করোনার দিনগুলিতে স্বপ্ন : কান্তিরঞ্জন দে

—-করোনা নিয়ে কবিতা? অসম্ভব।
—– তাহলে প্রবন্ধ লেখো।
—— পাগল নাকি?
—— কেন?
—— আমি কি বিজ্ঞানী? না ডাক্তার? না ভাইরোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট? ও সব কিছু তো নই।
—— ভাইরাস নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে গেলে ডাক্তার, বিজ্ঞানী হতে হবে, কে বলল? কাগজে, টিভিতে, সোস্যাল মিডিয়ায় যা পড়ছ, যা দেখছ, সেটুকু জ্ঞান একটা প্রবন্ধ লেখার পক্ষে যথেষ্ট।
—— আমি বর্তমান চিকিৎসা-ব্যবসার একজন ভুক্তভোগী উপভোক্তা মাত্র। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছুই জানি না। এমনকি, ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট পর্যন্ত নই।
—-আহা হা, চটছ কেন? এ যুগে যাহা ফিচার, তাহাই প্রবন্ধ। স্কুলে রচনা লেখ নি?এতগুলো বছর খবরের কাগজে চাকরি করেছ, করোনা অতিমারী নিয়ে ২৫০০ শব্দ, মানে পাঁচ কলাম লেখা নামিয়ে দিতে পারবে না? এক-আধঘন্টার নোটিশে ওরকম তো কত্তো নামিয়েছ।
——না। পারব না।
—— অকম্মার ধাড়ি। তবে কি পারবে??

কবিতা গল্প প্রবন্ধ, ওসব এখন থাক।আমি ভাবছি, অদ্বিতীয়ার কথা।
—— অদ্বিতীয়া কে ?
——-কাল যদি সাতসাগরের পার থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি কি করে তাকে বুকে জড়িয়ে নেব? কি করে তার গালে গাল ঠেকাব? ঠোঁটে ঠোঁট? তার কুসুমকোমল হাত দুটো ধরব কি উপায়ে?
—–উহুঁ, উহুঁ, সোস্যাল ডিসট্যান্স মেইনটেইন করতে হবে ভাই। হাতে হাত ঠেকানোই বারণ , তো গালে গাল।
——তাহলে কথা বলব কি করে??
——কেন? মিনিমাম তিনফুট ডিসট্যান্স মেইনটেইন করে।
—–সে কি? আমরা তো মুখে কথা বলি না।
——তাহলে কিভাবে কথা বল?
—— ছোঁয়ায় ছোঁয়ায়। হাতের ছোঁয়ায়। বুকের ছোঁয়ায়। ঠোঁটের ছোঁয়ায়। আর কথা বলি, চোখে চোখে। মনে মনে।
——-এটা কি হেঁয়ালি হচ্ছে? না, কবিতা??
—— হেঁয়ালিও নয়। কবিতাও নয়। অনেকটা গানের মতো। সে যে সাগরপারের বাণী, মোর দুয়ারে দিয়াছে আনি। তুমি বলো, সে যখন সাত সাগরের ওপার থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, আমরা কথা বলব কিভাবে?
—— এই মরেছে।করোণায় শুনেছি, ফুসফুস ব্লক করে দেয়। এ তো দেখছি, মাথা ব্লক করে দিয়েছে। টানা তিরিশদিন কোয়ারান্টাইনের ফল।
—— না গো। শুধু এই একমাস নয়। এ আমার ছোটবেলা থেকে অভ্যেস। মুখে যত না কথা বলি, মনে মনে বলি, তার চেয়ে অ–নেক বেশি। আত্মার আত্মীয়দের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, ভাইদের সঙ্গে, কমরেডদের সঙ্গে। এমন কি, নিজের সঙ্গেও।
——বাহ্। এই তো বেশ কবিতার মতো শোনাচ্ছে। চট্ করে লিখে ফ্যালো দেখি। বেশি না। বারো-চোদ্দ লাইন হলেই চলবে।
——না। লিখব না।
——কেন? বেশ তো হচ্ছে। বেশ কবিতা কবিতা শোনাচ্ছে।
—— হবেই তো। একমাস ঘরবন্দী আছি বলে মনে মনে কথা বলা যে খুব বেড়েছে।
——- হ্যাঁ, সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলো তুমি ?
—— কেন? গাছের সঙ্গে, জলের সঙ্গে , আকাশের সঙ্গে। পাখির সঙ্গে, হাওয়ার সঙ্গে। রবি ঠাকুরের সঙ্গে। আর নিজের সঙ্গে।
——-হুঁম্। কি কথা বলো?
——- নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করি, সারা পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে সব রকমের ফারাক ঘুচে গেছে? মুছে গেছে সব কাঁটাতার?
——-বাব্বা, ভৌগলিক আলোচনা মনে হচ্ছে? না না, ভৌগলিক নয়। এ তো রীতিমতো রাজনৈতিক কথাবার্তা।
——-হ্যাঁ, ভৌগলিক বলতেই পার। রাজনৈতিকও বলা যায়। আসলে তো মানসিক, মানে মানবিক।
——- মানে ??

——সাদা-কালো, গরীব-বড়লোক, হিন্দু-মুসলমান, ইহুদি-খ্রিষ্টান। করোণা এসে সব সীমারেখা কি এখনও মুছে দেয় নি? যেমনভাবে সমুদ্রের হিংস্র ঢেউ মুছে দেয় বালির আঁকিবুকি ?
—— চমৎকার এগোচ্ছে। আরেকটু বলো—-
——সে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগের কথা।ঊনিশ শো পঁয়তাল্লিশ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরেরও মৃত্যু হল। অথচ দ্যাখো, এতগুলো বছর ধরে আমরা তার লাশ কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
এবার কোভিড-নাইনটিন এসে সেই লাশের দাফনের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল।
—–না, না। কি বলছ তুমি? ঈশ্বরের মৃত্যু নেই।এই তো কয়েকমাস আগেই মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এলাম। সেখানে ঈশ্বর এখনও প্রবলভাবে জীবিত। তার লম্বা ছায়া দেশে দেশে ছড়ানো। আমাগো দ্যাশে তো আছেই।
——তুমি জানো না। করোণা ভাইরাস এসে গড-আল্লাহ্-ভগবানকে কবরে পাঠিয়েছে। চিতায় পুড়িয়ে দিয়েছে।
—— ধ্যৎ, হতেই পারে না। না হে, ঈশ্বর বেঁচে আছেন।
—— না। বেঁচে নেই। আরেকটা খবরও তুমি পাও নি। এতদিন ধরে যাকে আমরা একটু একটু করে খুন করছিলাম, এই অবকাশে সে আবার একটু একটু করে বেঁচে উঠছে।
—– কে সে ?
—— কেন? প্রকৃতি। প্রকৃতি বেঁচে আছে। আর বেঁচে আছে মানুষ। করোণা এসে জানিয়ে দিল, মানুষের চেয়ে প্রকৃতি বড়।
——ধুৎ, যত সব গাঁজাখুরি কথা। মানুষও বড় নয়। প্রকৃতিও বড় নয়। বড় হচ্ছে টাকা। শুনে রাখো হে, এটা টাকার যুগ। মানে পুঁজির যুগ।
——জানি তো। এ যুগে টাকাই ভগবান। ভগবানকে খুন করে টাকাই তো তার জায়গায় ভগবান সেজে বসে আছে।
কিন্তু, আজ বোঝা যাচ্ছে, টাকা মানুষকে প্রাণ দিতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি পারে। মানুষ যদি প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, তাহলে মহাশক্তিশালী কোভিড–নাইনটিন, করোণা ভাইরাসেরও একদিন মৃত্যু হবে।
—–বেশ বেশ। বাহ্, এই তো একটা জম্পেশ প্রবন্ধের বিষয় ভেবে ফেলেছ। “পুঁজিবাদ বনাম করোণা”। লিখে ফ্যালো দেখি বাবা চট্ করে।
—–ধ্যৎ, আবার বলে লিখে ফ্যালো। শুধু লিখে হবেটা কি? গত একশো বছরে এ বিষয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত লক্ষ প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, হিসেব রাখো? এ হলো মনে মনে বোঝবার বিষয়। মনে-মগজে না ঢুকলে, শুধু চীৎকার করে লবডঙ্কা হবে।
——থামো তো ছোকরা। তোমার শুধু ওই এক কথা। মনের কথা, মনের কথা, মনের কথা।থামো—-
—–থামব? বেশ, থামছি। আর একটা কথা বলেই থেমে যাচ্ছি। সেপ্টেম্বরের একুশ তারিখ থেকে পৃথিবীর সব সীমান্তরেখা মুছে গিয়ে একটাই দেশ হয়ে যাচ্ছে।
——অ্যাঁ? কেন?? সেপ্টেম্বরের একুশ তারিখ কেন?
——-বাঃ, ওইদিন যে বিশ্ব শান্তি দিবস। তাও জানো না?
——তোমার মাথাটা একেবারে গেছে।
—–হ্যাঁ গো। সব কাঁটাতার মুছে যাবে। সব পতাকা গুটিয়ে ফেলা হবে। একটাই দেশ। তার নাম হবে, মানবভূমি।
—–নাহ, এবার সত্যিই অ্যাম্বুলেন্স ডাকার সময় হল। এ ছোকরাকে আইসোলেশানে পাঠাতেই হবে।
—–আমার কথা বিশ্বাস করো। করোনা কোয়ারান্টাইনের দিনগুলিতে আমি যে মনে মনে এই স্বপ্নই দেখে চলেছি। গোটা পৃথিবী মিলেমিশে একটাই দেশ হয়ে যাবে। তখন অদ্বিতীয়া এসে দাঁড়াবে আমার দরজায়। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে আর কোনও অসুবিধে থাকবে না। আর কোনও বিষবাষ্প থাকবে না হাওয়ায়।

[লেখক – প্রাবন্ধিক, আলোচক এবং চিত্রনাট্যকার।]

Facebook Comments

Leave a Reply