সেলফ্‌ কোয়ারেন্টিনের একদিন অথবা ফিলহালখাতা : প্রশান্ত সরকার

সকাল ৮.৫৬ মিনিট

এলার্মটা বেজে গেছিল কিংবা হয়ত বাজবে আরও ৪ মিনিট পর, ঠিক মনে পড়ে না। যেমনভাবে মনে পড়ে না কাল সারারত ঝগড়ার পর কে কার ছায়ার দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাতে আলো জ্বললে ঘুম আসে না… তাই আলোর প্রশ্ন এখানে অবান্তর। স্বভাবতই আলো জ্বলেনি তবু ছায়ার কথাই বললাম কারণ একটাই। সমস্ত মুখোমুখি থাকাই পারতপক্ষে একটা ছায়া তৈরী করে। কোনোটা তার আলোর অভিমুখে থাকে, আবার কোনোটা…

সন্দেহপ্রবণ হলে তখনই ডেকে তুলতে পারতাম পাখিদের। মশারিটা সরিয়ে রেখে নেমে আসি ঘাসে, ঘাসে তখনও শিশিরের ভিজেভাব। ভাবছি দরজা খোলাটা উচিত হবে কিনা কারণ আমি জানি দরজা খুললেই ওপারে রাখা আছে সারি সারি মৃতদেহ। শুধু সংখ্যাটা জানার জন্য টিভি চালানোটা জরুরি…

সকাল ১০.৩০ মিনিট

তখনও ভাত ফুটছে। যতক্ষণ না উপচে পড়বে ততক্ষণ সন্দেহ থেকে যায় আগুনের ওপর। হাঁড়ির ঢাকনা উঠছে নামছে স্ফুটনাঙ্কের আয়ুরেখা ধরে আর স্টেশনের চরাচর ধরে অসংখ্য পরিযায়ী, ওরা কাজ করে… বাতিল হয়ে যাওয়া ট্রেনের সংখ্যা গুনতে গুনতে ওরা তীব্র চিৎকার করছে, রোগা রোগা পেট ফেটে পড়ছে ক্ষোভে, [#########] বিক্ষোভে। তুমি তো জানোই সব ভীড় মিছিল হয়ে ওঠে না সহজে। তার আগেই চোখের সামনেই ছিটকে আসছে রক্ত, আসলে একবার বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে ভীড় আর ভীড় থাকে না। জমাট বাঁধতে পারে না হাড়ির চাল, তাই আরও একবার নেড়ে দেওয়া গেল। সরু চাল……… আয় বেশী……… ফুটলে ভাতে বাড়ে। বেড়ে চলে……… বেড়েই চলে যতক্ষণ না………

… অথচ এখনও ট্রেনের কোনো শব্দ নেই, যেন অসাড় হয়ে আছে দুটো সমান্তরাল লাইন দীর্ঘদিন কিন্তু তেমনটা হওয়ার কথা ছিল না। প্রতিশ্রুতিমতো যাতায়াত হওয়ার কথা ছিল নিয়মমাফিক। তাই গরীবগুর্বোরা ভীড় করেছিল শহরে, ওরা কি জানত না ওদের ফেরা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই! এ এক নিরন্তর সাপসিঁড়ি খেলা। আসলে খিদের কাছে যে কোনো অজুহাতই লঘু। এই সময় নিয়ম করে পাখিরা উড়ে যেত রোজ, আজ কেউ নেই। সারা দেশে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৬। হিসেব করে দেখতে গেলে হয়ত আরো কিছু বেশী। খিদে বাড়ছে… লক্ষ লক্ষ হাত কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছে খিদের দিকে। একটা ট্রেনের হুইসেল মুহূর্তে বদলে দিতে পারে অনেককিছুই। অথচ জীবন চাইছে আরও বেশী…

বেলা ১২.৪৫ মিনিট

“শিরোনাম এই মুহূর্তে……… নিবেদন করছে –

রাজ্যে করোনায় মৃত বেড়ে ৭
প্রধানমন্ত্রীর ১৫কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা
রাজ্যজুড়ে পুলিশি টহল, লকডাউন অমান্য করলে প্রয়োজনে গ্রেপ্তার
কল্যাণীতে ধর্ষণের শিকার এক প্রতিবন্ধী তরুনী, পলাতক ৩
রেশনের চাল নিয়ে দূর্নীতির অভিযোগ, অভিযোগ অস্বীকার করলেন শাসকদল
বান্দ্রা স্টেশনে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভ ঘিরে লাঠিচার্জ

শিরোনাম এই মুহূর্তে……… নিবেদন করছে –”

এইসব হুবহু শব্দে অভ্যেস হয়ে গেছে বহুদিন। যেমন পাখিদের চিৎকার বা শীৎকার কোনোটাই আর ঘুম ভাঙাতে পারে না পাতাদের। অভ্যেস তো আসলে অভিজ্ঞতাই এক, খুব বেশী কিছু প্রমাণ করতে না পারলেও তা সকলেই জানে। পাতারা এসব মেনে নিয়ছে একপ্রকার অভ্যেসবশতই। আর আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ফেলেছি যে কোনো ধর্মই আলোর দিকে ফেরায় না।

মিথ্যে সংক্রমনের ভয়ে জামা খুলে রাখছে আকাশ। মানুষ ততক্ষণই নিজের কাছে দায়বদ্ধ যতক্ষণ না সে নিজেই নিজেকে সন্দেহ করছে। ছায়া আর শরীর সরলরৈখিক হলে ছায়া উহ্য হয়, তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেব শরীরও উহ্য হয় কখনও কখনও অর্থাৎ যতক্ষণ না আলো এসে মধ্যস্থতা করছে ততক্ষন ধরে নাও ছায়াই উহ্য। বিরোধীতা করতে করতে রং বদলে নিয়েছে আলোই, বারবার। সমস্ত বিবৃতি থেকে শুধু ছায়াদের গান স্পষ্ট হল, যদিও কখনোই তার কোনো দায় স্বীকার করেনি পাতারা। এখানে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা প্রাসঙ্গিক নয় ততটা তবু সমস্ত আক্ষেপ, সমস্ত অভিযোগ নিয়ে পাখিদের যাবতীয় দাবী ফিরিয়ে দিতে সম্মত হল। বস্তুত সমস্ত গানই এখানে রূপক, সমস্ত ছায়াই… যদি না আলোর অভিঘাতটুকু বোঝো……

দুপুর ২.১৭ মিনিট

গলায় ঘন্টা রাখতে রাখতে
বেড়ালটা হুবহু নকল করে ফেলেছে তার স্বর

হাওয়া দিলে আপনিই ওঙ্কার উঠছে

আমরা ধর্ম নিয়ে সভা করছি
আর সে দুচোখ বন্ধ করে হাসছে

শুধু মৃদু মৃদু শব্দ বাজছে ঠোঁটে

দুপুর ৩.৩৫ মিনিট

নিঃশব্দে অতিক্রম করছি ঘর, জানলা, দরজা, কিংবা ঈশ্বরের যেটুকু বরাদ্দ। দুপুরের দিকে এখন আর ঘুম আসেনা। তানপুরার গত আর মানাচ্ছেনা এইসময়। পাতায় ভর করে সাঁতার কাটছি, মাঝেমধ্যে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আলো পুড়ে আসছে, জুড়ে আসছে সমস্ত ঘোলাজল ও উপেক্ষা… ঈশ্বরের রূপ, তার ধ্বংসাবশেষ কিছু…

“এখন, পকেটে রাখা রুমালের টানা ও পোড়েনে
হাত রেখে মনে হয়– মাঝেমধ্যে, চোর হওয়া মন্দ নয়। দৈবাৎ,
নিয়তিতাড়িত এক ঈশ্বরের মতো
চোখের আড়াল দিয়ে ফিরে আসা, তোমার পিছনে!”
(নিঃশব্দে অতিক্রম করি । শৌভ চট্টোপাধ্যায়)

বিকেল ৫.৪৯ মিনিট

সাধারণত এই সময়টা এতটা হু-হু থাকেনা এদিকটা। পাখিদের ডাক ভরিয়ে রাখে ব্যালকনি। মরা আলো ভাসিয়ে রাখে ছাদ। ছাদের এদিকটা থেকে যতটা দেখা যায় ততটাই বিপর্যস্ত এযাবদ। একটাই অসুখ গ্রাস করে ফেলেছে আমাদের দৈনন্দিন আলোছায়াটুকু। এখনও শহরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী, সন্ধে নামেনি এখনও। সমস্ত বারান্দা জুড়ে কমলা যেন পাখিদের ঘোর চেনার রাস্তা দেখাচ্ছে, দূরের শাঁখের ঠোঁটে ঠোঁট জুড়ে দিচ্ছে কেউ…

এতটা আলস্যের পর মনে হয় ফিরে যাই, চলে যাই যেদিকে হাহাকার, ক্লান্ত ডানা। শুধুমাত্র আকার নেই বলে যে কোনো আলোকেই দিন বলা গেল না সহজে। শুধুমাত্র আকার নেই বলে সব খিদেকেই লড়াই বলা যায় না অথচ কতজনই তো এভাবেই ভাসিয়ে দিচ্ছে সন্তানের লাশ শুধুমাত্র খাবারের অভাবে। কার্ণিশ বেয়ে আসতে আসতে অন্ধকার নামবে এখন। অথচ ঘুমের মতো কোনো আকার ছিলনা বলে কত অন্ধকারকেই তো রাত বলা যায়নি… হিসেব রাখো তার!

সন্ধে ৮.১০ মিনিট

ছোঁয়াগুলো ক্রমশ ছোঁয়াচে হয়ে উঠছে, তীব্র ফ্ল্যাশ থেকে চমকে উঠছে আকাশ। বৃষ্টির সম্ভাবনা নাকি অন্য কিছু? আবহাওয়া দপ্তর থেকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে মেগাহার্টজ। অন্যদিন হলে ঘন্টাখানেক এভাবেই মুখোমুখি বসে থাকা যেত। অন্ধকারের ভারসাম্য এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। অভুক্ত চোখেরা বন্ধ হয়ে আসবে ধীরেধীরে। এদিকে দূরদূরান্ত অবধি রটে গেছে মেঘেদের যাবতীয় মলহার। আর তুমিও হয়ত এখন প্রবাস থেকে ইয়ারপ্লাগ সংযোগ করছ কানে… ফরিদা খানম অথবা আবেদা পরভিন তবু আমি অন্ধকারকেই অলীক বলে জেনে এসেছি বরাবর…

রাত্রি ১১.৩৮ মিনিট

…অথচ হিসেবে কোনো ভুলত্রুটি ছিল না, নাহলে কিছুতেই পেরোনো যেত না এই অভ্যন্তরস্থ ত্বরণের মান। এই যে কাজের অজুহাতে বারবার সংক্রামিত হওয়ার ভয় উপেক্ষা করে নেমে পড়ছি নিজেরই পাঁজরের ভেতর, খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনছি অনাবশ্যকীয় স্মৃতির রসদ কিংবা এই যে নিজের হাতেই ধ্বংস করছি একেকটা ফলপ্রসূ দিন শুধুমাত্র তোমায় সংক্রামিত করব না বলে, সে-ই বা কম কী! আর তাছাড়া কতকিছুই তো আমরা এভাবেই হেরে বসে আছি, হারিয়ে বসে আছি শুধু অর্জন করতে চাইনি বলে…

রাত্রি ২.১৪ মিনিট

‘রাত্রি’ শব্দটার মধ্যে আমি কখনোই কোনো দ্বিচারিতা দেখিনি, আলোয় যতটা থাকে। বস্তুত আলোই তো প্রতারক… অন্ধকারের চেয়ে আলোই তো প্রতারণা করে সম্ভাবনার থেকেও বেশী। হয়ত ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না, হয়ত সবটা বুঝিয়ে বলা যায়ও না সেভাবে শুধু একটা বিভ্রমের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি সারি সারি লাশ, পড়ে আছে। তাদের আমি চিনি, খুব ভালো জানি তারা আমারই আত্মীয়। উঠে আসছে তারা আমাদের ছুঁয়ে দেবে বলেআর আমরা দৌড়ে পালিয়ে বাঁচটে চাইছি আমাদেরই প্রিয়জনের থেকে যেন ছুঁয়ে দিলে অনর্থ ঘটে যাবে।যন্ত্রণায় ছটফট করছে তারা তবু আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না কিছুতেই। কিছু কিছু ছোঁয়া ছোঁয়াচেনা হওয়াই ভালো। দেখতে পাচ্ছি তারা মরে যাচ্ছে একে একে আর সমস্ত মৃতদেহই আমার পূর্বপরিচিত, আমারই প্রিয়জন। শুধু এই মূহুর্তে আমার পাশে যে মানুষটি শুয়ে আছে তাকেই চিনে উঠতে পারছি না… মনে করতে পারছিনা। ঠিক যেমনভাবে মনে করতে পারছিনা ঘড়ির অ্যালার্মটা ঠিক কখন বাজবে, নাকি বেজে গেছে গতকাল রাতেই। খুব একটা প্রয়োজনও নেই যদিও আর, কারণ যতক্ষন আলো নিরাকার ততক্ষণ সেটা সকালই নয়।

Facebook Comments

Leave a Reply