ঘাস ও লতাপাতা সরিয়ে একটা চাকা পাওয়া যাবে : সঞ্জীব নিয়োগী

১.

অসীম চালাকি নিয়ে হেসে থাকি। স্বেচ্ছায় বড় হয় অন্যমনের দাড়ি। হাত নাড়ি, খুব ঘুঘু এক মেশিনের দম দেওয়া মাত্রায়। তুকতাক, ইন্দ্রজাল, টোটকা, ঝাড়ফুঁক এইসব হেথায় চিরকাল উপাদেয়। ফলোয়ার কমে গেলে ঝালিয়ে নিতে হয়, পাদপ্রদীপের গুণ।
ছবির স্মৃতি নিয়ে বড় হয় রাষ্টের সীমাহীন বুর্বকি। ঘুরপাক খাওয়া সূত্র ও ফুটনোট নিয়ে বিবেক কচলে থাকার আরেক নাম স্বাতন্ত্র্য। তোমাকে বলার ছাড় দেওয়া হলো না-বলার মন্ত্র শিখে নেবার শর্তে। হাবুডুবু খাবার মতো সততা আর পারে কে গো এই বারোভাতারি মেলায়।
গোড়াতেই তোমার দেখাটাকে আমি উল্টো দিকে ঘুরে দেবার বিদ্যে জানি সোনামনা। সেদিন খুব জবাই করা হবে আর রক্তে ভাসবে হৃদয় নদী, কান্না যদি উৎপাদন ঢেকে দেয় তো ভারি লস হবেক মাইরি সস্তা শ্রমের মক্কা জ্ঞানে চৈত্রের বাজারে। তাই অদিকের আতংক ভুলিয়ে তোমায় বললাম দেখিও রামছাগলের ফুলগাছ খাওয়ার দৃশ্যটা যেন মিস না করো প্রাইম টাইমে! না বাপু, এরচেয়ে সহজ করে বোঝানোর টাকা আমি অগ্রিম নিইনি কারো কাছে।
তবে সত্যের কালোবাজারি খুব অচিরেই একটা রোজগারমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটিকে কপি পেস্ট করে ট্রেন্ড উপস্থাপিত করা হয়েছে এবং কাদের অনুসরণ করতে হবে তা যথা সময়ে বলে দেওয়া হবে। বেশ? এই অব্দি বোঝা গেছে? চলো!

২.

এটা লংমার্চের দিকে আর যেতে পারে না। নানাদিক ঘুরে দিশাহারা প্রাণভিক্ষা চায় শুধু। তাহলে রসদটুকু নিঃশেষ হবার অপেক্ষা করছে কি মহাকাল?
কেউ আর এদিকে প্রতিভা নষ্ট করতে আসে না। ব্যক্তিগত ক্রয়শক্তি বৃদ্ধি করাই যে প্রকৃত তন্ত্র সাধনা, একথা আর গুজব নয়।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিপুল জনসংখ্যার চাপে নানান সমস্যায় জর্জরিত ও অপ্রতুল পরিকাঠামো সম্পন্ন এক ভূখণ্ডের শাসক অনেক সময়ই হাজার হাজার শ্রমিকের, দিন মজুরের আর ক্ষুদ্রতম রোজগেরের উদ্বেগ ও অসহায় অবস্থার আশু সদুত্তর দিতে পারেন না।
আচ্ছা, কেন হলো না?
কী বে? কী হলো না?
মরতে মরতে বাড়ির দিকে, গ্রামের দিকে ফেরার দিশামুখ কেন একটা বড় প্রশ্নের ফলা হয়ে ছুটে গেলনা সিংহাসনের দিকে? কেন বেঁকে বসল না মাঝপথে নাচার ইচ্ছার বমি!
হলোগ্রাম তোর পাছায় ঢুকিয়ে দিব বে চুতমারানি! -সে এইরূপে আমার সম্মুখে উদ্ভাসিত হইলে আমি যার পর নাই অসুস্থ বোধ করলাম সাজেশন অনুযায়ী রাজ্যপাট সাজিয়েও শেষরক্ষা হচ্ছে না অনুমান করে আর তখনই। আর তখনই নাটকীয় ভাবে যা হবার কথা তাই হল। চ্যাংদোলা করে হারামির বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে খাপে খাপ করে দেওয়া হলো। …উঃ। বাঁচা গেল। কেবল শালারা বিশুদ্ধ প্রশ্ন করে যায় প্রশ্ন করে যায় করে যায় যায়…
(সংলাপের আদলে আদলে যেমনটি অনেকদূর পাখি উড়ে যায়, কথার ছলনায়, ততক্ষণে। মাটির ভেতর থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেল যেন, না এখানে পুরাতত্বের কচকচি নেই, সবই ডলারে। )

৩.

তবে, তোমাদের কার কার গায়ে সরাসরি এসে লেগেছিল ওই গণ-স্প্রে, হাঁটু মুড়ে বসে থাকা পরিযায়ীদের সহমর্মে? কাদের গায়ে, বলো, হাত তোলো! … তোমরাও ছিল? বটে? গায়ে লেগেছে তোমাদেরও? কেন, তোমরা কি দেশপ্রেমহীন?
তোমরা কি একটা চাকা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত বোধ করছ? রমণ-ক্লান্ত? নাকি মরণ-ক্লান্ত? মাদারইন্ডিয়া তোমাকে কোলে নিয়ে দদন দেয়না? তোমাদের কি রিকেট জাতীয় কোনও সংগ্রাম আছে? এই দেখ, বিশুদ্ধ প্রশ্ন উঠে আসছে গো, পরপর। আচ্ছা, তোমাকেও কি বলা হয়েছিল, প্রশ্ন করার শিক্ষা গ্রহণ করতে? ইস, আবার একটা প্রশ্ন হয়ে গেল। আচ্ছা যাক, স্টেটমেন্টের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যাক এসো, কেউ চিনতে পারবে না তীক্ষ্ণ ফলা গুলো।
লিখে ফেল পঞ্চম বাহিনীর গান…
আর কোনও প্রশ্নচিহ্ন যেন গায়েগতরে প্রকাশ্য সমাবেশের নামাবলি চাপিয়ে বাটি না চমকায় নিত্যযাত্রীর ঢেকুর নিপীড়িত সরদারিতে। অপুষ্টি জনিত ছবির ধকল গিয়ে টোকা মারে সাদাবাবুদের অনুমোদন তিয়াসি। তাতে গৌরব আসে শিল্পের ও প্রতিনিধিত্বের। নানান গুণাবলী ঘটে সে বাবদ।

৪.

নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রস্তাবিত উপাসনালয় তৈরির ব্লুপ্রিণ্ট সংক্রান্ত আলোচনা: হওয়ায় অনেককিছু ভেসে থাকে। যথা মিথ্যাচার।লোভ বেশি ছিল। যা ছিল তা ছিল পরতে পরতে লালার হিসহিস। অনুরূপ উৎপাদিত পণ্যের বাজার এলাকায় রক্ত আর শান্তির হাসি। কেননা মোটা-বুনটের (coars texture) জীবন সহজে হার মানেনা। অনেক অনেক অবহেলার ঘাস জমে গিয়ে চাকাটা হারিয়ে গেছে।
একটা বারো বছরের বাচ্চা মেয়ে মরিচ বাগানে কাজ করতে গেছিল। একা, পরিবারের কারো সাথে নয়। নিজের ও বাড়ির লোকের মুখে অন্ন যোগানের সুরাহা করার আশায়। অতিমারীর প্রকোপ থামাতে তালাবন্দির ঘোষণার পর অসহায় মেয়েটি তিন দিনের হাঁটা পথে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। ফিরছিল। কিন্তু ওই ছোট্ট শরীর অনাহারের আর অপরিচিত পথের ভয় ও ক্লান্তির ধকল সইতে পারেনি। ঘরে পৌঁছনোর আগেই শুয়ে পড়েছে অবহেলার ঘাসের শয্যায়। মরার আগে কি সেই হতভাগ্য ঘাসের বাড়বাড়ন্তর মধ্য অসহায় হাত চালিয়ে শেষ বারের মতো খুঁজে পেতে চেয়েছিল হারিয়ে যাওয়া চাকা? নাকি সেই অনুসন্ধানেও মাথার দিব্বি দেওয়া আছে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ? অধিকারের প্রশ্ন এসে কি বিরত করতে চেয়েছিল তাকে?
লজ্জার দায় কেউ নিতে চায় না। এই মৃত্যুর আসামি কেউ চিহ্নিত হয় না। পরম অবিচল নিরহংকার নিনির্মেশ সেবকেরা নির্বিকার হাসিমুখে কথা বলে যায় কামনাবিহ্বল, জাদুকাঠির মাপে। দেশে দেশে যুগে যুগে।
কোথাও থেকে প্রত্যুত্তর, অতি ক্ষীণ হলেও ভেসে আসার ভয়ে হারিয়ে যাওয়া এবং এর মধ্যে দিয়ে চলে যায় শতাব্দীর দিকে ধাবমান স্বকীয় স্বদেশ।

অশিক্ষা অপুষ্টি আর অবহেলায় জর্জরিত কত কত মানুষের কাছেই তো রোগের ভাবনা শৌখিনতা, ভাতের ভাবনা তাদের ভাবায়। তারা প্রিভিলেজড নাগরিকদের মতো উদ্বিগ্ন নন, এমনকী বেশিরভাগ মানুষ জানেনই না গণতন্ত্র দেশ রাষ্ট্র এবং অতিমারী কী, খায় না মাথায় দেয়! এরকমই কোনও গ্রামের বৃদ্ধ মোড়লের সাথে আমাদের বিভিন্ন অন্তরালে সাক্ষাৎ হয়। সেই স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে এবং লাগাতার, সাম্প্রতিক কালে অবধি। তিনি সকাল থেকে হাতে একটা লাঠি আর এক জারিক্যান ‘মহুয়া’ নিয়ে গ্রামের একপ্রান্তে পাকুড় গাছের নিচে বসে থাকেন, সেখান থেকে পুরো গ্রামটার উপর নাকি তিনি ‘নজর’ রাখেন আর মন্ত্র দিয়ে আপদ-বালাই দূরে হটিয়ে রাখেন। হয়তো মোড়ল জানেন, এখনও একটা কেউ খুঁজে পেতে পারে বহুকাল আগে ঘাসে ঢেকে যাওয়া চাকার অবয়ব। সেই আশায় তিনি গ্রাম আগলে বসে থাকেন। গ্রামের মানুষকে অভয় দেন, ” কোনও হারামির ব্যাটা যদি মরদের ব্যাটা হয় তবে বদ মতলব মাথায় নিয়ে হামাদের গাঁয়ে ঢুকে দেখাক! উ ব্যাটাকে এই গাঁয়ে ঢুকতে দিবক নাই! হামি বাঁচাবক, হামার মাদারইন্ডিয়া সরকার কে হামি বাঁচাবক! …..”

আর আমরা প্রতিবারই দেখেছি মোড়লের কথার মাঝখানে ইলেকশনের প্রচার গাড়ি হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আর তখন মোড়ল, স্বাভাবিক ভাবেই, কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েন। তবে প্রচার গাড়ি চলে গেলে আবার পুরোনো কথার রেশ ধরে এগিয়ে যেতে চান। কিন্তু কণ্ঠস্বরে তখনই আর সেই আত্মবিশ্বাস লেগে থাকে না। তাছাড়া দুয়েকজন যা শ্রোতা ছিল, তারা কখন প্রচার গাড়ির পেছনে পেছনে চলে গেছে।

Facebook Comments

Leave a Reply