করোনা-র অর্থনৈতিক ছক : সুজন ভট্টাচার্য
রণবীর সিং। বয়স ৩৯। দুই সঙ্গীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিলেন দিল্লী থেকে। গন্তব্য মোরেনা, মধ্যপ্রদেশ। পথের দূরত্ব মাত্র ৩০০ কিমি। কেন নেমেছিলেন রণবীর সিং? কোনো ওয়াকিং রেসে নাম লিখিয়েছিলেন? গিনেস বুক অব রেকর্ডসে নাম তুলতে চাইছিলেন? আজ্ঞে না, রণবীর সিং স্রেফ পালাতে চাইছিলেন। এক ভয়ংকর অপরাধের বোঝা ছিল তার কাঁধে। কী অপরাধ? খুন-ধর্ষণ-ব্যাঙ্কের টাকা মেরে দেওয়া? না, তার থেকেও অনেক বড় এক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রণবীর। বাঁচতে চেয়েছিলেন রণবীর। লক ডাউনে কামকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মজুরি মেলার আর উপায় নেই; বন্ধ হয়ে গেছে খাবার-দাবার। এই পরিস্থিতিতে রণবীর ফিরতে চেয়েছিলেন মোকামে। গ্রামে অন্তত দানাপানির বন্দোবস্ত হয়ে যাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন রণবীর। বাঁচতে চেয়েছিলেন রণবীর, বাঁচাতে চেয়েছিলেন তার তিনটি সন্তানকে ।
দিল্লী থেকে হাঁটতে হাঁটতে আগ্রা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তারা। ২৮ মার্চ, শনিবার। আচমকাই বুকে ব্যথা শুরু হল রণবীরের। আর সেখানেই জীবনের পাল্লাটা ফুরিয়ে গেল তার। তিনটি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার দায়মুক্ত হয়ে গেলেন তিনি। ২২ মার্চ ঘণ্টা আর কাঁসর বাজিয়ে রাস্তায় গণনৃত্যের আসর বসানো হল। দু দিন পরেই শুরু হল দেশব্যাপী লক ডাউন। আর ঠিক চার দিনের মাথায় রাজধানী দিল্লী দেখল এক অদ্ভুত নাটক। আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাসে জড়ো হয়ে গেলেন হাজার হাজার মানুষ। সঙ্গে স্ত্রী, সন্তান আর বাক্সপ্যাটরা। একটাই দাবী, বাস দাও, ঘরে ফিরতে দাও। এখানে এখন কাজ নেই, উপার্জন নেই, খাবার নেই। অন্তত ঘরে ফিরে মরার সুযোগটুকু দাও। সুশিক্ষিত, মার্জিত ইন্ডিয়ান-রা শিউরে উঠলেন; সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর নামগন্ধ নেই যে। ঘরের দরজা বন্ধ করে নরম আলোয় টেলিভিশনের পর্দায় সামাজিক দূরত্বে বসে তারা দেখলেন ছবি, হাজারে হাজারে মানুষ হাঁটছে রাস্তায়। যে ভাবেই হোক ঘরে ফিরতে হবে। অন্তত তাতে যদি পেটে দু-চারটে দানা জোটে।
সেই একই তারিখ, ২৮ মার্চ। মহারাষ্ট্র-গুজরাটের সীমানায় অবস্থিত ভিল্লাড় থেকে সাতজন মানুষ হাঁটতে শুরু করলেন। গুজরাত পার করে তারা যাবেন রাজস্থানের বাসওয়াড়ায়। স্থান ও পাত্র আলাদা হলেও নাটকের ঘটনাবলী অনেকটাই এক। মুম্বাই সন্নিহিত শহরতলীর একটি ক্যান্টিনে তারা কাজ করতেন। তালা পড়ে গেল ক্যান্টিনে। ফলে তালা পড়ল তাদের পেটেও। স্রেফ বাঁচার তাগিদে তারাও নেমে পড়লেন রাস্তায়। ফিরতে হবে ঘরে। মুম্বাই-এ পড়ে থাকলে তো না খেয়েই মরতে হবে। বিরার-এর কাছে এক চলন্ত ট্রাক পিষে দিয়ে গেল তাদের চারজনকে। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ অবশ্যই আলাদা; কিন্তু ঘটনাক্রম আদতে সেই একই। মার্চের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ঘর ফিরতে চাওয়া এমন ২৪ জন মানুষের মৃত্যু হল রাস্তায়। কোথাও দুর্ঘটনা, আবার রণবীর সিং-এর মতো অনেকেই প্রাণ হারালেন অভুক্ত শরীরে ধকল সইতে না পেরে। এরা সকলেই আসলে লক ডাউনের শিকার।
লক ডাউনের বাধ্যবাধকতা
লক ডাউন না করেও বাস্তবত কোনো উপায় ছিল না সরকারের। পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড হাতে পেয়ে যাবার পরও যে ছাত্রের ঘুম ভাঙে না, তাকে তো পরীক্ষার আগের রাত না ঘুমিয়েই বইয়ের পাতা উল্টানোর মরিয়া চেষ্টা করতে হয়। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের হাল তার থেকে আলাদা কিছু নয়। চীন ঘুরে করোনা ফেব্রুয়ারিতেই থাবা মেরেছিল ইউরোপে। ৩০ জানুয়ারি ভারতে করোনা সংক্রমণের প্রথম ঘটনার রিপোর্টিং হল। ৩ ফেব্রুয়ারি আরো দুটি সংক্রমণের কথা জানা গেল। তিনটি ক্ষেত্রেই আক্রান্ত-রা ছিল চীনের উহানে পড়তে যাওয়া ছাত্ররা। ৪ মার্চ একটি ইতালিয়ান পর্যটক দলের ১৪ জন সহ মোট ২৯ জন আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হলেন। পরদিন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী ডঃ হর্ষবর্ধন রাজ্যসভায় একটি স্বেচ্ছা-বিবৃতি দিলেন করোনা প্রসঙ্গে। সেই বিবৃতিতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, আক্রান্তরা হয় বিদেশাগত অথবা তাদের সংস্পর্শে আসা।
অর্থাৎ রোগটা যে আদতে ইমপোর্টেড, সেটা অন্ততপক্ষে সেই দিনই কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে এসেছিল। রোগ যদি ইম্পোর্ট করা হয়, তাহলে তাকে শুরুতেই নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ইম্পোর্টের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াটাই ছিল এক ও একমাত্র কাজ। কিন্তু নানান বড় বড় পদক্ষেপের কথা বললেও সরকার কিন্তু আদপেই সেই দিকে হাঁটলেন না। আন্তর্জাতিক উড়ানের আসা অব্যাহত রইল। হাজারে হাজারে মানুষ অবাধে চলে এলেন ভারতে। হ্যাঁ, বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিং-এর বন্দোবস্ত ছিল। আর প্রতিটি যাত্রীকে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক আইসলেশনে থাকার অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। কিন্তু একজনকেও সরকারি ব্যবস্থায় কোয়ারান্টাইন করা তো দূরস্থান, নজরদারির আওতাতেও রাখা হয়নি। ফলকথা হল, এদের অনেকেই অবাধে ঘুরে বেড়ালেন নানা জায়গায় আর নিজের অজান্তেই ভাইরাস বিলিয়ে দিলেন অকাতরে।
৪ মার্চ যখন একসঙ্গে ২২ জনের আক্রান্ত হবার সংবাদ পাওয়া গেল, সেদিনই আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ ছিল। একটা অক্ষম যুক্তি কেউ কেউ দেখানোর চেষ্টা করছেন। বলা হচ্ছে, এমন একটা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফাটল ধরাতে পারত। তাই যদি হবে, তাহলে ২২ মার্চ থেকে যে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, তার প্রকোপেও তো আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ফাটল ধরা উচিত ছিল। সেটা কি হয়েছে? সম্ভবত একচুলও নয়। কারণ বিশ্বের বহু দেশ আরো আগে থেকেই সেই নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে। আবার যদি সেই সম্ভাবনা খুব বাস্তব বলেও মনে হয়, তাহলে আগত যাত্রীদের অবাধে ঘুরতে দেওয়া হল কেন? কেন তাদের দু সপ্তাহের জন্য সরকারি ব্যবস্থায় ঘরবন্দী করা হল না? তাহলেই তো ভারতে আদৌ হয়তো লক ডাউনের প্রয়োজন পড়ত না। না, এই প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর সরকারের কাছে নেই। স্রেফ শুয়েবসে সময় নষ্ট করেই সমস্যাকে ডেকে আনান হয়েছে দেশের মধ্যে, তাকে অবাধে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া হয়েছে।
ডঃ হর্ষবর্ধন তার বিবৃতিতে স্বীকার করেছিলেন, ‘World Health Organisation (WHO) has declared the outbreak as a “Public Health Emergency of International Concern (PHEIC)” on 30th January 2020 and raised the level of global risk to “Very high” on 28th February 2020’. বিবৃতিতে সঠিকভাবেই দাবী করা হল তখনো পর্যন্ত WHO এই রোগকে প্যানডেমিক বা অতিমারী বলে ঘোষণা করেনি। ঠিক, একদম ঠিক। সেই ঘোষণা না আসাটা যদি সরকারের চুপচাপ বসে থাকার কারণ হিসাবে মান্যতা পেতে পারে, তাহলে উলটো ঘটনাটার ব্যাখ্যা কী? ১১ মার্চ WHO করোনা ভাইরাসজনিত রোগকে প্যানডেমিক বলে ঘোষণা করল। আর সরকার আন্তর্জাতিক উড়ানের ভারতে আসা বন্ধ করল ২২ মার্চ রাত বারটায়। কেন? এক্ষেত্রে সরকার ১১ দিন কিসের অপেক্ষায় বসে ছিল? ১৩ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক কেন করোনা ভাইরাসকে ভারতে Public Health Emergency বলতে অস্বীকার করল?
নিন্দুকে তো বলছে, মার্চের ২২ তারিখ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এক ও একমাত্র নজর ছিল মধ্যপ্রদেশের গদি দখল করায়। সেই পালা মিটতে তবেই করোনা-র দিকে তাকানোর সুযোগ মিলল। ততক্ষণে যে জল অনেকদূর বয়ে গেছে, সেটা বোঝাই গেছিল। এয়ারপোর্টে আটকানো তো একটা প্রাথমিক প্রতিরক্ষা। পাশাপাশি টেস্টিং কিট, পি পি ড্রেস, আই সি ইউ, ভেন্টিলেটর, কোনোকিছুরই উপযুক্ত প্রস্তুতি ছিল কি? বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি বিবৃতি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, নিদেনপক্ষে ২৬ মার্চের আগে এমন কোনো প্রস্তুতির কথা সরকারের মাথায় আসেনি। এই অবস্থায় রোগটা যে ছড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই আর উপায় না দেখে দ্রুত লক ডাউন করতে হল। শুধু লক ডাউন করে যে কিচ্ছু হবে না, সেটা অভিজ্ঞ মাত্রেই জানেন। WHO তাই ব্যাপকমাত্রায় পরীক্ষার উপর বার বার জোর দিচ্ছে। লক ডাউন আসলে একটা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ, যাতে অন্যের থেকে সংক্রমণ চট করে আমার শরীরে না আসতে পারে। আমাদের দেশে লক ডাউন-কে বেছে নেওয়া হল সময় কেনার উপায় হিসাবে। সবাই যদি ঘরে বসে থাকে, তাহলে আর যাই হোক সংক্রমণের হার কম থাকবে। একসঙ্গে যদি অনেকেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে অপ্রতুল পরিকাঠামো দিয়ে সামাল দেওয়া যাবে না। ঠিক এই কারণেই চটজলদি লক ডাউন করে ফেলা হল ন্যূনতম কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই।
করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে
দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। আজকাল তো লোকজন এমনিতেই সন্ধেবেলা দরজা বন্ধ করে টিভি চালিয়ে সিরিয়ালের কথকতা দেখে। বাড়িতে তখন কোনো অতিথি এলে বরং বিরক্ত-ই হয়। তাহলে আর অসুবিধা কোথায়? বরং এই গরমে রোদে পুড়তে হবে না ভেবে তো আহ্লাদ হবারই কথা। আছে, আছে; সামান্য হলেও কিছু সমস্যা আছে। সেই চিরন্তন পাপী পেট কা সওয়াল। যে মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় দিন-মজুরি, তার পক্ষে ঘরে বসে করোনা তাড়ানো-র বিলাসিতা করা সম্ভব নয়। পেটের তাড়নাতেই তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। এক যদি তার প্রতিদিনের খাবারের উপযুক্ত যোগান রাখা যায়, তাহলেই সে ঘরে বসে থাকতে পারে। স্থিতবুদ্ধি কোনো সরকার লক ডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে সেই প্রস্তুতি সেরে রাখত। গরিব মানুষের ঘরে আগে থেকেই খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হতো। একমাত্র এভাবেই এদেরও ঘরে বসিয়ে রাখা যেত। আমাদের দুর্ভাগ্য, তেমন কোনো প্রস্তুতির চিন্তা সরকারের মাথাতেই ছিল না।
২২ তারিখ জনতা কারফিউ শেষ হবার আগেই বাজি ফাটিয়ে পাগলু ড্যান্সের আয়োজন হল। ২৩ তারিখ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে দিলেন পরের দিন থেকেই লক ডাউন। সরকারের প্রস্তুতিহীনতা টের পাওয়া গেল পরের দিন। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন সাংবাদিকদের জানালেন, লক ডাউন জনিত অর্থনৈতিক সমস্যার চেহারাটা কী হতে পারে, সেই নিয়ে আলোচনা চলছে। উপযুক্ত সময়ে সরকার তার পরিকল্পনা ঘোষণা করবে। গরিব মানুষের যে সমস্যা হবে, এটা বোঝার জন্য অর্থনীতির ডিগ্রী-র প্রয়োজন পড়ে না। সামান্য সহমর্মিতা থাকলেই সেটা অনুভব করা যায়। বোঝাই যায়, এমন কোনো সমস্যার কথা সরকারের বিবেচনাতেই ছিল না। লক ডাউনের কর্মসূচী একদিন গড়াতে না গড়াতেই দেশজুড়ে লাখেলাখে হতদরিদ্র মানুষের নাভিশ্বাস শুরু হয়ে গেল। স্বভাবতই নানাজনের সমালোচনার তীর আছড়ে পড়তে শুরু করল। তার পরই সরকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেন। যদিও সেই প্যাকেজের বিজ্ঞাপন আর বাস্তবতার মধ্যে সামঞ্জস্য কতটা, সেই নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপাতত সেই বিতর্ক থাক। এটুকু তথ্যই যথেষ্ট যে লক ডাউন শুরুর আগে সরকার দরিদ্রদের আশ্বস্ত করার জন্য কোনো কর্মসূচী ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বোঝাই যায়, এমন কোনো ভাবনা সরকারের মাথায় আদৌ ছিল না।
পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার প্রসঙ্গে এই কথা আরো বেশি করে সত্যি। গোটা দেশে অন্তত দু কোটি মানুষ পেটের দায়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্যান্য রাজ্যে অস্থায়ীভাবে বাস করেন বাস্তবত ঠিকানাহীন অবস্থায়। রাস্তার ধারের অস্থায়ী ঝুপড়িতেই এদের বাস। এরা মূলত নির্মাণ-কর্মী কিংবা অন্যান্য দিন-মজুরির সঙ্গে যুক্ত। যে রাজ্যে এরা উপার্জন করেন, সেখানে এরা অবাঞ্ছিত। সেখানে এদের রেশন কার্ড নেই, নেই অন্য কোনো সনদ। ফলত এদের অবস্থা আরো সঙ্কটজনক। খাবার নেই শুধু না, সেটা পাবারও উপায় নেই; কারণ এদের রেশন কার্ড অন্য রাজ্যের স্থায়ী ঠিকানায়। এই মানুষগুলোই ভিড় জমিয়েছিলেন দিল্লীর আনন্দ বিহার বাস স্ট্যান্ডে, কোনোরকমে একবার ঘরে ফিরবেন বলে। এইসব মানুষেরাই হাঁটতে শুরু করেছিলেন রাস্তায় ঘরে ফিরবেন বলে। লক ডাউনের প্রথম এক সপ্তাহ এদের নিয়ে কোনো চিন্তাই কেউ করেনি। যদি করত, তাহলে এরাও প্রাণের ভয় নিয়ে রাস্তায় নামতেন না। ভিন রাজ্যে এরা এসেছিলেন পেটের ভাত যোগাড়ের জন্য। সেটা যদি মিলত, তাহলে নিঃসন্দেহে এরা যে যেখানে ছিলেন, সেখানেই থেকে যেতেন।
আনন্দ বিহার বাস স্ট্যান্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ মার্চ কেন্দ্রিয় সরকার ঘোষণা করলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্যের বন্দোবস্ত করা হবে। করা হবে আর করা হয়েছে, ব্যাকরণের নিয়মেই একদম আলাদা। স্থায়ী বাসিন্দাদের তবু যা হোক একটা ঠিকানা আছে, রেশন কার্ড আছে। লাইন দিয়ে সেটা তারা সংগ্রহ করতে পারবেন। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের তো সে সব কিচ্ছু নেই। যে যেখানে কাজ করছিলেন, সেখানেই যা হোক গোছের একটা চালা বানিয়ে কিংবা খোলা আকাশের নিচেই তারা রাত কাটান। তাদের ধারেকাছে প্রায়শই কোনো রেশন দোকান নেই। আবার থাকলেও সেখানে তাদের পাত্তা দেবে কেন? এই অবস্থায় তাদের কাছে রান্না করা খাবার কিংবা উপকরণ নিয়ম করে পৌছে দেবার ব্যবস্থা করাটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত। হ্যাঁ, সেটা অবশ্য-ই করা হয়েছে। এবং তার নানান ছবি আমরা নানান মিডিয়ায় বারবার দেখছি। সকাল থেকে লাইন দিয়ে খাবার জুটছে শেষ দুপুরে। কোনোদিন সেটাও জুটছে না; কোনোদিন আবার একবেলা।
একটা কথা খুব পরিষ্কার। ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এমন দু-এক কোটি মানুষকে রোজ দুবেলা খাবার পৌছে দেওয়াটা মুখের কথা নয়। তার জন্য প্রস্তুতি লাগে। চাইলেই সেটা সঙ্গে সঙ্গেই করে ফেলা যায় না। ফল যা হবার, তাই হয়েছে। অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের হাহাকারের এই কাহিনী সমস্ত রাজ্য থেকেই শোনা যাচ্ছে। ১৫ এপ্রিল মুম্বাইয়ের বান্দ্রা রেল স্টেশনের ঘটনাটা ঠিক এই কারণেই ঘটতে পেরেছে। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লক ডাউন হবার কথা। রেল কোম্পানি ইতিমধ্যেই ১৫ এপ্রিল থেকে টিকিট বুকিং শুরু করেছিল। যদিও বলা হয়েছিল কোন কারণে যদি ট্রেন বাতিল হয়, টাকা ফেরত দেওয়া হবে। ১৩ তারিখ পর্যন্ত ট্রেন বাতিলের সংবাদ কোনো মিডিয়াতেই বলা হয়নি। মহারাষ্ট্র, দিল্লী, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু কেবল নিজেদের রাজ্যে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লক ডাউন হবে বলে ঘোষণা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী টিভি-র পর্দায় আবার দেখা দিলেন ১৪ তারিখ সকালে। তখনই জানা গেল লক ডাউন চলবে ৩ মে পর্যন্ত।
কিন্তু সম্ভবত সেই ঘোষণাটা এদের কানে আর পৌছনোর সময় পায়নি। তার আগেই তারা দলে দলে হাঁটা লাগাতে শুরু করলেন স্টেশনের দিকে। যে ট্রেন আগে ছাড়বে, তাতেই সওয়ার হতে হবে। যত জলদি ফেরা যায় ঘরে। কারণ মজুরি নেই, আবার কবে জুটবে তারও স্থিরতা নেই। সবথেকে বড় কথা রোজকার খাবারেরও নিশ্চয়তা নেই। করোনা-য় মরবে কিনা, সেটা তো অনিশ্চিত। কিন্তু এভাবে চললে তার অনেক আগেই মরে যাবে অনাহারে, সপরিবারে। এখন ষড়যন্ত্রের গল্প শোনা যাচ্ছে; কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি অন্তত আরো দু দিন আগে জনগণের সামনে জানান দিতেন, তাহলে কি এমন ঘটনা ঘটত! অন্তত দু দিন আগেই তারা জেনে যেতেন ট্রেন চলবে না। ষড়যন্ত্রের গল্প যদি সত্যিও হয়, তাহলেও কুচক্রীরা খুব একটা সুবিধা করতে পারত না। সব থেকে বড় কথা, নিয়ম করে খাবারের বন্দোবস্ত থাকলে, এই মানুষগুলোও এইভাবে স্টেশনের দিকে দৌড়তেন না। এই অসহায়তার জন্যই তারা বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করছিলেন। হাজার চক্রান্তের গল্প দিয়েও সেই বাস্তবতাকে মুছে ফেলা যাবে না।
সামনের অন্ধকার
করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে দ্রুত সংক্রমণ ঘটায়, মৃত্যু-ও ডেকে আনে। আর তাকে প্রতিহত করার জন্য যে লক ডাউন কর্মসূচী, সে ইতিমধ্যেই গ্রাস করে নিয়েছে হতদরিদ্র মানুষের রুজি-রুটি। এবং সেখানেই যে সে থেমে থাকবে না, ইতিমধ্যেই সেই ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লক ডাউন চালু হয়েছিল ২৪ মার্চ। মার্চ মানে অর্থবর্ষের শেষ। তারও শেষ সপ্তাহ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই এই সময়ে কর্মকাণ্ড তুঙ্গে ওঠে। সেই সময়েই লক ডাউন হল। এর ফলে একটি প্রতিষ্ঠানও তার আর্থিক লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেনি। অসংগঠিত বাজারের হাল তো আরও খারাপ। ফলে এপ্রিলে প্রায় কোনো ছোট বা মাঝারি সংস্থা তার কর্মীদের পুরো মাইনে দিতে পারেনি, কিংবা দেয়নি। একটা অ্যাড-হক টাকা ধরিয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের যুক্তি খুব পরিষ্কার। আমার হাতে যদি টাকা না থাকে, কোত্থেকে দেব! যুক্তিটা একেবারে ফেলে দেবার মতও নয় কিন্তু।
২০১৩-১৪ সালের আর্থিক সেনসাস অনুযায়ী কৃষি ও স্ব-উদ্যোগ বাদে ভারতে কর্মীবাহিনীর সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি। এদের মধ্যে ১০ জনের বেশি কর্মী আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ২.৪ কোটি। অবশিষ্ট ১০.৬ কোটি নিযুক্ত ছিলেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এপ্রিল মাসে হাতগুনতি কয়েকটি অত্যাবশ্যক পণ্য ও পরিষেবার যোগানদার ছাড়া বাকিরা কাজ করতে পারেনি, পারবেও না। মার্চের শেষ সপ্তাহের ক্ষতির উসুল তো হলই না, বরং নিদেনপক্ষে আরো একটা মাস উপার্জনের বালাই রইল না। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা এই অবস্থায় মে মাসে মাইনে পাবেন, এমনটা ভেবে নেওয়াটাই কষ্টকল্পনা। সবথেকে বড় কথা, প্রায় ছ সপ্তাহের লক ডাউনের ফলে এদের অধিকাংশেরই মাজা ভেঙ্গে গেছে। সেই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে এদের অর্থনৈতিক কোরামিন চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই বিষয়ে সরকারের আদপেই কোনো মাথা ব্যথা আছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না।
২৬ মার্চ যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধের মাসিক কিস্তি ৩ মাস দিতে হবে না; পরে দেওয়া যাবে। সেই সঙ্গে তিন মাসের সুদ মকুব করলে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মঙ্গল হত। ঠিক আছে, যতটুকু পাওয়া যায়। হা হতোস্মি! পরে দেখা গেল, তিন মাস কিস্তি না মেটালে সুদের হার বেড়ে যাবে। এমনিতেই যদি কেউ কোন মাসের কিস্তি মেটাতে না পারে, তাহলে তার বকেয়া কিস্তির উপরে সুদ চাপে। অর্থাৎ বাস্তবে এটা কোনো রেহাই নয়, স্রেফ কথার খেলা। এমন একটা সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সরকার যদি এমন জাগলারি করেই তার দায় সারে, তাহলে অর্থনীতির পরবর্তী গঙ্গাযাত্রা কল্পনা করে নিতে কষ্ট হয় না। কেন্দ্রীয় সরকার ২০ এপ্রিল থেকে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প চালু করতে বলেছে। অথচ তার ঠিক আগেই কমিয়ে দিয়েছে আর্থিক বরাদ্দ। তাহলে সরকার চাইছে কী?
সংগঠিত ক্ষেত্রের হাল-ও যে খুব আলাদা কিছু এমনটা আদপেই নয়। ছোট প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এদের আর্থিক ভিত্তি পোক্ত, এটুকুই যা পার্থক্য। কিন্তু সরকারি কর্মীবাহিনী ছাড়া সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের অধিকাংশের আর্থিক সুবিধা তাদের প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। মোদ্দা কথা, রপ্তানি হলে এদের সংস্থার হাল ভাল, নইলে নয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বের বাজার আজ অবরুদ্ধ। জানুয়ারি মাস থেকেই রপ্তানি কমছে। আর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকেই একদম বন্ধ। রপ্তানির বাজার আবার কবে খুলবে, সেটাও বলা মুশকিল। ফলে এইসব সংগঠিত প্রতিষ্ঠানেরও ভবিষ্যৎ মোটেই উজ্জ্বল নয়। স্বভাবতই তাদের কর্মীদের ভবিষ্যতও সুরক্ষিত নয়। দেশিয় বাজারে চাহিদা এমনিতেই ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল। একের পর এক ব্যবসায়ী ব্যাঙ্কের ঋণ মেরে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোও নতুন করে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি শুরু করেছিল। সেই চাপে সংগঠিত ক্ষেত্রেও আতঙ্ক শুরু হয়েছিল করোনা ভাইরাসের আগমনের অনেক আগেই। করোনা-র দাপট এবং লক ডাউনের ফলে হাল আরো খারাপ হতে বাধ্য।
পরিষেবা ক্ষেত্র বিশেষত তথ্য-প্রযুক্তির রমরমা প্রায় সর্বাংশেই বৈদেশিক চাহিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন বরাত আসে, তেমনি অন্যদিকে এদেশের কর্মীরা বিদেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পান। সামগ্রিক সঙ্কটের ফলে দুটোই যে কমবে, সেটা অবধারিত। ইতিমধ্যেই ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করতে গিয়েছেন, তাদের তিন মাসের মধ্যে সে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একদিকে কোম্পানির বরাত কম। তার উপর এদের ফিরিয়ে আনতে হবে। সব মিলিয়ে কোম্পানিতে কর্মীসংখ্যা হবে উদ্বৃত্ত। ফলে ছাঁটাই অনিবার্য। ইতিমধ্যেই টি সি এস ঘোষণা করেছে, ছাঁটাই না হলেও বেতনের নিয়মমাফিক বার্ষিক বৃদ্ধি বন্ধ করা হচ্ছে। অন্যান্য সংস্থাগুলো বড় জোর এই পথেই হাঁটতে পারে। কিন্তু সেটাও সাময়িক। আভ্যন্তরিন চাহিদার সঙ্গে যেহেতু এদের শ্রীবৃদ্ধির খুব একটা সম্পর্ক নেই, তাই অচিরেই এদেরও কর্মীসংখ্যা কমাতে হবে। আর বি পি ও বা কল সেন্টারগুলো তো ইতিমধ্যেই সেই রাস্তায় নেমে পড়েছে।
ভারতীয় বস্ত্র-রপ্তানিকারকরা ইতিমধ্যেই বেশ বড় মাপের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। ঈদ উপলক্ষ্যে এরা বেশ মোটা একটা রপ্তানি করে থাকেন প্রতি বছর। এবারে তাদের উৎপাদন সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কেবল রপ্তানিটাই হয়নি। ফলে তাদের গুদামে মাল মজুত। এই অবস্থায় তারা নতুন করে উৎপাদনের ঝুকি নিতে চাইবেন, সেটা কষ্টকল্পনা। রপ্তানির পণ্য যদি দেশিয় বাজারে বিক্রির সম্ভাবনা থাকে, একমাত্র তাহলেই হতে পারে; নচেৎ নয়। মোদ্দা কথা, করোনা-পরবর্তী ভারতবর্ষে আর্থিক সঙ্কট অনিবার্য। চাহিদার হ্রাসের রোগ দেড় বছর ধরে ভারতীয় অর্থনীতিকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আগামী দিনেও যে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, এমন ইঙ্গিত তো নেই-ই, বরং বিপরীত সম্ভাবনাটাই আছে। একই সঙ্গে ঘটবে ব্যাপকহারে ছাঁটাই। আগামী তিন মাসে চার কোটি ছাঁটাইয়ের একটা সম্ভাবনার কথা কোনো কোনো সমীক্ষায় বলা হয়েছে। প্রতিটি ছাঁটাই চাহিদাকে আরো কমিয়ে দেবে, যার আঘাত পড়বে অর্থনীতির উপরই।
একটা সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়া, সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে না। আভ্যন্তরিন চাহিদার উপর নির্ভর করেই বাজারকে চাগিয়ে তুলতে হবে। তার জন্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে কৃত্রিমভাবে হলেও বাড়াতে হবে। মাসের পর মাস বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রীর জোগান দিয়ে অর্থনৈতিক ভরাডুবি আটকানো যাবে না। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থের যোগান চাই, যাতে বাজারে সেটা চক্রাকারে ঘুরতে পারে। তার জন্য ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তা প্রাথমিকভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু কিছুদিন পরে সেটাই আবার সর্বনাশ ডেকে আনবে। চাই প্রতিটি স্তরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষুদ্র উদ্যোগে। তার জন্য যথাসম্ভব কম সুদে অঢেল ঋণ দেবার দরকার। মুশকিল হল, একগাদা বড় ব্যবসায়ীকে ব্যাঙ্কের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়ে সরকার ব্যাংকের হাল ইতিমধ্যেই খারাপ করে রেখেছে। এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঞ্চিত তহবিল থেকেও খাবলা মেরে প্রচুর টাকা সরিয়ে নিয়েছিল সরকার। তার সদ্ব্যবহার কী হয়েছিল, কারো জানা নেই। এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কিভাবে সেই অর্থের বন্দোবস্ত করা হয়, সেটাই দেখার।
[লেখক – প্রাবন্ধিক, কালামিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।]
Posted in: April 2020, Cover Story