কাছে মোদির আত্মসমর্পন ভারতকে হেয় করেছে
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে মার্কিন অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির পাল্টা বিশ্বের বাকি বিশেষ করে ইউরোপের উন্নত দেশগুলি সেই অনুদানের অর্থ দেবেন এমন কোনও জবাব আমরা প্রত্যক্ষ করলাম না। আর মার্কিন হুমকির কাছে যেভাবে মোদি সরকার আত্মসমর্পন করে দেশ থেকে ওষুধ পাঠাতে বাধ্য হলেন তা আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও দেশের নাগরিকদের আত্মমর্যাদাকে হেয় করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপের মুখে ওষুধ দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে মানবিকতার আড়ালে চাপা দেওয়ার প্রচার করা হলেও ভারত যে এখন একটি ভীতু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এমন ভাবমূর্তি কিন্তু আন্তর্জাতিকস্তরে প্রতিভাত হয়েছে। মোদিজি, ভারতবাসী হিসেবে প্রতিটি নাগরিক কিন্তু নিজেদের অপমানিতই বোধ করছেন। কেন এই ভারতের হুমকিতেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে মদত দিতে মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে কিন্তু পিছু হঠতে হয়েছিল। মোদিজি দেশবাসী সেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকায় গর্বিত হয়েছিলেন। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাত্র ৫০ বছর পর আপনি যে ভীরুতার সাক্ষ্য রাখলেন তা ভারতবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করলেন।
উপেক্ষিত খাদ্য সুরক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
ভারত সরকারের তরফে প্রচার করা হলেও অতিরিক্ত খাদ্য শষ্য এখনও অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। এটি অবশ্যই লক্ষণীয় যে কেবল ৮০ কোটি দেশবাসী রেশন কার্ডের আওতায় রয়েছেন। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৬৭ শতাংশ জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন(এনএফএসএ)-এর আওতাভুক্ত। এই আইনের আওতায় এখনও অন্তত ২৫ কোটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। যারা এই আইনের আওতা থেকে বাদ পড়েছেন তাঁদের অধিকাংশই প্রান্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিক, গৃহহীন ব্যক্তি, দলিত, আদিবাসী, একক মহিলা এবং প্রবীণ মানুষেরাও রয়েছেন। এই সব মানুষদের খাদ্য সংকট সমাধানে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য শষ্য রয়েছে। আমন ধান সহ ৭৬৫ মিলিয়ন টনেরও বেশি খাদ্য শষ্য রয়েছে। আর আগামী কয়েক মাসে রবি ফসল থেকে এফসিআই গোডাউনগুলিতে আরও ৩৫-৪০ মিলিয়ন টন খাদ্য শষ্য সংগ্রহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রাম বিলাস পাসওয়ান নিজেই স্বীকার করেছেন যে, খাদ্যের কোনও ঘাটতি নেই। এই সময়ে রাজ্যগুলির ওপর দোষারোপ না করে দরিদ্র বা অভাবীদের চিহ্নিত করে সেই সব মানুষদের বিনামূল্যে রেশন পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করুক কেন্দ্রীয় সরকার। যার মধ্যে অন্তত ১০ কেজি খাদ্যশষ্য, দেড় কেজি ডাল এবং ৮০০ গ্রাম ভোজ্যতেল থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই মর্মে নির্দেশিকা জারি করে রাজ্য সরকারগুলিকে বিনামূল্যে এফসিআই গুদামগুলি থেকে খাদ্য শষ্য তোলার অনুমতি প্রদান করুক। আমরা যেন ভুলে না যাই খাদ্য সংকটের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে অনাহারে মৃত্যুর মধ্যেই তা শুধু সীমাবদ্ধ থাকে না। ক্ষুধাজনিত সমস্যার দীর্ঘকালীন প্রভাব যেমন যক্ষার প্রকোপ এবং অপুষ্টিজনিত রোগ বিশেষত: শিশু এবং মহিলাদের মধ্যে দ্রুত বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল রয়েছে। এছাড়া লক ডাউনের ফলে খাদ্য সরবরাহের যে স্বাভাবিক শৃঙ্খল ছিল তা ব্যাপকভাবে বিঘ্ন ঘটেছে। দেশে ইতিমধ্যেই সর্বত্র কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। এইরকম পরিস্থিতিতে অন্তত আগামী এক বছরের জন্য বিনামূল্যে সেই সব অসহায় মানুষদের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখা উচিত।ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় প্রত্যেক মানুষের জীবনের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেখানে দেশবাসীর প্রধান খাদ্য চালকে এখন স্যানিটাইজার তৈরির উপাদান ইথানল তৈরির জন্য ব্যবহার করার মাধ্যমে রাষ্ট্র কার্যত গণ বন্টন ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আসলে মার্কিন মুলুকে স্যানিটাইজার সরবরাহ সুনিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা।
পরিশেষে বলা যায় করোনা অতিমারি গোটা বিশ্বকে যখন কাঁপিয়ে দিয়েছে। তখন আমাদের দেশের সরকার মানুষের চাহিদার অপিরহার্য বিষয়টিকে সুনিশ্চিত না করে লক ডাউন করার ফলে বিরুপ প্রতিক্রিয়া ঘটছে ভুখা মানুষগুলির মধ্যে। করোনা সংক্রমণের মৃত্যু মিছিল নিশ্চিতভাবে দেশের কোনও মানুষ দেখতে চায় না কিন্তু অনাহার জনিত মৃত্যু মিছিল সেটাও মেনে নেওয়া যায় না। প্রতিটি মানুষের খাদ্য, পুষ্টির বিষয়টি সুনিশ্চিত করতেই হবে রাষ্ট্রকে। এটা করুণার বিষয় নয়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়।
[লেখক – বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।]
Posted in: April 2020, Cover Story