আমস্টারডাম বা পাশের বাড়ির করোনাকথা : সত্যি যখন গল্পের মত – মৌমিতা চক্রবর্তী

রান্না করতে করতেই শুনলাম শ্যামের বাঁশি বাজছে। অথৈ চেঁচিয়ে বলল, আমি ধরছি। চাপ নিলাম না আমি। এমনিতেই সারাদিনে কাজের অন্ত নেই- তার ওপর নিরন্তর এই ফোন ধরা একটা উপরি কাজ হিসেবে জুটেছে। যে বা যারা করছেন, নিখাদ দুশ্চিন্তা থেকেই করছেন, জানি। আসলে এমন এক দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী, হাতের স্মার্ট ফোনটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্ত জগৎ। রান্নাঘর থেকে শুনতে পেলাম মেয়ের অভিমানী গলা- “মিটিং যখন আছেই, তখন ফোন না করলেই পারতে। বুঝলাম, বাবা-মেয়ের রোজকালীন মান-অভিমান পর্ব চলছে। বাবার সাথে মেয়ের এর এই মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়া, ঝগড়াঝাঁটি বছরের অন্য সময়গুলোর থেকে অনেকটাই বদলে গেছে হঠাৎ করে। ১০ বছরের অথৈ মানিয়ে নিতে শিখছে নিজের মতো করে। কিন্তু ওর ছোট্ট মনটারও তো কিছু দাবি থাকে। আর তা না পূরণের অনুযোগই চলে রোজ নিয়ম করে‌। আমার নি্জের কথা আর আলাদা করে কি বলব? সারাদিন ধরে সব কাজ করে চলেছি, কিন্তু মাথাব্যথার মতো লেগে রয়েছে একটা সমীক্ষা। মাঝে মাঝেই হোয়াটস অ্যাপ এ পাওয়া লিংক খুলে দেখে নিচ্ছি, বিভিন্ন দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কতো হোল? জানি অনর্থক, তবু কেন যে দেখছি তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। ভাবতে ভাবতেই আবার ফোন- মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করল-  অমুক কাকু ফোন করেছে- জিজ্ঞেস করছে, বাজার করতে যাচ্ছে,  কিছু লাগবে কিনা? আমি বললাম, “না, তুমি বলো, সবকিছু আছে। আমি দরকার হলে বলব।” এরকম ফোন দিনে বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকজনের কাছে থেকেই আসছে।
আমার বর দীপমাল্য এখন কর্মসূত্রে দেশের বাইরে সুদূর আমস্টারডামে। ভাই একই কারণে অন্য রাজ্যে। ননদ বিবাহ পরবর্তী সময় পুরোটাই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে। মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ী ও কন্যা– ৪ জন বয়স্ক মানুষ ও একটি বাচ্চার দায়িত্ব বছরের বেশীরভাগ সময়টা আমাকে একাই নিতে হয়। কিন্তু অভ্যস্ত হলেও এই লক ডাউনের সময়টা চিন্তা একটু হচ্ছিলই। বিশেষত আমার শ্বশুরমশাই মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতএব, প্রথম প্রথম বেশ ভয় করছিল। কিন্তু তারপর…
আমি একটা থিয়েটার দলের সংগে যুক্ত– যেখানে হয়তো কারোর সবুজ রঙ পছন্দ, কারো গেরুয়া, কারো আবার লাল- কেউ কোরান পড়ে, কেউ বাইবেল, কেউ গীতা।
কিন্তু প্রায় প্রতিটি সদস্য আমাকে ফোন করে দীপমাল্যর খবরাখবর নিচ্ছে। আমি আর অথৈ ঠিক আছি কিনা জানতে চাইছে। শ্বশুর-শাশুড়ী-বাবা-মা, সবাই ঠিক আছেন কিনা খোঁজ নিচ্ছেন। কেউ নিজে বাজার যাবার সময় আমাকে ফোন করে জেনে নিচ্ছে, আমার জন্য কিছু এনে দিতে হবে কিনা? ওষুধ পাইনি শুনে জিজ্ঞাসা করছে, স্টেশনের এর পাশের বড়ো দোকান থেকে এনে দেবে কিনা? বাড়ীর সামনে দিয়ে বাজারওলা যাচ্ছে, ফলে বাজারের অসুবিধা নেই শুনে আন্তরিক প্রশ্ন- “সে তো কাঁচা আনাজ, মাছ-মাংসের কি করছিস? আমার বাড়ীর সামনেই মাংসের দোকান-একদম লজ্জা না করে, যেদিন দরকার, ফোন করে দিবি, আমি গিয়ে তোর ফ্ল্যাটের নীচতলায় গিয়ে টুক করে দিয়ে চলে আসব।“  দল-মত কিছু আলাদা করে দেখতে পাচ্ছি না। দেখছি মানুষ।
একদিন বেল বাজলো- দেখি জাভেদ, পেশায় টোটো চালক। আমার মেয়েকে সব activity class এ নিয়ে যায়। হাতে একটা মুড়ির প্যাকেট। “দিদি, আপনি পরশু দোকানে গিয়ে মুড়ি পেলেন না। এইমাত্র গাড়িটা এলো। আমিও নিলাম, আপনার জন্যও।” তখন মুড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না একদম। “এমনিতে গাড়ি বের করছি না। কিন্তু আপনি মামণিকে নিয়ে একা আছেন, কিছু দরকার হলে বলবেন, গাড়ি নিয়ে চলে আসব।” পাড়ার বয়স্ক জেঠিমা জানেন, আমার মেয়ে ফল খেতে ভালবাসে। সেদিন ফোনে কথা বলার সময় বলেছিলাম, বাড়ীতে ফল নেই। হঠাৎ দুপুরবেলা ফোন নাসরিন জ্যেঠিমার- “মৌ, একটা তরমুজওলা যাচ্ছে। আমি বলে দিয়েছি। তুমি ফ্ল্যাটের নীচে এসে দাঁড়াও।” জাতপাত আলাদা করে দেখতে পাচ্ছি না তো। দেখছি মানুষ।
শুধু নিজেরই অভিজ্ঞতা এরকম তা নয়, আমার নীচের ফ্ল্যাটে জেঠিমা একা থাকেন। জেঠু মারা গেছেন, বেশ কয়েক বছর হোল। তার ওপর ফেব্রুয়ারি মাসে চোখের অপারেশন হয়েছে। তারপর থেকেই পাশের ফ্ল্যাটের রাজু যখন যা দরকার এনে দেয়। এমনকি আমার ১০ বছরের মেয়েও যতোবারই মুদিখানার দোকানে যায়, ওনাকে জিজ্ঞেস করে যায়, কিছু লাগবে কিনা? শুধু করোনা কারণ নয়, এই মানুষগুলোর সাহায্যে, এই মানুষগুলোর সংগেই তো আমার রোজকার দিনযাপন। কোনদিন জাতপাত তো আলাদা করে চোখে পড়েনি। দেখেছি, দেখছি মানুষ।
দীপমাল্যর অফিসের রঞ্জন ও তার স্ত্রী দুজনেই কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকে। ছেলেটির বাড়ি ওড়িশার ভঞ্জনগরে, মেয়েটি প্রবাসী বাঙালি– পিতৃকুল বরোদায়। একই অফিসে কাজের সূত্রে উভয়ের পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয়। আপাতত দুজনের সংসারে তৃতীয়জনের আগমনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মেয়েটি পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক। এই অবস্থায় রঞ্জনকে ১৫ দিনের জন্য যেতে হয় আমস্টারডামে। সে চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারতো- কিন্তু নন্দিনী আশ্বাস দেয়, “মাস তিনেক সময় আছে এখনও। আমার কোন সমস্যাও নেই সেভাবে- ১৫ দিনের ব্যাপার, কিচ্ছু হবে না।” অনেক দ্বিধা নিয়ে রঞ্জন যায়। ওখানে কাজের দিন সংখ্যা একটু বেড়ে হয়ে দাঁড়ায় ২১ দিনের। রঞ্জন নন্দিনীকে ফোনে জানায়, নন্দিনী বলে, কোন অসুবিধা নেই। নতুন অতিথি আসার সম্ভাব্য সময় তো মে মাসের মাঝামাঝি। সে কাজটা সেরেই আসুক। কোন অসুবিধা হচ্ছে না আপাতত। এরপর শুরু লক ডাউন। রঞ্জন সেখানে বসে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেছে টেনশনে। এতদিন ধরে এত সাহসিকতার সাথে সবকিছু সামলে চলা নন্দিনীও ভয় পাচ্ছে প্রবল। উভয়ের বাড়ীর লোকজনেরও দুশ্চিন্তায় পাগল হবার উপক্রম।
আমি ফোনে সব শুনছি। কি করব বুঝতে পারছি না। এগিয়ে এলেন প্রতিবেশীরা। পুরো আবাসনের লোকজন দায়িত্ব ভাগ করে নিলেন। রঞ্জনকে বার বার ফোন করে আশ্বাস দিতে লাগলেন- “চিন্তা কোর না। আমরা আছি।” যেখানে social distancing ই সমাজকে বাঁচাবার একমাত্র উপায়; সেখানে একজন অন্তঃসত্ত্বা র দায়িত্ব নেওয়াটাও প্রবল দায়িত্ব ও সতর্কতার মধ্যে পড়ে। দীপমাল্য ও আরো অন্যান্য সহকর্মীরা ছেলেটিকে ফেরানোর জন্য বিশেষ কোন অনুমতির আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রতিবেশীরাই বারণ করেন। কারণ, ছেলেটি দেশে ফিরলেও এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরাটা সমস্যার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও অন্ততঃ ১৪ দিনের quarantine period  কাটাতেই হবে তাকে আর সেটা কোনমতেই তার নিজের আবাসনে সম্ভব নয়, উচিত ও নয়।
হঠাৎই কিছু সমস্যার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের অল্প আগেই ডাক্তার অপারেশন করতে বাধ্য হলেন। গত ২৩শে এপ্রিল একটি সুস্থ কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় নন্দিনী। দুজনেই ভালো আছে। নন্দিনীর বাবা-মা special permission করিয়ে টানা গাড়িতে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন।
আমরা যারা মফস্বলে থাকি, তাদের একটা ধারণা আছে- কলকাতার flat গুলোতে কেউ কারোর সাথে মেশে না। প্রত্যেকটা বাড়ী এক-একটা দ্বীপের মতো- পাড়া কালচার নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ধুর মশাই, মানুষ দেখুন, মানুষ।
করোনা যা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, সেটা একদম basic। মনুষ্যত্ব ছাড়া আর কোনকিছুরই বাস্তবগতভাবে কোন প্রয়োজন নেই। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে থাকাটাই আদত কথা। আমি জাতপাত মানি না। রাজনীতি বুঝি না। শুধু এটুকু অনুভব করছি, এই জরুরী পরিস্থিতিতে আমার আর ভয় করছে না। মানুষ আছে আমার পাশে, আমি তাদের সাথেই আছি।
যেমন আমার বাবা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অন্ধ ভক্ত আর মায়ের যতোদিন দেহে প্রাণ থাকবে, ওনার ভাবনার রং লালই থাকবে। কিন্তু আমাদের বাবা-মা হিসেবে আমার আর ভাইয়ের ভালো চাওয়ার ক্ষেত্রে, ভবিষ্যত গঠনের ক্ষেত্রে দুজনের একমত হতে, পরস্পরকে support করতে কোন অসুবিধা হয়নি। আমরা এই মুহূর্তে ঠিক এমন করেই ভাবতে পারি না? দেশের জন্য, তথা পৃথিবীর জন্য।
দল তো অনেক আছে, থাকবেও। কিন্তু আজ দেশের এই সাংঘাতিক সংকটের মুহূর্তে আমাদের সকলের বাকি সব পরিচয় মুছে যাক। দল-মত-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা শুধু মানুষ হয়ে উঠি বরং। সারা পৃথিবী একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হোক, এই তৃতীয় বিশ্বের অনেক সমস্যায় জর্জরিত দেশটা বিপদের সময় প্রমাণ করে দিয়েছে, এটা সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, সংবেদনশীল দেশ, মনুষ্যত্বের দেশ।
আর এই ভারতবর্ষের ছবিটাই তো বোধহয় সবার কাছে সবথেকে প্রিয়- অন্তত আমার কাছে তো বটেই।

[লেখিকা – গৃহবধূ এবং নাট্যকর্মী।]
Facebook Comments

Leave a Reply