লক ডাউন : পূবালী রাণা

রেটিনায় এ বড় দোদুল্যমান সময় । এ বড় মৃত্যুপ্রবণ দুঃসময় ! রুলটানা একটা দীর্ঘশ্বাস বিরহের মধ্যে ফুঁপিয়ে ওঠে । হাওয়ায় ভিতরে বন্য হাহাকার ঘুরেফেরে। মৃতপ্রায় পরিযায়ী শ্রমিকের কান্না অদৃশ্য হয়ে যায় ইসলাম ফোবিয়ার অশ্লীল উচ্ছ্বাসে । মৃত্যুদেবতা অনাহারী বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বেড়ায় । কাপালিকের মতো চোখে তার নিহতের জগত । কিন্তু বসন্ত মৃত্যু বোঝে না , শুনশান রাস্তায় হলুদপাতা উড়িয়ে গেয়ে যায় বসন্তের গান । বৃষ্টির প্রাচীন ছাঁটে মাটি থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধ ওঠে , যেন আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে ।চৈত্রের কালবোশেখির ঝড় -আমাকে তোমার দিকে টেনে নিয়ে যায়।যেন তুমি সমুদ্র , আর আমি নদী । সমুদ্রে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনায় আমাকে হয়তো বাঁচিয়ে রাখে ।
নিহতের দেশে তবুও সন্ধ্যা নামে । ফুলের গন্ধে ভরে থাকে সন্ধ্যা ।রজনীগন্ধা আর বেলিফুলের বান্ধবীগন্ধ খেলা করে আমার শরীরে । স্পষ্ট টের পাই । গন্ধশিকারির মতো তুমি কি আমার দিকে এগিয়ে আসো তখন ? অনিশ্চিত জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে আমায় । মৃত্যুর পৃথিবীতে আমার অস্থিরতা তোমার বুকের কাছে পাক খায় , তুমি দেখতে পাও না । তখন তোমাকে আমার বাবা মনে হয় । ভালোবাসার মানুষ যখন বাবা হয়ে যায় , তখন বাবারা হয়ে যায় আকাশের তারা । তোমার মধ্যে বাবার ছায়া দেখে ভয় হয় । প্রেমকোষগুলি যখন ক্ষুধার্ত হয়ে ডাকবে , তখন যদি তোমার মধ্যে বাবার ছবি দেখে ফেলি , তাই ভয় হয় ।
অথচ , তুমি প্রেমিক কিংবা বাবা না হয়ে স্যাঁতস্যাঁতে একটু গলি হয়ে গেলে । যে- গলিগুলি নিষিদ্ধপল্লীতে গিয়ে শেষ হয় , সেরকম একটা গলি হয়ে গেলে । ঝাঁক বেঁধে জোনাকির সেখানে আসে না লুকোচুরি খেলতে । আসে না তৃষ্ণার্ত হরিণ ।
শিরিষ ফুলের মাতাল করা গন্ধে তন্দ্রা কেটে গেলে দেখি জ্যোৎস্না শেষের চাঁদ মুখ লুকিয়েছে ইউক্যালিপটাসের পাতার গভীরে । জঙ্গল ঘেরা গ্রামে লকডাউন চলছে শহরের মতো নিয়ম মেনে । যদিও প্রকৃতির এতে কিছু এসে যায় না। সে তার নিজের ছন্দে পেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মাইল । ভাবি , জীবনের লকডাউন কেটে যাবে একদিন । স্তন্যপায়ী শিশুরা মুখ রাখবে পৃথিবী মায়ের বুকে । আমার দুঃখরা পেরিয়ে যাবে অগুনতি লাইটহাউস …

Facebook Comments

Leave a Reply