হে মোর দুর্ভাগা দেশ : সুকান্তি দত্ত

পাড়ার সেলুনে দাড়ি কাটছিলাম। আরও দু-তিনজন অপেক্ষায়।তখনও লক ডাউন চালু হতে আট-ন’দিন বাকি। কিন্তু চায়ের দোকান থেকে ট্রেনের কামরা, অফিস-কাছারি সর্বত্র আলোচনায় উঠে আসছে করোনা ভাইরাস। সংবাদ মাধ্যমেও সিংহভাগ জুড়ে বিশ্ব ও দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণের আপডেট।
সেলুনেও এলোমেলো আলাপচারিতার কেন্দ্রে সেই করোনা বা কোভিড-১৯। এ-দেশেও লকডাউন হবে কি না? এই ভাইরাস কি চিনের ষড়যন্ত্র? গোমূত্র খেলে এ-রোগ সারবে কিনা?
সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল মাঝবয়েসী একজন। আলাপ না থাকলেও চেনা মুখ, একটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংস্থার কর্মী, বিড়িটিতে শেষটান দিয়ে মাটিতে ফেলে চটি দিয়ে পিষে দিতে দিতে বলল, কত অসুখ কত রোগ চারপাশে, ছাঁটাই, বেকারত্ব, খেতে-না-পাওয়া, করোনা ভাইরাস আর বেশি কী করবে? কত লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে প্রতিদিন, করোনাতেও মরবে! এর বেশি আর কী হবে?
ক্ষৌরকার বন্ধুটি আমার দাড়ি কাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামিয়ে বলল, হবে। অনেক বেশি কিছু হবে। তুমি যা বললে সব গরীবের রোগ, কিন্তু করোনা গরীব বড়লোক মানছে না।
সেলুনে বা চা-দোকানে বা ট্রেনে-বাসে কত লোক কত কী বলে ভেবে কথাটি উড়িয়ে দেওয়া যেত, বিশেষত যখন নানা সংবাদমাধ্যমে জাঁদরেল বিশেষজ্ঞদের গম্ভীর ভাষণমালা সঙ্গে অন্য বিশেষজ্ঞদের মতের ফারাক আমাদের মতো সাধারণ জ্ঞানগম্যির মানুষের পক্ষে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে। যেমন সকলের মাস্ক পরার দরকার নেই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই নির্দেশিকাও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বদলে গেল।
যা হোক, সেলুনে শোনা ওই মন্তব্য ও প্রতিমন্তব্য কেন জানি না আমাকে ভাবিয়ে তুলল। লকডাউনের অলস বেলায় অফুরন্ত অবসরে ইন্টারনেট ঘেঁটে পেলাম, কোনোরকম হইচই না তুলেই আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া কত মৃত্যু মিছিলের খবর এবং তার শিকার অবশ্যই গরীব মানুষ, গরিব পরিবারগুলি। এ লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন একটি তথ্য আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। দুরারগ্য কোনও ব্যাধি নয়, নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন আছে, অ্যান্টিবায়োটিক আছে। তবুও UNICEF-র হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ২২০০ শিশু মারা গেছে নিউমোনিয়ায়, মৃত্যুহারে দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত, ১ লক্ষ ২৭ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে (তথ্যসূত্র : বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা, ১৩ই নভেম্বর, ২০১৯), দূষিত জল ও পরিবেশ, অপুষ্টি, দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে ওই শিশুমৃত্যু—ভারত ছাড়া প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে আছে নাইজিরিয়া, পাকিস্তান, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া।
না, তার মানে একথা বলতে চাইছি না, করোনা রুখতে বিশ্বজুড়ে সরকারি-বেসরকারি স্তরে ও জনগণনার সম্মিলিত উদ্যোগের কোনও প্রয়োজন নেই আলাদা করে। অবশ্যই করোনার-বিভীষিকা রুখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, তারই একটি অংশ লকডাউন, বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্ত সব দেশকেই সে পথে যেতে হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে চাইছি, করোনার আগেও বিশ্বজুড়ে নানা কারণে ঘটে চলা মৃত্যুমিছিল, বিশেষত গরিব মানুষের এবং করোনা পরবর্তী সময়ে অসুখে মৃত্যু ছাড়াও জনজীবনে কীভাবে নেমে আসতে পারে ধ্বংস-মৃত্যু-হাহাকার, তার কিছু লক্ষণ কি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে?

লকডাউনে গৃহবন্দী থাকতে থাকতেই আমরা আমাদের সহনাগরিকদের সচেতনতার অভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছি। আমরা দেখেছি সমাজ পেশা বা অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় উচ্চবর্ণীয় কিছু মানুষ কীভাবে রোগ গোপন করে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। আবার এও দেখেছি তুলনায় দুর্বলতর পিছিয়ে পড়া মানুষের একাংশও লকডাউন অমান্য করে রাস্তায় বেরিয়েছে কিংবা করোনা রুখতে থালা বাজিয়ে মিছিল করেছে। আমরা যারা সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যাদের খাওয়া-পরার কোনো সংকটের ছবি কল্পনাতেও আসে না, আমরা ক্ষোভে বিদ্রুপে ফেটে পড়েছি সোশাল মিডিয়ায় বস্তিবাসী ইতরজনের কাণ্ডকারখানা দেখে—করোনা তাড়াতে লাঠি দিয়ে থালা পেটাচ্ছে, ‘চা খাবনা আমরা, আমরা কি চা খাব না’ বলা দিনমজুরের ছবি ভাইরাল হয়েছে—সামাজিক দূরত্বের দফারফা হয়ে যেতে পারে, এবং তার ফলে মৃত্যুশেল ভাইরাসটি আমাদেরও আক্রমণ করতে পারে, এ ভেবে আশঙ্কায় কেউ কেউ হয়ত উন্মাদ হয়ে গেছি! হ্যাঁ, শুধু উন্মাদ নয়, নিশঠুর উন্মাদ।
আমাদের কেউ কেউ চাল-ডাল-অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মজুত করেছি। তার পরিমাণ হয়ত ছমাসের চাহিদাকেও ছাড়িয়ে যায়। আমার ঘরে সবকিছু মজুত, আমি বেরোচ্ছি না, তো অন্য লোকের বেরুনোর কারণ ‘বদমায়েশি’ ছাড়া আর কীই বা হতে পারে। আর এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে উঠে এল রাজ্যে রাজ্যে আটকে পড়া ঘরছাড়া শ্রমিকদের দুর্দশা, রাজপথ ধরে বাচ্চা কোলে নিয়ে মালপত্রসহ তারা হাঁটছে, তারা ঘরে ফিরতে চাইছে। কেউ দেড়শো থেকে সাতশো কিলোমিটার পথ হেঁটে। দিল্লির আনন্দবিহার বাসস্টেশনে ঘরছাড়া শ্রমিকদের ভীড় দেখে আমাদের অনেকের চোখ কপালে উঠল। হাউ ডিসগাস্টিং। এরাই রোগ ছড়াবে! সোসাল মিডিয়ায় চোখে পড়ল, দুটি ছবি পাশাপাশি পোস্ট করা হয়েছে, একটিতে শারিরীক দূরত্ব বজায় রেখে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে বসে থাকা তিনটি কুকুর আর অন্যদিকে আনন্দবিহার বাসস্ট্যান্ডে ঘরে ফেরার আকুতি নিয়ে জমা হওয়া শ্রমিকদের ভিড়। পোস্টের ক্যাপশন – কুকুরদের যে শৃঙ্খলাবোধ আছে, এদের তাও নেই!
নিষ্ঠুর উন্মাদ না হলে কি এই পোস্ট দেওয়া সম্ভব! আর এই পোস্টেও নিন্দার পরিবর্তে নেটিজেনদের সরোষ সমর্থনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আসলে লকডাউনের সময়টিতে উদ্বেগে উৎকন্ঠায় আমাদের অনেকেরই মুখোশটি খসে পড়েছে, তা অবশ্য একরকম ভালোই হয়েছে। লকডাউন বেআব্রু করেছে আরও অনেক কিছু, একদল প্রচারসর্বস্ব মানুষ অসহায় মানুষকে সাহায্য দেওয়ার ছবি সোশাল মেডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে আত্মগর্বে মেতেছে। আবার দেখেছি মানবতার পতাকা উর্ধ্বে তুলে বহু যুবক, আমার চেনাজানা পরিসরেই রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত হয়ে প্রবল ঝুঁকি নিয়েও কী ভাবে বিপন্ন মানুষকে খাবার জোগাচ্ছে দুবেলা। তারা কাদের সাহায্য দিচ্ছে সেই ছবি দিচ্ছে না, শুধু কাজের সংবাদটি তুলে ধরছে সেইসব মানুষের জন্য, যারা তাদের পরোক্ষভাবে মদত করেছে অর্থসাহায্য দিয়ে।
লকডাউন যত এগিয়েছে, নানা সংবাদমাধ্যমে ভেসে উঠেছে বিপন্ন মানুষের ক্ষোভ-ক্রোধ, বেঁচে থাকার আর্তি। আমরা পড়ছি, দেখছি, শুনছি ঘরছাড়া শ্রমিকদের ঘরে ফিরতে চেয়ে বিক্ষোভ। তারা জানাচ্ছে ওদের খাবার নেই, বাচ্চার দুধ নেই, আশ্রয় নেই, বাড়িওয়ালার ভাড়া দেওয়ার অর্থ নেই। কোথাও রেশন না পেয়ে বা প্রতিশ্রুত সামগ্রী না পেয়ে বিক্ষোভ।
নানা খবর পাচ্ছি। নানা পরিচিত বা বন্ধুদের কাছ থেকে। নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এক ছোটো প্রোমোটার জানালো তার কাজের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা অনেকগুলি পরিবারের অসহায়তার কথা। তার আশঙ্কা নির্মাণশিল্পে তার মতো ছোটো ব্যবসায়ীদের অবস্থা ভালো চলছিল না, এরপর কী হবে? কী হবে ওই পরিবারগুলির? ইলেকট্রিকের ছোটো দোকানদার থেকে ছোটো প্রকাশক, জানাবেদ কোনও মতে চলছে। কিন্তু এরপর কী হবে? কী হবে তাদের সংস্থার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা কর্মীদের?
সমাজের অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী স্তরেও নানা সুঃসংবাদ। আইটি থেকে শুরু করে নানা প্রাইভেট সেক্টরে, বিশেষত রিটেল সেক্টরে ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে। নতুন চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়া তরুণদের নিয়োগপত্র ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আইআইটি থেকে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসিং বাতিল। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির যে সব রিপোর্ট আসছে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধিসহ দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থা নিয়ে তা খুবই উদ্বেগজনক।
পৃথিবীতে শেষ যে মহামারিটি কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, সেটি ছিল ১৯১৮-২০ সালে, স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা এপিডেমিক। ভারতবর্ষেও এক কোটির বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে অসুখের কারণে মৃত্যুর পাশাপাশি ছিল খাবারের অভাব যা মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনাহারে মৃত্যু। আমাদের অনেকের জীবনকালে নানা দশকে আফ্রিকার নানা দেশে, স্বাধীন ভারতের কালাহান্ডি ইত্যাদি অঞ্চলে ধ্বংস মৃত্যুর দিক থেকে ছোটমাপের দুর্ভিক্ষ বা অনাহারে মৃত্যু হয়ত দেখেছি। বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর দেখা জীবিত মানুষ এখন হয়ত খুবই কম। আমাদের স্মৃতিতে হয়ত আছে ‘নবান্ন’ নাটক কিংবা সত্যজিত রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিটির শেষ দৃশ্যে সেই ভুখা মানুষের মিছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ৭৬-এর মন্বন্তরের দৃশ্য হয়ত গল্প হিসাবেই স্মৃতিতে থেকে গেছে আমাদের। কিন্তু জীবনকালে আমরা কি এক ভয়ংকর মন্বন্তরের মুখোমুখি হতে চলেছি?
রাষ্ট্র তো তার মতো করে ভাবছে। এ নিয়ে বিভিন্ন শিল্প সংস্থা বা আন্তর্জাতিক অর্থ বাণিজ্য সংস্থাও ভাবছে বা ভাববে। হয়ত বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভারসাম্যের অনেক পরিবর্তন ঘটবে। এটা তো নিশ্চিত করেই বলা যায় করোনা পূর্ববর্তী সমাজ ও করোনা পরবর্তী সমজ একরকম থাকবে না।
আর এই প্রসঙ্গেই আমি ভাবতে চাইছি এদেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজ-মানুষের কথা। যে সমাজের এক বিরাট সুবিধাভোগী অংশ নীচুতলার মানুষকে নির্দ্বিধায় কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে, কুকুরের মতো গুলি করে মারতে চায়। যাদের কাছে ওই মানুষগুলির বাঁচা মরায় কিছু এসে যায় না। একজন মরলে আরেকজন তো আছেই। ওইসব নোংরা হাভাতের দল শুধু তাদের নিরাপদ আরামদায়ক জীবনচালনার মেশিনটির তেলমাত্র।
কিন্তু এবার সংখ্যাটি যে বিশাল, এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে বিপর্যস্ত রেখে ন্যূনতম চাহিদাটুকু পূরণ না করতে পারলে কি স্বস্তিতে থাকবে ওই সুবিধাভোগী শ্রেণী? নিশ্চিন্তে থাকবে আমাদের স্বচ্ছল জীবনধারা? সম্পদ-সুবিধা বন্টনের বৈষম্য কি খুলে দেবে না ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি?
এ-প্রশ্নের উত্তর লেখা আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। আমার শুধু মনে পড়ে যাচ্ছে রবি ঠাকুরের লেখা একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি –
‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
সবারে যদি না ডাক
এখনও সরিয়া থাক
আপনারে বেঁধে রাখ চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান—
মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।’

Facebook Comments

Leave a Reply