অন্তরঙ্গ নাট্যচর্চায় বিকল্প অনুসন্ধান – একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা : সৌরিক সামন্ত

নাট্যশিল্প মানবিক বিকাশের গর্ভগৃহ, ‘বড় আমি’র জাগরণ। আত্ম-আবিষ্কার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মশিক্ষার অন্যতম ধারকক্ষেত্র নাট্যশিল্প। নাট্যকর্ম মানুষকে মহৎ থেকে মহোত্তর, শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর, পূর্ণ থেকে পূর্ণতর এবং শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর করে তোলে। সম্ভবত নাট্যশিল্প-ই সবচেয়ে বেশি সমাজ সম্পৃক্ত। সে সমাজকে বিশ্লেষন করে, ব্যাখ্যা করে, জনচেতনাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ইতিহাস থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, নাট্যশিল্পের সামাজিক দায়কে অস্বীকার করার উপায় নেই।

নাট্য-নির্মানের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন ভাব ও আঙ্গিকে সমৃদ্ধ হয়েছে নাট্যশিল্প। ভাব-ভাষা-আদর্শগত মতানৈক্য সত্ত্বেও নাট্যনির্মাণ নিয়ে চলেছে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ভাঙাগড়া-ই নাট্যশিল্পের চলন। তার ক্রমবিবর্তনে নানা তত্ত্ব, রীতিনীতি ক্রমশ ডানা মেলেছে আপনধর্মে। কোনও নাট্যে যেমন পাওয়া গেছে দেশজ লৌকিক আঙ্গিকের প্রাধান্য, তেমন-ই কোনও নাট্য আবার ভাষার চমকপ্রদ খেলা। কোনও নাট্য সমাজ সচেতনতার দৃষ্টিতে পুষ্ট, আবার কখনো আত্মানুভবের কঠিন অথচ তীক্ষ্ম রসে দ্রবীভূত। কোনও নাট্য আবার, প্রথাবিরোধী প্রকরণের শিল্প-অভিজ্ঞান। এরকম প্রতি ক্ষেত্রেই, নতুন শৈলীর উন্মেষ ঘটেছে। মঞ্চবিন্যাস থেকে অলঙ্কারের কারুকৃতি – সবক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অভিনয়ের তাৎপর্য, ব্যাকরণ এবং প্রয়োগরীতি; সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে তৈরি হয়েছে নব্যধর্মী, স্বতঃস্ফূর্ত নাট্যদর্শন। প্রাচীন গ্রিক থিয়েটার ও প্রাচীন ভারতীয় থিয়েটার থেকে শুরু করে একে একে পাপেট, রিয়ালিস্টিক, ন্যাচারালিস্টিক, পিপলস, সিম্বোলিক, এক্সপ্রেশনিস্ট, ফিউচারিস্ট, গ্রুপ, গ্রোটেক্স, ফ্রিনজ, লিভিং, অ্যাবসার্ড, পুওর,ওপেন, থার্ড, এনভায়রমেন্টাল, পপুলার থেকে সমকালীন রেপার্টারি – এত বিপুল ও বৈচিত্রময় নাট্য-আঙ্গিক এবং নাট্যদর্শন তৈরি হয়ে এসেছে, সময়ের দাবি মেনে। বিষয়, ভাবনা, দৃশ্যকলা, আঙ্গিক, পোষাক, আলো, আবহ – এর পাশাপাশি সবথেকে বদলে গেছে রঙ্গমঞ্চ বা নাট্যশালা (Stage/Space)। প্রথাগত ধারণায়, রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে বলা হয় – “The space in which actors perform a play usually a raised platform. In traditional Theatres the stage is an area like a room, of which one of the wall has been removed, allowing the audience to see the action there.” (A Dictionary of Literary Terms/ Martin Gray)

প্রসঙ্গত উল্লেখিত ” the space in which actors perform”- এই স্পেস নিয়েই চলেছে, চলছে নিরন্তর পরীক্ষা- নিরীক্ষা। যেহেতু, নাট্যশিল্প একটি প্রায়োগিক কলা, তাই সেখানে এই নিরন্তর পরীক্ষার অবকাশ-কে অস্বীকার করার উপায় নেই, বরং চেষ্টা চলছে বিকল্প অনুসন্ধানের। প্রকরণগত দিক দিয়ে নাট্য উপস্থাপন-কে এনে ফেলা হয়েছে এক গবেষণাগারে। এরকমই এক সাম্প্রতিক পরীক্ষালব্ধ নাট্যআঙ্গিকের (মতান্তরে নাট্যদর্শন) নাম অন্তরঙ্গ নাটক বা Intimate Theatre।

সাম্প্রতিক বাংলা থিয়েটারে প্রথাগত ঐতিহ্যকে ভাঙার উপযোগী প্রয়াস চোখে পড়ছে। স্পেস, স্ক্রিপ্ট,ফর্ম, কনটেন্ট- সব কিছুতেই চলছে বিকল্প অনুসন্ধান। আসলে, ‘বিকল্প’ শব্দটার মধ্যেই একটা প্রতিস্পর্ধার গন্ধ পাওয়া যায়। বাংলা থিয়েটারে প্রসেনিয়াম গন্ডী থেকে সেই কবে সত্তরের দশকে তরুণ ‘শতাব্দী’ আগুন বুকে চেপে, থিয়েটারকে মানুষের জন্য, মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। সেই শুরু, তারপর থেকে সমান্তরাল দুটি ধারা একসাথে চলেছে; পরস্পরকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানিয়ে। বিরোধ তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিরোধিতা করেনি কেউ কাউকেই। কারন, বাদল সরকারের শিক্ষা, থিয়েটার দর্শন এবং নাটককার হিসাবে অসামান্য দক্ষতার কারনে। শুধু বাদল সরকার নন, ভারতীয় থিয়েটারে তার অব্যবহিত পরেই চলে এসেছেন আরও একজন বিকল্পসন্ধানী থিয়েটার কর্মী সফদর হাশমি। অ্যাজিটপ্রপধর্মী পথ-নাটিকা থেকে বেশ কিছুটা আলাদা হয়ে বাদল সরকার এবং সফদর হাশমি পথে-অঙ্গনে বিকল্প থিয়েটারের নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ করলেন। ‘মিছিল’ থেকে ‘মেশিন’, ‘ভোমা’ থেকে ‘আওরত’ কিংবা ‘ভুল রাস্তা’ থেকে ‘হল্লাবোল’–কাতারে কাতারে মানুষ মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়েই থিয়েটারের মধ্যে স্বাদ পেয়েছে মুক্তির, সাধ জন্মেছে বদলে দেবার।

স্পেস এবং ফর্ম নিয়ে অনুসন্ধান, বাংলা থিয়েটারে মজ্জাগত। এরকমই সাম্প্রতিক পরীক্ষামূলক থিয়েটার চর্চা, ‘ইন্টিমেট থিয়েটার’। প্রথম যখন শুনি, মানে বুঝতে পারিনি। টুকিটাকি পড়াশোনার দৌলতে আস্তে আস্তে অগস্ত বোয়ালের ‘ফোরাম থিয়েটার’, গ্রতোস্কির ‘পুওর থিয়েটার’, জুলিয়েন বেকের ‘লিভিং থিয়েটার’, জোসেফ চাইকিনের ‘ওপেন থিয়েটার’, এবং রিচার্ড শেখনারের ‘এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার’ সম্পর্কে কিছুটা আত্মীকরণ ঘটেছে। পাশাপাশি বাদল সরকারের মনন, চলন ও দর্শন বুঝতে শিখেছি। তথাপি, ইন্টিমেট থিয়েটারের ব্যাখ্যা কোথাও পাইনি। তবে এটা পরিষ্কার যে, উক্ত সমস্ত থিয়েটার চর্চাই বিকল্পের সন্ধান করেছে। বিকল্প অর্থে থিয়েটারের মধ্য দিয়ে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ বিষয়ে তিনটি সম্পর্কের উপর আলোকপাত করা হয়েছে- অভিনেতার নিজেদের মধ্যে, অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে এবং দর্শকের নিজেদের মধ্যে। অভিনেতা-দর্শকের মধ্যকার সম্পর্কেই তারা বলতে চেয়েছেন- ‘দর্শক সংস্থাপন’, যা পরম্পরাগত থিয়েটারে (গ্রোতস্কি কথিত রিচ থিয়েটার) অবহেলিত হয়ে এসেছে চিরকাল।

থিয়েটারে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব? দুজনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সম্ভব? দর্শক কি নাট্যানুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে? নিষ্ক্রিয় দর্শককে কি সক্রিয় করা যায়? অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যেকার স্থানিক দূরত্ব ঘোচানো কি সম্ভব? প্রসেনিয়াম মঞ্চ, আলো, আবহসঙ্গীত, স্লাইড প্রজেকশন, সাউন্ড এফেক্ট, পোশাক, দৃশ্যপট, মঞ্চোপকরণ যাদের সম্ভব নয়, তাদের জন্য নাট্যাভিনয় কি সম্ভব নয়? এরপরও, বিপুল সমারোহের বাইরেও থিয়েটার ‘গণমাধ্যম’ হয়ে উঠতে পারে। আসলে অভিনেতা ও দর্শকের জীবন্ত উপস্থিতি ছাড়া থিয়েটার অসম্পূর্ণ। থিয়েটার যেহেতু ফিল্ম নয়, যেহেতু এক জীবন্ত অনুষ্ঠান, তাই অভিনেতা-দর্শকের পারস্পরিক উদ্দীপনা ও উজ্জীবনই থিয়েটারের প্রধান অভিপ্রায়। তাই, কখনও কখনও মনে হয়, দূরদর্শন ও চলচ্চিত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় এই যন্ত্রনির্ভর থিয়েটারে অন্তরঙ্গতা সত্যি তৈরি হয়? ঘনিষ্ঠতা জন্মায়?

মঞ্চের অসমতলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে, একটি নির্দিষ্ট পরিশীলিত ঘরে অভিনয় অনুষ্ঠানকেই অন্তরঙ্গ থিয়েটার বলা সঙ্গত? মঞ্চোপযোগী সমস্ত উপাদান-উপকরণ নিয়ে, শুধুমাত্র সমতলীয় দর্শক সংস্থাপন হলেই অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়?-এ প্রশ্ন বহুদিনের। মনে হয়, প্রসেনিয়াম মঞ্চের মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া বাঁচাতেই বেছে নেওয়া হয় একটা স্পেস এবং নির্মিত হয়ে যায় অন্তরঙ্গ থিয়েটার। প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে – এই স্পেসে নাট্যাভিনয়ে সত্যি কি অন্তরঙ্গতা তৈরি হচ্ছে? হলেও সেটা কতটা? নাকি অযথা তাত্ত্বিক কারনে অন্তরঙ্গতার উপকরণটা প্রাধান্য পাচ্ছে? প্রশ্নটা সেখানেই, যদি বিকল্প স্পেস আর অভিনেতা-দর্শক মিথস্ক্রিয়াই প্রধান হয়, তাহলে বাদল সরকারের ‘মিছিল’ কিংবা সফদারের ‘মেশিন’ নাটককে অন্তরঙ্গ নাটক বলা কি অন্যায় হবে? উল্টো দিক দিয়ে ভাবলে, ‘মিছিল’ বা ‘মেশিন’ নাটকদ্বয় প্রসেনিয়াম মঞ্চে উপস্থাপন করা বা দেখা সম্ভবপর হবে কি? অথচ, অন্তরঙ্গ থিয়েটার নামে যে থিয়েটার প্রতিদিন প্রসেনিয়াম আর্ট সেন্টার অথবা তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে বা অন্যত্র প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেই নাট্য প্রযোজনাগুলি অর্থ অনুদান বা সুযোগ পেলে একাডেমি, মধুসূদন মঞ্চ কিংবা নিদেনপক্ষে শিশির মঞ্চে অভিনয় করবেন নির্দ্বিধায় এবং নিঃসঙ্কোচে।

তাহলে যা দাঁড়াল সেটা হল এই যে, বিকল্প থিয়েটার চর্চার জন্য বাদল সরকার থেকে রিচার্ড শেখনার প্রমুখেরা যে অন্তদর্শন নিয়ে ভাবতে চেয়েছিলেন তা আজকের অন্তরঙ্গ থিয়েটারে অনুপস্থিত। আসলে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় অন্তর থেকেই। অন্তরের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হতে হতে। যে প্রশ্নে মিলে যায় নাটককার থেকে নির্দেশক, অভিনেতা থেকে দর্শক। এক সামগ্রিক ঐকচেতনায় দ্রবীভূত হয়ে নতুনের সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু কোথায় সেই আত্মসমালোচনা? আত্মমূল্যায়ন? অন্তরদৃষ্টি? বা অন্তরঙ্গতা? কিংবা সেই ঘনিষ্ঠ বোধ?

সুতরাং যে প্রশ্নটা অনিবার্যভাবে উঠে আসে, তা হল; প্রসেনিয়াম আর অফ-প্রসেনিয়াম মঞ্চের স্থানিক দুরত্ব এবং সরাসরি দর্শক সাঙ্গীকরণ। প্রসঙ্গত, রুশ থিয়েটারে মায়ারহোল্ড মঞ্চ ভাবনার ক্ষেত্রে যে অভিনবত্ব এনেছিলেন, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দর্শকের সাথে অভিনেতার সম্পর্ক-কে আরও নিবিড় করে তোলা। প্রসেনিয়াম মঞ্চের চিরাচরিত অর্ধাচন্দ্রাকৃতি সন্মুখাংশকে অন্যভাবে ব্যবহার করে মঞ্চ থেকে দর্শকের যাতায়াতের জন্য সিঁড়ি যুক্ত করে দিতেন। একাধিক প্রযোজনা চলাকালীন মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহের সমস্ত আলো জ্বালিয়ে রাখতেন স্বচ্ছন্দে। অভিনেতা-অভিনয় ক্রিয়া- দর্শকের মধ্যে সেতুবন্ধনের এমন অনন্য ব্যবস্থা সেই কবে মায়ারহোল্ড প্রণয়ন করেন, যার জন্য তাঁকে আলাদা করে কোনও ম্যানিফেস্টোর আশ্রয় নিতে হয়নি। তিনি করেছিলেন প্রয়োজনের তাগিদে। এইভাবে প্রযোজনার তাগিদেই, বোয়ালের নাট্যদর্শনে ‘Spectator’-এর নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। যেখানে একজন দর্শক শুধুমাত্র দর্শকের ভূমিকাতেই আবদ্ধ থাকেন না, তাকে অভিনেতার সাথে সম্পৃক্ত হতে হয় প্রযোজনা চলাকালীন। যেখানে সেই দর্শক সরাসরি তার ভাবনা এবং মত প্রকাশ করবেন। অপরপক্ষে, অভিনেতাও দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন অভিনয়ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। ফলে, বোয়ালের থিয়েটারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা শুধু অভিনেতার নয়, সমানভাবে দর্শকেরও। তাঁর থিয়েটারে একজন ‘Spectator’ হয়ে ওঠেন একজন ‘Spect-actor’, —- “not only a spectator in the sense of receiving, but someone who would participate and intervene”। পরবর্তী সময়ে জার্জি গ্রোটস্কি দৃশ্যপট, স্থায়ী মঞ্চ-ভাবনা, পোষাক, যান্ত্রিক আবহ, আলোর কারসাজি ইত্যাদিকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বিষয় বলে মনে করেননি। বস্তুত, এই ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ থিয়েটারকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘Synthetic Theatre’ নামে। যে থিয়েটারকে তিনি নস্যাৎ করে, গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন অভিনেতা এবং দর্শকের উপর। তাঁর থিয়েটারে শুধু অভিনেতা এবং দর্শকই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা; অভিনেতা-দর্শকের সরাসরি, জীবন্ত সংযোগ-ই এই শিল্প-আঙ্গিকের সত্যিকারের ঐশ্বর্য — “The encounter between two groups of people – Performer and Spectator”।

দ্বিতীয় আর একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রথাগত থিয়েটারে অর্থাৎ প্রসেনিয়াম থিয়েটারে কি অভিনেতা, অভিনয়ক্রিয়া এবং দর্শকের মধ্যে সম্পৃক্তিকরণ (প্রক্সিমিটি) গড়ে তোলা একেবারেই সম্ভব নয়? ত্রিমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পৃক্ত হয়ে থাকাই কি অন্তরঙ্গতার এক ও একমাত্র বিচার্য? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি বহুবার। বহুবার এমন মনে হয়েছে, একাডেমি কিংবা রবীন্দ্রসদনের শেষ রো-তে বসে কোনও নাট্যপ্রযোজনার কার্টেন কলের পরেও নিভৃতে কেঁদেছি একা একা। হয়তো সেই নাটকের শেষ দৃশ্য এমনভাবে ছুঁয়ে গেছে, এমনভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি কখন নাটক শেষ হয়েছে! একটা মায়া মেশানো, কান্না মেশানো অনুরাগ নিয়ে কতক্ষণ ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছি, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এমনই অন্তরঙ্গ হতে পেরেছি সেই নাট্যের সাথে, সেই অভিনেতার সাথে। কিন্তু, সবটাই ঘটেছে আমার একান্ত ব্যক্তিসত্ত্বায়। অন্ধকারে, মঞ্চ থেকে অনেকদূরের অসমতলে বসে, আমার ব্যক্তিগত চোখের জলটাও থেকে গেছে আমারই কাছে। নাটকের শেষে মনে হয়েছে, ঐ যে-মানুষটার চরিত্র ‘সহৃদয় হৃদয়সংবাদী’র মতো আমার হয়ে গেছে, যাই তাকে গিয়ে প্রচন্ডভাবে জড়িয়ে ধরি, উজার করে দিই, সমর্পণ করি নিজেকে। আমার ‘বড়ো আমি’-টাকে কাছে এনে দেবার জন্য, ভিতরের সমস্ত তাপ-উত্তাপ বিনিময় করি তার সাথে। কিন্তু সম্ভব হয় কি? হতে পারে কি? সম্ভব নয়, জানি। আসলে সেই অভিনেতা আর আমার( দর্শকের) স্থানিক দুরত্ব থেকেই তৈরি হয়ে যায় বোধ, মনন আর হৃদয়ের মধ্যকার হাজার যোজন দূরত্ব। যে অভিনয় স্কিল আমাকে মুগ্ধ করেছে, তা আসলে জাস্ট একটা পারফর্মেন্স ছাড়া আর কিছুই না। ফলত, নাটকের শেষে আমার উক্ত হর্ষ, বেদনা, ক্ষোভ, অভিমান, ক্রোধ কিংবা ভালোবাসা- সবই তার (অভিনেতা) কাছে অনুভূতিহীন, মূল্যহীন, উত্তাপহীন একটা অনাগ্রহের চর্চা ব্যতীত কিছুই নয়। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, এই অন্তরঙ্গতাও তো আসলে একধরনের ফ্যান্টাসি। একটা তীব্র ইল্যুউশন। সিনেমা হল দেখে বার হলে যে সুখানুভূতি, তার সাথে এই অন্তরঙ্গতার কোনও পার্থক্য নেই। দুটো ক্ষেত্রেই ক্ষণিকের অন্তরঙ্গ হবার একটা চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি।

বোয়াল যাঁর দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সেই ফ্রেইরির ‘পেডাগজি অফ দ্যা অপ্রেসড’ গ্রন্থে ফ্রেইরি, সমস্ত স্লোগান, ভাষণ, ইস্তেহারকে বর্জন করার কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, এসব উপকরণ পোষ মানানোর হাতিয়ার, দলে টানার কৌশল। আদর্শের নামে ইচ্ছামত ব্যবহার করার গূঢ় পদ্ধতি। আর এই গূঢ় পদ্ধতি আর কৌশল-ই বাংলা অন্তরঙ্গ নাট্যচর্চার সবচাইতে বড় অন্তরায় এবং বিপজ্জনক প্রবনতা। সাম্প্রতিক বাংলা থিয়েটারে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, কোনও কোনও নাট্যদল( যারা দাবী করেন, তারাই অন্তরঙ্গ থিয়েটারের হত্তা-কত্তা-বিধাতা) এবং নাট্য-বিশারদরা, পাশ্চাত্য নাট্যগুরুর প্রতি অনুরক্ত। পাশ্চাত্য নাট্য আন্দোলন কিংবা দর্শন- দুটোরই সময়, প্রেক্ষিত এবং অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। তবু, ঐশ্বরিক বিশ্বাসে তাঁর বা তাঁদের নাট্যদর্শনকে ব্যবহার করছেন অন্তরঙ্গ থিয়েটারের মোড়কে। এ বঙ্গের সেই নাট্য-বিশারদ-রা সংজ্ঞায়িত করছেন, ‘কাকে বলে অন্তরঙ্গ নাটক’। তৈরি হচ্ছে, অন্তরঙ্গ নাটকের কিছু শর্ত, ম্যানিফেস্টো। যেমন, অন্তরঙ্গ নাটকের প্রথম উপযোগী উপকরণ হ’ল মোমবাতি। তার সাথে অন্ধকার ঘর, আদুর গা, পারস্পরিক নিবিড় ঘনিষ্ঠতা (বিপরীত লিঙ্গ হলে, অন্তরঙ্গতার প্রকাশ আরও নিবিড় হয়) ইত্যাদি। এর সাথে তদোপযুক্ত স্ক্রিপ্ট, যার ভাষা হতে হবে ‘Language of Enigmatic’, আলো-অন্ধকারের মতো কতক বোঝা যায়, কতক বোঝার উপায় নাই। এই অন্তঃসারশূন্য একধরনের যে নাট্যচর্চার বিকাশ ঘটেছে বাংলা থিয়েটারে, তা একেবারেই অনুকরণপ্রিয়। যার নির্যাস, বহু নাট্যপ্রেমী মানুষ এই অন্তরঙ্গতাকে মেনে নিতে পারছেন না, অন্তরঙ্গ নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেই প্রসেনিয়াম থিয়েটারের দিকেই।

অন্তরঙ্গ থিয়েটার আসলে একটা মনন-কে আশ্রয় করে নির্মিত হয়। Audience-Performer-Space-Togetherness, — এই সমন্বয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয় অন্তরঙ্গ থিয়েটারকে। এক নিবিড় অনুশীলন এর ভিত্তি। স্পষ্ট বিশ্বাস, স্পষ্ট বিষয় এবং স্পষ্ট সাংস্কৃতিক ভিত্তি নিয়েই অন্তরঙ্গ নাটকের পথ চলা। আসলে, থিয়েটার বরাবর-ই সময়ের কাছে দায়বদ্ধ। সময়ের দাবি মেনেই তাকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দর্শনে প্রকাশিত হতে হয়েছে বারবার। তাই, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতোই, থিয়েটারেরও একটা স্পর্ধা আছে। প্রথাগত যা কিছু, তাকে সে ভাঙতে চায়, বদলাতে চায়। বিকল্পের সন্ধান, সে করবেই। আর এই বিকল্পের খোঁজ মানে আসলে বিষয় অনুসন্ধান, আর তার সাথে পূর্বে কথিত Audience-Performer আর Space-এর অনুসন্ধান। এই Togetherness-এর সাথে হৃদয়ের তাপ-উত্তাপ আদান-প্রদানের খোঁজ, এই থিয়েটারের পাথেয়। ফলে, বিকল্প অনুসন্ধানে অন্তরঙ্গ তো হতেই হবে। অন্তরঙ্গ না হলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা অসম্ভব। বিকল্প মানেই সে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট -এর বাহক, নতুনের দিশারী। তার সাথে,সেই লড়াই-এর সমান্তরাল পথে চলার থেকে অন্তরঙ্গতা আর কিছু হয় নাকি? তাই, মেকি দর্শন আর সেই দর্শনের নামে তৈরি করা কিছু ডক্ট্রিন নিয়ে আর যাই হোক, অন্তরঙ্গ নাট্যচর্চা কার্যত অসম্ভব। অন্তরঙ্গতা বরং থাকুক, আমাদের অন্তরে, অন্তরতম হয়ে সবার মধ্যে।।

[লেখক – বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, সংগঠক এবং নাট্যকর্মী।]

Facebook Comments

Leave a Reply