গল্প : সিন্ধু সোম

ওয়াক্ত

বিজন ঘরের ভেতর পায়চারী করে। তার কপালে বলিরেখার ছোবল! “এখনও এল না!” পায়ের বেগ হলের চৌকো চৌকো মার্বেলের বাঁধানো অবকাশ মুহূর্তে পার করে গেলে জোর করেই তাকে উল্টো মুখে ঘুরতে হয় এবং হলটা তার সামনে কেমন যেন একটু গুটিয়ে নেয় নিজেকে! দোতলা বাড়িটার নিচের তলায় কোনও বেডরুম নাই। রাখা হয় নাই অপ্রয়োজনীয় হিসেব করেই। চারজনের সংসারে ছেলে বউ বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে সংসার, বয়সও হলো প্রায় ষাটের ওপরে বিজনের। প্রোস্টেটের সমস্যাটা একটু ভোগায় মাঝে মধ্যেই। বাড়িটা সে একটু বয়েসেই বানিয়েছে। কাজেই ওপরের তলায় দুটির বেশি বেডরুম তাদের প্রয়োজন ছিল না, রাখাও হয় নাই। সেই বেডরুমের বড়টায় লিসা শোয় মায়ের সঙ্গে, আরেকটায় ছেলে। বিজনের বসবাস নিচের ঘরেই আপাতত। নিচের দীর্ঘ ডাইনিং কাম ড্রেসিং একটা হলের মতো। এক কোণে রান্নাঘর, এবং তার গায়ে লাগা বসার ঘর। সেই লম্বা ডাইনিং ধরে অনেকক্ষণ পায়চারী করতে দেখে লিসা বাইরে বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। “কী গো? একটু বসো! তখন থেকে শুধু ঘুরঘুর করছে! আরে বাবা বুলু ঠিক নিয়ে আসবে! অত চিন্তা করতে হবে না!” বিজন যেন ধরা পড়ে গিয়েছে এভাবে অপরাধীর মতো হাসে। “চিন্তা কি আর সাধে করি গো? অবস্থাটা দেখেছো? একটা লোক আছে পাড়াতে আজ? কাল অবধি ঘুরঘুর করছিল সব!” মুখে সে বলে বটে, কিন্তু বোঝা যায় একটা অস্বস্তির খেঁকুড়ে কাঁটা তার দুচোখের মাঝে এসে বিঁধেছে। সেখান থেকে উদ্বেগের একটা জাল ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়লে একা পুকুরের নীরব তল হয়ে জেগে থাকে তার চোখজোড়া।

সত্যিই রাস্তাঘাট আজ একেবারে শুনশান। বিজনের বাড়িটা সদর থেকে দূরে। বড় রাস্তা থেকেও অনেকটাই ভিতরে, গ্রামের মধ্যে। কেবলস্‌ বন্ধ হওয়ার সময় বিজনকেও বাদবাকি কয়েক হাজার শ্রমিকের মতোই ‘স্বেচ্ছাবসর’ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল প্রায় বছর তিনেক হল। অবিশ্যি কারখানার অবস্থা দেখে তার বছর পাঁচেক আগেই বিজন বাড়ি করে শহর থেকে খানিকটা দূরে এই গ্রামে উঠে এসেছিল। লিসা একটা সরকারি স্কুলে চাকরি করে এবং তার চাকরি আছে এখনও বেশ কয়েক বছর। সেই সূত্রেই হোম লোন নিয়ে বাড়ি। বছর বছর টাকা গুনতে হয় তার। সব মিলিয়ে সৎ পথের রোজগার বাড়ি এবং সংসার নিয়ে জীবন তার ভালোই কাটার কথা! চাকরির ব্যস্ততা না থাকলেও বিজন আর চার পাঁচজনের মত এই বয়সে অথর্ব হয়ে পড়ে নাই। কারণ ঘরে তাকে খুব একটা দেখা যায় না। নইলে চাকুরিজীবি লোক উপযুক্ত সঙ্গ আর পেনশনের মোটা অঙ্ক না পেলে রিটায়ার করার পর খুব একটা বাঁচে না। কেবলস্‌-এর পেনশন মাসে দুহাজার টাকা! আর বন্ধু-বান্ধবও সব উপযুক্ত পাওনা গণ্ডা কিছুই না পেয়ে শেষ জীবনে আবার নতুন করে কিছু করার দুর্বল চেষ্টায় আবার ছড়িয়ে পড়েছে এদিকে ওদিকে। প্রথম বয়েসে তারা যখন এখানে চাকরি করতে এসেছিল, কেউই ভাবে নাই এখানেই থেকে যাবে। ধীরে ধীরে উপড়ে আসা শেকড় ঝুরি নামায়। নতুন করে জমি পাওয়ার স্থৈর্য আসে। শেষ বয়সে আবার এই উপড়ে ভেসে যাওয়ার ধাক্কা সামলানো কম ব্যাপার না! বহু লোক কলকাতায় গিয়েও থাকতে পারে নাই। কয়েক মাসের মধ্যে মরেছে কিছু, কিছু ফিরে এসে আশে পাশে বাসা করেছে। কিন্তু সেটা যাদের সংস্থান আছে। যাদের নাই, তারা ফেরার উপায় করতে পারে নাই, থাকার উপায়ও করতে পারে নাই। তাদের কেউ দেশের বাড়িতে পরিচিত কনট্রাক্টরের আণ্ডারে সাইট দেখাশোনা করছে, কেউ ব্যাবসা ইত্যাদিতে আবার নতুন করে নেমেছে। কাজেই বিজনের বন্ধু বান্ধব প্রায় তলানিতে। কষ্ট হয়, কিন্তু অথর্বের মতো বসে যাওয়ার পাত্র সে নয়। বিজন একটা ছোট বামপন্থী দলের রেড কার্ড হোল্ডার! দায়িত্ব প্রচুর! ফলত সারাদিনে তার এনগেজমেন্টও কিছু কম থাকে না। কেটেও যায় একরকম সময় হু হু করে। স্কুলের সময় বাদ দিয়ে লিসা টুকটাক লেখালেখি পড়া আবৃত্তি নিয়ে থাকে। দুজন সম্পূর্ণ স্থির নিজের বৃত্তে। বিশেষত একটা বয়সের পর সম্পর্কটা নিছক অভ্যেসেই দাঁড়িয়ে যায়! ছেলে বিলুও নিজের মতোই থাকে! পাটুলীর সেন্টার থেকে পল সায়েন্স নিয়ে এম ফিল করে এখন নেট-এর প্রিপারেশন করছিল কয়েকদিন বাড়িতে থেকেই। কিন্তু তার মধ্যেই এই! লক ডাউন! করোনার বিভীষিকায় আচ্ছন্ন সমস্ত উপমহাদেশ। স্কুল বন্ধ, কারখানা বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ। মানুষ ঢুকে গিয়েছে ঘরের ভিতর এবং নিজের ভিতর প্রাণের ভয়ে। হু হু করে বেড়ে চলেছে গৃহ হিংসা! পরিবারের সংকট যে কোন মাত্রায় এসে পৌঁছেছে, তা এতদিন বোঝা গেলেও এত নগ্ন ভাবে নখ দাঁত বার করে মানুষের সামনে আসে নাই। পরিসংখ্যা থেকে মানবিক হতে যে বিপন্নতা দরকার তা আচমকা হু হু করে মানুষকে গ্রাস করতে থাকলে মানুষ তার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারে নাই প্রথমে! শুরুতে কিছু লোক নিতান্তই বাড়িতে থাকতে অনিচ্ছুক হয়ে “এসবে কিছু হবে না” ভাব নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ১৮৮ ধারা জারি থাকার পরেও এই অসীম সাহসিকতা প্রশাসন মানতে পারে নাই। ফলত শুরু হয় তুমুল লাঠি চার্জ। প্রথম প্রথম ঘরে বন্দী মানুষজন ব্যাপারটা উপভোগ করে। খানিকটা ভয়ের সঞ্চার এই উপমহাদেশের গোঁয়ার্তুমির প্রতিষেধক হিসেবে হয়তো দরকারও মনে করেছিল তারা। কিন্তু প্রশাসনের ব্যাপার কি আর ওই টুকুতে থেমে থাকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ল লাঠির আঘাতে বহু লোক, যারা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিল, আহত হচ্ছে। পুলিশ বাছবিচার না করেই বেদম লাঠি চালাচ্ছে। শেষে লাঠির আঘাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে- এমন অভিযোগ এলে মুখ্যমন্ত্রী আসরে নামতে বাধ্য হন, এবং পুলিশের কড়া সমালোচনা করেন। ততদিনে রোগ বেড়েছে, মৃতের সংখ্যা বেড়েছে! উচ্চবিত্ত এবং মূলত মধ্যবিত্তের মনে আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। আতঙ্কের অ্যাসিডে ভিজিয়ে রাখলে মানুষের শিরদাঁড়া নমনীয় হয়। বিদ্রোহী গন্ধগোকুল মধ্যবিত্তের বেশিরভাগ এখন প্রধানমন্ত্রীর সবথেকে বড় সমর্থক হয়ে উঠেছে!

কিন্তু গ্রামাঞ্চলে, বিশেষত বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের বর্ডারে অবস্থিত এই অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে পুলিশ লাঠিও চালায় নাই, লক ডাউনকে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত লোকজন অত গুরুতর ব্যাপার হিসেবেও নেয় নাই! বিকেল হলে কাল অবধি মাঠে ছেলেরা খেলেছে। লোকজন হাঁটতে বেরিয়েছে, হরিমন্দিরের চাতালে বসে তাস পিটিয়েছে। কিন্তু কাল রাতের ঘটনার পর বোঝা যাচ্ছে শহুরে ভয়ের হাওয়া তাদেরও ভিতর ভিতর জমি তৈরী করেই রেখেছিল। কাজেই হালকা টোকায় উপরের ডোণ্ট কেয়ারি ভাব ঝুরঝুর করে ঝরে গেছে। বিজনের পাড়ায় কাল রাতে একজনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে করোনা সন্দেহে। মিশ্রদের বড় ছেলে। সৌদি থেকে ফিরেছিল ন-দশদিন আগে এই ঝুট ঝামেলার মধ্যে। ঘরেই ছিল। কাল রাত থেকে নাকি শ্বাসকষ্ট জ্বর কাশি। বাড়াবাড়ি হওয়ায় পুলিশে খবর দিয়েছিল কেউ। কে দিয়েছে সেটা স্পষ্ট নয়। মিশ্রদের যৌথ ফ্যামিলি। ঘরে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন লোক। নিজেদের মধ্যে চুরি করা জমি জায়গা নিয়ে খুব একটা সদ্ভাব না থাকলেও এরা এতজন কীভাবে এখনও একসঙ্গে থাকে সেটা একটা রহস্য! যদিও গ্রামে এ জিনিস এখনও দেখা যায়। হয়তো গ্রাম বলেই সম্ভব! কাল বিকেল অবধি পশুপতির চপের দোকানে দাঁড়িয়ে চপ খেতে খেতে তারা আরো দশজনের সঙ্গে গল্প করেছে। হাঁটতে বেরিয়েছে! পাড়ায় আড্ডা দিয়েছে! কতদূর যে ব্যাপারটা গড়িয়েছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আচমকা যেন একটা থাপ্পড় খেয়ে গোটা গ্রাম পাখনা গুটিয়ে নিয়েছে। বিজনের অবশ্য ব্যবস্থা আলাদা। সে আজীবন সক্রিয় বামপন্থী দল করলেও তার পরিবারের কেউ এখনও গ্রামের সঙ্গে মিশ খেয়ে যেতে পারে নাই। লক ডাউনের শুরুর দিন থেকেই তার বাইরের গেটে তালা। শুধু সপ্তাহে একবার কি দুইবার প্রয়োজনীয় বাজার করতে বেরোনো ছাড়া তাদের ঘরের কাউকেই গাঁয়ের কেউ দেখে নাই বাইরে। ছাদে গোটা পরিবারটাকে দেখা যায় বিকেলের দিকে। বুলু আগে উঠে সিগারেট খেয়ে নেমে এলে, লিসা আর বিজন ওঠে। হাঁটাহাঁটি করে একটু। বাদবাকি দিন ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে শেষ করে নিজেদের নিজেদের বৃত্তে নিজেদের নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছে তারা। ফেসবুক করছে, খবর শুনছে, বই পড়ছে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্প করছে। একরকম সবার সঙ্গে বাস্তব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তাদের। কিন্তু গ্রামের ঘটনাটা তাদের মনেও ছায়া ফেলেছে। আরো গম্ভীর হয়েছে বিজনের মুখ। শাশুড়ির ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। নিয়ে আসা দরকার। কাল রাতে খাবার সময় সমস্ত ঘটনা শুনে বিলুই বলে, “তোমাকে আর বাজার যেতে হবে না বাবা, আমিই যাব কাল। একটু বেশি বেশি করে জিনিস আনব, হপ্তাখানেক চলে যাবে। কম কম খেতে হবে এই কদিন!” বিজন আর কিছু বলতে পারে নাই। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্কদের এক্সপায়ার করার রেট বেশি। বিলু সেদিকটা ভেবেই বলেছিল। লিসা বলে, “চাল, আটা এইসব একটু বেশি করে আনিস বাবা! কী অবস্থা হতে চলেছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না!” বিজন আঁতকে ওঠে, “বেশি মানে? স্টোর? স্টোর করে রাখবে তুমি? মানুষ খেতে পাচ্ছে না……” । “যেভাবে সব প্রোডাকশনের জায়গা গুলো বন্ধ এরপরে চাল আঁটা পাওয়াও মুশকিল হতে পারে! লোকাল শাক সবজি, মাছ হয়তো পাওয়া যাবে! মাংস ডিমও পাওয়া যাবে। কিন্তু চাল আটা নাও পাওয়া যেতে পারে যে সেটা ভেবেছ? আশ্চর্য বাবা! এদিকে চাষবাস তো কিছুই হয় না প্রায়!” লিসা একটু উষ্ণ স্বরেই কথাটা জানিয়েছিল। “না পাওয়া গেলে খাবে না! স্ট্যু খেয়ে থাকবে! সবজি খেয়ে থাকবে! আশ্চর্য! তার জন্যে স্টোর করতে হবে নাকি? আমরা যখন সংসার শুরু করি একটা অ্যানামেলের থালা আর একটা হাঁড়ি ছাড়া কিছু ছিল আমাদের? তখন যদি চালাতে পেরে থাকি এখনও পারব!” বিজনের উত্তরে লিসা আর কিছু বলে না! অবস্থা তাদের সত্যিই ভালো ছিল না খুব একটা লিসার চাকরিটা হওয়ার আগে অবধি। কিন্তু সে তো বিগত কাল। যৌবনের শুরুতে আর পাঁচজনের মতো সেও পার্টিতে এসেছিল বিজনের হাত ধরেই। কষ্ট করা অভ্যেস ছিল তখন। কারণ তারা দুজনেই অত্যন্ত গরীব পরিবারের সন্তান। চাকরি হওয়ার পর নানা কারণে সেই সময়টাও কেটে গিয়েছে, পার্টি থেকে অনেকটা সরেও এসেছে লিসা। দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক কাজকর্মের ফল হিসেবে নিজের একটা পৃথক জগত হয়েছে। উপরন্তু মুখে সর্বহারার কথা বলা নেতাদের ভোগ সর্বস্বতা আর ব্যাক্তিগত বিরোধের চূড়ান্ত ছ্যাবলামি দেখে দলের স্থানীয় শাখার উপর এখন সেই সময়ের স্বপ্নদ্রষ্টারা অনেকেই বিরূপ। দীর্ঘদিন কোনও আন্দোলন নাই। দলের ভিত কুরে কুরে খাচ্ছে ক্ষমতা গুছাবার পোকায় আর আত্মসন্তুষ্টির বিষে। চিত্তরঞ্জনের লোকাল কমিটির সঙ্গে কেবল্‌সের লোকাল কমিটির এত বিরোধ যে কাজকর্ম লাটে উঠেছে প্রায়! এসব খবর হয়তো ওপর অবধি পৌঁছায় না, অথবা সব জেনে শুনেও ওপরওয়ালারা নীরব। বড় নেতারা ছোট নেতাদের হালকা সমালোচনা ছাড়া আর কিছু করারই ক্ষমতা রাখেন না, বরং সাধারণ কর্মীদেরই ঝড় ঝামলাতে হয় বেশি। দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করা স্থানীয় নেতারা কর্মঠ কর্মীদের দূরত্ব রেখে চলতেই অভ্যস্ত! আর কর্মঠ কর্মীদের মধ্যে এক পার্টির মুখপত্র বিক্রী ছাড়া অন্য কোনও কাজ দেখা যায় না। পড়াশোনার চর্চা তো নাইই, প্রশ্ন করার মত সচেতন হওয়া তো অনেক দূরের কথা! বহু কর্মী, সৎ লোক বসে গিয়েছে! তাও শিল্পাঞ্চলের ইউনিয়নভিত্তিক পার্টি, এর সঙ্গে কৃষিজমি যুক্ত থাকলে পার্টির অবস্থা কী হত বলা মুশকিল! তারপরেও লিসার পার্টির উপর যে পুরোপুরি ভক্তি উড়ে যায় নাই তার প্রধান কারণ বিজনের মতো টিকে থাকা কিছু সৎ লোকজন। যারা পার্টিটাকে এখনও ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

লিসার পাশে বেতের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বিজন। তার ভুরুতে উদ্বেগের চিহ্ন তখনও স্পষ্ট। যতক্ষণ বাজারে থাকবে চিন্তা তত বাড়বে। কিন্তু আজকে তো বাজারেও ভিড় খুব বেশি হওয়ার কথা নয়! শুরু থেকে যারা মালসংগ্রহ করছিল সেই ভিড়টা অনেক কমে এসেছে আজকাল। এখন বাজার বেশ ফাঁকাই থাকার কথা। তার মধ্যে গরম! বাইরে লু বইছে। বিজনের নিচের তলাটা খুব একটা গরম হয় না, বেশ ঠাণ্ডা! এসির পাট রাখে নাই সে। লিসার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে বিজন বলে, “এর মধ্যে খবর শুনলে তো! একটা বাঘিনীরও নাকি করোনা হয়েছে! তাজ্জব সব ব্যাপার স্যাপার ঘটে চলেছে!” লিসা ভুরু নাচিয়ে বলে, “তুমি কি প্রকাশকে দুধ দিয়ে যেতে বারণ করার কথা ভাবছ নাকি?” একসঙ্গে এতদিন ঘর করার এই সমস্যা! নাড়ি নক্ষত্র সব চেনে লিসা! বিজন আরো নার্ভাস একটা হাসি হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষণে লিসার মুখে হাসির দাগ স্পষ্ট। বিজনের ভারি অপ্রস্তুত লাগে! এরকম প্রাইভেসির অভাবটা কি ঠিক? একটু নার্ভাসনেসই না হয়! তবু তো নিজস্ব! ভেবে দেখতে গেলে তার বিরক্ত হবারই কথা! কিন্তু বহুদিন পরে সারাদিন দুজনেই একসাথে থাকতে থাকতে তারা আবিষ্কার করেছে তাদের দুজনেরই সহ্যশক্তি বেড়েছে। আগের মতন আর বিরক্তির উত্তাল উদ্দাম প্রকাশে দুজনের কেউই খুব একটা আগ্রহ বোধ করে না। পাশের বাড়ির উচ্চকিত অনর্গল ঝামেলার শব্দ তাদের আরো স্নিগ্ধ করে তোলে। বিজন যেন পার্থক্যটা আরো বেশি বুঝতে পারে। বরং ছেলেটার সঙ্গেই কথায় কথায় লেগে যায় আজকাল! দুইজনেরই!

এ কথা সেকথায় লিসা বলে, “কতদিন রাখবে বোঝা যাচ্ছে না গো! মাইনে টা না বন্ধ হয়ে যায় এরপর! আজ তো প্রায় সাড়ে চার হাজার আক্রান্ত দেখাচ্ছে। এর মধ্যে মোদি যদি লকডাউন তোলে, কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছ? শুনছি টানা ৪৯ দিন করা নিয়ম নাকি?” বিজন বলে, “হতেও পারে, মাইনে বন্ধ হয়ে যেতেও পারে! এই অবস্থা থেকে উঠতে গিয়ে যা ধাক্কা খাবে তাতে করোনার থেকে অনেক বেশি লোকজন মারা যাবে।”
হ্যাঁগো! কত হাজার লোক দেখেছ? সব রাস্তায়! ইশ্‌শ্‌শ্‌! আমরা তো অনেক ভালো আছি!
আরে আমি দেখি নি? ডি আই এফ আরের মিটিং-এ যখন দিল্লি যেতাম, পার্টি অফিসে একবার না একবার দেখা করতামই! করোলবাগের পিছন দিকে দু তিন হাত ঘেঁষা ঘেঁষা সব গলি, বুঝলে তো! গলির দুধারে, যেমন দিল্লিতে থাকে আর কি, চার তলা পাঁচতলা বাড়ি। একেকটা তলায় দশ বারোখানা করে এতটুকু টুকু রুম! আর সেখানে প্রত্যেক রুমে গাদাগাদি করে পনেরো ষোল জন সোনার কাজ করছে। সেগুলো এখন তো সব বাড়ি ভাড়া ছাড়িয়ে দিচ্ছে! কাজ নেই, থাকার জায়গা নেই, খাবার কিছু নেই, কী করবে? মুম্বইতেও এরকম আছে প্রচুর! মাইতির ব্যাটা পালিয়ে এল দেখলে না সেবার! বলে খাওয়ার মধ্যে ভাত আর ডাল, সে ডালে ডালের দানা খুঁজে পাওয়া যায় না! সে তো এমনি সময়ে, এখন দেখ গা সেটুকুও নেই। আশেপাশের বস্তিগুলোতেও কেউ এখন আর এদের থাকতে দেবে না। এখন সবাই বেরিয়ে পড়েছে পরিবার নিয়ে মালপত্র নিয়ে দেশের বাড়ির দিকে! আয়রনি হল যে দেশে ৯০ শতাংশ উদ্বাস্তুর বাস, সে দেশে মোদি করবে এন আর সি!
ভাবা যায় বলো, কয়েকশো মাইল পথ হেঁটে বাচ্চা কোলে কাঁখে নিয়ে এক একজন বাড়ি ফিরছে…রামলালদা ঠিকই বলেছে…বহুলোক এদিক ওদিক মরে পড়ে থাকছে, কোনো খবর হচ্ছে না…
সে তো হচ্ছেই…
আরে শুধু রাস্তায় না, এদেশের ফুটপাত কোটি কোটি মানুষের থাকার জায়গা…সবথেকে বেশি মরছে তারাই…কতটুকু আর রিলিফ!

বিজন রিলিফের প্রসঙ্গে অত্যন্ত বিরক্ত হয়। “আর রিলিফ! কোটি কোটি টাকা ঝেড়ে সব ফাঁক করে দিচ্ছে, তার মধ্যে রিলিফ! অমিত শা কে দেখেছ একদিনও এর মধ্যে? দেশে আছে কিনা তাই বোঝা যাচ্ছে না! এদিকে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনোরকম উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে টিভিতে এসে আধঘন্টা ধরে শুধু জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছে, কী, না ঐ থালা বাজাও, আলো জ্বালাও…শুয়োরের বাচ্চা! কী কী করলি, কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটা বল! আর পাবলিকও হয়েছে সেরকম! সফ্ট হিন্দুত্ব খেলতে পেলে বোঝা যায় এদেশে একশো জনের মধ্যে একশো জন সাম্প্রদায়িক!” লিসা এই কথায় একটু ক্ষুণ্ণ হয়, “তুমিও নাকি?” বিজন বলে, “একশো তিরিশ কোটির দেশে তুমি আমি এত নগন্য যে তারা হিসাবের মধ্যেই আসি না…আর সাম্প্রদায়িক যে নই তা তো আর হলফ করে বলতে পারি না আজকাল…পুরো দেশটা শেষ হয়ে গেল! সিপিএম যে কী বামপন্থার চর্চা করল এতদিন! সমস্ত পার্টি— সিপিআই, সিপিএম, আমরা কেউই যে সাধারণ স্তরে বামপন্থী আদর্শ নিয়ে খুব একটা ঢুকতে পারি নি সেটা স্পষ্ট, লড়াইয়ের উন্মাদনা নিয়ে মানুষ খেপিয়ে তোলাটা সহজ যদি আদর্শের চপ্পলটা দরজার বাইরে পড়ে থাকে! ” লিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিজন সেইদিকে তাকিয়ে বলে, “আর এই যে আমরা নিজেদের সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে মনে করছি, অথচ প্রসূনের মুখে শুনে ঘটনাটা তো তুমি বিশ্বাস করেছিলে!” লিসার এবার আর কিছুই বলার থাকে না। পরশু রাতের দিকে লিসা প্রসূণের কাছ থেকে খবর পায় চিত্তরঞ্জনে দুটো কোয়ার্টারে প্রায় চল্লিশ জন মুসলিম পালিয়ে এসে লুকিয়ে ছিল। এরা নাকি নিজামুদ্দিনের সঙ্গে জড়িত সবাই। করোনা ছড়াতেই এসেছিল। চিত্তরঞ্জন কর্তৃপক্ষ ওয়ার্ডেন আর ভাইস ওয়ার্ডেনকে সাসপেন্ড করেছে। পুলিশ সবাইকে তুলে নিয়ে গেছে। শুনে লিসার তো হাত পা ঠাণ্ডা। বিলু অবশ্য বিশ্বাস করে নাই। বলেছিল, ‘ধুর! এই সময়ে ইসলামোফোবিয়াটা কাজে লাগাতে চাইছে লোকাল বিজেপি। কেন আজেবাজে খবর বিশ্বাস করছ মা?” প্রসূন যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য সূত্র, প্রসূনের কথা…আর তাছাড়া সে বিজেপিকে পছন্দও করে না! সবেতেই বিজেপি দেখাটা বিলু আর বিলুর বাপের একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল লিসার। বিজন পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে পুলিশ তুলেছে ঠিকই, চল্লিশের কাছাকাছি সংখ্যাটা তাও ঠিক। এরা এসেছিল আত্মীয়ের ছেলে হওয়ার পর মুসলিমদের কী একটা অনুষ্ঠান হয়, তার সম্পর্কে বিশদ বিজনও জানে না, খবর নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করে নাই, সেই অনুষ্ঠানে। দুটো খালি কোয়ার্টার, যার বাড়ির অনুষ্ঠান, সেই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল আত্মীয়দের। ইতিমধ্যে আচমকা লক ডাউন হওয়ায় কেউই আর ফিরে যেতে পারে নাই। ওয়ার্ডেন ভাইস-ওয়ার্ডেনকেও শো কজ করা হয়েছে মাত্র! গসিপ মঙ্গারদের আশানুরূপ শাস্তি হয় নাই। এরকম অসংখ্য ঘটনা হয়েছে পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থাহীন আচমকা লকডাউনের ফলে। কিন্তু সেটা বড় কথা না। বড় কথা এই বিশেষ করে মুসলিম ও নিজামুদ্দীনের প্রসঙ্গ তুলে ধরাটা- বুলুর প্রশ্ন ছিল সেটাকে নিয়েই! অনুষ্ঠানটা সম্পর্কে বিজনের উদাসীনতা নিয়েও বুলুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। কাজেই এখন সে প্রসঙ্গটা উঠে আসায় দুজনেই চুপ করে যায়।

ইতিমধ্যে ফোন আসে বিজনের শালির। প্রথমেই হাঁউমাউ করে ওঠায় বিজন বলে, “আস্তে বল্‌! কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না!” এই একটা কাজ বিজন বেশ নিয়ম মাফিক করছে। লিসা বা বিলুর মতো বই পড়া তার স্বভাবে নাই। ফলত রোজ নিয়ম করে দশ বারোজনকে ফোন করে খবর নিয়ে গল্প করেই তার অনেকটা সময় কেটে যায়। তা শালির কাছ থেকে খবর আসে বিজনের ভায়রা মুখে মাস্ক টাস্ক না বেঁধেই বেরিয়ে পড়েছে কোথায়! তাই নিয়ে রাইয়ের উদ্বেগের শেষ নাই। বিজনের ভায়রা একই পার্টির হোল টাইমার। তাই রাই আগেই নেতৃত্বকে নালিশ করেছে। সেখান থেকে এখনও কোনও ব্যবস্থা না হওয়ায় ফোন করেছে বিজনকে! বিজন বললে যদি শোনে! “সেকিরে? এই অবস্থায় কোথায় বেরোলো?” রাই একটু দম নিয়ে বলে, “আরে নজরুল বাগের অবস্থানেরই কয়েকটা ছেলে, আদিবাসী এলাকাগুলোতে রিলিফ পৌঁছে দিচ্ছে! ওরাই ওকে ফোন করেছিল। ব্যাস! বেরিয়ে গেল! কিচ্ছু নেয় নি! উল্টে আমি বলতে গেলাম বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কতগুলো কথা আমাকে শুনিয়ে গেল!” এটা কোনও নতুন ব্যাপার না! রামলাল আর রাইয়ের সংসারে এই অশান্তি বারোমাসই লেগে থাকে। ইদানীং লকডাউনে আরো বেড়েছে। রামলাল এবং রাই, দুজনেই সারাক্ষণ কাজ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু ঘরে বসে বসে রামলাল যতটা হাঁফিয়ে উঠেছে রাই ওঠে নাই, ফলে এক দুদিন অন্তর অন্তর রামলালের এই কোথাও বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা নিয়ে ঝামেলা এখন দুজনের মধ্যে তুঙ্গে। বিজন ভাবে কত মানুষ এভাবে একসঙ্গে থাকে শুধুমাত্র সত্যিটা মেনে নেওয়ার সাহসের অভাবে! তারাই কি সব সত্যি মেনে নিতে পারে? লিসার সঙ্গে সুপর্ণর কী সম্পর্কটা……না না ধুর! কী যে ভেবে ফেলছে না! ঘরে থাকতে থাকতে তার মাথাটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ! যাই হোক, পুরো ব্যাপার যা বোঝা গেল, নজরুল বাগে আসানসোল ও তার আশে পাশের মুসলমানদের একটা দীর্ঘদিন ব্যাপী অবস্থান চলছিল এন আর সি-র বিরুদ্ধে! শাহিনবাগের অনুসারেই বলা যায়। বিজন নিজেও বহুবার গিয়েছে সেখানে! লিসাও গিয়েছে। রামলাল আর রাই তো পার্টির তরফ থেকেই দেখাশোনা করত ওদের কিছু প্রয়োজন কিনা! সেই অবস্থান তারা তুলে নিয়েছে লকডাউনের পর। এখানেও বিজনের একটা প্রশ্ন আছে! সরকারের কাছে করোনা নিয়ে খবর ছিল ডিসেম্বরের শেষ থেকে! তারপরেও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধের ক্ষেত্রে এই উদাসীনতার কারণটা কী? এন আর সি, সি এ এ নিয়ে বিজেপি ব্যাকফুটে ছিল। অবস্থানটা ঝালিয়ে নেওয়া হল কি? যে কোনও ন্যাচারাল ক্যালামিটির ক্ষেত্রে সরকারের ভগবান হয়ে ওঠার একটা অবকাশ থাকে। কারণ সেই, ভয় শিদাঁড়াকে নমনীয় করে! সেই জন্যেই কি করোনাকে খানিকটা ছাড় দেওয়া হল? একেবারে অপদার্থতা ভাবতে অসুবিধা হয়! ডেস্পারেশন আর প্যারানইয়ায় যে কোনও স্টেট যে কতদূর যেতে পারে তার বহু উদাহরণ রয়েছে। এখন আক্রান্তের সংখ্যা চেপে দিয়ে করোনা সেভাবে ছড়ায় নাই বলা হচ্ছে। গতকালই দুখানা পজিটিভ বেরিয়েছে আসানসোল থেকে। চেপে দেওয়া হয়েছে। ভিতরের খবর! ষোলো লক্ষ ভারত ফেরতের মধ্যে চার লক্ষ পোটেনশিয়াল ক্যারিয়ার! আর টেস্ট হয়েছে কতটুকু? সেখানেও আম্বানির স্বার্থ দেখছে সরকার! ওয়র্থলেস! সেই সুযোগে অবস্থান আপনিই উঠে গেল সব! প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম পঞ্চাশ টাকা করে দেওয়া গেল! সিনিয়ার সিটিজেনদের সুবিধা তুলে নেওয়া গেল! এবং সবটাই নির্বিবাদে! সর্বোপরি লকডাউন হল মধ্যপ্রদেশের ইলেকশনটার পর! কংগ্রেস জেতার পরে এম এল এ কিনে নিল বিজেপি সরকার! তার আগে অবধি কিন্তু লকডাউন করে নাই সরকার! স্কুল কলেজ বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই! এমনকি রাজ্য কেন্দ্রের আগে লকডাউন ঘোষণা করেছে! কী যে হচ্ছে সবটাই ধোঁয়া ধোঁয়া! নজরুল বাগের অবস্থান উঠে যাওয়ার পর ছেলেগুলি রিলিফ সংগ্রহ ক’রে খুবই সংগঠিত ভাবে প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকা গুলোতে রিলিফ পৌঁছে দিচ্ছে। রামলালকে ফোন করলে রামলাল জানায়, ইসমাইলের অনুরোধেই ওদের জন্য রিলিফ সংগ্রহ করতে বেরিয়েছে সে। বিজন বলে, “তা প্রোটেকশান না নিয়ে বেরিয়ে কাজটা ঠিক করো নি! আর দশজনকে বিপদে ফেলার কোনও অধিকার তোমার নেই! খুব ভালো কাজে সাহায্য করছো, অ্যাপ্রিসিয়েট করছি। গরীবের জন্য কাজ করতে গিয়ে মরাটাও সম্মানের! কিন্তু গাধামি করে মরাটাকে সমর্থন করা যায় না, বুঝলে! আর দশটা লোককে মারার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? পার্টি জানে? তুমি একজন হোল টাইমার, এরকম রেকলেস ব্যবহার তোমার কাছ থেকে আশা করা যায় না! বাড়ি গিয়ে মাস্ক পরে এসো! আর সব হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে জামাকাপড় কেচে নিও। কই, পাঠাও, গুগল পে-র নাম্বার পাঠাও, আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি ওদের!” টাকাটা পাঠাতে পাঠতেই বিজন ভাবে এইসব খবর কিন্তু খবরের চ্যানেলগুলো শিরোনাম করে না। মানুষও এইসব ব্যক্তিগত উদ্যোগে রিলিফের দায়িত্ব নেওয়া যুবকদের ধর্ম খুঁজতে চায় না! অথচ বামপন্থীরাই নাকি পক্ষপাত দুষ্ট! ছোঃ! এমন শিক্ষার মুখে মুতি!

ছেলেটা এখনও আসছে না কেন? পুলিশে টুলিশে আটকালো না তো? ঘরের থেকে বেরিয়ে উঠোনে নেমে দাঁড়ায় বিজন। গেটের দিকে পাশের বাড়ির ছায়া পড়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে অস্থির ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই সুরেশ বেরিয়ে আসে সামনের বাড়ি থেকে। বাড়িটা একতলা, মাটির গাঁথনি, টালির চাল। গাঁয়ের দিকে কিছু ঘোষদের শরিকদের কপালে গরুও জোটে নাই, চাকরিও জোটে নাই। সুরেশ ঘোষের বাপ চালাত অটো। আর সুরেশ হয়েছে এল আই সির দালাল। খুব একটা ইনকাম নাই এ পড়ন্ত অঞ্চলে। ফলত, বাড়ি ঘর দোর খুব একটা গুছিয়ে উঠতে পারে নাই সে। সুরেশের পেছন পেছন তার বছর চারেকের ছেলে টলমল করতে করতে বেরিয়ে এসে সুরেশের পায়ে ধাক্কা দেয়, “বাবা, বাজাল লিঞ্চল…” অনেকক্ষণ থেকেই সে দাবিটা বগলে চেপে ঘুরঘুর করছিল বাপের আশে পাশে। ঘরে মায়ের মারের ভয়ে খুব একটা দাবিটাবি গুলো সে আজকাল জানাতে পারছে না। এতক্ষণে বাবা বেরিয়ে আসায় সুযোগ পেয়েছে। বাপের সঙ্গে বাজার বেড়ানো তার রোজকার শখ। এই কদিন তা একদম বন্ধ। প্রথম প্রথম চান করব না বলে বিকট চিৎকার করছিল, এখন তাতে খুব একটা চিঁড়ে ভিজছে না দেখে চুপ মেরে গেছে। মায়ের উপর তার খুব একটা ভরসা নাই। কাজেই একান্তে বাবার কাছে আর্জি জানাবার সুযোগটা সে কাজে লাগায়। বিজন তাকে হাসতে হাসতে বলে, “অ্যাহ্ই হতভাগা! বাইরে বেরোনো একদম বন্ধ এই কদিন। একদম না।” সুরেশ তার দিকে তাকিয়ে বলে, “শুনলি দাদু কী বলল!” ছেলের মুখ দেখে বোঝা গেল এই অবাঞ্ছিত দাদুর উপস্থিতিতে সে মোটেও খুশি হয় নাই। বিড়বিড় করে কি একটা বলতে বলতেই বোধহয় এক ছুটে সে ভেতরে চলে যায়। সুরেশ বলে, “এদিককার খবর শুনলেন তো?”
হ্যাঁ! আর কী বলবে বলো! কাল অবধি সব গল্প করেছে সবার সাথে…
আরে সেই জন্যই তো ভয়! বুঝলেন না!
তা তোমার তো ব্যবসা বন্ধ।
দালালদের আর রোজগার কাকু! জমাতেও তো তেমন কিছু পারি নাই যে বসে বসে খাব। আজ আছি, দুদিন পরে বিরাতেই হবে কিছু একটা দেখতে…
আর কী বলবে জিনিষপত্রের দাম যা বাড়ছে! সাধারণ মানুষ খাবে কী করে কে জানে। বস্তা বস্তা চাল আঁটা তুলছে সব! আর এ সময়ে দাম বাড়াতে বোধহয় মানুষই পারে একমাত্র…
আসলে কাকু ভয়। দশজনকে দিয়ে খাও! নিজে খাও, কেউ বারণ করছে না! কিন্তু পাড়ার আর দশজনের কথাটাও তো আমাদের ভাবতে…… ঐ যে বিলু এসে গেছে? বাজারে গেছিলে নাকি হে?

বিজন কিছু একটা বলার চেষ্টা করে, পারে না। গেটের ওপর লতিয়ে ওঠা মাধবীলতা সবে একটা দুটো ফুল ছাড়তে শুরু করেছে! তার ফাঁক দিয়ে সুরেশের ঘরের দুয়ার দেখা যায়। দুয়ার উঠে এসেছে একদম গাঁয়ের রাস্তার উপর! এইদিককার গাঁয়ে বাড়ির এটাই বৈশিষ্ট্য! রাস্তার উপর ঘর, গোয়াল ঘর! সরু গলি দিয়ে ভিতরে ঢুকে বড় উঠান আর এক পাশে পায়খানা বাথরুম। সেই দুয়ারের ওপরের ঢালাইয়ের দুদিকে দুটো ঠাকুর দেবতার ছবি বসানো! সুরেশ গ্র্যাজুয়েট! এ নিয়ে বিজন বেশ আমোদ অনুভব করত। শিক্ষিত হয়েও কী অবস্থা, অ্যাঁ? দরজার ওপরে দিল দেবদেবীর ছবি লাগিয়ে। তার নিজের ঘরে এসবের পাট নাই, ছিলও না কোনদিন। কিন্তু আজ, এই মুহুর্তে বিজনের বুকের খাঁচার ভিতর অজান্তেই বাস করা সেই ভয়টা বীভৎস ভাবে নখ দাঁত বার করলে তার মাথার ভিতরের চোখকানগুলো অত্যন্ত ভোঁতা হয়ে উঠতে থাকে! সুরেশের চোখের থেকে বিজন চোখ নামিয়ে নেয়। মাথার ভিতরে অনেক কিছু একসঙ্গে ছিঁড়ে এসে দলা পাকিয়ে যেতে থাকলে একটা অদ্ভুত বয়স সংক্রান্ত অসহায়তা তাকে পেয়ে বসে। এর আগে এমন বোধ হয় নাই কখনও। বন্ধু বান্ধব যখন ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছিল কলিজার খানিকটা খানিকটা করে, তখনও সে দাঁতে দাঁত চেপে ছিল। কিন্তু অসহায় সে কখনও বোধ করে নাই! আজ মনে হয় সে তার নিজের সময় পেরিয়ে এসেছে। আদর্শটা রয়েছে বটে, তবে সময়ের স্রোতে আঁজলা করে যেটুকু নিজের জন্যে তোলা যায়, সেটুকুতে আদর্শের যে প্রতিফলন পরিষ্কার দেখা যায়, এই বয়েসে এসে সেই আঁজলা যখন প্রায় খালি তখন আর তার অস্তিত্ব কাউকেই খুব একটা বোধহয় স্পর্শ করে না। বিলুর সঙ্গে সুরেশের কথাবার্তাও আবছা হয়ে আসতে থাকে ধীরে ধীরে। শুধু বিজনের সামনে দিয়ে বিলুর মোটরসাইকেলের পিছনে বাঁধা দুখানা পঁচিশ কেজির চালের বস্তা একটা সময়ে মোটিফ হয়ে ওঠা পুলিশের গাড়ির পিছনে বাঁধা আদর্শের লাশের মতোই অবিকল গেট পেরিয়ে তার উঠোনে উঠে আসে।

Facebook Comments

Leave a Reply