অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

জেরম রদেনবার্গ ও ‘অপর’জনের অপর

মার্কিন কবি জেরম রদেনবার্গ। না, শুধু কবি বললে ভুল বলা হয়। চার্লস বার্ন্সটাইনের মতো করে বললে তিনি হলেন হাইপেনীত কবি; একাধারে সমালোচক-নৃতত্ত্ববিদ-সম্পাদক-সাহিত্যসঙ্কলক-পারফর্মার-শিক্ষক-অনুবাদক। এহেন কবির বই A Field On Mars: Divagations & Autovariations, যেখানে কবির এই সমস্ত সত্তার উপস্থিতি। কেমন এই মঙ্গলের জমিটি? বইটির মুখবন্ধে আছে তার সংক্ষিপ্ত আভাস। শব্দের শুদ্ধতার পবিত্রতার যে জমি, একজন শিল্পীর একজন কবির সেই বাসস্থান, একসময়ে হয়তোবা উর্বর ছিল, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কবির শব্দচয়নও রোমান্টিসিজমে ছিল ভেজা ভেজা। কিন্তু আজকের এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই প্রতিকূল পৃথিবীর বাতাসে তার সেই জমি হয়ে উঠেছে মঙ্গলের মতোই শুষ্ক, নিঃসঙ্গ। ফলত কবিগুরুকে স্মরণ করে বলা যায় আজকের কবি পুরোনো কবির শব্দের স্যাঁতস্যাঁতে অনুভব মুছে কোণওয়ালা গথিক গির্জার ছাঁদে তাকে তীক্ষ্ণ করে তোলেন, তার গায়ে লেগে যায় অভাবনীয়ের কচ্চিৎ কিরণ, আর কবির মননের আলোয় সেই শব্দ দীপ্ত হয়ে ওঠে ন্যুরালজিয়ার ব্যথার মতো। তাই এই “Divagation”, এই বিপথগামিতা, এই “Autovariation”, এই স্বতঃস্ফূর্ত স্বয়ংক্রিয় রূপান্তর। তাই পুরোনো কবির নির্ভার স্বচ্ছতা ঘেরা ছন্দের মদিরতা মাখা সরল জলধর্মী কাব্য থেকে নতুন কবির বিপথগমন, বর্তমানের জটিল পৃথিবীর আবর্তে তাঁর নিত্যমন্থন। সতত দিকপরিবর্তন, মূল বিষয় থেকে এক বিচ্যুতি, এক বহির্গমন যেখানে সমস্ত বন্ধনী ছেড়ে চলে যায় বিষয়বস্তু, শুধু পড়ে থাকে এক সেন্সেশন। রদেনবার্গের এই বিপথগমনের কেন্দ্রে আছে একটি নতুন শব্দ, Ethnopoetics[1], যাকে বাংলায় হয়তো নৃকাব্যতত্ত্ব বলা যেতে পারে। জেরম রদেনবার্গ ১৯৬৭ সালে শব্দটি কয়েনেজ করেন, যা হল প্রাচীন জাতি ও উপজাতির লিখিত বা মৌখিক কাব্যতত্ত্বের সন্ধান ও তার বিকাশসাধন। আর এই নৃকাব্যতত্ত্বের উন্নতি ও ক্রমবিকাশের প্রাণপুরুষ হলেন রদেনবার্গ, যিনি মনে করেন, সৃজনশীল কাব্যতত্ত্বের এ এক অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তাই তাঁর খোঁজ বিশ্বজুড়ে যত প্রাচীন জাতি ও উপজাতির সাহিত্য (প্রধানত ট্রাইবাল আমেরিকান ইন্ডিয়ান গোষ্ঠি), সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গভীরে ছড়ানো প্রচল ও অপ্রচল, লিখিত বা মৌখিক কবিতা ও সংগীত। শুধু সংগ্রহ নয়, তিনি তার অনুবাদ করেন, সম্পাদনা করেন, যেখানে কাজ করে তাঁর বিপথগামিতার সূত্র; রদেনবার্গের ‘othering’, অপর। এই সেই ‘অপর’জনের অপর। আবহমানের মূলধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি নয়, বরং বাঁকবদল, যা আবহমান কালের রীতি। বিশ্বের সমস্ত কবিতাই এভাবে মূলধারা থেকে বিভাজিত হয় সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে, পরিবর্তনের রং লাগে ভাষার গায়ে, শব্দের রূপে; ঘটে কবিতাধারার মুক্তি। রদেনবার্গের এই অপরকে বুঝতে গেলে তাঁর কবিতার ধর্মবিশ্বাস জানতে হয়। তিনি সেই ‘অপর’জন, যিনি তথাকথিত ধর্ম যেখানে বিশ্বাসগুলো স্থান-কালের নিরিখে স্থির ও অপরিবর্তনীয় রয়ে যায়, সেখানে তিনি বিধর্মী। কিন্তু ভাষার ধর্মীয় অঙ্গনে যেখানে প্রতীকের সঙ্গে নিত্য গৌরবময় সংঘর্ষ, সেখানে তিনি অত্যাচারী বিশস্ত ধার্মিক। তাঁর এই ধর্মবিশ্বাসে থাকে কল্পনার আদিগন্ত আকাশ, যেখানে সমস্ত অনুবাদ হয়ে ওঠে একাধারে সামাজিক ও নান্দনিক নীতির কোলাজ। ফলত সংগৃতীত ও সম্পাদিত কবিতার মধ্যে এক নতুন সৃষ্টিশৈলীর অভিযোজন হয়; তার নিজস্ব দেশকালের ভিত্তিতে তার অস্তিত্ত্ব স্বীকার করে বর্তমানের করে তোলা। এ এক সম্পূর্ণ অনুবাদ, রদেনবার্গের ভাষায় ‘a total translation’, যেখানে শুধু শব্দের অনুবাদ নয় বরং কবিতায় সংযুক্ত সমস্ত ধ্বনি্র উপস্থাপন; এক “full verbo-vocal-visual spectrum”। ফলত আমরা পাই রদেনবার্গের কবিতা যেখানে অনুরণিত হয় সেই অতীতের এসেন্স কিন্তু তার প্রতিটি শব্দে জেগে ওঠে বর্তমানের নয়া আলেখ্য, জড়িয়ে যায় এই প্রতিকূল পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা। আমরা পাই রদেনবার্গের সেই কবিতা যেখানে এই অনুবাদ হয়ে ওঠে এক কোলাবোরেটিভ কাজ, “preservation of larger human memory”, একচেটিয়া সংস্কৃতি-একত্রিকরণের অস্বীকারে বিশ্বের বিদ্যমান বৈচিত্র্যের স্বীকার, এক বৃহত্তর মানব স্মৃতির সংরক্ষণ। তাই দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন উপজাতির মৌখিক প্রচল কবিতার অন্তরমহলে প্রবেশ করে তার সহজাত অন্তর্নিহিত যে সংগীত, তারই বীজ বুনেছেন নিজস্ব বোধের আলোয় উদ্ভাসিত স্বাধীন মাটিতে। তাঁর কাছে কবিতা লেখা হল এক “activity shared with all who are the users and makers of our common language.” রদেনবার্গের এই অনুবাদ প্রসেস শুধুমাত্র উপজাতীয় সাহিত্যে নয়, বহু মর্ডান, পোস্টমর্ডান, অ্যাঁভাগার্দ কবি ও শিল্পীর কাজের অনুবাদেও সমান ক্রিয়াশীল, যেমন স্পেনীয় মর্ডান কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, লাতিন আমেরিকা সাহিত্যের পুরোধা নোবেল প্রাপ্ত মেক্সিকান কবি অক্টাভিও পাজ, বলিভিয়ার ভিস্যুয়াল কবি অইগিন গমরিংগার, জার্মান ইন্সটলেশন শিল্পের পুরোধা শিল্পী কোর্ট সুইচার্স, কিউবিস্ট আন্দোলনের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্প্যানিশ পেইন্টার পাবলো পিকাসো, অ্যাব্‌‌স্ট্রাক্ট ইম্প্রেশনিস্ট আমেরিকান চিত্রশিল্পী আরশিলে গোর্কি, চেকোশ্লাভাকিয়ার সুররিয়ালিস্ট কবি ভিটেস্লাভ নেজভ্যাল ইত্যাদি। এ শুধু আক্ষরিক অনুবাদ নয়, কবির ভাষায় বললে এ এক “স্বাধীনতার স্বীকৃতি যে আমি অন্য কবিতার শব্দ ও ভাবনা থেকে একটা কবিতা তৈরি করতে পারি, শুরুতে যার ওপর আমার কোনও দাবি ছিল না। একবার অনুবাদ করা হলে সেগুলো তখন আমার এবং একই সাথে আমার নয় …. একধরনের মিডিয়ামশিপ যেখানে একটা স্বর কবির সঙ্গে কথা বলে এবং কবির মাধ্যমে কথা বলে: এক কবি-মানসী, মৃতদের আত্মা, দেবদূতীয় বার্তাবাহক, মহাশূন্যের ট্রান্সমিশন। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে ‘স্ব’ ও ‘অপর’-এর এক টানাপড়েন যা আমি কখনও সমাধান করি নি এবং কখনই করার ইচ্ছাও নেই” এই হল রদেনবার্গের ‘writing through’ প্রসেস যার বিশ্লেষণ করেছেন Writing Through: Translations and Variations বইটিতে। অপর কবির কবিতার শব্দ ও তার ধ্বনি এই যে অসীম শূন্যতার কথা, নিঃসঙ্গ নীরবতার কথা বলে, তাই নিয়ে কবির মনের ভেতর অবিরাম চলে এক ডিসকোর্স, কাউন্টার ডিসকোর্স। ক্রমে ক্রমে জন্ম নেয় এক অভ্যন্তরীণ ভাষা, “internalized language”, যাকে শব্দে গেঁথে তৈরি হয় ‘self voice’, কবির ভাষায়, “I want to speak in my own voice but others intervene & speak through me.” যেখানে পুরোনো ইমেজের সরব উপস্থিতি প্রকাশিত হয় তার নীরব অনুপস্থিতিতে, ধ্বনির মন্ত্রণায়, শব্দের উৎসবে, কবির ভাষায়, “to celebrate all that we have in common—in the way we cry,* (* we die) the sound & impulse shared by all—& noted as the source of song.”

A Field On Mars বইটি শুরু হয়েছে ফরাসী চিত্রশিল্পী অঁরি মাতিসের এপিগ্রাফ দিয়ে – একজন কবি তাঁর নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো এক নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সম্ভাবনাগুলোর দিগন্ত উন্মোচন করেন তাঁর কবিতায়। একসময় সেই সময়টা অতীত হয়ে যায়। আবার অন্য এক সময়ে দাঁড়িয়ে অন্য আরেক কবি সেই সম্ভাবনাগুলোর নতুন দিঙ্‌নির্ণয় করেন বর্তমানের পরিবর্তীত পটভূমিকায়।…তাছাড়াও নিজের পুরোনো কাজ ফিরে দেখা দরকার, অন্তত জীবনে একবার, কারণ তার নিশ্চিত হওয়া দরকার সে আবেগের বা নিয়তির শিকার হয়ে পড়েছিল কিনা। বইটির তেরোটি অধ্যায়ে রদেনবার্গের কবিতার অন্তরমহলে চোখ পেতে শোনা যায় মাতিসের এই ভূমিকার অনুরণন। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে আছে কবির দেওয়া টীকা যা পাঠকের আঙুলে আলতো আঙুল জুড়ে রেখে যায় উৎসের আভাস।

প্রথম অধ্যায় “THE JIGOKU ZOSHI VARIATIONS” জিগোকু জশি হল দ্বাদশ শতাব্দীর জাপানী বৌদ্ধ চিত্রশিল্প, গোটানো স্ক্রলের আকারে “Hell Scroll”. ৮টি উচ্চ নরক ও ১৬টি নিম্ন নরকের চিত্র ও তার বর্ণনা। ১৯৬২ সালে রদেনবার্গ রচনা করছিলেন “The Seven Hells of the Jigoku Zoshi” নামে একটি কবিতা সিরিজ যেখানে এই স্ক্রলগুলোর ইমেজ ও টেক্সটের থিম কেন্দ্র করে কবিতা লিখলেও ইমেজগুলোর নির্দিষ্টতার বন্ধনে আবদ্ধ হননি। বরং একধরণের জাক্সটাপজিশন বা তার কোলাজ কাজ করেছে ইমেজের অন্দরমহলে। কিন্তু নৃকাব্যতত্ত্বের প্রবক্তা তিনি, যেখানে অতীতকে সংগ্রহ করতে ঘুরেছেন দেশেবিদেশে পুরোনো সাহিত্য সংস্কৃতির পিছনে, তাকে গেঁথে তুলেছেন নতুন সময়ের আলোয়, সেই কবি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে নিজেকে ফিরে দেখবেন সেটাই অবশ্যম্ভাবী! তাই দেখি নিজের সেই সিরিজ আবার ফিরে দেখছেন ২০১৬ সালে এক অন্য পৃথিবীর অন্য সময়ের বর্তমানে A Field On Mars এ বসে। দ্বিতীয় অধ্যায় “THE GORKY VARIATIONS” মার্কিন ইহুদি চিত্রশিল্পী আরশিলে গোর্কির চিত্রসম্ভার থেকে ১৯৬২ সালে রদেনবার্গের এক নতুন কবিতা সিরিজের জন্ম হয় “Sightings (i-ix) & Further Sightingsনামে এবং ১৯৭১ সালে সংকলিত হয়েছিল তাঁর Poems for the Game of Silence” বইটিতে। তাকেই আবার ফিরে দেখা ২০১৬ সালে মঙ্গলের লাল ঊষর মাটিতে। তৃতীয় অধ্যায় “THREE VARIATIONS: ON OCTAVIO PAZ’S “BLANCO”-যেখানে মেক্সিকান কবি অক্টাভিও পাজের “BLANCO” কবিতার অনুবাদ করেছেন। তবে এইগুলো অনুবাদ বা অনুসৃজন নয়, রদেনবার্গের সেই ‘othering’; এভাবেই চতুর্থ অধ্যায় “THE LIKHT VARIATIONS” মর্ডান ইদ্দিস কবি Mikhl Likht এর Processions ইংরাজিতে অ্নূদিত হয় মার্কিন ইহুদি কবি এরিয়েল রেজনিকফ এবং কানাডার কবি স্টিফেন রসের যৌথতায়। এই অনুবাদের “VARIATIONS” করেছেন রদেনবার্গ। পঞ্চম অধ্যায় “Divagation” অর্থা্ৎ রদেনবার্গের সেই বিপথগামিতা। এখানে তিনি শব্দকোষে বেঁধে দেওয়া শব্দার্থ থেকে যাত্রা শুরু করেছেন, যেখানে “Divagation” এর তিনটে অর্থ দেওয়া আছে, ১)একটা বার্তা, মূল বিষয় থেকে যার বহির্গমন। ২)যেদিকে তোমার পথ, যেখানে তোমার নজর বা যা নিয়ে তুমি সংশ্লিষ্ট সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। “প্রধান হাইওয়ে থেকে বিকল্প পথে যাত্রা”। “অপ্রাসঙ্গিক বিবরণে অবান্তর যাত্রা”। “লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি”। ৩)বিষয়ের বাইরে পা রেখে যুক্তি হারাতে হারাতে ঘুরে বেড়ানো। তো অভিধানে বেঁধে দেওয়া শব্দের এই নির্দিষ্ট অর্থ থেকে শুরু করে কবি চলেছেন নিজস্ব (বি)পথে; শব্দের অভিধা আর আপন অভিব্যক্তির দ্বন্দ্বে ভাষা ও বস্তুর মধ্যে, শব্দ ও না-শব্দের মধ্যে সতত পরিবর্তনশীল এক বিনিময় চলেছে যেন। শব্দ যেখানে সংকেত সেখানে সে বিষয়গত। আর যেখানে তার ইঙ্গিত লুপ্ত হয়ে কবির উপলব্ধিকে বয়ে নিয়ে যায় পাঠকের দিকে সেখানে সে বিষয়ীগত। সমাজের বিকৃতি আর বিনাশের মধ্যে বসে নৈরাশ্যের প্রতিক্রিয়ায় চলে নিরন্তর এক আত্মপরিক্রমা। ডায়ালেকটিক জড়প্রকৃতি, যাকে নিয়মের নিগড়ে বাঁধা যায় সেইই বাস্তব আর সে জাগতিক নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই অবাস্তব। এই বাস্তব আর অবাস্তবের সীমারেখা পেরিয়ে ভাষাবিজ্ঞানে বেঁধে দেওয়া চিহ্ন পেরিয়ে শব্দার্থকে নিয়ে কবির এই অনন্ত যাত্রা। ষষ্ঠ অধ্যায় “TRAVEL NOTES & DREAM NOTES” যেখানে অচিন শহরে স্বপ্নভ্রমণ, যেখানে খোঁজ থাকে সেই অলীক বিমানবন্দরের, যেখানে দেশকালের আপেক্ষিক বন্ধনে আমাদের যাতায়াত। এই ভ্রমণ জীবন ও মৃত্যুর অনন্ত চক্রে, যেখানে “Time cuts the touch of fingers, the breath of life, the wings of love” এই স্বপ্ন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক যুবকের, স্বপ্নদেখার কাল্পনিক টীকা সমাজ নির্দেশিত বুদ্ধি অতিক্রম করে বোধির দরবারে তোলে অনুরণন, শব্দে, ধ্বনিতে। সপ্তম অধ্যায় “GRAFFITE: THREE SUITES AFTER IMAGES BY ARIE GALLES”। পোল্যান্ডের অসউইচ-এর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে পরিত্রাণ পাওয়া পিতামাতার সন্তান মার্কিন শিল্পী অ্যারি গালি। ১৯৯৩ সালে আকাশ থেকে দেখা এই ক্যাম্প নিয়ে “14 Stations” নামে চারকোল গ্র্যাফিত্তির চিত্রসম্ভার এঁকেছিলেন অ্যারি গালি আর সেই চিত্রের সঙ্গে কবিতা সংযোজন করেছিলেন জেরম রদেনবার্গ। কুড়িটি গ্রাফিত্তির সঙ্গে কুড়িটি কবিতা এবং এইরকম তিনটি সেট তৈরি হয় কবি ও শিল্পীর যুগ্মশিল্পকলায়। সেই তিনটি সেট এই অধ্যায়ে, যেখানে কাব্য ও শিল্পের কোহেরেন্স, অথচ শিল্প থেকে কবির দূরত্ব ও স্বাধীনতা বজায় থেকেছে পূর্ণমাত্রায়; যেখানে মধ্যযুগীয় জাপানিদের পন্থা অবলম্বন করে কবি সরাসরি মন্তব্য বা চিত্রবর্ণনা করেননি বরং জাক্সটাপজিশন বা তার কোলাজ সৃষ্টি করেছেন। অষ্টম অধ্যায় “RUSSIAN SCENES & IKONS” ২০০২ সালে কবির মস্কো ও পিটার্সবার্গ ভ্রমণের এবং নবম অধ্যায় “CHINA NOTES & THE TREASURES OF DUNHUANG for Wai-lim Yip” ২০০২ সালে বন্ধু ওয়াই-লিম-ইপের সঙ্গে চীন ভ্রমণের অনুষঙ্গে রচিত। দশম অধ্যায় “SIX POEMS FOR A ROUND OF RENSHI for Hiromi Ito” প্রায় ৮০০ বছরের পুরোনো জাপানী কোলাবোরেটিভ সাহিত্যরচনা প্রথা “রেঙ্গা” এবং তারই পরিপূরক বর্তমানের পোস্টমর্ডান প্রথা “রেনশি” যেখানে বহুকবির যৌথতায় লেখা হয় কবিতা। জাপানের আমন্ত্রণে ২০১০ সালের এই সাহিত্য উৎসবে যোগদানের ফলশ্রুতি এই অধ্যায়ের কবিতাগুলো। একাদশ অধ্যায় “CROSSING THE ANDES for Cecilia Vicuña & Nicanor Parra” ২০০৪ সালে জেরম রদেনবার্গ চিলি, আর্জেনটিনা, উরুগুয়ে ও ব্রাজিলে সাহিত্যপাঠের আমন্ত্রণে যোগদান করেন চিলির নৃকাব্যতত্ত্বের কর্মী, চিত্রনির্মাতা ও কবি সিসিলিয়া ভিকুনার সঙ্গে। আর সেই ভ্রমণের ফলশ্রুতি এই কবিতাগুলো। দ্বাদশ অধ্যায় “A FURTHER WITNESS for Anselm Hollo”। ফিনল্যান্ডের কবি ও অনুবাদক আনসেল্‌ম হোলোর সঙ্গে রদেনবার্গের বন্ধুত্ব ১৯৬১ সাল থেকে। ২০১৩ সালে সেই কবির মৃত্যুশয্যায় শেষদিনগুলোর সময়ে এই কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল। এই অধ্যায়ের পনেরটি কবিতার কেন্দ্রে কবির যে বোধ অনুরণিত হয়েছে তা আমাদের সকলের জীবনের, সমস্ত বিশ্বের বিয়োগব্যথার এক ধারাবাহিক ধ্বনি। মাথার ওপর ঝুলে থাকা এই জীবন ও মৃত্যুর রহস্য আমরা অস্বীকার করতে পারিনা কিন্তু জীবনের এই ক্ষণিক সময়টুকু এক হাতের ওপর অন্য হাতের স্পর্শ স্বীকারে যায় যেন-এই বার্তা এক সাক্ষীর বয়ানে। ত্রয়োদশ অধ্যায় “A POEM OF MIRACLES for Jack Collom” এই কবিতাগুলোর রচনাকাল ২০১১ সালে মার্কিন কবি জ্যাক কলামের ৮০-তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে শুরু হয়ে কবির নিজের ৮০ তম জন্মদিন পর্যন্ত বিস্তৃত। সময় এক রহস্য। তারই প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্মদিন, মৃত্যুদিন, যাপনের সমস্ত উৎসব আর মহাকাল বয়ে চলে প্রবাহের মত। অনাদি অনন্ত বিস্তার। শুরু নেই শেষ নেই। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ তার সমস্ত আলোড়ন নিয়ে ইউনিফায়েড হয়ে আসে সময়ের নাভিতে। আর সেই নাভি থেকে উৎসারিত তৃতীয় পদচিহ্নে নতজানু কবি খুঁজে ফেরেন নিজেকে, “there is/ no time/ but now/ which holds/ all times” আমাদের চারপাশের এই প্রাকৃতিক জগত তার মুহূর্তযাপনের উৎসব নিয়ে অতিপ্রাকৃত জগতের থেকেও অনেক বেশি অলৌকিক হয়ে ধরা দেয় কবির বাস্তবতার বোধে; যতই তার নিকটবর্তী যাওয়া যায় ততই সে অসীম অন্ধকারের দিকে যাত্রা করে, কবির ভাষায়, “The mysteries of time & rhyme loom up for me & will until all time is lost.” 

রদেনবার্গের কবিতা এভাবেই শব্দে ছন্দে ধ্বনিতে বেজে ওঠে তার রূপ নিয়ে আর রূপের অতীত এক বৃহত্তর সত্তার ব্যঞ্জনায় তার বোধ নিয়ে; ইন্দ্রিয়গম্যের মধ্যে ইন্দ্রিয়াতীতের প্রকাশ। হোক সে real কিংবা virtual, হোক সে জৈব কিংবা ভৌত, কোনো বিজ্ঞানের দাবি মেনে নেওয়ার দায় নেই কবির। সমাজ নির্দেশিত বুদ্ধি অতিক্রম করে বোধির দরবারে তার অনুরণন। শেষ করি কবির ব্যক্তিগত ম্যানিফেস্টো দিয়ে, 1)I will change your mind; 2)any means(=methods)to that end; 3)to oppose the devourers=bureaucrats, system-makers, priests etc.(W. Blake)। A Field On Mars বইটিতে ফরাসী ও ইংরাজি দুই ভাষার একত্র সমাবেশ। এখানে ইংরাজি থেকে অনুবাদ করা হল। আসুন পাঠক, এবার পড়ি “A FURTHER WITNESS” অধ্যায়টি থেকে কবিতার অনুবাদ।

আরো এক সাক্ষী 

(A FURTHER WITNESS for Anselm Hollo)

সকলেরই ধীশক্তি আছে আর আছে তার ভাবনার শরিকানা

– আক্রাগাসের এম্পেডোক্লিস

১।

আরো গভীরে যাই আমি
(I Move Into a Deeper Space)

মৃত আমি
জীবিত ভাইদের ডেকে বলি
কী অর্থহীন তোমার চলা
কেবল দায়মুক্ত ভেসে বেড়ানো
জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি তুমি
তবু তোমার শব্দের হাতে হাতকড়ি
খাঁচায় বদ্ধ মন
আমি জানি তোমায়
বুঝি সব ব্যথা
অবাধ তীব্রতায়
আরো গভীরে যাই আমি
যেখানে কেউ নাগাল পাবে না আর
আমি আঘাত করি
আর শরীর থেকে এক আহ্বামক তরল             
(. আর্তুদ)
গড়িয়ে যায় মাটিতে
রুদ্ধ করে প্রবেশপথ
পাখিরা যেমন
ছুরি মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আকাশ থেকে
le mal du ciel
শব্দবন্ধ শুনে উড়ে যাই আমি 

—–  

২।

বুকের ঘড়িটা কাঁপছে তোমার
(The Clock Inside Your Heart Atremble)

আলোকণা হয়ে গেল স্নায়ু্র প্রান্তরেখা
গ্রহণবিদ্ধ চোখ
গেঁথে যায় গলার ভেতর
চেষ্টা করি উগরে দিতে কাশির দমকে
পারি না
নখের চেয়ে তীক্ষ্ণ এক জিভের ধার
আমাকে অসাড় করে
অধরায় রয়ে যায় আমার যন্ত্রণাস্মৃতি
ছোট গাছের নকশা আমার বাধা
চোখের পিছনে ঝলকে ওঠা আলো
কূজনে মাতে
বাতাসে তৈরি পাখির
ডাক
ঠুনকো
হাড়
আমার আ
ঙুল ফাটিয়ে তার বোনে
(হতবুদ্ধি) রক্তের ধারা
এমন
সূক্ষ্ম যেন ক্রমশ অদৃশ্য
শুধু টিকটিক করে বুকের ঘড়িটা
ক্রমাগত ঠন্‌ ঠন্‌
ঘুমন্তদের পেরিয়ে যাবে রাত
আর আমরা চাদর উঠিয়ে দেখব
কেমন তারা ঝরে যায়
অশরীরী হয়ে
হাজার বিশ্বমাঝে

——-  

৩।

রহস্য কেবল শব্দেই থাকে
(The Mystery Is in the Words Alone)

শব্দ দিয়ে ধরতে পারিনা মনরহস্য
কী এক শক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে
অন্তরমহলে জিয়নো মহাবিশ্বে
ভাবনারা ফেরে উৎসমুখে
মানচিত্রহীন
অনুপস্থিতি
বন্ধুর বিদায় এক দূরত্ব
বুকের শ্বাস বরাবর
দিন ঘনায় মুহূর্তে
রাত দিনের গভীরে
রহস্য কেবল শব্দেই আছে
(সে লেখে)
বাকিসব অজানায়
শুধু মনে রয়ে যায়
সকলেরই ধীশক্তি আছে
আছে তার ভাবনার শরিকানা

——  

৪।

আকাশ যখন কালো হতে থাকে
(As the Sky Goes Black)

স্থির কিংবা চলন্ত
আধেক মানুষ
আর আধখানা
পাগল মেশিন

সে নিজেই টের পায়
নিজের হয়ে ওঠা
যার জন্য তার দৌড়
হাড়মাসের বন্ধনমুক্তি

একাকী চোখ
পাখিময় পথ দেখে

দুষ্টুমিষ্টি ওই কিচমিচ
তাকে জীবনের ডাক দেয়
আর সদাই পাখি             (হ্যানশান)

আমার ভার তোমার চেয়ে বেশি
এক জীবন কত নিঃস্ব ও নিখাদ

ওই ধ্বনিতে ডুবতে ডুবতে
দাহ যাবে দিগন্তে

বাতাসে পালতোলা স্বপ্ন শেষ
তবুও হাতে হাত পৃথিবী ছুঁয়ে
ঠিক নীচে এগোনো থাবা
বিস্ময়ে দেখে
আকাশ কালো হতে থাকে

——–   

৫।

সময়ের স্রোত
(The Flow of Time)

একটা প্রশ্ন
আর উত্তর
একটার পর একটা প্রশ্ন
যোগ করতে করতে
সে দেখতে পেল
এমন বাছাই কী হাস্যকর
কিন্তু থামাতে পারে না স্রোত
সময়ের
*                                 *অন্ত্যমিলের
এ তো প্রবাহ নয়
কেবল এক অস্তিত্ব
রাস্তার ছোট সেই গাছটা
কী স্বপ্নাতীত বেড়ে ওঠা
জঞ্জালিত রাস্তার জল
ছুটছে সেই গর্তের দিকে
যে তাকে নামিয়ে দেয়
*                                 *ছেড়ে দেয়
যেখানে তার শৈশব শুরু
অতীত ও কবরিত
সময় নিমেষে মুহূ্র্ত
যেমন মহাবিশ্বের আইন
কত সহজেই
তিরস্কৃত
*                                 *অস্বীকৃত
যেখানে সময় স্থির
ঠিক বিপরীতে
নিদারুণ নজির
*                                 *নিমেষ

———  

৬।

এক নিটোল বৃত্ত
(A Perfect Circle)

আলোর প্রোটোকল
উড়িয়েপুড়িয়ে দেয়
স্বপ্নচারীর ভাবনা

আমি তাকে দখল করি
আনমনে
বলি আমারই ঝলক

বাড়তি জ্বলন
জাগছে ভ্রান্তিবিলাস

সামনে থেকে পিছনে
রঙে রঙে বৃত্ত নিটোল

উড়ন্ত কণাসকল
হাজার বনপাখি

কোনো প্রোটোটাইপই এত বাস্তব নয়
গোপন জীবনসত্যের কাছে

জন্তুগুলোর এমন ফ্যান্টাসি
যেন আচ্ছন্ন ইঁদুর                                    (জন সোল্টের জন্য)
আর মাকড়সা

দেখো পাশরাস্তা উঠছে
তোমাকে মারবে বলে

যেভাবে স্বর্গের রাস্তা পিছু হাঁটে
আর আমাদের বদ্ধ করে*                                 *আমাদের অন্ধ করে

———  

৭। 

এক ঈশ্বর মুখ লুকোলো
(A God Concealed)

আমি
সেই অহং
অন্য জিভে

কে সে
তারই ফুলে ওঠা বোধ

তাকে দুর্ভাগা ক’রে
বিচ্ছিন্ন একদিন

তার কথাপাঠ
কাচে আর বাতাসে

অথবা আকাশের চোখে
তোমার মুখপাঠ

উজ্জ্বল চোখ
বরফকণা যেমন

এক ঈশ্বর মুখ লুকোলো
তির্যকতায়

শব্দটা অন্য জিভে
formidable                                  [form-i-dabley]

শব্দগুলো নেচে নেচে
নেমে এল শ্রবণে

মনে পড়ে
কথায় লেখায় কীভাবে তুমি

বন্ধু ও কমরেড মনে পড়ে
চলে গেছে সেই কবে 

——  

৮।

শরিকানায় রাখা বন্ধুদের নাম
(The Names of Friends We Share)

মৃতজন প্রতিটা কোণে
ওইখানে খুলছে এখন
সময়মুক্ত
নাম আর মুখ

নিঃসঙ্গ মৃতরা আমাদের দেখে
খেলাটা শেখে
তারপর শেখায় আমাদেরই
কীভাবে সময়পাঠ
আগে ও পরে

এক ঝাঁক অতীত
মুখহীন অন্তরমহল
যেমন দেখি
প্যারিসের পুরোনো পথ

বার্লিনমুখী ওড়া
শরিকানায় রাখা বন্ধুদের নাম
(Amirgen White Knee)
বিবর্ণ মুখ আর ধূসর চুল
অন্য জগৎ অচেনায়

অতল অগাধ
আমাদের উল্টোপিঠে
হিমানীল আকাশমুখী চোখ
বদলের ব্যারোমিটার
জীবিত ও মৃত একসাথে

আমার হাতে হাত রাখো
খুঁজে নেবো পৃথিবীর পথ
ওইখানে মন
রেখে দেবে মনে
হৃদয়ের শরিকানায় থা
কুক ইরাদা
মৃত
জন রেখে গেছে
আমাদের জন্য
এক অনুপস্থিত মুখ

——– 

৯।

তোমার আমার মনের ভেতর
(Inside My Mind & Yours)

নিজেই যে উঠে এল
শব্দটা
সঠিকও নয় সম্পূর্ণও নয়

তাকে চুষে চিবিয়ে
মুখ থেকে ছুঁড়ে
জীবন্ত করে

অবাক দেখে
কাচের ওপর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত

তোমার আমার মনের ভিতর
গ্রহটাকে
দেয় জমি

শুধুই মনের চোখ
অন্য কিছু দেখিনি আর

সাদা ও কালো আগুন
লোহিত কেন্দ্র

তোমাকে ডেকে নেয় মন আমার
তুমি খুঁজে পাবার আগেই

কোণ সব হাটখোলা এমন
যেন সাগরও চোঁয়াবে

তরল বাতাস এখনও
আরা
মহারাম গরম

কালো আগুনের ওপর সাদা আগুন

সাদার ওপর কালো

——–  

১০

মৃত্যু নিয়ে ভাবতে দাও আমায়
(Let Me Consider Death)

মৃত্যু নিয়ে ভাবতে দাও আমা
অথবা
এখনই বাতিল করো

কঠিন সত্য ভেবে
নামি
ধাপে ধাপে

কবরে
মোহভঙ্গ হয় না
কেবল গড়িমসি করি

আজ রাতে শব্দটা
অন্য প্রজন্ম
আমাদের পরে

নতুন পৃথিবীটা ঝলকাবে
যখন হেঁটে যাবো গলি ধরে

তবু নাম অজানায়
যে নাম বাঁধা থাকে কিছু অনুষঙ্গে

তবু কী নীরব দেখো
নীরোগ নবীনেরা

রক্তশূন্য অন্ধ পূজারিদের
কবরে

কোনো মানে রাখে না
আমাদের মৃত
জনে
নাম
আর মুখ

দৃশ্য পৃথিবীগুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে
পথের সংকেত পিছনে
কিছু

কোথাও সময় নেই
তবু এই সময়
ধরে রাখে সমস্ত সময়

ওইখানে দেখি
ঝাঁপ ফেলছে আগামী

——–  

১১।

ভেবে থাকা ভাবনাটা বেঁচে থাকে
(A Thought Once Thought Survives)

আমি আর নেই যখন
তখন কী বা কে রয়ে গেল
গণইতে আমাদের নাম

ছোট্ট বিশেষ্য
এখনই গলার কাঁটা
উগরানো কষ্ট আরো

ভেজা শব্দগুলো ছড়িয়ে পড়তে দাও
পাঠাও ওয়েবে
হলুদ জাল
এমন টার্মিনাল
নিঃশ্বাস কালো হয়ে ওঠে

কাচের ওপর এমন ইমেজ
যেন তারকামণ্ডল
এত ম্লান
চোখ যায় অধরায়
কেবল দেখে রাত

শিরদাঁড়া বেয়ে ভেঙে পড়ে
মালা গাঁথা দেহ
মুখখোলা হাড় বেয়ে
মজ্জার স্রোত

দূরবর্তী অধিবাসী
ঘোড়সওয়ারী কেউ
আমাদের চিহ্নিত করে
পুরোটা স্বপ্নে দ্যাখে
তারপর ভুলে যায়

মেঘালি এই জীবন
ভেবে থাকা ভাবনাটা বেঁচে থাকে
টার্মিনাস নেই
কোথায় ছিলাম বা আছি

মহাবিশ্ব শুষে নেয়
রূপ তার
চিরকালের জন্য

রাগী, হিংস্র আর নিষ্ঠুর
যতটা শাসিত ভালোবাসায় 

——-  

১২।

অব্যক্ত শব্দ
(The Word Unspoken)

মানুষের স্পর্শহীন
দূরে একা একা
ঘরের অন্ধকার
তাকে ঘিরে গুহার মতো
অচিন দেশ এক
ওইখানে জিওল সব
যন্ত্রণা নতুনের আহ্বান

অব্যক্ত শব্দটা সৃষ্টি
স্বপ্নটা যেমন অনেকদিনের পূর্বাভাস
নিজের জীবন ভেবে এইসব খেলা
এখন অতীত
মাঝের সময়টুকু বাস্তব নয় আর

মন তার পুরোনো পথে
আক্রোশে আনন্দ মিশে
নিষ্ঠুর বুদ্ধি
হয়ে ওঠে মহাবিশ্ব
আবিষ্কার করে মিথ্যে
সময়ের*                                 *অন্তমিলের
গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে
নিজেকে খুঁজে পাবে
আলোলিত হয়ে  

———  

১৩।

ওই আকাশ যে স্বর্গের আশ্রয়
(The Sky that Harbors Heaven)  

কবির পঙ্‌ক্তিরা হেঁটে যায় গৃহহীন
কঠিন হয়নি এখনও
বিশ্বাসে
নিষ্ঠুরতায়

সেইসব স্বর হারিয়েছে আমাদের কাছে
নীরব সংকেত
নিশ্চিত মৃত্যুর মতো*                                  *নিঃশ্বাসের মতো
এখনও উচ্চরোল
শুনে আমি জমিয়ে তুলি কান্নার ধন

সবচেয়ে বড় কান্নাটা
নীরবতা
জ্ঞানীরা যেমন বলে
আর মুখোমুখি সেই আগামীর
যে এখনও তার পিছে

রহস্য ভালোবাসি
ওই তো ভাঙে পৃথিবীকে
এমন
যেন দীনালোও দীপ্তি দেয়

ওই আকাশ যে স্বর্গের আশ্রয়
সে কোনো আকাশ নয়
অন্ধকার পৃথিবীর বুকে
নির্বোধ অপেক্ষায় থাকে
পুরো দেহমন
গিলে ফেলে যতক্ষণ

শুধু দুর্লভ চিহ্নটা রয়ে যায়
শেষবারের মতো

———  

১৪।

পৃথিবীটা আমাদের দর্শন আর অনুভবে গড়া
(The World Is What We See & Feel)

পৃথিবীটা যদি তেমন হতো
যেমন মনে হয় সূর্য পরিক্রমা
ছুটে যায় স্বর্গের মাঝবরাবর
মহাবিশ্ব এক নক্ষত্রখচিত ছাদ
নাগালের বাইরে নয়
এগোতে চায়
এখনও সমতল পৃথিবীর দিকে

গ্লাসের জল শূন্যতা জীবনের
মুখহীন স্বর ওই বাতাস
সমুদ্র এক উপস্থিতি
জীয়ন্ত

দেবদেহগুলো ছায়া ফেলে সমতলে
মৃতরা স্বপ্নে এসে কাঁদে

আমাদের দর্শন আর অনুভবে গড়া এই পৃথিবীটা
কখনই নয় আজকের মতো
যখন খুনিরা আবার জেগে ওঠে
মুলতুবি রাখা গুপ্তঘাতকের যুগ ফিরে আসে
পুরো বিস্ফোরণ
আর হাতছানি
আবার দৌড়ের

যেমন একবার হয়েছিল

———  

১৫।

কোডা 

ডায়ানার উদ্দেশ্যে

(Coda

for Diane)

চিরন্তনের আশায় কিছু লেখা 
অন্য এক স্বপ্ন
জেগে উঠে জানি
এটা পড়ার জন্য কেউ থাকবে না
IKKYU[2]

আলোতে নিমগ্ন
চরম অন্ধত্ব বন্দি করে তাকে
চলন্ত গাড়িতে ঠুসে দেয় দেহ
অতীত ও ভবিষ্যৎ
ধাক্কায় ফেটে পড়ে বিস্ফোরণে

শেষ ইমেলটা করি
যারা আমার অচেনা
মন আমার অন্ধকার এখন
মহাবিশ্বের মতোই অব্যক্ত

আমার হাত থেকে পড়া বইটা
কোনো আলোর বল নয়
ছেড়ে আসার ব্যথা আমার
কখনই তোমার হতে পারে না
অন্য এক স্বপ্ন
আমাকে দখল করে

তোমাকে ভালোবেসে সামনের পথ
দেয়ালের দূর এক প্রান্ত
নতুন নির্মাণে আরো এক সাক্ষী
ভালবাসার নামে ইশারা
এমনই শক্তি

শুধু বর্তমানটুকু আমাদের
তোমার সঙ্গদিন বসে বসে গুনি
আঙুলের যোগ বিয়োগ
তারপর বেঁচে থাকি ধার করা সময়ে
বই ফেলে চলে যায় শব্দেরা
জ্বলজ্বল করে আমার স্বপ্নে
যাদের জন্য এইসব
লেখা আর বলা
জেগে উঠে জানি
এটা পড়ার জন্য কেউ থাকবে না

———- 

কবি পরিচিতি-

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্কিন কবি জেরম রদেনবার্গ পোল্যান্ডের ইহুদি পরিবারের সন্তান, জার্মানির কবি Meir of Rothenburg এর বংশধর, জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকায় ১৯৩১ সালে। স্যান্ডিএগোতে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সাহিত্য ও ভিস্যুয়াল আর্টের অধ্যাপক। নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পেয়েছেন ডক্টরেট উপাধি। প্রায় নব্বইটি কবিতার বই তাঁর (Poland/1931, That Dada Strain, The Lorca Variations, Khurbn ইত্যাদি) এবং নটি সাহিত্য অ্যাসেম্বেল্‌জ-Technicians of the Sacred, Shaking the Pumpkin, Revolution of the Word, আর Poems for the Millennium(খণ্ড ১ ও ২ পেরি জরিসের সঙ্গে, খণ্ড ৩ জেফরি রবিনস্‌নের সঙ্গে, খণ্ড ৪ পেরি জরিস ও হাবিব ত্যাঁগরের সঙ্গে, খণ্ড ৫ জন ব্লুমবার্গ-রিসম্যানের সঙ্গে)। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন ধরণের কবিতা পারফর্ম্যান্সের সঙ্গে জড়িত, যেমন হ্যানন রেজনিকভ তাঁর Poland/1931 বইটি লিভিং থিয়েটার ও নাট্য সংস্করণ করেছেন এবং তাঁর Khurbn বইটির একটি সংগীত সংস্করণ করেছেন সুরকার চার্লি মোরো ও জাপানী উপন্যাসিক মাকোতো ওডা যা 1995 সালে ‘ব্রেড ও পাপেট’ থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নৃকাব্যতত্ত্বের প্রাণপুরুষ জেরম রদেনবার্গের অ্যানথোলজি ও জার্নাল যেমন Alcheringa New Wilderness Letter. তাছাড়া তিনি অনুবাদ করেছেন অজস্র জার্মান কবি ও শিল্পীর যেমন লোরকা, গমরিঙ্গার, সুইচার্স, পিকাসো‌ ইত্যাদি। বহু বিস্তৃত কবির কাজের ক্ষেত্র, লাভ করেছেন অজস্র পুরস্কার- Guggenheim ফেলোশিপ, Wenner-Gren Foundation পুরস্কার নৃকাব্যতাত্ত্বিক অনুবাদের জন্য; শিল্পে তাঁর অবদানের জন্য National Endowment for the Arts থেকে পেয়েছেন বহু পুরস্কার; কবিতার ক্ষেত্রে PEN Oakland Josephine Miles Awards, PEN Center USA West Award, এবং অনুবাদের জন্য PEN American Center award, Alfonso el Sabio Translation Award; তাঁর কাব্যতত্ত্ব ও অ্যান্থোলজি Poems for the Millennium3 পেয়েছে American Book Award; তাঁর অন্য আরো উল্লেখযোগ্য কবিতা ও অ্যান্থোলজি A Book of Witness, Triptych, French edition of Shaking the Pumpkin, Barbaric Vast & Wild: Outside & Subterranean Poetry, Poetics & Polemics 1980-2005, Gematria Complete, Concealments & Caprichos, Retrievals: Uncollected & New Poems 1955-2010, A Poem of Miracles, A Field on Mars (English and French editions), The President of Desolation (2019), Eye of Witness: A Jerome Rothenberg Reader ইত্যাদি। বর্তমানে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার কবিতার ওপর কাজ করছেন নৃকাব্যতত্ত্বের সঙ্কলন হিসেবে। 


[1] ubu.com/ethno/discourses
[2] IKKYU -(1394–1481) was an eccentric, iconoclastic Japanese Zen Buddhist priest, poet and calligrapher.

Facebook Comments

Leave a Reply