গল্প : শঙ্কর দাস
লকডাউন
১
নারকেলডাঙ্গা স্কুল যাওয়ার রাস্তা দিয়ে কালো রঙের পুলিস ভ্যানটা ধীরে ধীরে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এসে গোলকালি মন্দিরের তেমাথায় থামল। এখান থেকে অন্য দুটো রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। তালপুকুর রোড শুনশান। কিন্তু হরমোহন ঘোষ লেনের উপর বেশ কিছুটা দূরত্বে একটা চায়ের দোকানের ঝাঁপ অর্ধেকটা খোলা ছিল। পুলিসের গাড়ীটা ধীরে ধীরে সেদিকে এগোতে লাগল। চায়ের দোকানের ভেতরে আধো-অন্ধকারে একটা কাঠের বেঞ্চে বসেছিল বাচ্চু আর খোকন। বড় একটা কয়লার উনুনের উপর চা ফুটছে। খেটুয়া হাত-পাখা দিয়ে উনুনের জানালায় হাওয়া মারতে মারতে হঠাৎ চাপা স্বরে বলে উঠল——
“অ্যাই, আর চা খেতে হবে না, যাও।”
বাচ্চু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আমরা খাবো না চা?”
বিরক্ত খেটুয়া ভর্ৎসনার স্বরে বলে উঠল—
“পুলিসের গাড়ী ঢুকেছে দেখছ না?”
“কোথায়? কীভাবে বুঝলি?”
“উল্টোদিকের রক থেকে ছেলে দুটো দৌড়ে গলিতে ঢুকে গেল দেখলে না?”
তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় বাচ্চু আর খোকন। দোকানে ঢোকার দরজাটার উল্টোদিকে নর্দমার ধারে আর একটা দরজা আছে। সেখানে বসে খেটুয়া এঁটো কাপ-ডিশ বাসনপত্তর মাজে। বাচ্চু আর খোকন ঐ দরজা দিয়ে লাফ মেরে নর্দমা পেরিয়ে তিন্নিদের কলপাড়ে গিয়ে পড়ল। টাইম কলের জলে তখন একবস্ত্রে স্নান করছিল তিন্নির পিসি জয়ন্তী। বাচ্চু, খোকনরা লাফ দিয়ে কলতলায় এসে পড়তে জয়ন্তী ‘ও মাগো’ বলে বুকের কাপড় টানতে টানতে তাড়াতাড়ি একপাশে সরতে গিয়ে শ্যাওলায় পা হড়কে ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ল।
অন্য সময় হলে অন্য কথা হতো। কিন্তু এখন বাচ্চুরা ফিরেও তাকাল না। তিন্নিদের বাড়ির ভেতর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে বিশ্বাসদের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে ওদের বাড়িতে ঢুকে গেল। তারপর পাঁচিলের গা ঘেঁসে জমাদারদের ঢোকার রাস্তা দিয়ে গিয়ে পেছনের গেট খুলে পাড়ার ভেতর ঢুকে গেল। জয়ন্তীর ‘ও মাগো’ চীৎকার আর আছাড় খাওয়ার ধপাস শব্দ শুনে বাড়ির ভেতর থেকে জয়ন্তীর অন্ধ বাবা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “কী হল রে কালী?”
কালী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হি হি করে হাসছিল। তিন্নির বয়সী এই মেয়েটা শিশুকাল থেকেই এ বাড়িতে আছে। যদিও এই পরিবারের কারোর সঙ্গেই ওর রক্তের সম্পর্ক নেই। কেন আছে? কোথা থেকে এসেছে? কেন এসেছে? এসব কোনো কথাই আজ আর কারোর মাথাতে নেই। কে যে সঠিক জানে তাও বলা মুশকিল। কালীর অস্তিত্ব স্বাভাবিক ও অমোঘ।
হাসি চাপতে চাপতে কালী ঘরের দিকে মুখ করে চীৎকার করে বলে উঠল——
“ও কিছু হয় নি, তুমি খেতে বসো দাদু!”
পুলিসের গাড়ীটা ধীরে ধীরে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ীর সামনের সিট থেকে ফুলবাগান থানার বড়বাবু গজেন্দ্র ঘোষাল ওরফে গজু ঘোষাল বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে অতিকষ্টে নামলেন। ভিলেনের হাসি মুখে। তার সঙ্গে থানার একজন এস. আই. আর পাঁচ-ছয়জন কনস্টেবল রয়েছে। যেন বাপের জমিদারীতে ঢুকছে এমনভাবে সবাই গটগট করে খেটুয়ার সংকীর্ণ দোকানের ভেতর ঢুকে আসল।
“দোকান খুলেছিস কেন?” গজু ঘোষাল জিজ্ঞাসা করলেন। মুখের কুটিল হাসি অদৃশ্য হয়ে এখন একটা কদাকার, ভয়ানক চেহারা নিয়েছে মুখটা। খেটুয়ার হাত-পা কাঁপছিল। গজু ঘোষাল মানে মূর্তিমান ত্রাস। পার্টির ছেলেদের ভাষায়– “নটোরিয়াস”। গত তিন বছরে কম করে ২২ জন পার্টিকর্মীকে “এনকাউন্টার” করেছে এই নরখাদক। পার্টির সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক আছে বা পার্টির ওপর দরদ, সমর্থন আছে, কারুর প্রতি এই ধারণা যদি কণামাত্র তার মনে জন্মায় তাহলে তার আর নিস্তার নেই। কোনো না কোনো অজুহাতে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বীভৎস অত্যাচার চালিয়ে তিনি মজা পান। বিশেষ করে তার নজর থাকে মেয়েদের দিকে। মেয়েদের ওপর অত্যাচারের নিত্যনতুন পন্থা আবিষ্কার করা তার বিশেষ একরকম হবি।
খেটুয়ার মুখে কোনো কথা আসছিল না৷ কিন্তু উত্তর দিতে দেরি হলে সন্দেহ আরও বাড়বে। মরীয়া হয়ে সে বলে উঠে——–
“দোকানে ক্যাশবাক্সটা ফেলে গেছলুম স্যার৷ নিতে এসেছি।”
—- “ক্যাশবাক্স ফেলে গেছিলি? কোথায় ক্যাশবাক্স?”
খেটুয়া ক্যাশবাক্সের দিকে তাকায়। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে গজু ঘোষালের চোখ উনুনের পাশে বেঞ্চের এককোণে রাখা ক্যাশবাক্সের ওপর পড়ে। বেঞ্চের উপর ক্যাশবাক্স। বেঞ্চের পাশে উনুন। উনুনের উপর তখনও চা ফুটছে।
গজু ঘোষালের মুখের কদাকার ভাবটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়ে আবার সেই কুটিল হাসিটা ফিরে আসল।
“কার্ফুর মধ্যে ক্যাশবাক্স নিতে এসে উনুন জ্বালিয়ে চা বসালি?” গজু ঘোষাল অট্টহাসি হাসতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড পরেই দুম করে হাসি থামিয়ে কনস্টেবলদের বললেন,
“নিয়ে চল তো কুত্তার বাচ্চাটাকে থানায়”।
কনস্টেবলরা ঝাঁপিয়ে পড়ল খেটুয়ার ওপর। চড় থাপ্পর লাথি ঘুঁসি দমাদম পড়ল সেকেন্ডের মধ্যে। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জীটা টানাটানিতে ছিঁড়ে কুটিকুটি হয়ে গেল৷ চুলের মুঠি ধরে খেটুয়াকে টানতে টানতে বাইরে আনতেই ও রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে গজু ঘোষালের পা জড়িয়ে ধরল।
“স্যার দোকান না খুললে পেট চলবে না স্যার।”
তার কথা কেউ শোনে না। মুখে বুকে পেটে দমাদম বুটের লাথি পড়তে থাকে। মুখ ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। কনস্টেবলদের দুজন তার দুটো হাত আর দুজন তার দুটো পা ধরে চ্যাংদোলা করে গাড়ির পেছনে দরজার কাছে নিয়ে যায়। এস.আই দরজা খুলে দেয়। গজু ঘোষাল দুই কোমরে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলেন। খেটুয়া শেষ চেষ্টা করে। ঝুলতে ঝুলতেই বলতে থাকে——-
“স্যার বাড়ীতে দুটো বাচ্চা আছে। বউটা কীভাবে খাওয়া যোগাড় করবে স্যার? ছেড়ে দিন স্যার। পায়ে ধরছি স্যার।”
দাঁত বার করে হাসতে হাসতে এস.আই বলে ওঠে———
“তোর বউ-এর চিন্তা স্যার করবে খন। তোর থেকে অনেক বেশি টাকা রোজগার করাবে। নে চল শালা!”
ওরা চ্যাংদোলা করে খেটুয়াকে গাড়িতে ছুঁড়ে দেয়। এস.আই সাহেবের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠে।
হাসি শেষ হল না, বিকট শব্দে গোটা পাড়া থরথর করে কেঁপে উঠল। গি—দু—-ম! সংকীর্ণ রাস্তার দুপাশের বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে সে শব্দ আরও একবার ধ্বনিত হল। নীলমণিদের গলির মুখ থেকে প্রথম বোমাটা পুলিসের গাড়ির একেবারে সামনে এসে পড়ল। কেঁপে উঠল গাড়িটা। ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়ল উইন্ডস্ক্রিনের কাঁচ। “শালে লোগ বোম মার দিয়া!” বলতে বলতে কনস্টেবলরা দৌড়ে গাড়ির সামনে ছুটে গেল। গজু ঘোষ বিদ্যুতের গতিতে কোমর থেকে পিস্তলটা বার করে গাড়ির গায়ে পিঠ ঘসে ঘসে সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। এদিকে হঠাৎ করে কেউ নেই দেখে খেটুয়া লাফ মেরে গাড়ির দরজা দিয়ে নেমে এসে গোলকালি মন্দিরের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। খেটুয়া পালিয়ে যেতেই বুলবুলের ঠেকের দিক থেকে আর একটা বোমা গাড়ির পেছনে এসে পড়ল। সামনে থেকে আরও দুটো। একের পর এক গগনবিদারী শব্দে কাঁপতে লাগল চারপাশ। সাদা ধোঁয়া অন্ধকার করে দিল সবকিছু।
চারদিক থেকে ট্র্যাপড হয়ে গেছে বুঝতে পেরে এস.আই আর কনস্টেবলরা বন্দুক পিস্তল ফেলে দিয়ে শুঁড়াকন্যা স্কুলের দিকে দৌড়ে পালাল। গজু ঘোষালের পায়ে বোমার সপ্লিন্টার লেগেছে। গাড়ির সামনের ডানদিকের চাকার ঠিক পাশে তিনি চিৎ হয়ে পড়েছেন। হাতের পিস্তল ফুটপাত পেরিয়ে নর্দমায় গিয়ে ছিটকে পড়েছে। তার দিকে কেউ ফিরে তাকাল না৷
গজু ঘোষাল একটা গাড়িতে কয়েকটা পুলিস নিয়ে কোনো ব্যাক আপ ছাড়াই তান্ডবে বেরিয়েছে বুঝতে পেরেই পার্টির ছেলেরা মারাত্মক আঘাত হানল। হরমোহন ঘোষ লেনের দুই দিকে অনেকগুলো সরু সরু গলি পাড়ার ভেতরে ঢুকে গেছে। প্রতিটা গলির মুখে পজিশন নিয়েছে পার্টির ছেলেরা। নরহরিবাবুর বাড়ির গলির মুখে পাঁচিলের আড়াল থেকে বাচ্চু তার ছঘড়াটা থেকে একটা গুলি ছুঁড়ল গজু ঘোষালকে লক্ষ্য করে। গুলিটা ডাক্তারবাবুর বাড়ির পাঁচিলে গিয়ে লাগল। পুলিসের গাড়ির পেছন থেকে শম্ভু চীৎকার করে বলে উঠল——- “গুলি ছুঁড়িস না! গুলি নষ্ট করিস না!”
চারপাশ থেকে কুড়ি পঁচিশ জন সশস্ত্র ছেলে ভূপতিত গজু ঘোষালের দিকে ছুটে এল। শৈলেনের হাতে একটা বড় ন্যাপালা। হাঁফাচ্ছে ও। চোখে মুখে অপার্থিব হিংস্রতা। পাগলের মতো জিজ্ঞাসা করতে থাকল গজু ঘোষালকে—–
“কৃষ্ণকে যেদিন গুলি করে মারলি, মরার আগে ও জল চেয়েছিল। তুই ওর মুখে পেচ্ছাপ করে দিয়েছিলি না রে?”
জিজ্ঞাসা করছে আর কাঁদছে শৈলেন। প্রতিহিংসার আগুনে হিংস্র চোখমুখ ভেসে যাচ্ছে অশ্রুধারায়। শৈলেনকে দেখে মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। আবেস্তার পাতা থেকে উঠে আসা কোনো দেবতা বলে ভ্রম হচ্ছিল যিনি চার হাজার বছরের অন্যায় আর অত্যাচারের যেন জবাব দিতে হাজির হয়েছেন বেলেঘাটা নামের এক ক্ষুদ্র জনপদে।
কোনো কথার কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগ পেলেন না গজু ঘোষাল। উপুর্যুপরি ন্যাপালার এলোপাতাড়ি কোপে তার বিরাট ভুঁড়ি চিরে হাঁ হয়ে গেল। নাড়িভুড়ি গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। মন্দিরের পাশের বটগাছটা থেকে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল কটা অচেনা পাখি।
২
১৯৭৩ সালের কলকাতা। সিদ্ধার্থ শংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী। বেশ কয়েকবছর বাদে ইন্দিরা কংগ্রেস আবার ফিরে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯-এর দু দুটো যুক্তফ্রন্ট সরকার স্থায়ী হয় নি। ১৯৭০-এ জারি হল রাষ্ট্রপতি শাসন। আর ‘৭২-এ ব্যাপক রিগিং করে সিদ্ধার্থ শংকর মুখ্যমন্ত্রী হলেন। কংগ্রেসি লুম্পেন আর দুর্বৃত্ত বাহিনী দাপিয়ে বেড়াতে লাগল কলকাতায়। পার্টি দুবার ক্ষমতায় গিয়েও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে নি। উল্টে পার্টি সরকারে থাকলে তার কাজ কী হবে এই প্রশ্নে পার্টি ভেঙ্গে গেছে। নকশালরা সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় পার্টিকে তখন ত্রিমুখী লড়াই লড়তে হচ্ছে। একদিকে কংগ্রেস। পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে তারা পার্টির ক্যাডারদের খুন করছে। সমর্থকদের উপর অত্যাচার করছে। আর অন্যদিকে নকাশালপন্থীরা পার্টিকে অ্যাখ্যা দিয়েছে সংশোধনবাদী, আপোষপন্থী বলে। নকশালবাড়ীর কৃষক আন্দোলনে গুলি চালিয়ে পার্টি তখন নকশালদের চোখে ঘৃণার বস্তু। ফলে তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম প্রায়শই পার্টির বিরুদ্ধেও চলে যাচ্ছে।
নকশালরা কারা? তারা তো পার্টিরই লোক। অন্তত তাই তো ছিল এই কিছুদিন আগেও। মন ভেঙ্গে গেছে। ঘর ভেঙ্গে গেছে। একসঙ্গে উঠা, বসা, খাওয়া আলাদা হয়ে গেছে। বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। কমরেড-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ঘৃণা বেড়েছে। শত্রুতা বেড়েছে। সবার হাতেই অস্ত্র রয়েছে। সুতরাং একের রক্তে প্রায়শই অন্যের হাত রেঙে উঠছে। শ্রেণিশত্রুর তো কথাই নেই, সাধারণ রাজনৈতিক শত্রুর রক্তে হাত না রাঙিয়ে তখন আর কোনো উপায় নেই। বাঁচার একটাই রাস্তা তখন। অন্যকে মারতে হবে৷ রাজনীতি ব্যাপারটাই উঁচু তারে বাঁধা। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় তখন ত্রিমুখী লড়াই। কখন যে কে কার সাথে হাত মিলিয়ে তৃতীয়কে আক্রমণ করছে বোঝা শক্ত। এইরকম আঁতাতের পেছনে কোনো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নেই। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতাই একমাত্র চালিকাশক্তি।
বেলেঘাটা মেন রোড পেরিয়ে মিঞাবাগান বস্তিতে ঢোকার মুখেই বাচ্চুকে ঘিরে ফেলল অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী কয়েকটা সশস্ত্র ছেলে। আজ কয়েকদিন হল বাচ্চু, খোকন, শৈলেনরা পাড়া ছেড়ে মিঞাবাগান বস্তিতে শেল্টার নিয়েছে। গজু ঘোষালকে মারার পর থেকেই পুলিসের অত্যাচার চরমে উঠেছে। সেদিন সন্ধ্যার মুখে বিরাট পুলিস বাহিনী গোটা পাড়ায় কোম্বিং চালিয়েছে। পার্টির ছেলেরা সরে পড়েছিল আগেই।পুলিস কাউকে না পেয়ে গোটা বিশেক বাচ্চা ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে। ঘরে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ভেঙেছে। মেয়েদের সাথে অশ্লীলতা চালিয়েছে। শৈলেন বাচ্চুদের নামে খুনের মামলা দিয়েছে। ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। গোটা বেলেঘাটায় তখন এক একটা অঞ্চল এক এক দলের কব্জায়। ফুলবাগানের মোড়, নারকেলডাঙ্গা মেন রোড কংগ্রেসি লুম্পেনদের দখলে। সুতরাং এই দুই দিকে যাওয়ার উপায় নেই। সরকার বাজার নকশালদের কব্জায়। বেলেঘাটা মেন রোড পার করে যতই খালপাড়ের দিকে এগোনো যাবে ততই নকশালদের এলাকা বাড়তে থাকবে। এর মধ্যে মিঞাবাগানেই পার্টির শক্তিশালি ঘাঁটি রয়েছে। বাচ্চু খোকনরা তাই আপাতত মিঞাবাগানে সরে এসেছে৷ গজু ঘোষালকে মেরে দেওয়া গেছে বটে কিন্তু হরমোহন ঘোষ লেন হাতছাড়া হয়ে গেছে। পুলিসকে সামনে রেখে এখন সেখানে দুবেলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেপাড়ার কংগ্রেসি মাস্তানরা। পার্টির ছেলেদের বাড়িতে বাড়িতে অত্যাচার চলছে চরম। সুতরাং, যে কোনো মূল্যে পুনরুদ্ধার করতে হবে হরমোহন ঘোষ লেন। মিঞাবাগান থেকে তার প্রস্তুতি চলছে।
পার্টির একটা গুপ্ত মিটিং থেকে ফিরছিল বাচ্চু। বেলেঘাটা মেন রোডটা পেরনো সব সময়েই একটা কঠিন কাজ। এত আলো চারদিকে। কিন্তু উপায় নেই। হয়ত নজরে পড়ে গিয়েছিল আগে থেকেই। মিঞাবাগানের ঠিক আগেই একটা পাঁচিলের পাশে অন্ধকারে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল ছেলেগুলো। পরিষ্কার করে কারোর মুখ বোঝা যায় না। হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে আবার ধড়ধড় করে চলতে শুরু করল। নিজের অজান্তেই হাতটা কোমরে গোঁজা দেশি ছঘড়াটার ওপর চলে গেল বাচ্চুর।
“কী বাচ্চুদা ভয় পেয়ে গেলে?”
গলার আওয়াজে বাচ্চু বুঝল, এ মৃগাঙ্ক। পার্টির অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্রনেতা। অসাধারণ ছাত্র ছিল। এদের গোটা ব্যাজটাই নকশালদের দিকে চলে যায়। মৃগাঙ্কের দলটা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটা মার্ডার করেছে। ওদের ভাষায় “শ্রেণিশত্রু খতম”। তাদের মধ্যে রাসমণি বাগানের চালের আড়তদার তথা কুখ্যাত কংগ্রেসি মাস্তান গালকাটা কেষ্টও ছিল। প্রচুর হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল ঐ খুনটায়।
” কোমর থেকে হাত সরাও!”
কঠিন গলায় নির্দেশ আসে। বাচ্চুর চারপাশে কম করে পনেরটা ছেলে। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। বাচ্চু ধীরে ধীরে রিভলবার থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
“কী বলবি বল।” বাচ্চু জানে এদের সঙ্গে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত কথা বলাটাই কম বিপজ্জনক।
“বলব আর কী? বাগে পেয়ে গিয়েছিলাম, মেরে দিতাম। কিন্তু গজু ঘোষালকে মেরে তোমরা একটা ভালো কাজ করেছ। আমরাও অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিলাম। শালা আমাদের লাইফ হেল করে দিচ্ছিল৷ তাই তোমায় এ যাত্রা পুরষ্কার দিলাম, বুঝলে?”
“বুঝলাম। এখন রাস্তা ছাড়।”
“আরে এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? শোন একটা কথা আছে।”
“কী কথা?”
“শোনো, আমরা বটা বোসকে অ্যানিহিলেট করব। ”
“তা কর। আমায় বলছিস কেন?”
“বলছি তার কারণ হল এতে তোমাদেরও সুবিধা হবে। হরমোহন ঘোষ লেনের ওপর চাপ কমবে। কি ঠিক বলছি? ভেবে দেখো। এই অপারেশনটাতে তোমাদের সাহায্য লাগবে।”
দ্বিধায় পড়ে গেল বাচ্চু। এমনিতে ও নকশালদের পছন্দ করে না। এড়িয়ে চলে। খুব একটা বিশ্বাসভাজন বলে মনে করে না। কিন্তু এমন একটা তারে মৃগাঙ্ক টোকা দিল, বাচ্চু চিন্তায় পড়ে গেল। বটা বোস ফুলবাগানের কুখ্যাত কংগ্রেসি নেতা। বহু অপরাধের অপরাধী। অগাধ টাকার মালিক। অনেক ছেলে ওর হয়ে কাজ করে। বাচ্চুরা হরমোহন ঘোষ লেন থেকে সরে আসার পর এখন ওখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বটা বোসের ছেলেরাই। ফুলবাগান মোড়ের দখল নিয়ে বটা বোসের সঙ্গে নকশালদের দ্বন্দ্ব এখন পেকে উঠেছে। কিন্তু বটা বোসকে মারা কি অত সোজা? মুখে নিস্পৃহ ভাব বজায় রেখে বাচ্চু বলল——
“বটা বোস কি অ্যানোফিলিস মশা? উড়ে বেড়াচ্ছে!! দুহাতের চেটো দিয়ে পট করে মেরে দিবি!!’
” আমাদের কাছে পাক্কা খবর আছে বটা বোস রবিবার সকাল দশটায় তোমাদের পাড়ায় আসবে। তোমাদের পার্টি অফিস তো ওদের কব্জায় গেছে। সেখানে কংগ্রেসের বোর্ড লাগিয়ে ওদের অফিস খোলা হবে বুঝলে? বটা বোস উদ্বোধন করতে আসবে।”
“হুম। তালে তো পুলিস থাকবে। ওদের অনেক ছেলেও থাকবে।”
“আরে সে সব ব্যাপার আমাদের ওপর ছেড়ে দাও। তোমর গোলকালি মন্দিরের দিকটা ব্লক করে রাখবে। ওদিক দিয়ে যাতে ওদের কোনো ছেলে বা পুলিস ঢুকতে না পারে৷ আমাদের একটা দল শুঁড়াকন্যার দিকটা ব্লক করবে। আর একটা দল অ্যাকশন চালাবে।”
“তালে তো প্রচুর মালপত্তর লাগবে!”
“কিছু তো লাগবেই! এ কাজ তো একটা পাইপগানে হয় না। আমাদের হাতে বেশ কিছু গ্রেনেড আছে বুঝলে। একেবারে মিলিটারি মাল।”
“বুঝলাম। ঠিক আছে দলে কথা বলে দেখি।”
“বলো! তবে সাবধানে। প্ল্যান যেন ফাঁস না হয়ে যায়৷ কাল রাত নটায় খালপাড়ে শণিমন্দিরে এস।”
অন্ধকারে মিলিয়ে যায় মৃগাঙ্করা। গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে বাচ্ছু মিঞাবাগানে ঢোকে।
৩
করোনা নামের একটা জীবানু সারা পৃথিবীতে তান্ডব বাধিয়ে দিয়েছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি। আজ চার মাস হল লকডাউন চলছে সারা দেশে। টেলিভিসনে প্রধানমন্ত্রী অমৃত ঝুনঝুনওয়ালার ভাষণ চলছিল। তাতে কাজের কথা বিশেষ ছিল না। এই মুহুর্তে সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় ষাট কোটি মানুষ একেবারেই নিরন্ন বুভুক্ষু অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরে খাবার নেই। কাজকর্ম জীবন জীবিকা সব রসাতলে গেছে। এই চার মাসে কত পরিবার যে একসাথে গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল তার ইয়ত্তা নেই। রোজ রোজ যেমন খবর আসে করোনার থাবায় আজ মারা গেল হাজার জন। তেমনি চলে আত্মহত্যার সংখ্যা। মাঝে মাঝে যেন প্রতিযোগিতা চলে কে আগে এগিয়ে যেতে পারে। যার বাড়ি বসে থাকার সংগতি আছে অথবা বাড়িতে থেকে কাজ করে দুপয়সা রোজগারের মত ক্ষমতা ও ব্যাবস্থা আছে সে চায় না লকডাউন উঠে যাক। যার সে ক্ষমতা নেই সে হাহাকার করে, অভিশাপ দেয়। কিন্তু ঠিক কী করলে সে মুক্তি পাবে তা সে নিজেই জানে না। একসময়ে মুক্তি আসে বিষের কৌটোয় অথবা সিলিং থেকে নেমে আসা দড়িতে। ঝুনঝুনওয়ালা এসবের ধারকাছ মাড়ান না। কখনো হাসতে বলেন। কখনো নাচতে বলেন। কখনো কাগজে আঁকিবুঁকি কাটতে বলেন। ভারত সরকারের ছাপ মারা ঘোষণা বের হয় সর্বত্র। দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী ঝুনঝুনওয়ালাজীর দেশবাসীর প্রতি আহবান — এই বিপদের দিনে সমগ্র জাতি যে ঐক্যবদ্ধ আসুন আমরা তার প্রমাণ দি। সামনের পূর্ণিমাতে ঠিক রাত দশটায় দশ মিনিট ধরে অট্টহাসি হেসে আমরা বিপদকে জয় করব। ইত্যাদি।
সাড়ে এগারোটা বাজল। টিভিটা বন্ধ করে উঠলেন অনিমেষ। পাঞ্জাবীটা গায়ে চড়িয়ে একটা মাস্ক লাগালেন মুখে। শ্রীময়ি এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায় —–
“বেরচ্ছ নাকি?”
“হ্যাঁ, পার্টির ছেলেরা স্যানিটাইজার তৈরি করছে। ওখানে একবার যেতে হবে।”
“পার্টির মেয়েরা নেই বুঝি?”
অনিমেষ প্রমাদ গুণলেন। এক্ষুনি সর্বনাশ হয়ে যাবে। ছোটোবেলা থেকে এমন সব ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে, শ্রীময়ির কাছে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বকা খাচ্ছেন তবু শুধরোতে পারছেন না। তাছাড়া বিষয়টা তো সঠিকও নয়। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা সমান তালেই পার্টির কাজকর্ম করে চিরকালই। তাড়াতাড়ি বলে উঠেন—–
“আছে আছে। অভ্যাস হয়ে গেছে এমন!”
“তা সময় সুযোগ পেলে বাড়ি বসে তো একটু ভালো অভ্যাসও রপ্ত করতে পারো!”
“আছা আছা ঠিক আছে।”
“দেরি হবে ফিরতে?”
“হ্যাঁ, দুটো আড়াইটে বাজবে। চাল ডাল আলুর নতুন প্যাকেটগুলো রেডি হয়ে গেছে। নবদিগন্ত বস্তিতে নিয়ে যেতে হবে।”
“ঐ করে যাও। যাদের জগতপতি বানাবে বলেছিলে তাদের এখন ভিখারি বানাও!”
“লোকগুলো ঠিক মতো খেতে পাচ্ছে না, জানো!”
“হ্যাঁ, সে তো ঠিকই আছে। ত্রাণ তো দিতেই হবে। কিন্তু আজ এতদিন পরেও মানুষগুলো এই অবস্থায় রইল কেন, আমি বলছিলুম সেই কথা।”
“কী করব শ্রীময়ি? আমাদের হাতে তো এর বেশি কিছু নেই!”
“থাকবে কী করে? ৩৪ বছর সরকার চালালে। কোথায় গেল বিপ্লব, কোথায় গেল জনতা কা রাজ! আজ সব খুইয়ে চাল আলু বিলি করা ছাড়া উপায় কী?”
এবার অনিমেষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ঝটকা মেরে বলে উঠলেন ———
“তা তোমরা কী করলে? আমরা না হয় সংশোধনবাদী, সরকার-সর্বস্ব, ভোটবাজ। আর তোমরা তো বিপ্লব করে দেশটাকে একদম কিউবা বানিয়েছ! হুঃ! তোমাদের ছেলেরাও তো চাল-আলু দিয়ে বেরানো ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা পাচ্ছে না।”
অনিমেষ বেরনোর জন্য রেডি হয়ে বসার ঘরে এসে ঢুকলেন। দেওয়ালে বাবার ছবি। পাশেই শ্বশুড়ের, মানে শ্রীময়ির বাবার ছবি। দুজনেই কমিউনিষ্ট। যদিও আলাদা দলের। উনিশশো সত্তরের রাজনৈতিক ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ বেলেঘাটায় দুজনেই শহীদ। একজন কংগ্রেসি দুর্বৃত্তদের হাতে। আর একজন অন্য একদল কমিউনিষ্টের হাতে। দুটো ছবি পাশাপাশি। তাতে বাসি মালা লেগে রয়েছে।
অনিমেষ হৃদয়ে হাত চাপা দিয়ে শপথ নেওয়ার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে। মিনিট খানেক দাঁড়াবেন। কোনো নির্দিষ্ট ছবির নিচে দাঁড়াবেন না। এমনভাবে দাঁড়াবেন যাতে ছবির ভেতর থেকে কেউ পক্ষপাতের অভিযোগ তুলতে না পারে। এমনভাবে দাঁড়াবেন যাতে মনে না হয় তিনি তাঁর বাবার ছেলে। যেন অনিমেষ তাঁর পিতৃপরিচয় কোনো একজন ব্যাক্তির কাছে অর্পণ করতে নারাজ। তাঁর পিতৃপরিচয় তিনি অর্পণ করেন একটা গোটা প্রজন্মের কাছে। এমন একটা প্রজন্মের কাছে যারা স্বপ্ন দেখতে জানত। শোষিতজনার রাজের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের জন্য জীবন দিতেও জানত।
৪
খালপাড়ের শণিমন্দিরে পর পর দুদিন বৈঠক বসল। একদিকের রাস্তায় পার্টির ছেলেরা, অন্যদিকে নকশালদের আর্মড গার্ড পাহারায় রইল। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সেই সময়ে বেলেঘাটায় নকশালদের সব থেকে বড় নেতা সুজয় চ্যাটার্জী। বটা বোসকে মারা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও হবে সুদূরপ্রসারী। শুধুমাত্র মৃগাঙ্কের সাথে কথা বলে তো এ ধরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা যায় না। বেলেঘাটার পার্টির জেলার নেতারাও মিটিঙে ছিলেন। বিস্তারিত আলোচনা হল। নিখুঁত প্ল্যানিং হল। শৈলেন, বাচ্চুরা এরপর নিজেরা বসে নিজেদের প্ল্যানিং ঠিক করে নিল। সকাল নটায় তারা গোলকালি মন্দির চত্ত্বর দখল নেবে। তার আগেও না, পরেও না। ঠিক সেই সময়েই বটা বোস দলবল নিয়ে ফুলবাগান মোড় থেকে শুঁড়াকন্যা স্কুলের সামনে দিয়ে হরমোহন ঘোষ লেনে ঢুকবে। সঙ্গে হয়ত কিছু পুলিস থাকবে। বটা বোসরা ঢুকে গেলেই ঐ একই রাস্তা দিয়ে এসে ঠিক নটা কুড়ি নাগাদ নকশালদের একটা বাহিনী শুঁড়াকন্যা স্কুল চত্ত্বর দখল নিয়ে নেবে। আর একটা স্নাইপার এন্ড অ্যাসাল্ট বাহিনী রেললাইন ধরে এসে ঐ একই সময়ে হরমোহন ঘোষ লেনে নামবে। এই সঙ্গে আরো দুটো ব্যাপার ঠিক হল। ফুলবাগান থানা এলাকার ঠিক বিপরীত প্রান্তে কাদাপাড়ায় বেলেঘাটা লেকের ধার ঘেঁসে পার্টির কিছু ছেলে সাড়ে আটটা থেকে ব্যাপক বোমাবাজি করবে। ফলে থানার প্রধান বাহিনী ঐ দিকে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। আর ঠিক হল, শৈলেন আর জগা আগের রাতেই পাড়ায় ঢুকে যাবে। মণিকুন্তলাদের বাড়ির ছাদে প্রচুর জিনিসপত্র রাখা আছে। সেগুলো আগে থেকে সাবধানে নামিয়ে নিয়ে এসে জায়গামত রাখতে হবে। প্রয়োজন পড়লে যাতে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা যায়।
পরিকল্পনামত জগাকে নিয়ে আগের রাতে বারটা নাগাদ পাড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় শৈলেন। অ্যাকশনের ব্যাপারে নকশালদের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে শৈলেনের৷ ও জানে নকশালদের কাছে ভায়োলেন্স শুধুমাত্র কার্যসিদ্ধির উপায়মাত্র নয়। ব্যাপারটা তাদের কাছে অনেকটা ধর্মের মতো। মানুষ যেমন ধর্মাচরণের জন্য নিবেদিত কায়মনোবাক্যস্থিত হয় এরাও খানিকটা সেরকম। নিজেদের জীবনের পরোয়া তারা করে না। প্রয়োজনে নিজেদের সারা গায়ে বোম বেঁধে তারা টার্গেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। পরিকল্পনার সফলতা নিয়ে শৈলেনের মনে কোনো সংশয় ছিল না।
সংশয় বাচ্চু খোকনদেরও ছিল না। কিন্তু পরদিন সকালে সাড়ে আটটা নাগাদ পার্টির বিরাট বাহিনী সরকার বাজারের দিক থেকে ঢুকে কমলা বিদ্যামন্দির স্কুল পেরিয়ে গোলকালি মন্দিরের তেমাথা থেকে ঠিক পাঁচশ মিটার আগে আর একটা তেমাথায় পৌঁছে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বিরাট পুলিস বাহিনী গোলকালি মন্দির চত্ত্বর সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নিয়েছে আগে থেকেই। কম করে তিনটে থানার পুলিস তো হবেই। এমন তো হবার কথা ছিল না। একাধিক থানা একসাথে অপারেট করে খুবই কালেভদ্রে। অত্যন্ত বড় কোনো ব্যাপারে। তালে কি প্ল্যান ফাঁস হয়ে গেল? হতচকিত বাচ্চুরা এগোবে কি পেছবে বুঝে উঠতে পারে না। শম্ভু চীৎকার করে বলে উঠল—–
“ভাবাভাবি নেই। যে করেই হোক গোলকালি মন্দির দখল নিতে হবে। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
হতভম্ব অবস্থার মাঝে একটা ডিরেকশন, একটা স্পষ্ট নির্দেশের মূল্য অনেক। তা সে ঠিকই হোক আর ভুলই হোক। এখানেই নেতৃত্বের পরিচয়। কঠিন পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে শৈলেনের পরেই তাই শম্ভুর স্থান।
মুহুর্মুহু বোম্বিং শুরু হয়ে গেল পুলিসকে লক্ষ্য করে। পুলিসও গুলি চালাতে শুরু করল। দুটো তেমাথার মাঝখানে পাঁচশ মিটারের সংকীর্ণ রাস্তাটায় ধুন্দুমার বেধে গেল। কিন্তু পুলিস বাহিনী আগে থেকে তৈরি ছিল। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পজিশনগুলো তারা দখলে রেখেছিল। ফলে হাজার চেষ্টা করেও পার্টির ছেলেরা এগোতে পারল না। বরং পনেরো মিনিটের মধ্যে তারা নিজেরাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছতে শুরু করল। এইবার পুলিস বাহিনী হিংস্র শার্দুলের মতো পার্টিকে পিছন থেকে আক্রমণ করল৷ বাচ্চুদের গোটা বাহিনী সেদিন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এমন সময়ে অলৌকিক ঘটনা ঘটল। দিলীপ স্টোর্ষের উল্টোদিকের তিনতলা বাড়িটার ছাদ থেকে পুলিসকে লক্ষ্য করে একের পর এক লাল-সাদা চার্জ করা হতে লাগল। মধ্যে মধ্যে দু একটা গ্রেনেড৷ পুলিসের একটা গাড়িতে আগুন ধরে গেল৷ এই বাড়িতে তিন বোন থাকত৷ সুভদ্রা, সুদীপ্তা আর সুজাতা। এরা ছিল পার্টির গোপন সেলের সদস্য। এরা পার্টির হয়ে নানা ধরনের দুঃসাহসিক কাজকর্ম করে বেড়াত। সে সময়কার বেলেঘাটায় এদের নিয়ে নানা গল্পকথা লোকের মুখে মুখে ফিরত। ছাদ থেকে এই অতর্কিত আক্রমণে পুলিস বাহিনী হকচকিয়ে গেল। ব্যাবস্থাটা পার্টির জেলার নেতারা আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। আপৎকালীন পদক্ষেপ হিসাবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তা ঠিকঠাক কাজে লেগে গেল। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে পুলিস আর বাচ্চু শম্ভুদের চার্জ করতে পারল না। তারা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল। এবার পুলিসের আক্রোশ গিয়ে পড়ল এই বোনেদের ওপর। পুলিস বাহিনী একযোগে নিচ থেকে ছাদ লক্ষ্য করে ভয়ঙ্কর গুলিবৃষ্টি শুরু করল৷ কিন্তু কোথায় কে? কেউ ছাদ থেকে আর নিচে তাকাল না। আর একটা বোমাও রাস্তায় এসে পড়ল না। বাচ্চুরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতেই সেই অমৃত-কমিউনিষ্ট বোনেরাও হরিণের গতিতে তিনতলার উপরে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদ অনায়াসে লাফিয়ে চলে গেল পুলিসের নাগালের বাইরে বহু দূর। নিচে অসহায় পুলিস রাগে গজরাতে লাগল।
কিন্তু শৈলেন মৃত্যুফাঁদে আটকা পড়ে গেল।
শৈলেনের বাড়ি ঘিরে নিয়েছে এক দেড়শ সশস্ত্র কংগ্রেসি লুম্পেন আর খুনে বাহিনী। পুলিস দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। শৈলেনই যে গজু ঘোষালকে মেরেছিল সে কথা জানতে কারোর বাকি নেই। পুলিসের ভয়ঙ্কর রাগ আর প্রতিহিংসা রয়েছে। সুতরাং শৈলেনকে তারা বাঁচাতে আসবে না সেটাই স্বাভাবিক। সুযোগ পেলে তারাই মারত। কিন্তু এখন অন্য এজেন্সি যখন একই কাজ করছে তখন হাতে রক্ত না লাগানোই ভালো।
বাড়ির বাইরে থেকে বীভৎস হুংকার ভেসে আসল। “অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা শৈলেন, বেড়িয়ে আয়! নইলে বোম মেরে বাড়ি উড়িয়ে দেব!”
খাটের এককোনে বসে শৈলেনের মেয়ে তিন্নি উদভ্রান্ত্রের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বাধা দেওয়ার ভঙ্গীতে যন্ত্রচালিতের মতো এক একবার হাতটা তুলছে। কালী পাথরের মতো বোবা হয়ে জড়সড় মেরে ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে। তিন্নির দাদা অনিমেষ বাবাকে আড়াল করে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে লুম্পেন বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে চায়। শৈলেনের মা শৈলেনের বউকে ক্রমাগত বলতে থাকেন, “বাবুকে আটকাও বউমা, লাল্টুকে আটকাও!” অন্ধ বাবা দুহাত হাতড়াতে থাকেন——-
“চলে গেছিলি লাল্টু, আবার কেন আসতে গেলি!”
শৈলেনের মা হঠাৎ বলে ওঠেন—-
“কেউ বাইরে যাস না বাবা। আমি ওদের পা ধরে ক্ষমা চাইব। বলব, শৈলেনকে তোমরা ক্ষমা করে দাও, বাবারা। ওরা কি মায়ের কথা রাখবে না?”
শৈলেন প্রচন্ড জোরে ধমকে ওঠে—-
“চুপ করো! চুপ করো সবাই! এত ঘাবড়ানোর কিছু হয় নি।”
স্ত্রীর বাধা আলতো ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে শৈলেন বাইরে বেরিয়ে আসে। ও জানে ওকে জীবনদান করতে হবে। নইলে বাড়ির একজনও বাঁচবে না। পরিস্থিতি রক্ত চাইছে। প্রতিটি পরাজয়েরই মূল্য চোকাতে হয়। কাউকে না কাউকে।
বাইরে থেকে আবার চীৎকার। “অ্যাই শৈলেন, হারামীর বাচ্চা!” সঙ্গে সঙ্গে কলপাড়ে একটা পেটো এসে পড়ল। বিকট শব্দে কেঁপে উঠল বাড়িটা। ধোঁয়ায় ধোঁয়া চারদিক।
মুখে অপরিসীম ঔদ্ধত্য আর অবজ্ঞা নিয়ে বেরিয়ে এল শৈলেন।
“অ্যাই শুয়োরের বাচ্চারা চেঁচাচ্ছিস কেন রে?”
সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এত অবজ্ঞা, এত ঔদ্ধত্য দেখানো যায়? বিপ্লবী না হলে এ কাজ অসম্ভব। কংগ্রেসি বাহিনী এক মুহুর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল। একই রকম পরিস্থিতিতে পড়লে তারা তো হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইত। এক আধ ঘন্টার জন্য কমিউনিষ্ট হতেও তাদের বাধত না। কিন্তু একজন কমিউনিষ্ট সর্বদাই একজন কমিউনিষ্ট। সে জানে আত্মবলিদানও একটা হাতিয়ার। তাকেও এমনভাবে প্রয়োগ করা যায় যাতে করে হত্যাকারীর মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয় তা কোনোদিন মোছে না।
খুনেদের দলট ঘিরে ধরল শৈলেনকে। একটা দাগির হাতে একটা বড় চকচকে ছুরি। চীৎকার করে বলতে থাকল, “বটা বোসকে মারবি, শালা শুয়োরের বাচ্চা? বটা বোসকে মারবি?”
শৈলেন ওর মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দেয়। বলে ওঠে, “সব জবাব ঠিক সময়ে পেয়ে যাবি রে শুয়োরের বাচ্চারা।”
পুরো কথা শেষ করতে পারে না শৈলেন। ছুরিটা শৈলেনের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। গলা দিয়ে দমকা আওয়াজটা বেরিয়ে আসে। চেষ্টা করেও আটকাতে পারে না শৈলেন। চাপা চীৎকার গোঙানি……. শৈলেন সামনে ঝুঁকে মাটিতে পড়ে যায়। রক্ত গড়াতে থাকে কলপাড়ের দিকে।
বাড়ীর ভেতর থেকে ছুটে আসে শৈলেনের মা আর বউ। ছুটে আসে কালী। “বাবা লাল্টু বাবা লাল্টু বলে ছুটে যেতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান শৈলেনের মা৷ ভেতর থেকে অন্ধ বাবার চীৎকার ভেসে আসে——
” কী হল রে কালী? লাল্টুর চীৎকার শুনলাম! কী হল কালী?”
“তুমি ঘরে যাও দাদু, ঘরে যাও, কিছু হয় নি!” বলতে বলতে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে কালী। উঠোনে গড়াগড়ি খেতে থাকে। মাথা ঠুকতে থাকে অবিশ্রাম!
৫
উদভ্রান্তের মতো বাচ্চুরা ছুটে এসে মিঞাবাগানে ঢোকার মুখেই জগা ছুটে আসে পাগলের মতো। বাচ্চু ওকে জাপটে ধরে—-
“কীরে জগা! কীভাবে পালালি?”
“আমি মণিকুন্তলাদের ছাদে লুকিয়ে ছিলাম বাচ্চুদা। শৈলেনদাকে ওরা মেরে দিয়েছে বাচ্চুদা!” বলতে বলতে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জগা বাচ্চুর গায়ে এলিয়ে পড়ে। বাচ্চুর কেমন পাগল পাগল লাগে। মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে বোধহয়। চারদিকে ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে খোকন, শম্ভুরা। একটু ধাতস্থ হয়ে বাচ্চু জিজ্ঞাসা করে— “প্ল্যানিংটা কীভবে ফাঁস হয়ে গেল রে জগা?” ফুঁসে উঠে জগা, বলে—-
“প্ল্যানিং ফাঁস হয় নি বাচ্চুদা। বেইমানি হয়েছে।”
“মানে?”
“কংগ্রেসের শুয়োরের বাচ্চাদের সাথে রথীন আর তারক ছিল।”
“রথীন আর তারক? মৃগাঙ্কের শাগরেদ? ওদের সাথে?”
বাচ্চুর গলা দিয়ে কথা বেরতে চায় না। চোখ বিস্ফারিত। এতবড় বেইমানি! মুখে বিপ্লব আর কাজে কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়ে পার্টিকে নিকেশ করার চেষ্টা? বাচ্চুর চোখমুখ কঠোর হয়ে ওঠে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল। কিন্তু মুখমন্ডলে ক্রোধের উত্তাপ অশ্রু শুষে নিয়েছে মাঝপথেই।
ছঘড়াটা নিজের মাথায় ঠেকিয়েই ট্রিগারটা টেনে দিতে ইচ্ছে করছিল বাচ্চুর। সেদিন মৃগাঙ্কের কথাটা কেন ও এত সিরিয়াসলি নিতে গেল? এত বড় ট্র্যাপ! এত বড় বেইমানি! বাচ্চু এখনও ভাবতে পারছে না।
বাচ্চু শম্ভুরা বদলা নিল তিন দিনের মাথায়। সকাল নটার দিকে সুজয় চ্যাটার্জী চায়ের দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সরকার বাজারের ভিড়ভাট্টার মধ্যে কখন বাচ্চুরা তাঁর কাছাকাছি চলে এসেছে খেয়াল করেন নি তিনি। সটান তিনটে গুলি পেটে চালিয়ে দেয় বাচ্চু। সুজয় চ্যাটার্জী বুঝতেও পারেন নি কে মারল, কেন মারল!
তখন কি আর বাচ্চুরা জানত রথীন আর তারক কংগ্রেসের এজেন্ট হিসাবে অনেকদিন ধরেই কাজ করছিল মৃগাঙ্কদের দলটাতে। সে হিসাব মৃগাঙ্কদের কাছেও ছিল না। প্রত্যেকদিনের প্রতিটা ঘটনা, শনিমন্দিরের মিটিংয়ের প্রতিটা খবর তারা জুগিয়ে গেছে পুলিসকে। মৃগাঙ্করা বুঝতেও পারে নি। ১৯৭৩ সালটা নকশালদের কাছে ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জের বছর। নেতৃত্ব শহীদ হয়ে গেছে। কংগ্রেস থেকে আসা যে বেপরোয়া ছেলেরা একদিন নকশালে যোগ দিয়েছিল, সেই ঝাঁকের কই আবার ঝাঁকে ফিরতে শুরু করেছে৷ কে যে দলের আর কে যে নয়, তা বোঝা তখন শিবের বাবার পক্ষেও সম্ভব নয়। সময়ের সামন্য হেরফের হলে সেদিন মৃগাঙ্করাও খতম হয়ে যেতে পারত। বরাতজোরে বেঁচে গেল নকশালদের দল দুটো। বাচ্চুরা এসব কথা জেনেছে অনেক পরে। ‘৭৭- পার্টি ক্ষমতায় আসার পর।
৬
খবরের কাগজ আর চা নিয়ে বসার ঘরে বসেছিলেন অনিমেষ আর শ্রীময়ি। একটা গোটা কাগজ পড়ে ওঠা যায় না। বুকে ব্যাথা করে। মৃত্যু, মৃত্যু, শুধু মৃত্যু। ভাইরাসে মৃত্যু। তার সঙ্গে সমানতালে চলছে আত্মহত্যা। প্রথম পাতার খবর, টানা পনেরদিন খাবার না পেয়ে বিহারের সমস্তিপুরে এক মা তার তিনটে সন্তানকে দা দিয়ে কুপিয়ে নিজে আত্মঘাতী। অসীম অন্ধকার শ্রীময়ির মুখে। ধীরে ধীরে বললেন —–
“এই প্রত্যেকটা মৃত্যুর সমস্ত রক্ত আমাদের হাতে লেগে থাকবে। একশ বছর ধরে কী করলাম আমরা? যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছিল। ইতিহাসে লেখা থাকবে কমিউনিষ্টদের হেলায় সময় হারানো, কাজের থেকে কাজের কর্তা বড় মনোভাব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীবাজি, গড্ডলিকায় ভেসে ভেসে দিন কাটনোর খেসারত দিতে হয়েছিল শ্রমিক কৃষকদের।”
বিমর্ষ অনিমেষ চুপ করে বসে থাকেন। কিছু বলেন না। আর শ্রীময়িকে তো কিছু বলার নেই। সুজয় চ্যাটার্জীর মেয়ে। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়া শেষ না করেই পার্টির হোলটাইমার হয়ে উত্তরবঙ্গে চলে গেছিলেন। ‘৭৮-এ কানু সান্যাল জেল থেকে বেরিয়ে নতুন দল গড়ে তুলেছিলেন। চারু মজুমদারের লাইন ভুল ছিল এই জ্ঞানে সিপিয়াই(এম এল) গঠন করেন নি। অন্য নামে দল তৈরি করেছিলেন। শ্রীময়ি কানু সান্যালের সঙ্গে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন পার্টি করেছেন। আবার সংসারও করেছেন অনিমেষের সাথে। অনিমেষের এখনও মনে আছে শ্রীময়ির সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা। পূর্ব কলকাতা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ বলে নকশালদের একটা সামাজিক সংগঠনের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ফাইনালে তিনি শ্রীময়ির কাছে গো-হারা হেরে গেছিলেন। কানু সান্যাল আত্মহত্যা করার পর আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকেন নি শ্রীময়ি।
পুরনো কথাগুলো আবার নতুন করে মনে পড়ে স্মিত হাসি হাসেন অনিমেষ। শ্রীময়ির ঐ ‘হাতে রক্ত লেগে থাকবে’ কথাটা হঠাৎ করে মনে পড়তে তাল কাটে অনিমেষের। আড়চোখে একবার নিজের হাতের চেটোর দিকে তাকান তিনি। হাতের সঙ্গে রক্তের চিরকাল একটা আধি-ভৌতিক সম্পর্ক আছে। বাচ্চুকাকার কথা মনে পড়ে যায়। বছর দশেক আগে হার্ট স্ট্রোকে মারা যান বাচ্চুকাকা। পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে পার্টিতে ব্রাত্য হয়ে যায় বাচ্চুকাকাদের গোটা দঙ্গলটা। এক সময়ে আর পার্টি অফিসের ভেতরে ঢুকতেন না। বাইরের বেঞ্চে বসে থাকতেন তার মতো আরও অনেকের সাথে। সেখানে বসেই দেখতেন পার্টি অফিসে ঢুকছে বেরচ্ছে প্রোমোটারের দল। নতুন নতুন নেতা অনেক। এমনকি যে বটা বোসকে মারতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনিমেষের বাবা সেই বটা বোসও তো পার্টির নেতা হয়েছিল এক সময়ে। তবু পার্টি ছাড়তে পারেন নি বাচ্চু কাকা। শেষ দিকে একটু পাগল পাগল হয়ে গেছিলেন। নানা রকম ম্যানিয়া তৈরি হয়েছিল। বারবার হাত ধুতেন। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না। হাতে রক্ত লেগে আছে ভাবতেন সব সময়ে!
সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে অনিমেষ কখন বেসিনে চলে এসেছেন, জানেন না। হাত ধুতে ধুতে সম্বিত ফেরে। স্যানিটাইজারে হাত ঘষেন। ভাইরাস নয়, হাজার হাজার মৃত্যুর রক্ত থেকে পরিত্রাণ চাইছেন অনিমেষ। নিদারুণ ব্যার্থ এক আন্দোলনের এক সাধারণ পদাতিক সৈন্য তিনি। পরাজয়ের দায় তো তবু নিতে হয়। কাউকে না কাউকে।
চেয়ারে ফিরে আসেন অনিমেষ। আর একবার চা করেছে কালী। “তুই চা খাবি না কালী?” জিজ্ঞাসা করেন শ্রীময়ি। কালী জবাব দেয়, “না, তোরা খা। তোদের সাথে চা খাবার কম্পিটিশনে আমি পারব না।” হেসে ওঠেন অনিমেষ।
মাঝে মাঝেই যেমন করেন, তেমনভাবে এবার আবদার শুরু করেন অনিমেষ—–
“শ্রীময়ি, রবি ঠাকুরের ঐ গানটা গাও না!”
প্রশ্রয়ের হাসি শ্রীময়ির মুখে, বলেন
“সেই গানটাই আবার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটা।” বলেন অনিমেষ।
সামান্য সময় নিয়ে শ্রীময়ি গানটা ধরলেন, মাঝখান থেকে —–
“এসেছি কি হেথা যশের কাঙালী?
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি?
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালী?
মিছে কথা কয়ে
মিছে যশ লয়ে
মিছে কাজে নিশি যাপনা
এ যে নয়নের জল
হতাশের শ্বাস
কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ
এ যে বুকফাটা দুখে গুমরিছে বুকে
গভীর মরম বেদনা!
এ কি শুধু হাসি খেলা
প্রমোদের মেলা
শুধু মিছে কথা, ছলনা?
কে জাগিবে আজ?
কে করিবে কাজ?
কে ঘুচাতে চাহে
জননীর লাজ?
কাতরে কাঁদিবে
মায়ের পায়ে দিবে
সকল প্রাণের কামনা।
আমায় বলো না গাহিতে বলো না!”
অসাধারণ গানের গলা শ্রীময়ির। চোখ বুজে শুনছিলেন অনিমেষ। গান শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ থেকে যায়৷ সেই রেশটুকুও হাতছাড়া করতে চান না তিনি। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে শ্রীময়িকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“আমরা কেন পারলাম না শ্রীময়ি?”
“কেন পারলাম না? আসলে লকডাউন চলছে। কমিউনিষ্টদের মাথায় লকডাউন চলছে অনেকদিন হল। সব লকডাউনের শেষ আছে। এ লকডাউনের শেষ নেই।”
শ্রীময়ি চিরকালই সব সত্যের সার সত্যে পৌঁছে যান অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায়। অনেক কথা বলার অভ্যেস তাঁর নেই। তিনি চিরকালই নির্দিষ্ট…. পিন পয়েন্টেড।
কয়েকজন পরিচিত নকশাল নেতাদের নাম করেন অনিমেষ। জিজ্ঞাসা করেন, “ওঁনারা কী করছেন এখন?”
নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেন শ্রীময়ি—–
“সবাই যা করছে ওঁনারাও তাই করছেন। দুটো হাতের বুড়ো আঙ্গুল মুখে পুরে আচ্ছা করে চুষছেন। বছরের পর বছর শুধু থটলেস অ্যাক্টিভিসমে ডুবে থাকার খেসারত। আরে আজ আমরা কী করতে পারবো, কতটুকু করতে পারবো তা তো নির্ভর করছে গতকাল আমরা কী করেছিলাম তার ওপর, তাই না? আর গতকাল আমরা কী করেছি তা তো গোটা দুনিয়া জানে, কী জানে না?”
চুপ করে থাকেন অনিমেষ। টেবিল ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে যান শ্রীময়ি। অনিমেষও উঠে পড়েন। স্নানে যাবার সময় হল।
৭
লকডাউনের বাজারে বেলা ১১-টার মধ্যে বাজার-হাট দোকানপত্তর বন্ধ হয়ে যায়। সকাল সাতটা থেকে এগারোটা অবধি মানুষ মুখে মাস্ক লাগিয়ে পরষ্পরের সঙ্গে দূরত্ব রেখে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে। বাকী সময়ে ঘরে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। বাজারহাট করে বেলা দশটা নাগাদ হারু হনহন করে বাড়ি ফিরছিল। অনিমেষবাবুর বাড়ির সামনে জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। সর্বনাশ, ওদের বাড়ির আবার কেউ করোনায় আক্রান্ত হল নাকি? অনিমেষবাবু যেভাবে রোজ বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে ত্রাণ বিলোচ্ছেন তাতে এরকম কিছু ঘটা বিচিত্র ব্যাপার তো নয়, ভাবল হারু। তাড়াতাড়ি বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল পার্টির অনেক লোক জড় হয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও রয়েছে। তাদের মুখে বিষ্ময়, বিমর্ষতা আর প্রচন্ড শক্। কী ব্যাপার কী? বাইরে থেকে তো কিছু বোঝা যায় না। একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন বাড়ির ভেতর থেকে। সঙ্গে পার্টির এরিয়া কমিটির সম্পাদক মৃণাল গোস্বামী। হারুর একবার মনে হল ওঁকেই জিজ্ঞাসা করে। তারপরেই ভাবল, জিজ্ঞাসা করলে এখন জবাব দেবে কিনা কে জানে! হারুর সামনে একজন প্রতিবেশী দাঁড়িয়েছিলেন। দোনামোনা করতে করতে হারু তাঁকেই জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার দাদা?” সে ভদ্রলোক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে হারুর দিকে দেখলেন, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কয়েক সেকেন্ড বাদে আবার কী মনে হতে হারুর দিকে ঘুরে তিনি উত্তর দিলেন —-
“অনিমেষবাবু……. আজ ভোরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে……. আত্মহত্যা!”
স্তম্ভিত হয়ে যায় হারু।
এই তো কালই দেখা হল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাঁচ-দশ মিনিট কথাও হল। কিছুই তো বোঝা যায় নি। হারু শুনতে পায় আশেপাশে পার্টির কয়েকজন লোক নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছে —-
“অনিমেষদা চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কাউকে কিছু বুঝতে দিতেন না। বাড়িতে খুব আশান্তি ছিল। বউ তো নকশাল! মিলত না…… ঝামেলা ঝঞ্জাট লেগেই থাকত……. বুঝলেন না!”
হারুর কিছুই মাথায় ঢোকে না। মাথায় ঢোকে না কারোর। মাথা থাকলে তো ঢোকার প্রশ্ন। সবাই নিজের নিজের মতো ব্যাখ্যা খুঁজে নেয়। সবার পরাজয়ের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন অনিমেষ। সব কিছুরই মূল্য আছে। পরাজয়েরও। সে মূল্য চোকাতেও হয়। কাউকে না কাউকে।
পুলিসের গাড়ি আসছে। বডি যাবে পোষ্টমর্টেমে! একটানা কেঁদে চলেছে কালী। যেন শুনতে পায় অলক্ষ্য থেকে চীৎকার করছে দাদু——–
“কী হল রে কালী? কী হয়েছে কী? হ্যাঁ রে কালী?”
কথা যোগায় না মুখে। কালী কেঁদেই চলে।
Posted in: April 2020, Cover Story