লকডাউনের মিউজিক্যাল দিনলিপি : সংযুক্তা পাল
[সংযুক্তা পাল। কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। শিক্ষকতা পেরিয়ে সংযুক্তার যাপন সৃষ্টিশীলতায়। ‘লকডাউন’-র দিনগুলো তিনি কেমন কাটাচ্ছেন, কি ভাবছেন, মুহূর্তে সুর লাগছে কেমন—পাঠিয়েছেন আমাদের এক ভিডিও রেকর্ডিং ও গদ্যের এর মাধ্যমে। আমরা রাখলাম আপনাদের সামনে।]
দীর্ঘ সময়… বন্ধ দরজা…স্পর্ধিত পৃথিবীর বিষণ্ণ মুখ কেবেলের তার ছুঁয়ে শিরা-উপশিরা, তবু আসমানি রং… প্রিয় গানের কিছু কলি উদ্বায়ী নিঃশ্বাসে প্রাণ ঢেলে দেয়। কিছু খোয়াব জন্ম হয়ে কথা বলার রাস্তা তৈরি করে নিজের সঙ্গে; আমি রঙিন কাঁচে মেহেফিল সাজাই বেরঙিন দিনে।
আঙুল হারমোনিয়ামের রিড ছুঁলে এখনো আগের মতই স্বর্গ নেমে আসে। ভূপালীর জেনানা মহলে মীড় আর তানের কোলাহল এভাবে শোনা হয়নি অনেকদিন।ত্রস্ত সময়… সংক্রমণ… বিপন্ন সঞ্চয়ের উদ্বেগ প্রাত্যহিক ফিরে আসে মগজে;
সুরের রোশনাই এ দরবার বসাই ভিতরের একান্ত মগ্ন আমির সৃজনশীলতার। স্মৃতির গন্ধে লেপ্টে রাখতে ইচ্ছে হয় নিজেকে,পাছে দুঃস্থ সময় গ্রাস করে নেয় অস্তিত্ব।
আসলে একটা ভাইরাস খুলে দিয়েছে প্রকৃতির হাঁ-মুখ; উদ্গত লাভা আবার তার সঙ্গে কোকিলের ডাক, গাছের সবুজ রং, জলের স্বচ্ছতা। সত্য মৃত্যুভয়, খিদের চিন্তা, মুক্তির সংকট এমনকি দিন দিন সত্য হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক শক্তির হাতে পর্যুদস্ত অবদমিত সত্তার বিকার, ঠিক তেমনি সত্য বিশ্রাম এবং চেতনার ওঠাপড়া। মনগড়া এক আত্মকল্প কখনো গান কখনো বা কবিতা হয়ে নিজের অজান্তেই রচিত হয়ে যায় পছন্দের মুহূর্তকে কাছে পাবার বাসনায়। সৃষ্টি তার দাবি নিয়ে চোখ বুজলে ঝড়ের মত আসে,চোখ খুললেই চলে যায়। চোখে লেগে থাকে তৃষ্ণা।
শূন্য রাস্তাঘাট—তাড়া নেই হেঁটে রাস্তা পেরোবার, শূন্য স্কুলঘর—ভিড়ে ঠাসা কচি নরম হাতে দিদিমণির জন্য রাখা নেই জংলি ফুলের গোছা,মিড্ ডে মিলের ঘণ্টার আওয়াজ… খিচুড়ির সান্ত্বনা…তাও নেই; এমন নেই দিনগুলোর বোঝা ক্রমশ ভারী হয়ে এলে ছাদে পায়চারি…
সুপুরি গাছের ফাঁক দিয়ে সন্ধে দেখার অনভ্যস্ত খেয়াল… এলো চুল ওড়ার ফাঁকে হঠাৎ-ই জানান দেয় আরো স্বাদ লেহন করা বাকি,
আরো স্বপ্ন মন্থন করা বাকি—গাঢ় রাত্রির চিৎকার একদিন বদলে যাবে ভোরের প্রসববেদনায়; তাইতো
‘চিতায় বসে রোধ করে মন্ত্রের বিপর্যয়,
একা এক রাসায়নিক শব্দ বিক্রেতা।’
Posted in: April 2020, Cover Story