মণিদীপা সেন-র কবিতা
লাল পরিসীমায়
১
আজকাল বুঝি। এই সড়ক, আমার জমি থেকে তোমার পর্যন্ত গিয়েও থামেনি যা, এই অব্যবহৃত সড়কই এখন একমাত্র ভরসা। মধ্যবর্তী নোডাল পয়েন্টগুলো স্থির ও শুকনো । রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে মুখ চাপা দেওয়া পুরোনো লোক্যাল ট্রেনের কামরা তার কাঠের সিট, লোহার গরাদ জানলা পেরিয়ে কোনো গ্রাম ছুটে যাচ্ছে না। ঘুমের মধ্যে ভিন্ন শহরের সূর্য একসাথে দেখার পরিকল্পনা পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রখর রোদে সময়ের চাকা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শালগাছের ছায়ার দীর্ঘতা, এক নিষ্ঠুর খরচের ইঙ্গিত। তবু ভাবি দুশ্চিন্তা সরে গেলে অসংখ্য সিঁড়ি ভেঙে পুরাতন শহরের ওভারব্রিজ কাঁপুনিতে ফিরে যাবো আমরা।
আজকাল বুঝি। সময়ের চেয়ে কঠিন এ পৃথিবীতে কিছু নেই। আর নদীর মুখ আটকে গেলে দূরত্ব প্রকৃত হয়ে ওঠে। নিস্তরঙ্গ দিনে প্রবল দোলা লাগে, চাইলেও আগামীকাল যেতে পারব না তোমার কাছে। এ অসহায়তার কাছে সভ্যতা তুচ্ছ । ক্ষিদে ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
২
সাদার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে বন্ধ হলুদ। পাশাপাশি পাহাড় চূড়ায় বসে দুজন। মাঝের সেতু কেউ পেরোয় না কোনোদিন। তাকায় না অপরের দিকে । কারণ, আজকাল শুনলেই বোঝা যায় কোথায় আছো। ঝিঁঝিঁ, ব্যাঙের ভাইব্রেশন, অথবা পাখার ব্লেড বলে দেয় তোমার ছাদ আছে কি নেই। টিউবিক ঠাণ্ডা চোখ না লম্ফর ছোটবড় চকমকি, তুমি ঠিক কোথায় ফিরে যেতে চাইছ। বহুদিন সামনে না এলে স্বরের পেছনের স্বর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর ক্ষীণ হয়ে আসি আমরা।
৩
দূরত্ব নির্মোহ বিদ্যার প্রথম ধাপ। সেখান থেকেই শুরু করেছিলাম আমরা । ভুলে যেও না। একটা মধ্য রাস্তার মোড়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছি। যেখান থেকে তোমার আমার বাড়ির দূরত্ব সমান। তবু ফিরে গেছে আগে কে ? ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে আমি তো দেখি প্রতি স্টেশনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। হাত নাড়ছো। ট্রেন ছাড়ার সময়ই নিংড়ে যায় আমার সাফল্য। এভাবে দূরত্ব বাড়ি নিয়ে আসি। মোহমুক্তির পাঠও।
৪
অত্যধিক রাতে চোখ লাল হয়ে যায়। সরু সূক্ষ্ম রক্তজালিকা যেন মানচিত্রের বেনামী নদী। তার পাশের গ্রামে মধ্যরাতে আমরা শহুরে শোয়া বর্জন করার শপথ নিচ্ছি। গামছার বিঁড়ে মাথায় রেখে তোমার পায়ে মেটাচ্ছি পাশবালিশী অভাব। নাভিকমলের উত্তাপে তুমি বোঝাচ্ছ রাতের সূর্যের অবস্থান। শান বাঁধানো মেঝে পিছলে উঠছে। আত্মার সমুখে দাঁড়াতে দেহগন্ডী মুছে ফেলতে হয়।
৫
জানিনা কী কারণে টান। কবে কোন অতর্কিত ছবিতে তোমার হাসি ধরেছিলাম । দুর্দিনে সেটুকুই ভাঙিয়ে খাই। নাম ছাড়া কল্পনা থেকেই আঙুল বুলিয়ে আসি তোমার দরজার কাঠখোদাই নকশায়। এটুকু ভাবতে, আমার নামের পৃথিবীর সব চা, ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
Posted in: April 2020, Poetry