যেভাবে বেঁচে থাকা যায় বা না থাকাও যেতে পারে : শুভঙ্কর দাশ
পয়লা বৈশাখ শুরু করেছিলাম ডিমের স্যান্ডউইচ আর কালো কফি দিয়ে। আমি আবার দুধ চিনি মারা রান্না করা কফির মানে বুঝি না। তারপর সুইজারল্যান্ড থেকে সম্পাদক জানালেন আমার কবিতা তাঁর পছন্দ হয়েছে। আমার কবিতা এখনো ভালো লাগে কারো কারো। ব্যাস এই অনেক। আর আজ বাজার যাই নি। কাল একটু নিম পাতা কিনতে বেরোতে হবে। নিম বেগুন আমার প্রিয়। অনেকটা ভাত মেরে দেওয়া যায়।
সকালটা আমার বড্ড তাড়াতাড়ি শুরু হয়। উঠেই ভাবি কী নেই যেটা কিনতে বাজার যেতে হবে? মাস্ক একটা জোগাড় হয়েছে। বন্ধু কাম এক ভাই বাড়ি বয়ে দিয়ে গেছে আমায়। মাঝে মুখে গামছা জড়িয়ে বেরোচ্ছিলাম। ভাবছিলাম কিষেনজির মত লাগছে কিনা? তারপর নিজের হাতে বাজারের থলি দেখে নিজেই হেসে ফেললাম।
যাই লোকাল বিস্কুট যা আমি খাই, তা পাই কিনা। ওসব বড়কা কোম্পানির বিস্কুট আমার ভালো লাগে না। বড় একঘেয়ে মনে হয়। সকালে আমার মহান রোগের নিজস্ব চিকিৎসা যা আমি নিজেই করি সেগুলো খালি পেটে খেয়ে দিন শুরু করি। এই লক ডাউনের দিনগুলোতে ভাবি কত কী করার বাকি থেকে গেল। গৌতমদার এই গানটা আমার বড় প্রিয়। আমার কাছের লোকজন জানে মাল পেটে পড়লে আমার বেসুরা গলায় এই গান তাদের শুনতে হবেই। তারা হাসেও। কিন্তু তখন আমার আবেগ এসে গেছে। আমি কি ডরাই সেই সামান্য হাসিকে! বাজার থেকে ফিরে বাসন ধোয়া। এই ফ্ল্যাটে জলের বড় অভাব। খাওয়ার জলও ভরে নিতে হয় সময় মতো। তারপর কম্পিউটার চালু করে বসি। নিউজ, ফেক নিউজ দেখি। বোর হই। রান্না চাপাই। সেইসঙ্গে চলে লেখালিখি। ওই করতে গিয়ে একদিন ভাত ধরে গেল। তা এসব তো খেলারই অঙ্গ, তাই না? তবে কিনা পোড়া বাসন মাজতে কবজি খুলে আসে। এই বোধ যাদের নেই তাদের নেই।
অনেক আঁতেল অবশ্য আছেন যারা রান্না জানেন না। বা জানতেও চান না। আমি রান্না করতে ভালোবাসি, খেতেও। তাদের কথা শুনে হাসি পায় করুণাও হয়। এরা স্বাধীন লেখক বলে শুনি। কীভাবে যে তারা একটা স্বাদহীন জীবন বাঁচে পরের দয়াতে, কে জানে! কোনও শহরে একবার একা পড়ে গেলে কী হবে এদের? কতো আর হোটেলে খাবে সেই এক ঘেয়ে খাবার? অবশ্য পকেটে মাল থাকলে অনেক কিছু হয় হয়ত। আমার ছিল না তাই চেন্নাই থাকার সময় আমিও ঠেকেই রান্না শিখেছি। পেট আর সাথ দিচ্ছিল না। সব কিছুতে মহান সেই কারিপাতা আমার না পসন্দ। তা তার যতই উপকারিতা থাকুক। তখন দেখলেই ওয়াক উঠে আসত। তারপর শিখলাম বেশি হলুদ দিলে তরকারি তিতে হয়ে যায়। মাছটা আমি ঠিক চিনে কিনতে পারি না। এখনো পারি না বলে ডিমই আমার একমাত্র খাদ্য যা সস্তা এবং টিকাও।
রোজ বাসন মাজতে গিয়ে আমার এক ইতালিয়ান বন্ধুকে মনে পড়ে। তার ফোন নামবারটা হারিয়ে ফেলেছি। ব্যাটা ফেসবুকেও নেই। তালবাদ্যের মায়েস্ত্রো। স্কুল টিচার। ওর বাড়িতে যখন ছিলাম দেখেছি একজন মানুষ কীভাবে জুতো শুদ্ধু বিছানায় শুয়ে পড়তে পারে। আমার থেকেও ল্যাদ তাই ঘর পরিষ্কারের ঝামেলা করে না কোনোদিন। একটা কবিতা লিখেছি ওকে নিয়ে।
তোমার কথা মনে পড়ছে
হে বন্ধু আমার
তুমি কি এখনো
বেঁচে বর্তে আছো মিলানে?
রোজ বাসন মাজার সময় আরো বেশি করে
মনে পড়ে তোমায়।
তোমার মতো
কাগজের প্লেটে খাওয়ার প্র্যাক্টিস করা ভালো।
খেয়েদেয়ে প্লেট ফেলে দাও স্রেফ
ক্রমাগত বেশিনে জমাবার দরকার নেই,
জমে থাকা জলে ডুবো পাহাড়ের মতো।
বাঁধা কপি কিনে এনে ঘচাঘচ কেটে
অল্প নুন আর মরিচ আর স্যালাড অয়েল মেরে
কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়ে নাও যদি
নিজেকে খুব গরু গরু লাগবে কি?
আমার লাগে নি যদিও।
সাথে রেড ওয়াইনের তাগড়াই বোতল খানা
ছিল সাথ দেওয়ার জন্য বলেই কি?
ইতালির ঠাণ্ডায় বেশ একটা আরাম
ঘনিয়ে আসছিল শরীরে।
তুমি কি এখনো
বেঁচে বর্তে আছো মিলানে?
নাকি মারা গেলে
কিছু না বলেই?
যে বন্ধু কাম ভাই আমায় মাস্ক দিয়ে গেছিল আজ শুনলাম তার অল্প জ্বর এসেছে। শুনেই তাই কি আমার গলাটা ব্যথা ব্যথা করছে।
গোডো কি তাহলে এসেই পড়ল? ওর তো আসার কথা ছিল না।
Posted in: April 2020, Cover Story